(Little Magazine)
কয়েকদিন আগেই একটা লেখায় লিখেছিলাম, এই বিশ্বজগতের যতটুকু অনুভূত হয় আমাদের শরীর আর মন দ্বারা, তার বেশিরভাগটুকুই কল্পনা। এটা পড়ে কবি কৌশিক বাজারী বলেছিলেন আরও লিখতে। লিখব লিখব করে কিছুই লেখা হচ্ছিল না কিন্তু আজ হঠাৎই এই ছবিটার দিকে চোখ চলে গেল। একজন মহাকাশচারী নীল রঙের গ্রহটির উপর ভাসছেন। এই ‘নীল’ প্রসঙ্গেই দু’একটি কথা প্রথমে বলে নিই। আমরা অনেকেই জানি, নীল রং আক্ষরিক অর্থেই আধুনিক একটা রং। বা সহজ সাদাসিধে ভাষায়, নীল রঙটা একটা ‘কাল্পনিক’ রং। কেননা কয়েক হাজার বছর আগেও নীল রং বলে কোনো রঙের অস্তিত্ব ছিল না। মানে নীল যে একটা রং, এটা মানুষ জানত না। তাই বলে কী নীল রঙকে তখনকার মানুষ দ্যাখেও-নি? আকাশ বা সমুদ্র তো তখনও নীল ছিল! তাহলে?
(Little Magazine)
গ্ল্যাডস্টোন আরও নিবিড় অধ্যয়ন করে বের করলেন, যেখানে কালো রং ২০০ বার, শাদা রং প্রায় ১০০ বার, নীল রং একবারও নেই ওডিসি-তে।
সামান্য একটু ডিটেইলসে যাই। ওডিসি-তে হোমার সমুদ্রকে বলছেন, “wine-dark sea”, কিন্তু কেন? কেন ডিপ-ব্লু বা সবুজ নয়? ১৮৫৮ সাল নাগাদ, উইলিয়াম প্ল্যাডস্টোন নামের একজন স্কলার, পরবর্তীকালে যিনি গ্রেট-ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, লক্ষ্য করলেন, এটাই একমাত্র অদ্ভুত কালার রেফারেন্স নয়। যদিও কবি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে চরিত্রদের পোশাক, মুখ ও শারীরিক গড়ন, অস্ত্রশস্ত্র, পশুপাখি, স্থান-কাল-পাত্রের বর্ণনা করেছেন, কিন্তু রঙের বর্ণনার ক্ষেত্রে তার লেখা অদ্ভুত আড়ষ্ট। লোহার বস্তুসামগ্রী আর জাহাজ বেগুনী (violet), মধু সবুজ। অদ্ভুত নয়? গ্ল্যাডস্টোন আরও নিবিড় অধ্যয়ন করে বের করলেন, যেখানে কালো রং ২০০ বার, শাদা রং প্রায় ১০০ বার, নীল রং একবারও নেই ওডিসি-তে। এমনকি ‘নীল’ বলে কোনো শব্দই নেই এই মহাকবির অভিধানে। মনে পড়ে গেল, এক আধুনিক বাঙ্গালী মহাকবি তাঁর ‘বনলতা সেন’ নামক কৃশকায় কাব্যগ্রন্থে, কতবার যে ‘নীল’ শব্দটি ব্যাবহার করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তবে গ্রীকরা কি এক ধূসর ঘোলাটে জগতে বাস করতেন? কিন্তু লাজারেস গাইগার (Lazarus Geiger) নামে একজন ভাষাবিদ, গ্ল্যাডস্টোনের পথেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিরীক্ষণ করে দেখালেন, সারা পৃথিবীর সব জায়গাতেই এই একই অবস্থা। কোনো নীল নেই। (Little Magazine)
আরও পড়ুন: ‘সূত্রপাত’ পত্রিকা নবপর্যায়: চতুর্থ সংখ্যা: সম্পাদকীয়
ভাইকিং বা আইসল্যান্ডিক সাগা, কোরান ও অ্যারাবিক উপকথা, চৈনিক প্রাচীন সাহিত্য, বাইবেলের হিব্রু ভার্শান, ঋগ্বেদের শ্লোকগুলি… কোথাও নীল পাওয়া গেল না। ঋগ্বেদ প্রসঙ্গে লাজারেস লিখলেন, “দশ হাজারেরও বেশি এই স্তোত্রগুলি স্বর্গের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। কোনো কোনো বিষয় আবার একটু বেশি ঘন ঘন উচ্চারিত হয়। সূর্য এবং ভোরের আকাশে লালচে রঙের খেলা, দিনরাত, মেঘ ও বিদ্যুৎ বায়ু এবং আকাশ, এই সব আমাদের সামনে বার বার উন্মোচিত হয়… কিন্তু নীল কোথাও নেই।” লক্ষণীয়, তুলনামূলক ভাবে নতুন রেফারেন্স, “নব দূর্বাদল শ্যাম”-এও শ্যাম, নীল নন, ঘাসের মতো সবুজ। গাইগার এর পর আরও দেখতে চাইলেন, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রধান ভাষা ও সংস্কৃতিগুলিতে, কখন “নীল” রং এলো এবং সারা বিশ্বেই তিনি একটি অদ্ভুত প্যাটার্ন খুঁজে পেলেন।
