banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মালালার পাশে সত্যজিৎ (প্রবন্ধ)

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

national herald

পাঁচ বছররে পুরনো ডায়রেরি পাতা

৩০শে জুন, ২০১৫

দিন যত বছর গড়াচ্ছে, পৃথিবী-জুড়ে ততোই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন সত্যজিৎ রায়। আজ, ৩০-শে জুন । নিউ ইয়র্কে ঘটছে এক বিরল ঘটনা। ‘ইউনাইটেড নেশন্স’-এর সদর-দপ্তরে । এইমাত্র উদ্বোধিত হলো এক আশ্চর্য প্রদর্শনী ।

সারা পৃথিবী থেকে মাত্র ১৬-জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে এক বিশেষ সম্মানের জন্য। এমন ১৬-জন, যাঁরা গোটা মানবজাতিকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন — নানা মানবিক গুণাবলীকে আমাদের হৃদয়ে লালনপালন করার প্রয়োজনীয়তার কথা। মনে করিয়ে দিয়েছেন — প্রকৃতির উপর মানবজাতির নির্ভরতার কথা। যে-নির্ভরতা অবিচ্ছেদ্য। অলঙ্ঘ্য।  চিরকালীন।

এই ব্রত নিয়ে নিজেদের সারাটা জীবন যাঁরা অক্লেশে নিবেদন করেছেন — এমন মাত্র ১৬-জনের মধ্যে সম্মানীত হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়ও। তিনি লোকান্তরিত হবার সুদীর্ঘ ২৩-বছর পরেও। আশ্চর্য নয় কি?

এ’খানে একটা প্রশ্ন উঠবেই। এইরকম নানা গোত্রের নানা সম্মান সারা জীবন পেয়েছেন সত্যজিৎ! তা’হলে আজকের এই ঘটনাটায় উচ্ছসিত হবার কোনও মজবুত-ভিত্তি আছে কি? আছে। এই ঘটনায় প্রমাণিত হল — সত্যজিৎ রায়ের শিল্প আজও সমান প্রাসঙ্গিক। যে প্রাসঙ্গিকতা শুরু হয়েছিল ৬০-বছর আগে।

এই প্রদর্শনীতে যাঁরা সম্মানিত হচ্ছেন তাঁদের অনেকেই তরুণ প্রজন্মের। যেমন, মালালা। বয়স মাত্র ২০ বছর! নোবেল শান্তি-পুরস্কার পাওয়া-সত্ত্বেও যে-এখনও বাড়িতে ভাইয়ের সঙ্গে দিন-রাত অশান্তি করে! (মানে, হাতাহাতি, মারপিট) এই-রকম একটা দুষ্টু-বাচ্চার পাশে আজও সহজেই নিজের স্থান করে নিলেন সত্যজিৎ রায়। এ এক অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব। মালালার সংগে সত্যজিতের বয়সের তফাৎ ৭৬ বছর। ছোটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজের জায়গা ধরে রাখা যায় না। কারণ, শিল্পের আঙ্গিক বদলে যায়। বদলে যায় প্রতিবাদের ভাষা। মুখের ভাষা। এমন-কী গানের ভাষাও। এখানে একটা উপযুক্ত উদাহরণ দেওয়া দরকার । সত্যজিৎ রায় সারাজীবন বাংলার জনজীবন নিয়েই কাজ করেছেন। তাই বাংলার ইতিহাস থেকেই দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।

ভাষা ও সুর পরিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-প্রেমের গানগুলির কথা মনে আসে । ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন অখন্ড বাংলাকে দু’টুকরো করে দিতে চেয়েছিলেন। সেটা ১৯০৫। ইংরেজ-সরকারের এই ষড়যন্ত্রকে মানবেন কেন রবীন্দ্রনাথ? তাই নিজেকেশুধুই প্রেম ও প্রকৃতির ‘গীতি-কবি’র পরিচয়ে বেঁধে রাখতে পারলেন না। লিখলেন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশ-পর্যায়ের গান। মোট ২৬টা গান। সব গানেই তিনি অখন্ড-বাংলাকে ‘মা’-রূপে কল্পনা করলেন। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ‘মা’ মানে কিন্তু কোনও দেবী নয়। তাঁর স্বদেশি গানের ‘মা’ হলেন আপন-মা এবং প্রকৃতি-মায়ের এক আশ্চর্য মিশ্রণ। শুধু তাইই নয় — এই পর্যায়ের প্রায় সব গানই তিনি বাঁধলেন বাংলার লোকসংগীতের সুরে, যাতে গ্রাম ও শহর মিলিয়ে বাংলার সমস্ত মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে তাঁর এই গান। গানগুলো আজও সমস্ত বাঙালির মনে বাসা বেঁধে আছে। তার মধ্যে একটা গান তো পৃথিবীর নানা-প্রান্তে শোনা যায় গত চার দশক ধরে। কারণ, সেই গানটা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত — “আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালোবাসি…”। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদের ভাষা ছিল এরকমই ভালোবাসায় ভরা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি বিষোদ্গার তাঁর গানে তিনি করেননি। অর্থাৎ, ব্রিটিশ-শাসকের অস্তিত্বকেই তিনি গানের কথায় সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন। তবুও তাঁর স্বদেশি-গানের এমনই শক্তি যে, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ সরকারিভাবে রদ হয়ে গেল। কী-ভাবে?.. এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কলকাতায় মোটামুটি এক লক্ষ মানুষের একটা মিছিল হয়েছিল। আবেগে ধাবমান সেই প্রতিবাদী জনসমুদ্রের প্রথম মানুষটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নিজের গান গাইছিলেন। মিছিলের প্রায়-সবাই তাঁর সংগে গলা মিলিয়েছিল। সে ছিল এক সবার-প্রাণে-আগুন-জ্বালানো, কলকাতা-কাঁপানো-কোরাস । গাইতে গাইতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের হাতে রাখী বেঁধে দিচ্ছিলেন। এমন-কী ইংরেজ-সরকারের পুলিশও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বিস্মিত নয়নে রবীন্দ্রনাথের গান শুনেছিল! ভুলে গিয়েছিল লাঠিচার্জ করতে!

কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের সে’দিন-গাওয়া গানগুলো কি আজও প্রসঙ্গিক? আজও বেঁচে আছে?

নতুন ভাষা

রবীন্দ্রনাথের এই বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী গানগুলো লেখার ১০২-বছর পরে, এই বাংলারই এক নতুন কবি-গায়ক আবার প্রতিবাদের গান বাঁধলেন । তাঁর নাম — কবীর সুমন । কেন বাঁধলেন ? কারণ, পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল । ২০০৭-এর ১৩ই মার্চ। তারই প্রতিবাদে গান বেঁধেছিলেন কবীর সুমন । কিন্তু, যেহেতু মাঝে ১০২-বছর পার হয়ে গেছে — তাই, নতুন-যুগের এই কবি-গায়কের গান একেবারেই অন্যরকম । তাতে বাংলার লোকসংগীতের সুর সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । (বরং, পাশ্চাত্য-লোকসংগীতের ছোঁওয়া অনেক বেশি । বব ডিলান কিংবা, পিট সিগারের স্টাইল মনে পড়ে যায়।) গানের পংক্তিগুলোও রবীন্দ্রনাথের গানের চেয়ে দৈর্ঘ্যে অনেকটা ছোট। অথচ, কবীর সুমনের প্রতিবাদী-গান ২১-শতকের শিক্ষিত মানুষকে মাতিয়ে দিল । ২০০৭-এ, রাষ্ট্রীয় রোষরে বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ যে-ক’টি কারণে সরব হয়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে একটি প্রধান-কারণ অবশ্যই কবীর সুমনের গান ।

এ’খানে আবার মূল প্রশ্নে ফিরে যাই।

কবীর সুমনের প্রতিবাদী-গান শোনার পর, বাঙালি কি রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী-গান ভুলে গেছে ? .. অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ কি তাঁর চেয়ে ৮৯-বছরের ছোট এক কবি-গায়কের কাছে নিজের স্থানটি খুইয়েছেন?
রবীন্দ্রনাথ কি স্থান হারয়িছেনে?

কবীর সুমনের প্রতিবাদী-গানগুলোর মধ্যে একটা-দুটো করে হয়তো অনকেই ইতিমধ্যে ভুলতে শুরু করেছে। মাত্র ৮-বছর কাটতে-না-কাটতেই! কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী-গান মানুষ ভোলেনি। ১১০-বছর পরেও। তার অগুন্তি রহস্যময় কারণের মধ্যে একটা নিশ্চয়ই বাংলার লোকসংগীতের চিরকালীন সুর প্রয়োগ ।

সুতরাং, বয়সে প্রায় এক-শতাব্দী ছোট, প্রচন্ড জনপ্রিয় আধুনিক এক ‘আইকন’-এর পাশে কী অনায়াসে নিজের আসনটা বাঁচিয়ে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ । প্রমাণিত হল, তাঁর গানের মূল্য চিরকালীন। নতুন-যুগের গানের সুর ও বাংলা-ভাষার কোনও পরিবর্তনই রবীন্দ্রনাথের পুরনো-গানের আবেদন আজও একটুও কমাতে পারেনি । এটা অভাবনীয়। যেমন — “তোর মরা-গাঙে বান এসেছে / ‘জয় মা’ বলে ভাসা তরি ..” — বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী এই গানটি এখনও বিখ্যাত কয়েকটি আধুনিক-ব্যান্ড কোরাসে গায়। একটুও সুর না পাল্টে।

সত্যজিৎ কি পুরনো?

সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্বও এই জাতের ।

তাঁর চেয়ে ৬৯-বছরের ছোট একটা বাচ্চার পাশে নিজের স্থানটি বাঁচিয়ে রাখলেন ।

এটা কি নিজেও তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন ?

শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এর এডিটিং শেষ-করার দিনও তিনি কি ভেবেছিলেন — আগামী শতাব্দীতে আরও মূল্যবান হয়ে উঠবে তাঁর শিল্প?

কোনও যথার্থ শিল্পী কি ভাবতে পারেন এ-কথা? যতদূর মনে হয়, পারেন না।

তাই, সত্যজিতের শেষ-ছবির শেষ-সংলাপে কেন্দ্রীয়-চরিত্র বলেছেন — “আমার সামনে আমার রচনা পড়লে আমার বড়ো এমবারাস্ড বোধ হয় ।… ইংরেজিতে একটা কথা আছে জানো? ‘ফ্লক্সিনোসিনিহিলিপিলিফিকেশন’!! .. মানে কী জানো ?.. ‘সেটিং লিটল অর নো-ভ্যালু’! — এইটা বোঝাতে উনত্রিশটি অক্ষর! এই না-হলে সভ্যতা?” — এই সংলাপের মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ রায় যেন ইঙ্গিত করেছেন — তাঁর সৃষ্টির মূল্য যে অস্থায়ী — সে’ বিষয়ে তিনি প্রায়-নিশ্চিৎ ।

সুতরাং, ইউনাইটেড নেশন্স যে-ভাবে তাঁকে আজ সম্মানীত করছে — আজও বেঁচে থাকলে, সেটা তাঁর কাছে হতো অভাবনীয় ।

কারণ, তিনি জানতেন — সবকিছুই পাল্টে যায়। পাল্টে যাবে। পাল্টাতেই থাকবে … সিনেমায় গল্প-বলার কৌশল, ক্যামেরার চলাচল, আলোছায়ার ব্যঞ্জনা, অভিনয়ের ধারা। একই সংগে, বাংলায় কল্পবিজ্ঞান-কাহিনির প্রচন্ড জনপ্রিয় লেখক ছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাই, এটাও তিনি জানতেন — অচিরেই সিনেমায় এসে যাবে কম্পিউটারের নানা চোখ-ধাঁধানো-খেলা। সেটাই হয়েছিল। তাঁর প্রয়াণের মাত্র তিন-বছর পরে, কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল ‘জুরাসিক পার্ক’। চারদিকে এতরকম পরিবর্তনের মধ্যেও, তাঁর ছবিকে ২৫-বছর পরেও পৃথিবীর মানুষ মূল্য দেবে কি? — এই ভরসাটা রাখার কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ সত্যজিৎ নিজেই খুঁজে পাচ্ছিলেন বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। কারণ, শেষ-জীবনে একটি ফরাসি-ইন্টারভিউ-তে সত্যজিৎ বলেছিলেন — “পৃথিবীটা এখন স্কাউন্ড্রেলে ভরে গেছে!” এই কথা কীকরে বলতে পারলেন প্রেমে ও স্নেহে জারিত-ছবি ‘অপুর সংসার’-এর সেই কোমল-হৃদয় স্রষ্টা ? কিন্তু, অপ্রত্যাশিত এই কটূ-মন্তব্য থেকে এ’টুকু অন্তত আমরা বুঝতে পারি — গত শতাব্দীর ৯-এর দশকের মানুষের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় । সুতরাং, যে নৈতিক মূল্যবোধের উপর তাঁর সব ছবি প্রতিষ্ঠিত — তার উপর মানুষের আর বিশ্বাস আছে কি? না — সত্যজিতের ধারণা হয়েছিল — একেবারেই নেই। তাহলে, তাঁর ছবি আর মানুষ দেখবে কেন?

অর্থাৎ, ১৯৭৩-এ, যে-হৃদয় নিয়ে দলে-দলে জনগণ তাঁর ‘অশনি সংকেত’ টানা ৫-মাস ধরে দেখেছিল — ১৯৯০-সালে সেই হৃদয়ের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিল কি?

সত্যজিতের সংশয়

এই গভীর সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল সত্যজিতের মনে। তবে এ’রকমই হবার কথা। সমাজ ও ইতিহাস-সচেতন, এবং সেই সঙ্গে অতি সাধারণ মানুষের প্রতি যিনি আজীবন-দরদী — এমন শিল্পীর মনে এই বিশেষ অনুভব জন্ম নিতে বাধ্য। বিশেষত, জীবনের শেষ-প্রান্তে এসে ।

এই অনুভব রবীন্দ্রনাথেরও হয়েছিল। পৃথিবীর প্রতি তাঁর শেষ-সম্ভাষণে এই মহাকবি বলেছিলেন — ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ নামক আজগুবি প্রশাসনিক বস্তুটি ছাড়া ব্রিটিশরা ভারতীয়দের আর কিছুই শেখায়নি। বলেছিলেন — পাশ্চাত্যের দিকে তাকালে এখন তিনি শুধু এক ধন-গর্বিত ‘সভ্যতা’র অর্থহীন ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।

ভবিষ্যতে যদি-বা তাঁর ছবি-দেখার উপযুক্ত দর্শক পাবার কোনও সম্ভাবনা থাকে — তবুও তাদের দেখার মতো কোনও ছবি আর বেঁচে থাকবে না । এই আশংকা ছিল সত্যজিৎ রায়ের মনে । কারণ, ভারতে সিনেমার অরিজিনাল-নেগেটিভ-সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই তখনও গড়ে ওঠেনি । কেউ ভেবেও দেখেনি এ’সব কথা । সুতরাং, অদূর-ভবিষ্যতে যে তাঁর ছবির কোনও ফিজিকাল-অস্তিত্ব থাকবে না — ততোদিনে এটা তিনি এক-রকম ধরেই নিয়েছেন বলা যায় । সেটা ১৯৮০/৮১ সাল । তাঁর ‘সদগতি’-ছবির শ্যুটিং শুরু হতে চলেছে । ঠিক এই সময়, একটি বাংলা পাক্ষিক-পত্রিকার সাক্ষাৎকারে এই-আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন সত্যজিৎ । সোজা-কথায় — যে-জিনিসটাই থাকবে না, সেটা আর মানুষ দেখবে কী-করে ?

সুতরাং, দুটি সমান্তরাল ভয় —

১. সহৃদয় দর্শক থাকবে না ।
২. যদি-বা দর্শক থাকে, তা’হলেও ফিল্মগুলো থাকবে না ।

তখন, রঙিন ছবি তো আদৌ রাখা যাচ্ছে না। ৫-বছর কাটতে-না-কাটতেই প্রিন্টের স্বাভাবিক রং উঠে গিয়ে ছবি লাল হয়ে যাচ্ছে। সত্যজিতের রঙিন ছবি ‘অশনি সংকেত’ তৈরি হয়েছিল ‘সদগতি’র শ্যুটিং-এর মাত্র ৮-বছর আগে। কিন্তু, তারই মধ্যে ‘অশনি সংকেত’-এর যতগুলো প্রিন্ট ছিল — সবকটারই রং উঠে গেছে। সেই খবর অবশ্যই সত্যজিতের কানে পৌঁছতো। কারণ, রবিবার সকাল ১০টায়, পুরনো ভাল-ছবি দেখানোর একটা রীতি সেই-সময় চালু ছিল বাংলায়। সেই মর্নিং-শো-এ মাঝেমাঝেই দেখানো হত ‘অশনি সংকেত’। কাজেই ছবিটার রং যে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে — এই দুঃসংবাদ সত্যজিতের কানে ঠিকই পৌঁছে যেত। তিনি আঘাত পেতেন কি?

দেখে বোঝা যেত না। সত্যজিৎ নির্বিকার থাকতেন। এই ভয়টা যখন তুঙ্গে — ঠিক তখনই সত্যজিৎ রায় শ্যুটিং করতে শুরু করলেন তাঁর নতুন ছবি ‘সদগতি’র। সেটা ১৯৮০। সুতরাং, এই-ছবির অস্তিত্ব ৫-বছর পর নাও থাকতে পারে — এটা তিনি জানতেন। তবু, নির্বিকারচিত্তে, গভীর মনোযোগ দিয়ে, মধ্যপ্রদেশের চড়া রোদ, প্রচন্ড বৃষ্টি ও নিজের মেরুদন্ডের অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করে, তিনি ‘সদগতি’র শ্যুটিং শেষ করলেন। বহু-বহু বছর পরে ‘ডিজিটাল টেকনোলজি’ নামে একটা কিছু আবিষ্কৃত হবে, আর তার সাহায্যে পুরনো-ছবির নষ্ট-প্রিন্ট আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা যাবে — এটা ছিল যাকে-বলে ‘অলৌকিক দুরাশা’। সুতরাং, সম্পূর্ণ নির্বিকারত্ব ছাড়া তখন সিনেমা-পরিচালকদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব ছিল না।

সত্যজিতের পুনরুত্থান

এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখলে, ‘ইউনাইটেড নেশন্স’-এর প্রধান-অফিসে আজকে যা ঘটছে — তা অভাবনীয়। কারণ, এখন বোঝা যাচ্ছে — আর্টের চারটি দিক থেকেই, পৃথিবীর নানা-দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য। এবং, সেটা গভীরভাবে। সেই চারটি দিক হল —

১. তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা (অপু-ট্রিলজি)

২. তাঁর নৈতিকতা, দর্শন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ (প্রতিদ্বন্দ্বী / আগন্তুক)

৩. ছবির আপাত-মন্থরতা সত্ত্বেও ভিতরে লুকনো মনস্তাত্ত্বিক গতি। (চারুলতা)

৪. আলোকচিত্র, সম্পাদনা, আবহসংগীত ইত্যাদি নানা টেকনিকাল কাজ। (প্রায় সব ছবি)

গত অর্ধ-শতাব্দীতে মানবজাতির দিন-যাপনের অভ্যাস আমূল পাল্টে দিয়েছে ইন্টারনেট, ডিজিটাল বিপ্লব ইত্যাদি। ইউ-টিউবের দৌলতে যে-কেউ এখন যে-কোনও সিনেমা বাড়িতে বসে দেখে নিতে পারে। তাই মানুষের সিনেমা দেখার অভ্যেস এখন অবিশ্বাস্য বেড়ে গেছে। এরই-সঙ্গে ইউ-টিউবে আছে অগুন্তি সিনেমার ক্লাস। যেমন — হিচকক মাত্র ১-মিনিটে শেখাচ্ছেন চলচ্চিত্র-সম্পাদনা ! .. হ্যাঁ, মাত্র ১-মিনিটেই । এটা লখোর ভুল নয় । সিনেমায় শব্দ ও সংগীত কীভাবে যথার্থ ব্যঞ্জনাপূর্ণ করে তুলতে হয়, সে’বিষয়ে পুরো সিলেবাস্ শেষ করে দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়। মাত্র ৮-মিনিটে ! .. যতবার খুশি দেখে শিখে নেওয়া যায়। .. নিজের জীবন-দর্শন ও শিল্প-ভবনা নিয়ে প্রঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছেন কুরোসাওয়া নিজে। এটা অবশ্য বেশ বড়। দেড়-ঘন্টা । … এঁরা সবাই সংশয়াতীত-জিনিয়াস । এঁরাই আমাদের ঘরে নেমে আসছেন। রোজ। যে-কোনও সময়। আমাদের ছেলেমেয়েদের ‘চলচ্চিত্র-শিক্ষা দিচ্ছেন, শিল্পবোধ বিকশিত করছেন — এটা কেউ কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল? অথচ সেটাই হচ্ছে রোজ। যখন-তখন আমাদের ঘর-দুয়ার এখন গম-গম করে ওঠে সত্যজিৎ রায়ের শ্রাবণ-মেঘের মতো কণ্ঠস্বরে!

‘গীতাঞ্জলি’র একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য-জগতের স্বপ্ন দেখেছিলেন । যেখানে জ্ঞান হবে মুক্ত —

প্রধানত ‘ইউটিউব’-এর দৌলতে জ্ঞানের এই আংশিক মুক্তি সম্ভব হয়েছে। (আমাদের স্বাস্থ্য-পরিষেবার মতোই এটাও আংশিক। ভারতে দারিদ্র্য-সীমার নীচে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের কাছে অবশ্য ‘ইউ-টিউব’-এর অস্তিত্বই নেই)।

সত্যজিতের নতুন প্রতিযোগীরা

শুধু সিনেমা কিংবা অন্য কোনও আর্ট নয় — যে-সমস্ত বিদ্যা এতদিন সাধারণ-মানুষের ধরা-ছোঁওয়ার অনেক বাইরে ছিল — জ্ঞানের সেই সমস্ত শাখা এখন হাতের মুঠোয়। যেমন, স্বয়ং প্রোফেসর স্টিফেন হকিং নিজে আমাদের ঘরে নেমে এসে বলছেন — ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবাটাই অর্থহীন । হিটলার যখন মৃতদেহের পর্বত তৈরি করছিল — ঈশ্বর তখনও হস্তক্ষেপ করেননি।

কসমোলজিস্ট কার্ল সেগান আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অনন্ত এই ব্রহ্মান্ডের সঙ্গে ।

যাঁরা দর্শনে আগ্রহী — তাঁরা দেখে নিতে পারেন, ১৯৫৬ সালে রেকর্ড-করা বার্ট্রান্ড রাসেল-এর দর্শন-বিষয়ক প্রোফাউন্ড সাক্ষাৎকার — যদিও মাঝে-মাঝে সেটা রাসেলীয় দুষ্টু-রসিকতায় ভরা ! ..

আরও বিস্ময় ! ইউটিউব-এ দেখতেও পাবেন, শুনতেও পাবেন — পরম-আশ্চর্য একটি দৃশ্য। ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ — এই কবিতাটি আবৃত্তি করছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। না, গাইছেন না। শুধুই আবৃত্তি। দৃশ্যটি ভারতের কোনও আর্কাইভে ছিল না। শুনলে, অন্তত আমার মনে হয়, জীবন ধন্য!

কিন্তু, কেন টানলাম এঁদের কথা?

কারণ, এঁরাই এখন সিরিয়াস-সিনেমার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই রবীন্দ্রনাথ, এই বার্ট্রান্ড রাসেল, এই স্টিফেন হকিং, কার্ল সেগান, কুরোসাওয়া, হিচকক, এমন-কী সত্যজিৎ রায় নিজেও!

কিন্তু কেন এঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী?

এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে অন্য-একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। সেটা হল, ৩০/ ৪০/ ৫০-বছর আগে, সত্যজিতের প্রতিযোগিতাটা হতো কার-কার সঙ্গে ? ..

প্রধানত, উত্তম-সুচিত্রা কিংবা রাজ কাপুর-বৈজয়ন্তীমালা জাতীয় রোমান্টিক জুটির সঙ্গে। ভারতের অধিকাংশ দর্শকের মনে এই-জাতীয় জুটির সম্মোহনী-প্রভাবের কথা আদৌ অস্বীকার করছি না। আরও পরে, ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী কিংবা রাজেশ খান্না-শর্মিলা ইত্যাদি।

কিন্তু আমরা আলোচনা করছি সিরিয়াস ছবি নিয়ে। উপরের জুটিরা কোনওদিন সিরিয়াস ছবিতে কাজ করতে চাননি। অথবা, ডাক পাননি। দুটোই সত্যি।

অবশ্য, এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার, ‘সিরিয়াস’ বলতে কী বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ? অবশ্যই রসিকতা-হীন গোমড়া-মুখো ছবি নয়। রস ও রসিকতা থাকবেই । বোঝাতে চাইছি এমন ছবির কথা, যাতে জীবন, সমাজ, ইতিহাস, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘায় পরযায়ী পাখিদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়ছিল। দর্শকদের অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে। সামাজিকভাবে আলোচনা করতে। শেষ-পর্যন্ত, ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে। যেমন চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’। অট্টহাসির ফোয়ারা সত্ত্বেও, এই-ছবি ধনতন্ত্র থেকে শুরু করে, নর-নারীর প্রেম পর্যন্ত মানব-সমাজের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এটাই সিরিয়াস-ছবির প্রধান ও একমাত্র চিহ্ন। ঠিক এই অর্থে সত্যজিতের সব ছবিই সিরিয়াস। এমনকি তাঁর ছোটদের ছবি, হাসির ছবি, রহস্যের ছবিও।

সুতরাং, সত্যজিতের ‘মহানগর’, ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ কিংবা ‘অশনি সংকেত’-এর পাশে, ‘কথায়-কথায়-গান-গেয়ে-ওঠা’ এবং ‘পুরো গোলাপি-রঙের-মুখ-ওয়ালা’ — এই রোমান্টিক-জুটিরা কোনও প্রতিযোগীই ছিলেন না ! কারণ, সিরিয়াস-ছবিতে আবগেরে পাশাপাশি মানুষ কোনও ‘গভীর-বাণী’ শুনতে বা অনুভব করতে আসেন। সেই ‘গভীর-বাণী’ অবশ্যই পাওয়া যাবে সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বা ‘অশনি সংকেত’-এ ।

সুতরাং, রাজ কাপুরের ‘ববি’ আর সত্যজিতের ‘অশনি সংকেত’-এর দর্শক সম্পূর্ণ আলাদা। স্বভাবতই। ‘ববি’র মতো বাণিজ্যিক-ছবির পাশে চলা-সত্ত্বেও, সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সত্যজিতের ‘অশনি সংকেত’ চলেছিল একটানা পাঁচ-মাস ! এ’কালে কেউ ভাবতে পারবে ‘গভীর-বাণী’-সমৃদ্ধ কোনও ছবির এমন জনপ্রিয়তা ?

এই প্রসঙ্গে আরও-একটা কথা ভোলা শক্ত । ‘ববি’ ছিল ‘টুসটুসে’-আবেদনে পূর্ণ, সদ্য-কৈশোর-উত্তীর্ণ দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমের গল্প ।

অন্যদিকে ‘অশনি সংকেত’ হল, ১৯৪৩-সালে সমগ্র-বাংলাদেশ জুড়ে, বৃটিশদের সৃষ্টি-করা যে-ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ — তার পটভূমিতে একটি ক্ষুদ্র কাহিনি । বাংলার কোনও অজানা-ছোট্ট-এক-গ্রামের অতি-নগণ্য এক দম্পতির জীবনের কয়েকটি মাস । আসন্ন-দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাকে তারা ঠিক অনুমান কিংবা অনুধাবন করতে পারেনি । কারণ, ক্ষেত-ভরা-ফসল আছে । তবু কেন দুর্ভিক্ষ এল ? সেই কারণটা গ্রামবাসীরা জানবে কীকরে ? জানত না বলেই, সেই দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে তারা সবে করুণ ও অসম-লড়াই শুরু করেছে, তাদের ব্রাহ্মণত্বর দেমাক সবে ভাঙতে শুরু করেছে — এই হল ‘অশনি সংকেত’-এর বিষয় ।

এই করুণ ও বিষাদময় ছবিটি পশ্চিমবঙ্গে চলেছিল ‘ববি’র চেয়ে অনেক বেশি ! .. এটা, এবং এ’রকম আরও অনেক ঘটনা থেকে আমরা একটি সহজ-সিদ্ধান্ত নিতে পারি । সেটা হল, জীবিতকালে সত্যজিৎ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী । কারণ, ভারতীয় ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর কোনও প্রতিযোগী ছিল না বললেই চলে ।

একই-সময় ভারতের অন্য দু’জন মহৎ পরিচালক ছিলেন ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন । যে-দর্শকরা গভীর-বাণীর সন্ধানী, তাঁরা সবাই এই দু’জন পরিচালকের ছবি নিয়মিত দেখতেন । কিন্তু, সব-রকম দর্শক তাঁদের ছবি দেখে আনন্দ/বেদনাময় কোনও সত্য অনুভব করতে পারতেন না । তাই, ঋত্বিক বা মৃণালের ছবি সেই-অর্থে কখনও বিপুল জনপ্রিয়তা পায়নি । এর আরও একটা কারণ আছে । ঋত্বিক বা মৃণালের চেয়ে সত্যজিৎ ছিলেন অনেক বেশি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব । তার তিনটি কারণ —
১. সত্যজিৎ নিঃসন্দেহে বাংলা-ভাষার ইতিহাসে জনপ্রিয়তম কিশোর-সাহিত্যিক ও কাহিনি-চিত্রকর । তাঁর বিপুল পাঠক-সমাজও হয়ে উঠেছিল তাঁর সিনেমার কমিটেড দর্শক ।

২. সত্যজিতের ছবিতে গল্প-বলার স্বচ্ছতা।

৩. তাঁর ছবির উপরের স্তরে আছে এক সরস-সরলতা। ফলে, তাঁর ‘দেবী’র মতো ভয়ংকর ট্র্যাজিক ছবিরও গোড়ার দিকে যথেষ্ট হাসির উপাদান আছে। তিনি জানতেন — সরল ও সংযত হিউমারের পটভূমতিে ট্র্যাজেডির ঘন-অন্ধকার মূর্তিটা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

এই তিনটি কারণে তাঁর ছবিও জনপ্রিয় হতো অনেক বেশি । (আরও অনেক অনাবিষ্কৃত কারণও অবশ্যই আছে।) যেমন, সত্যজিতের আপাত-দুরূহ ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ও সহজেই সিলভার জুবিলি করেছিল। তা-ও ১৯৬২ সালে। তার মানে, চলেছিল একটানা ২৫-সপ্তাহ !

নতুন প্রতিযোগীদের বিপুল ভার

কিন্তু ২১-শতকে এসে, সত্যজিৎ রায় এখন মহৎ মনীষীদের সামনা-সামনি হচ্ছেন। এটা ঘটছে প্রধানত ‘ইউ-টিউব’-এর মাধ্যমে । এই মনীষীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা তো দূরের কথা এঁদের পাশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই বেশ কঠিন। কারণ, তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, বার্ট্রান্ড রাসেল, আইনস্টাইন, জাঁ-পল সার্ত্র, স্টিফেন হকিং, বা কার্ল সেগান জাতীয় মানুষ। সাক্ষাৎকার দেবার সময় একটু হালকা চালে হলেও এঁরা ‘গভীর বাণী’ই উচ্চারণ করে থাকেন  এবং, এঁরা কেউ কেউ অতি সুর্দশন হওয়া সত্ত্বওে ঠিক চিত্রতারকা-গোত্রের নন!

সুতরাং, সিনেমা দেখে আনন্দ পাবার সঙ্গে সঙ্গে ‘গভীর-বাণী’ শুনতে যাঁরা সত্যিই আগ্রহী — তাঁরা সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ দেখতে-দেখতে, মাঝপথে হঠাৎ বার্ট্রান্ড রাসেল-এর সাক্ষাৎকার দেখতে শুরু করতে পারেন। কেন ? কারণ, দু’জনেই একই বিষয়ে কথা বলছেন। পরমাণু-বোমার সাহায্যে, চোখের পলকে, অকল্পনীয়-রকম-ব্যাপক গণহত্যা করার অধিকার ‘অর্জন’ করেছে কয়েকটি মানুষ । শুধু তারাই সভ্য । আর এটাই হলো মানব-সভ্যতার মহত্তম ‘অর্জন’ । উন্নততম “প্রকাশ” ! — সুতরাং, হঠাৎ ‘আগন্তুক’ দেখাটা থামিয়ে, কোনও-কোনও-দর্শক এক-মুহূর্তে ইউটিউবে টাইপ করতে পারেন — ‘বার্ট্রান্ড রাসেল ইন্টারভিউ বিবিসি অন নিউক্লিয়ার ওয়ার’ । চোখের পলকে বার্ট্রান্ড রাসেল ফুটে উঠবেন তাঁর কম্পিউটার-মনিটারে । বলতে শুরু করবেন — পরমাণু-যুদ্ধের আত্মঘাতী-ভয়ংকরতা সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ । রাসেলের অভিমতটা বার-দুয়েক শুনে নিয়ে, সেই-দর্শক আবার মাউসের একটামাত্র ক্লিকে ফিরে আসতে পারেন সত্যজিতের ‘আগন্তুক’-এ। (নাও আসতে পারেন। এটা তাঁর চয়েস।)

এই অভাবনীয় প্রতিযোগিতাই হলো বিংশ-শতাব্দীর পরিচালকদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । চ্যালেঞ্জটা প্রায় ‘আজগুবি’ পর্যায়ের । অনেকটা সুকুমার রায় কিংবা ল্যুইস ক্যারোল-এর কবিতার মতো । অনেকটা যেন সুকুমার রায়ের সেই কবিতাটার মতো — “ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা!” এখন বিংশ-শতাব্দীর পরিচালকদের কুস্তি করতে হচ্ছে ছায়ার সঙ্গে! সত্যজিৎ, বার্গম্যান বা কুরোসাওয়া যতদিন ছবি করেছেন — ততদিন রাসেল থেকে কার্ল সেগান ছিলেন তাঁদের কাছে ‘ছায়া’। অর্থাৎ, অলীক। কুরোসাওয়ার ‘রশোমন’ যে বছর ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হলো, সেই বছর পুরস্কার-বিতরণী মঞ্চে কার্ল সেগান-এর মতো কোনও দার্শনিক ফোর্থ কিংবা ফিফথ ডাইমেনশন-এর ‘ইলিউশন ও রিয়ালিটি’ নিয়ে বক্তৃতা দেননি। অথচ, এটাই ছিল কুরোসাওয়া’র ‘রশোমন’-এর প্রায়-প্রধান বিষয়বস্তু। এর থেকেই পৃথিবীর সাংস্কৃতিক-ইতিহাসের একটা সরল সত্য বেরিয়ে আসে। সেটা হল, গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত, সিনেমা, দর্শন, বিজ্ঞান — এইগুলোর মধ্যে তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না । প্রতিটি বিষয় সুরক্ষিত থাকত তাদের নিজস্ব ‘ওয়াটার-টাইট কম্পার্টমেন্ট’-এর মধ্যে। তথাকথিত ‘বিপরীত-ধর্মী’ বিষয়বস্তুর মধ্যে কোনওরকম আদান-প্রদান ছিল বেশ বিরল। একটা দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা সহজ হবে। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-ছবিটি দেখানো হয়েছিল বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। জুন, ১৯৭৩-এ । ছবিটির বিষয় — কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। উইনস্টন চার্চিলের ষড়যন্ত্র অনুযায়ী চালের কৃত্রিম-অভাব সৃষ্টি করেছিল। যাতে, জাপানী-সৈন্যরা বাংলার উপর দিয়ে মার্চ করে দিল্লির দিকে এগোতে না-পারে। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। জাপানীরা আসেনি। কিন্তু ফলটা ভয়াবহ। ৫০-লক্ষ নিরীহ বাঙালির মৃত্যু । তারা জানতই না, হঠাৎ কেন সমস্ত চাল উধাও হয়ে গেল ।

ছবিটা বার্লিনের সর্বোচ্চ সম্মান গোল্ডেন বেয়ার-এ সম্মানিত হয়েছিল।

এখানে একটা প্রশ্ন উঠবেই। সেদিন যদি বার্লিনের বিচার মঞ্চে অর্মত্য সেন উপস্থতি থাকতনে এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে কোনও ভাষণ দিতেন –- তাহলে কি ‘অশনি সংকতে’ ছবিটার নানা ‘অভাব’ নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে এই রীতিটাই ছিল না ।
সেই রীতি এখন প্রতিটা মানুষের করতলগত। পৃথিবীর ইতিহাসে সমস্ত মনীষী প্রতনিয়িত নৃত্য করেই চলেছেন সবার তালুতে। এই অদ্ভুত প্রতযোগিতায় টিকতে পারবনে ক’ জন সরিয়িাস পরচিালক ?
এই অবশ্বিাস্য প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর ছবির দর্শক বেড়েই চলেছে। এখন তিনি আইনস্টাইন, বারট্রান্ড রাসলে কিংবা সার্ত্র-এর পাশেই সমান প্রাসঙ্গিক।
মালালার পাশেই তাঁর প্রতকিৃতি টাঙানোই তার প্রমাণ!

10 Responses

  1. এই লেখায় একটা ব্যালান্সের অভাব আছে। মনে হচ্ছে, সত্যজিতের হয়ে কেউ আপ্রাণ চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করতে। মালালার পাশে সত্যজিৎ দাঁড়াতে পারেন কিনা এটা একেবারে অবান্তর প্রশ্ন। শিল্পকর্মের মূল্য এইভাবে নির্ধারিত হয় না, হলেও তাকে ইগনোর করা উচিত। আসল কথা হলো, আজ ইউটিউবের যুগে বহু জ্ঞান ও মনোরঞ্জনের উপাদানের মধ্যে ছবির মূল্য নতুন করে নির্মিত হওয়া। সেটা ভালো পয়েন্ট। কিন্তু সেখানেও টাইটানদের মধ্যে কম্পিটিশটা বড় কথা নয়, এক উপাদান আরেক উপাদানের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রসঙ্গটা বরং অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। আমি গভীর সত্যজিৎ অনুরাগী। কিন্তু ‘ভক্ত’ হওয়ার বিপদ হলো, অশনি সংকেত আর আগন্তুকের মধ্যে ফারাক না করতে চাওয়া। দ্বিতীয়টায় বিশ্ব প্রকৃতি বিষয়ে জ্ঞান শৈল্পিক শর্ত পূরণ করে না। রাসেলের বা সাগানের জ্ঞানচর্চা আর শিল্পের দর্শন এক জিনিস নয় একেবারেই। এটা এই লেখা পড়ে বোঝার উপায় নেই। বস্তুত, শেষ দিকে সত্যজিতের ছবি যত দুর্বল হয়েছে সরাসরি বক্তব্য জানানোর প্রবণতা তত বেড়েছে।

  2. বাঙালির সবকিছু রবীন্দ্রনাথ সত্যজিতে গিয়ে ঠেকা উচিত নয়। কেবল অতীতের গৌরব গান করলে আমাদের যে ভবিষ্যৎ নেই সেটা প্রমাণ করা হয়। এ জন্যেই আমি অনবরত সৌমিত্রচর্চারও বিরোধী। ওটা করুণ হয়ে উঠেছে।

  3. আপনার সঙ্গে আমি একমত । জ্ঞানচর্চা ও শিল্পের দর্শনের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল এতদিন !
    কিন্তু অধুনা সমস্যা একটাই । এই পার্থক্য ঘুচে গেছে বুড়ো আঙুলের কোমল ক্লিকে ।
    শিল্পকে চিরকালই জ্ঞানের মাপকাঠিতে যাচাই করা হয় । শতরঞ্জ কে খিলাড়ীর কোনো বিশ্লেষণ থেকে ডালহৌসির আগ্রাসন রীতি উহ্য রাখা কি সম্ভব ?

  4. এটা ঠিকই যে অতীতের মোহ থেকে বাঙালিকে বেরিয়ে আসতে হবে ।। আসুন আমরা সত্যজিৎ রায়ের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় একজন মানুষের সন্ধান করি জীবিত বাঙালিদের মধ্যে থেকে ।। তিব্বতে যেভাবে দালাই লামা খোঁজা হয় ।।

  5. ডক্টর রাণার অভিমত অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ।। ষাটের দশকে যুদ্ধ-পরিস্থিতি জিইয়ে রাখার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিকী প্রতিবাদ গুপী গাইন বাঘা বাইন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com