কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুদিত মহাভারত গম্ভীর গমক মন্ডিত, সুললিত তৎসম খচিত। সেই একই লোক হুতোম প্যাঁচার নকশা লিখলেন কেন, যা ফুকালীক্কুড়ি, ফাজলামি এবং ইচ্ছাকৃত গুরুচণ্ডালির আকরগ্রন্থ? কারণ একটাই। বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে কালীপ্রসন্নই প্রথম, যিনি অনুধাবন করেন, যে, ভাষা কেবল ভাবপ্রকাশের পোশাক নয়। ভাবটা একই থাকে, কেবল দোলের রবীন্দ্রনৃত্যে খোঁপায় পলাশ গুঁজতে হয়, আর নাইটক্লাবে শরীরে চড়িয়ে নিতে হয় ট্যাঙ্কটপ, ভাষা স্রেফ এ জাতীয় স্টাইল স্টেটমেন্ট নয়। ভাষা ভাবের পোশাক নয়, বস্তুত চামড়া। যে কবিতা চোখে জল আনে, তা কেবল এবং কেবলমাত্র ভাষার জন্যই আনে, আলাদা করে ছাল ছাড়িয়ে তার ভাবকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। আবার যে লেখা চামড়ার ভিতরে ঢুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, তাও স্রেফ তার ভাষার জন্যই দেয়। মহাভারতের ভাবের শরীর তৈরি হয়েছে তার তৎসম ভাষার চামড়া দিয়ে। একই ভাবে হুতোমের নকশা কেবল ফুক্কুড়ি করার জন্য তৈরি নয়। বরং যে বাস্তবতা তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন, তার চামড়া অস্থি ও মজ্জা ওই ভাষা।
এ অবশ্যই বাজার-চলতি ফাজলামির ধারণার ঠিক উল্টোদিকে। বাজারে মিডিয়ার পন্ডিতমশাইরা ইদানিং একটা ধারণা তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছেন, যে, শিল্পে ফাজলামি একটি অত্যন্ত সস্তা জিনিস, যাকে সিরিয়াস জিনিসের সঙ্গে কখনও সখনও গুঁজে দিতে হয় শো-পিস হিসেবে। চার্লি চ্যাপলিনের দিন গিয়াছে, সিনেমা-টিনেমায় চিত্রনাট্যকাররা এখন আন্ডারলাইন করে কমিক রিলিফ তৈরি করেন। এর একটা সোজা নিয়মও আছে। নিয়মটা হল, সংলাপে যেখানেই খিস্তি সেখানেই হাসতে হবে। সিরিয়াল বা vরিয়েলিটি শোয়ে তো আরেক কাঠি বাড়া। আন্ডারলাইন করলেও যদি দর্শক হাসতে ভুলে যায়? তাই দর্শকের উপর নির্ভরশীল না থেকে ব্যাকগ্রাউন্ডে জুড়ে দেওয়া হয় হাসির শব্দ। কোনোটা আস্তে, কোনোটা জোরে। কোনোটা হিহি কোনোটা হাহা। অর্থাৎ শুধু হাসি ব্যাপারটা আন্ডারলাইন করা তাইই নয়, কতটা এবং কীভাবে হাসতে হবে, সেটাও ঠিক করে দেওয়া।
হাসি নিয়ে এসব কুস্তির কারণ কী? এক তো হাস্যরস তৈরির অক্ষমতা। দুই হাস্যরস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণার অভাব, যে শিল্পে হাস্যরস মানেই ভাঁড়ামি নয়। বলাবাহুল্য ভাঁড়ামিকে এখানে কোনওরকম অপমান করার চেষ্টা হচ্ছেনা। কেউ যদি সৎভাবে ‘ভাঁড়ামি করছি’ বলে রাস্তায় নেমে উল্টো হয়ে অকারণে ক্রমাগত ডিগবাজি দিতে থাকেন, সেটায় কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা হল, যাবতীয় হাস্যরসকেই যখন ভাঁড়ামির পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়, এবং সেটাকেই উচ্চমার্গের শিল্প হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়। হুতোম এই অশিক্ষিত চালু ধারণার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে একবগ্গা গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। হুতোম আদ্যপান্ত পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায়, যে, হাস্যরস সেখানে রিলিফ নয়, বস্তুত অস্বস্তির কারণ। গোটা কলকাতার সমাজকে হুতোমের কথক ঘুরে দেখেছেন, এবং তাদের যে কার্টুন হিসেবে তৈরি করেছেন, সেটা স্রেফ নির্মল হাস্যরস তৈরির জন্য নয়। বরং কার্টুনপ্রতিম চেহারা তৈরি না করলে সমাজের অন্তর্লীন অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা অসম্ভব। হুতোমের ভাষা এই অসঙ্গতির শরীর। তার চামড়া। হুতোম একটুও ইয়ার্কি করেননি, ভাঁড়ামো তো নয়ই। বাস্তবতার শরীরকে তুলে ধরেছেন মাত্র। এর অন্তত কয়েকশো উদাহরণ দেওয়া যায়। একটাই দেওয়া যাক আপাতত। ‘ইংরিজি-শিক্ষিত বাবুদের ব্যঙ্গ করে হুতোম লিখেছেন, ‘টেবিলে খান, কমডে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ মোছেন’। এই ব্যঙ্গ কিন্তু স্রেফ লোক হাসানোর জন্য নয়, বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশের জন্য। ‘বাবুরা ইংরিজি আদবকায়দা অনুসরণ করে টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করেন ও কমোড ব্যবহার করেন’ — এই গুরুভাষায় লিখলে সেটাই বরং ইয়ার্কি হত। বাস্তবতা ফুটতনা, সে তো বলাবাহুল্যই।