(Little Magazine) খুব বোধ্য কারণেই প্রতিটি ভাষায় প্রথম যে রং দুটি এসেছিল তা হল কালো এবং সাদা (অন্ধকার এবং আলো)। এর পর প্রতিটি ভাষায় যে রঙটি এলো তা হল লাল, রক্তের রং। লালের পরে, ঐতিহাসিকভাবে হলুদ এবং তারপরে সবুজ (যদিও কয়েকটি ভাষায় সবুজ হলুদের আগে এসেছে)। প্রতিটি ভাষায় নিশ্চিত করেই শেষ রঙটি হল নীল। এখনো অনেক উপজাতীয় সংস্কৃতি আছে, বিশেষত যারা মোটামুটি আনটাচ্চ, যেমন নামিবিয়ার হিম্বা (Himba), তাঁদের কাছে নীল বলে আলাদা কোনো রং নেই। হিম্বা ভাষায় সবুজের বিভিন্ন শেডের জন্য আলাদা আলাদা শব্দ আছে এবং নীলকে সবুজেরই একটা শেড ধরা হয়। এখন অনেকেরই মনে হতে পারে, নীলকে হিম্বারা সবুজেরই একটা শেড হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করতে পারেন, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি অনেকগুলো একই শেডের সবুজ রঙের কয়েকটি ব্লক রেখে তার সঙ্গে শুধু একটি নীল রঙের ব্লক রেখে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা, হিম্বারা দীর্ঘক্ষণ কোনো পার্থক্যও করতে পারেননি, যে অনেকগুলি ব্লকের ভিতর কোনটি আলাদা। (Little Magazine)
সুতরাং আকাশী নীলকে হিম্বারা বা অন্যান্য সংস্কৃতিগুলিও, রঙ-হীনতা বা রঙের অনুপস্থিতি বলেই ধরে নিয়েছিলেন।
(Little Magazine) এর একটা কারণ কি এই, যে প্রকৃতিতে নীল রঙের পশু প্রায় দেখাই যায় না বা নীল রঙের ফুলও খুব একটা সুলভ নয়? (“নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো তোমার অভাব বুঝি”)। কিন্তু আকাশ বা সমুদ্র তো নীল? (যদিও হিম্বারা সমুদ্র উপকূলের উপজাতি নন) আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা হল, আকাশ যে মূলত শূন্যস্থান, তা এঁরা প্রথম থেকেই জানতেন। ওঁরা এও দেখেছেন, যে আকাশে নানা প্রকারের রং ধরে। সুতরাং আকাশী নীলকে হিম্বারা বা অন্যান্য সংস্কৃতিগুলিও, রঙ-হীনতা বা রঙের অনুপস্থিতি বলেই ধরে নিয়েছিলেন। এবং ঠিক এই কারণেই যতদিন না নীল রঙের পিগমেন্ট আবিষ্কার করছে কোনো জাতি ততদিন তাঁরা নীল রংকে, রং হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অবশ্য এখানে বলে রাখা ভালো, সমস্ত প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে একমাত্র ইজিপশিয়ানরাই নীল রঙকে একটা আলাদা রং হিসেবে চিনতেন এবং বলাই বাহুল্য নীল রঙের পিগমেন্টও ইজিপশিয়ানরা আবিষ্কার করেছিলেন। (Little Magazine)
(Little Magazine) আরেকটা ব্যাপার এখানে বলতে ইচ্ছে করল, কম্পিউটারের সাদা রঙের স্ক্রিনও আমরা জানি অসংখ্য নীল রঙের আলো দিয়ে তৈরি। সুতরাং নীলকে যে একধরণের রঙহীনতা বা রঙের অভাব হিসেবে প্রাচীন সভ্যতাগুলি দেখেছিল, তা কিন্তু একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবারে আসি আর একটু ক্রিটিক্যাল জায়গায়। ধরা যাক একই ছবি, একই দৃশ্য কিন্তু একটা পাখি আর একজন মানুষ, সেই একই দৃশ্যে আলাদা আলাদা রং দেখতে পায়। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই, যে আমরা চারপাশে সর্বত্র যে রঙগুলি দেখছি, সেই রঙগুলিও কিন্তু মৌলিক নয়। আবার কনচেট্টা আন্টিকো (Concetta Antico) বলে একজন শিল্পী আছেন যিনি সাধারণ মানুষের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি রং দেখেন। অর্থাৎ তাঁর পৃথিবী ১০০ গুণ বেশি রঙিন। কনচেটা আন্টিকো একজন টেট্রাক্রোম্যাট। সাধারণ মানুষের তিনটি রিসেপ্টর থাকে রেটিনায় কিন্তু কনচেট্টার আছে ৪টি। কনচেট্টা এক জায়গায় বলেছেন, যে গাছের পাতা আপনি শুধুই সবুজ দেখেন, আমি তার ধারগুলিতে লাল, বেগুনি বা কমলা দেখি। আপনি যাকে গাঢ় সবুজ দেখেন, আমি সেখানে বেগুনী নীল বা টারকোয়াইজ রঙও দেখি। তবে যে কথাটা বলতে গিয়েও হয়তো সাহস করে বলতে পারছি না, তা হল আপনি হলুদকে ঠিক যেভাবে দেখেন, একজন টেট্রাক্রোম্যাট না হয়েও আমি কি অবিকল সেভাবেই দেখি? নিশ্চিত করে বলা যায় না। হয়তো খুব কাছাকাছি কিন্তু অবিকল একই নাও হতে পারে। কেননা আমাদের অনেক অভিজ্ঞতাই আমাদের ভাষার উপর নির্ভরশীল। (Little Magazine)
হিম্বাদের ‘নীল’ রং সম্পর্কে ধারণার কথা হচ্ছিল, সেখানে আমরা দেখেছি যেহেতু নীল, সবুজ থেকে আলাদা কোনো রঙ নয় হিম্বাদের ভোকাবুলারিতে, তাই হিম্বা-রা নীল রঙকে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল টেস্টে সবুজ থেকে আলাদা করতে পারছে না।
(Little Magazine) একটু আগেই যখন হিম্বাদের ‘নীল’ রং সম্পর্কে ধারণার কথা হচ্ছিল, সেখানে আমরা দেখেছি যেহেতু নীল, সবুজ থেকে আলাদা কোনো রঙ নয় হিম্বাদের ভোকাবুলারিতে, তাই হিম্বা-রা নীল রঙকে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল টেস্টে সবুজ থেকে আলাদা করতে পারছে না। কিন্তু আমরা যদি একই জনগোষ্ঠীরও হই, আমাদের অন্তর্গত ভাষা তো একে অপরের থেকে আলাদা। অন্যপ্রকারের শারীরিক অভিজ্ঞতার নিরিখে এবার দেখা যাক আমি কী বলতে চাইছি। ধরুন একই ঝাল-লঙ্কা আপনাকে আর আমাকে দেওয়া হল, দেখা গেল আমাদের একজনের ঝাল লাগছে, অন্যজনের লাগছে না। আবার পাখিকে দেওয়া হল, তার ছোট্ট জিহ্বায় সে কোনো ঝালই অনুভব করতে পারল না। যদিও পাখিটি বলতে পারল না, কিন্তু আমরা দেখলাম প্রচণ্ড ঝাল-লঙ্কা, ওইটুকু পাখি একটার পর একটা খেয়েই চলেছে। আবার একই রকম গরমে কেউ ঘেমে নেয়ে একসা হয়, অন্য কেউ সেই একই গরমে বেশ ফুরফুরে বোধ করছেন। এই উদাহরণগুলি এতই সহজ, যে আমরা হয়তো ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর সেই জায়গায় পৌঁছতেই পারব না, যেখানে নীল রং স্রেফ একটা কল্পনা। (Little Magazine)
অবশ্য এসব কথা আজ আমার লিখবার কথাও ছিল না। এই ছবিটা যেখানে মহাকাশচারী ব্রুস ম্যাক্ক্যান্ডলেস্ নীল রঙের আমাদের গ্রহটির উপর ভাসছেন, সেটি দেখতে দেখতেই দু একটি লাইনে ছবিটি সম্পর্কে লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নীল রঙে আটকে গিয়ে, সেই দু একটি লাইন, এখনো লেখা হল না। যাক এবারে বলি, যদিও ছবিটা খুব সুন্দর এবং মায়াবী কিন্তু এর একটা ডার্কসাইডও আছে। যাঁরা অনেকদিন ধরে মহাকাশে থাকেন, তাঁদের সলিপসিজম সিন্ড্রোমে (solipsism syndrome) আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। সলিপসিজম কী? সলিপসিজমে মনে করা হয় এই জগত, আমাদের চারপাশ, এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, এ সবই ‘মায়া’। অর্থাৎ এসব কিছুই আসলে ঘটছে না, আমাদের সব অভিজ্ঞতা আসলে ব্রেইন সিমুলেশন! এটা যখন খুব খারাপ জায়গায় পৌঁছায়, মানে এর চূড়ান্ত অবস্থায়, রুগী মনে করেন এইসব সিমুলেশন কোনো এক ল্যাব থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ভাবা যায়, কী যাচ্ছেতাই অবস্থা! (Little Magazine)
(Little Magazine)
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।