‘আমার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি বাদামপাহাড়ে।’
কবির মতে আমাদের সময় চেতনা, ঘটমান বর্তমান। আর তাই পাশ্চাত্যের মতো ওয়ান্স আপ অন আ টাইম দিয়ে শুরু হয় না এখানকার গল্প। বরং বাস্তবের কোনও একটি ঘটনা থেকে চরিত্র উঠে আসে সাহিত্যে, তারপর ঘুমে অথবা জাগরণে সে ফিরে যায় শিকড়ে। উচ্ছেদ তাঁকে ভাবায়, কষ্ট দেয়। উৎপলকুমার বসু, (Utpal Kumar Basu) সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে হয়তো অচেনা এই নাম… জীবনানন্দের পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে সুবোধ সরকার অব্দি গড়িয়ে পড়া বাংলা কবিতার ঝোলে ন্যাকড়া চাপা দেওয়া বাঙালি পাঠক হয়তো খোঁজও পাবেন না এসমস্ত কবিতার, যদি আলোচনা না হয়।
বাঙালি পাঠক বলতে আমি বাঙলা সাহিত্য চর্চা করা সেই হাজার খানেক মানুষের কথা একেবারেই বলছি না, যাঁরা বইমেলায় বৃষ্টি হলে অন্যমনস্ক হয়ে আউড়ে ফেলেন উৎপলকুমার… এর বাইরেও যে বিপুল সংখ্যক মানুষের হাতে ভালো কবিতা পৌঁছে দিতে পারলে তা হয়তো জনপ্রিয় হত, আমি তাঁদের কথা বলছি।
আজ যাঁকে নিয়ে লিখতে বসা তিনি এক অদ্ভুত চরিত্র। ভালো আর খারাপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটি ট্যাক্সি চালিয়েছেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে করেছেন ট্রেড ইউনিয়ন, কিন্তু পরিচয় বলে, তিনি কবি! বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম উৎপলকুমার বসু। একের পর এক চমৎকার লেখা দিয়ে যিনি সমসাময়িকদের থেকে নিজেকে আলাদা করেছিলেন সেসময়েও। উৎপলকুমারের লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে যৌথতা। এক প্রবল ঘরোয়া মানুষ যেন ডায়রি লিখছেন আর কোনও এক যাদুতে সেই লেখা হয়ে উঠছে সকলের। একই লেখার প্রথম অংশে লিখছেন ‘স্বপ্নে পাওয়া আঙুল’ অথচ লেখার শেষে নিয়ে আসছেন রেলব্রিজের নিচে, রোদে বসা বাজারে।
এই জাম্পকাট খুব উৎসাহের সঙ্গে ব্যবহার করে গেছেন কবি। বুকে ঠুকে বলেছেন তিনি পড়াশুনা বিরোধী। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে তাঁর পরিচিতি। ১৯৬১ সালে শুরু হয় হাংরি আন্দোলন। কলেজের সহপাঠী সমীর রায়চৌধুরীর হাত ধরে সেই আন্দোলনে যোগ দেন উৎপলকুমার। এরপর বহু জল গড়ায়, ১৯৬৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জেরে কলেজের চাকরিটি হারান। ১৯৬৫ সালে উড়ে যান লন্ডনে এবং বসবাস শুরু করেন স্থায়ীভাবে, কবিতার চেয়ে অনেক দূরে, শান্তিতে অথবা অশান্তিতে কাটিয়ে ফেলেন প্রায় দু’দশক। এরপর ফেরেন কলকাতায়। পুনরায় শুরু হয় লেখা…
নিজের লেখাকে এক অন্যধারায় বয়ে নিয়ে গেছেন কবি। গুরুত্ব দিয়েছেন বাস্তবকে। তবে এই বলিদান তাঁকে খুব কিছু সম্মানিত করেনি। হাংরির প্রথম সারির কবিদের কাছে যথেষ্ট বিতর্কিত চরিত্র উৎপলকুমার বসু। কবি হিসাবে সারাজীবন গুরুত্ব দিয়েছেন পাতলা বইকে। নিজের অধিকাংশ কবিতার বই ছাপতে দিয়েছেন ছোট পত্রিকা বা তাদের মাপের ছোট প্রকাশনায়। ব্যক্তিগতভাবে এই পদক্ষেপকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলে মেনে এসেছেন তিনি। অথচ মৃত্যুর ঠিক ন’বছর আগে ২০০৬ সালে আনন্দ পুরস্কার গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার খুঁজেও উঠে আসেনি তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনের যুক্তি। বরং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন এই প্রসঙ্গ। তিনি নায়ক নন, নন খল চরিত্রও। বরং বাংলা সাহিত্যের বুকে এক ছাপোষা মধ্যবিত্তের মতো কাটিয়েছেন নিজের জীবন।
আজ ৩ আগস্ট, কবির জন্মদিনে অফুরান শুভেচ্ছা…
আকাশ লিখতে ভালোবাসে, ভালোবাসে গাছপালা আর বাইক রাইড! একসময় খেলাধুলার সঙ্গে কাটিয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা পোর্টালে কর্মরত। যদিও মন থেকে ব্যবসার প্রতি এক অদ্ভুত টান আছে তার!