Salil Chowdhury)
আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে এক বাদ্যযন্ত্রের দোকান, দর্শক-ক্রেতার আনাগোনা লেগেই আছে। হঠাৎ নিতান্তই সাদামাটা পোশাকে সেখানে হাজির এক ভারতীয়, বলা ভালো বাঙালি। ইতিউতি দেখে তাঁর চোখ গেল বেশ উঁচু তাকে রাখা একটি সেতারের দিকে। ভাবলেন কেনার আগে একবার বাজিয়ে দেখা যাক। তাঁর আবদারে খানিক বিরক্ত হয়েও দোকানের মালিক নামিয়ে দিলেন সেতারটি।
সেখানেই সেতার নিয়ে বসে পড়লেন বাঙালি ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে ভিড় জমে গেল দোকানে, আমজনতা, দোকানের কর্মী থেকে মালিক — সবাই অবাক! মুগ্ধ দোকানের মালিক ডেভিড জানতে চাইলেন, তিনি কীভাবে সাহায্য করতে পারেন? ভদ্রলোক বললেন, তিনি সেতারটা কিনতে চান। ডেভিড বললেন আমি এই সেতারটা আপনাকে উপহার দিচ্ছি। দেশে ফিরে সেই সেতারে তিনি কম্পোজ করলেন ‘না যেয়ো না, রজনী এখনও বাকি’, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে অমরত্ব পেল সেই গান। আর সেই সুরকার হলেন, এক এবং অদ্বিতীয় সঙ্গীত মায়েস্ত্রো সলিল চৌধুরী!
১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর সলিলের জন্ম আসামের লতাবাড়ি চা বাগান অঞ্চলে। বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরীর পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনার সূত্রে অল্প বয়সেই সলিলের পরিচয় ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দিকপাল বাখ, বিঠোফেন, চাইকোভস্কি, মোৎজার্টের সঙ্গে। সলিলের সুরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যে মেলবন্ধন আমরা দেখি, তার সূচনা এখান থেকেই।
১৯৪৪ সালে কলকাতায় এসে সলিল যখন ভর্তি হচ্ছেন বঙ্গবাসী কলেজে, তখন বাংলায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে, ১৯৪৩-এ কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। সেখানে জড়ো হয়েছেন বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটকের মতো অভিনেতা-পরিচালক। এই অবস্থায় সলিল যোগ দিলেন গণনাট্যে। কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিচ্ছুরণ ঘটল তাঁর সৃজন প্রতিভার। গান-কবিতা-গল্প-নাটক লিখছেন, আর তারই সঙ্গে চলছে গানে সুর দেওয়ার কাজ।
ভিডিও: ভারতীয় চলচ্চিত্রের তানসেন মহম্মদ রফি – জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
১৯৪৫ সালে বন্যায় আক্রান্ত কৃষকদের উপর প্রশাসনের অত্যাচারের প্রতিবাদে সলিল সৃষ্টি করলেন তাঁর প্রথম গণসঙ্গীত, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে, ধান গিয়েছে মরে’। ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই নৌ-বিদ্রোহকে সমর্থন করে দেশব্যাপী ধর্মঘটের দিন সলিল লিখলেন — ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’ এবং সেই দিনই মনুমেন্টের নীচে অজস্র মানুষের সমাবেশে গানটি গাওয়া হলো। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি সৃষ্টি করলেন ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’ কিংবা ‘ও আলোর পথযাত্রী’-র মতো অবিস্মরণীয় গান। Salil Chowdhury)
সম্পূর্ণ নতুন কথা, সুর আর অর্কেস্ট্রেশনের জাদুতে সাবালক হয়ে উঠল বাংলা গান। এর মাঝেই পরিচয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্ত নিজে অর্কেস্ট্রেশন করে রেকর্ড করলেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। তারপর একের পর এক ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ বা ‘পথে এবার নামো সাথী’। ততদিনে হেমন্ত-সলিল বাংলা গানের জগতে অনন্যসাধারণ জুটিতে পরিণত হয়েছেন। Salil Chowdhury)
১৯৪৮ সালে হঠাৎ-ই পার্টির অনুমোদন ছাড়া প্রকাশ্যে সলিলের গান গাওয়া নিষিদ্ধ হল। এই সময়েই মুম্বই থেকে বিমল রায়ের ডাক এল তাঁর কাছে। সলিলের ‘রিক্সাওয়ালা’ গল্প অবলম্বনে বিমল রায় হিন্দিতে তৈরি করলেন ‘দো বিঘা জমিন’, সলিল হলেন ছবির চিত্রনাট্যকার ও সুরকার। কিছুদিনের মধ্যেই দিলীপকুমারের ‘মধুমতী’ সিনেমায় সুর বাঁধলেন সলিল — ‘আজা রে পরদেশি’, ‘দিল তড়প তড়প কে’, ‘সুহানা সফর ঔর ইয়ে মৌসম হসিন’। গোটা ভারত উদ্বেলিত হয়ে উঠল তাঁর সুরের ঝর্নাধারায়। Salil Chowdhury)
ভিডিও: ভারতীয় সংগীতের দুঃখ রাতের রাজা : মুকেশ
এর প্রায় এক দশক পর ‘আনন্দ’ ছবির কাজ করছেন, রাজেশ খান্না আর অমিতাভ বচ্চন মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। এক জায়গায় থমকে গেলেন রাজেশ। আবহসঙ্গীত হিসাবে একটি বিশেষ গানকে বেছেছেন সলিল, তবে এমন একটি গানকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। রাজেশ খান্না জানালেন, তিনি নিজে লিপ দেবেন এই গানে, গানটি ছিল ‘জিন্দেগি ক্যায়সে হ্যায় পহেলি’। Salil Chowdhury)
আধুনিক গান তাঁর মূল বিচরণ ক্ষেত্র হলেও বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন চলচ্চিত্রে, বাংলা, হিন্দি, তামিল, মালয়ালম মিলিয়ে ১৪-টি ভাষায় কাজ করেছেন তিনি। ভারতীয় সঙ্গীতে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের ব্যবহার আগেও ছিল। সলিল ভারতীয় সঙ্গীতের ন্যারেটিভে জুড়েছিলেন ওয়েস্টার্ন হারমনি, কয়্যার অর্কেস্ট্রার মতো একাধিক নতুন সাঙ্গীতিক প্রয়োগ। পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে তিনি শামিল করেছিলেন ভারতীয় আত্মায়। Salil Chowdhury)
মান্না দে তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্র-নজরুলের পর ভারতে এমন সঙ্গীত স্রষ্টা আর আসেননি।’ তাঁর মৃত্যুতে নৌশাদ বলেছিলেন, ‘সঙ্গীত তার সপ্তসুরের এক সুরকে হারালো।’ রাষ্ট্রের তরফ থেকে তেমন কোনও স্বীকৃতি তিনি কোনোদিন পাননি। তবে আজও যেভাবে তিনি আসমুদ্রহিমাচল মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন এবং তাঁর সৃষ্টি মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে, তা সঙ্গীতের ইতিহাসে বিরল। তাই সুরের বরপুত্র সলিল চৌধুরীর শততম জন্মদিনে আমাদের বিনম্র প্রণাম! Salil Chowdhury)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