স্রেফ বাস্তবতাকে তুলে ধরাই নয়, যখনই তার অসঙ্গতিকে ফুটিয়ে তোলার প্রকল্পে ঢুকে পড়া হয়, সেটা নিঃসন্দেহে আর নির্দোষ থাকেনা, এক রাজনৈতিক প্রকল্পে পরিণত হয়। হুতোম নিঃসন্দেহে সেই দোষেও দুষ্ট। নকশার ভূমিকায় হুতোম নিজেই পরিষ্কার অক্ষরে লিখে গেছেন, ‘নক্সাখানিকে আমি একদিন আরসি হিসেবে পেস কল্লেও কত্তে পাত্তেম; কারণ পূর্ব্বে জানা ছিল যে, দর্পণে আপনার মুখ কদর্য্য দেখে কোন বুদ্ধিমানই আরসিখানি ভেঙে ফ্যালেন না, বরং যাতে ক্রমে ভালো দেখায়, তারই তদ্বির করে থাকেন। কিন্তু নীলদর্পণের হাঙ্গামা দেখে শুনে — ভয়ানক জানোয়ারদের মুখের কাছে ভরসা বেঁধে আরসি ধত্তে সাহস হয়না; সুতরাং বুড়ো বয়সে সং সেজে রং কত্তে হলো’। এখানেও হাস্যরসের কোনো কমতি নেই। কিন্তু সেটাই উদ্দেশ্য নয়। বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার করে বলা আছে। হুতোমের নকশায় এই রাজনীতি সর্বত্র।
বলাবাহুল্য, এই রাজনীতি কালীপ্রসন্নর সত্তা জুড়ে আছে। নীলদর্পণের হাঙ্গামা বলতে এখানে যা বলা হয়েছে, তা নীলদর্পণের প্রকাশক হিসেবে রেভারেন্ড লং ইংরেজ-কৃত এর জরিমানা। কালীপ্রসন্ন নিজের পকেট থেকে সেই টাকা মিটিয়েছিলেন। এসব কথা সর্বজনবিদিত, যেমন সর্বজনবিদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট এবং হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু যা ততটা জানা নেই, তা হল কালীপ্রসন্নর একটি বিশুদ্ধ বাংলা সংবাদপত্র চালানোর উদ্যোগ। সেই কাগজে, সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় প্রকৃত অর্থে রিপোর্টিং শুরু হয়। তাঁর বাকি দুটি কীর্তির মতো খবরের কাগজটি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বরং শুরুর কিছুদিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু স্থায়িত্বটা এখানে বিবেচ্য নয়, লক্ষ্যণীয় উদ্যোগটাই। একজন সাহিত্যিক, যিনি হুতোম প্যাঁচার নকশা লেখেন, তিনি হঠাৎ বাংলায় খবরের কাগজ এবং সাংবাদিকতার চর্চায় জড়িয়ে পড়েন কেন? কারণ লোকটি একই, উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর উদ্দেশ্যও বিশেষ আলাদা নয়। তিনি নকশায় প্রতিবেদন লেখেন, খবরের কাগজেও তাইই লিখতে চেয়েছিলেন। নকশাতেও তিনি নীলদর্পণ টেনে আনেন, আবার রাজনৈতিক খবরের কাগজের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। এর সবকটারই কাজ মূলত এক। তাঁর অননুকরণীয় ভাষায় বলা যায়, সবকটাই মুখের কাছে আরসি ধত্তে চাওয়া। কোনোটা রিপোর্টারের বেশে, কোনোটা সং সেজে রং মেখে। যে বাস্তবতাকে যেভাবে প্রকাশ করা যায়।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এটুকুই কালীপ্রসন্নর উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক এবং শৈল্পিক। তিনি তৎসম গাম্ভীর্য তৈরি করেননি, করেননি নির্মল হাস্যরসও। দুটোই তাঁর কাছে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার আয়ুধ। অধুনা পন্ডিতরা গোমড়া মুখে তৎসম (বা ইংরিজি) শব্দ এবং ব্যবহারকে পন্ডিতির একমাত্র লক্ষণ হিসেবে দেখেন। ফুককুড়িকে দেখেন রিলিফ হিসেবে। উনবিংশ শতকের পন্ডিত, প্রডিজি এবং শিল্পী কালীপ্রসন্ন তাঁদের সামনে মুখ ভেংচে দাঁড়িয়ে মূর্তিমান অ্যান্টিথিসিস হিসেবে। আজও।
পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এবং পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। প্রকাশিত উপন্যাসের নাম খেরোবাসনা, মহেঞ্জোদারো, দিনগুলি রাতগুলি, খান্ডবদাহন, ন্যানোপুরাণ।
One Response
অসম্ভব রকমের ভালো একটি লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম।