ষাটে পৌঁছে বোঝা যায় যে, এবার থেকে জীবনের হাল ধরবে অবসাদ আর নিঃসঙ্গতা। একদিকে, চাকরি থেকে অবসর, আর অন্য দিকে শরীরে ঘিরে আসা নানা জটিলতা। তারই সঙ্গে বাড়ির ভেতরটাও শুনশান; ছেলে মেয়েরা শুধু যে বড় হয়ে গেছে তাই নয়, থিতু হয়েছে বাড়ির বাইরে, দূর দূর দেশে। ফলে আমাদের ছোটবেলায় দেখা দাদু ঠাকুমাকে নিয়ে বাবা মায়ের সংসার বা জমজমাট মামার বাড়ি, পিসির বাড়ি, এমনকি জেঠিমার বাপের বাড়ি– সে সব হাওয়া হয়ে এখন শুধু খান কয়েক, মলিন সাদাকালো ছবি। এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’রকমের স্রোত– কেউ বলছে, বয়স একটা সংখ্যামাত্র; আর অন্যদের গেল গেল– হায় হায় রব। অথচ দুটোই তো ভীষণ সত্যি– সেই আধ গেলাস জলের মতো; আধা ফাঁকা আর আধা ভর্তি। হু হু করে বাড়ছে নানা মানের বৃদ্ধাবাস এবং মানসিক চিকিৎসার কেন্দ্র। বিশেষত শহরকেন্দ্রিক জীবনে। গ্রামে এখনও মানুষ অন্যের খোঁজ নেয়, পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু শহর দিয়ে যে ভাবে গ্রামের পর গ্রাম ঘিরে ফেলা হচ্ছে, তা আর কতদিন থাকবে জানা নেই। গ্রাম উজাড় করে চাষবাস, তাঁত বোনা ছেড়ে মেয়ে, বউ, ছেলেদের দল সব তো চলে আসছে শহরে- আমাদের ঘর সংসার, ইসকুল অফিস এসব সামলাতে। তারা তবু গ্রামে ফেরে ভোটের জোট বজায় রাখতে; আমাদের ছেলেমেয়েদের তো সে দস্তুরও নেই। আমাদের সংসার সামলায় বৈভব আর গ্রামের মানুষদের সংসার সামলায় দারিদ্র্য।
সমমনস্ক মানুষের অভাব মেটাতে চেয়ে, বিশেষ করে এই ষাট পেরনো শহুরেরা আজ দিশেহারা। তাদের হাতে অর্থ আছে, জীবন যাপনে আছে নিরুপদ্রব স্বাধীনতা, দেদার বেড়ানোর সুযোগ, এয়ারপোর্টে ঢুকলেই হইল চেয়ার, দিনক্ষণ মেনে দুরান্ত থেকে পাঠানো উপহার, প্রতিদিনের ভিডিও কল তবু যেন মন মানে না। শূন্য মনে হয়। মনের মধ্যে চরম নিরাপত্তার অভাব– কে দেখবে! কীভাবে কাটবে সময়! কারণ আমাদের দেখা ঠাকুমা দিদিমাদের বয়সে পৌঁছেও আমরা কিন্তু তাঁদের মতো সবাইকে নিয়ে জমিয়ে বসতে পারলাম না। কিন্তু এর বিপরীতেও হাঁটছে কিছু মানুষ। খবরের কাগজের ভাষা অনুযায়ী যাঁরা ‘প্রৌঢ়ত্ব পার করা বৃদ্ধ’। বৃদ্ধ শব্দটিকে মনে মনে হেসে উড়িয়ে দিয়ে, তাঁরা চেষ্টা করছেন একটু অন্যভাবে ঘুরে দাঁড়াতে। হাপিত্যেশে বসে না থেকে, নিজেরাই একটু চেষ্টা চরিত্র করে, আয়োজনে আর একটু ছেলেমানুষি ভাব জাগিয়ে নিজেরাই বাঁচতে; এবং একটু হলেও অন্যদের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে, এই চেনা ছকটা ভেঙে বেরোতে। আমার কাছে এই দ্বিতীয় দিকটাই খুব বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে কারণ, বস্তাপচা ধ্যানধারণাগুলোকে তুড়ি মেরে বাতিল করার বেশ একটা মস্তানি আছে এতে।

সদ্য পার হওয়া রথের ছবিটাই মনে আসছে। রথের আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড়। যার যতটুকু রথই হোক না কেন, বাড়ির সবাই মিলেই তা সাজানো হতো। খোকা খুকুর দল রাস্তায় বের করে, ভেঁপু বাজিয়ে তা টানতে টানতে চেনা চত্বরেই একবার এদিক আর একবার ওদিক। এইটুকু খেলাতেই সোজা রথ, উল্টো রথের মজা। আমাদের ছেলেমেয়েদের ছোটবেলাতেও রথ সাজিয়েছি এবং তারা টেনেছেও। নাতি বাবুর কচি বেলাতেও, অন্য বাবা মায়েদের মতো, তার মাও রথ সাজিয়ে টানিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি দেখছি যে পাড়ায় আর রথ বেরোয় না; কারণ বাচ্চাই তো নেই। বাবা মায়ের সঙ্গে তারাও তো পাড়ি দিয়েছে এদিক সেদিক। তার ওপর বেশির ভাগেরই ‘টিউশন’, না হয়তো এটা ওটা যা কিছু শেখা; এবং সব ওই বিকেল বেলায়তেই। সবচেয়ে তফাৎ যে পাড়ায় আর বন্ধু হয় না। পুজোর সময় পরিচিত বাচ্চাদের ডেকে এনে বড়রাই নাচ গান শেখান; তার পর কিন্তু সারা বছর আর কোনও যোগাযোগ থাকে না; তারা আবার যে যার দ্বীপে ঢুকে পড়ে।
ফলে, এবছর চমক লাগল কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজে। দেখি, একসময়ের জাঁদরেল সব অফিসার, প্রফেসর, প্রিন্সিপাল, হেডদিদিমণিরা নিজেদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে, পথে নেমেছেন; মাঝারি মাপের একটি রথকে সুন্দর করে সাজিয়ে, শোভাযাত্রা করে রথ টানতে। এ কোনও রিহার্সাল দেওয়া স্পন্সরড শোভাযাত্রা নয়, যে রথের আগে আগে তালিম পাওয়া ওডিসি নাচের দল বা রথের সঙ্গে সঙ্গে রঙিন সিল্কের ধুতি পরা ভাড়া করা ওড়িয়া পুরহিত; কিম্বা পুরোভাগে হাত জোড় করা কোন মন্ত্রী বা পৌরমাতা, কী পৌরপিতা। সহর্ষে জয় জগন্নাথ ধবনিও নেই। ফলে, চ্যানেলকে ডেকে এনে কভারেজের চিন্তাও নেই। একেবারেই ঘরোয়া এবং আটপৌরে রথ। সত্যিকারের রিয়েলিটি শো। বালক বালিকাদের বদলে, সরকারি চিহ্নে দেগে দেওয়া এক দঙ্গল ‘সিনিয়র সিটিজেন’। রথের সামনে একজন দাদু চলেছেন থালায় প্রদীপ সাজিয়ে। তাঁর পিছনে দুজন দিদুর হাতে, প্রসাদের থালায় সাবেক বাতাসা ও নকুলদানা। হাত পাতলেই তাঁরা বিতরণ করে যাচ্ছেন অকাতরে। লম্বা দড়িটি জুঁই-বেলের মালা দিয়ে সাজানো; বাদবাকি সাজানোয় মালিকে বলে, ক্যাম্পাস থেকেই জোগাড় করা দেবদারু আর ক্রোটনের পাতা এবং পাঁচমেশালি ফুল – কল্কে, রঙ্গন , গন্ধরাজ সন্ধ্যামণি ও চাঁপা। রথের দড়ি টানায় কোনও তাড়া নেই; যেন যত দেরি হয় ততই ভাল; ভেঁপু, কাঁসি, শাঁখ সব একসঙ্গে বাজাচ্ছেন হাত বদলা বদলি করে। চোখে মুখে সে যে কী পরিতৃপ্তি! বিকেলের আলোয় যেন আনন্দের রেণু। রথ নিয়ে, নিজেদের, ক্যাম্পাসেই দু চক্কর ঘোরা। অনেকেই আবার পরিচারিকার হাত ধরেও হাঁটছেন; কেউ কেউ ওয়াকার নিয়ে ধীরে। লাঠি হাতেদের গতি তুলনায় বেশি। দু’একজন, এসময়ে যাঁদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে বিকেলে ঘোরান হয়, আজ তাঁরাও চলেছেন রথের পিছু পিছু; এঁদের পরনে শাড়ি ধুতি, টি শার্ট, ট্রাউজার, সালোয়ার কামিজ, র্যাপার, এমন কি শর্ট প্যান্টও; কারণ রথটাই তো মুখ্য; পোশাক নো পরোয়া; তেমনই নো পরোয়া ব্যস্ত থাকা ছেলে, মেয়ে, বউ বা নাতি নাতনির দল। নো পরোয়া কাজের মেয়ের মুখ ভার।

আজ আর একা ঘরে, টি ভির সামনে বসে, পরিচারিকার কাছে স্মৃতি রোমন্থন নয়; নয় দু খানা সেঁকা পাঁপড়, একা একাই চায়ের সঙ্গে খাওয়া। নয়, টিভির পর্দায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা, পুরীর রথ বা কলকাতায় ইস্কনের সাহেব মেমেদের হরিবোল হরিবোল; নয়, ওয়াটস অ্যাপে এক ঘেয়ে ‘শুভ রথযাত্রা’ মেসেজ- যার বেশির ভাগই গণ এবং ফরোয়ার্ডেড; মানে চোখ পচে যাওয়া। নীচে নেমে দেখি দুর্গা মন্ডপের কাছে রথটি দাঁড় করিয়ে, গোটা তিরিশেক ভাড়া করা চেয়ারে আয়েস করে বসেছেন, ষাট পেরনো বালক বালিকার দল। অর্ডার দেওয়া পাঁপড় ভাজা এসে গেছে, পাঁচিলের বাইরের তেলেভাজার দোকান থেকে; সঙ্গে আদা দেওয়া চিনি ছাড়া এবং চিনি সমেত– এই দু সেট লিকার চা; এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে শহর, মফস্বল, গ্রাম, গ্রামান্তরে কাটানো শৈশবের রথ টানার স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছেন তাঁরা। সে আলোচনায় ছোটবেলার মতোই কয়েকটা জিনিস বাদ– যেমন রাজনীতি,পদ মর্যাদা এবং বিষাদাক্রান্ত বাড়ি বাড়ি খেলা। তেমনই নেই আগামী বছরের জন্যও কোনও পরিকল্পনা ফেঁদে বসাও। নিজেদের সাজানো রথ নিজেরাই টেনে, এক অনাবিল আনন্দে শৈশব যাপন; অন্তত একটা বিকেলে মানুষের সংস্পর্শে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, সুস্থ মনে যে যার ডেরায় ফেরা।
ঘরে ফিরতেই আমার পরিচারিকার সে কী হাসি! তুমিও গেলে ‘ওনাদের’ সঙ্গে! তার পরই অসন্তোষ – কে এখনও ফেরে নাই; কী রান্না হবে বলে নাই; কাজের লোকের ট্রেন মিস; ওভার টাইম দিলেই কী সব হয়! উত্তর দিচ্ছিনা দেখে, প্রসঙ্গ বদলে সে বলে চলল, এ পাড়ার কাউন্সিলার আজ একশো রথ বিলি করছে; আমিও একটা আনছি নাতির জন্য; কিন্তু বউমা তো নাতিরে নিয়া বাপের বাড়ি থেকেই আইলই না; কী আর করি, জল বাতাসা দিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করলাম। পার্টি অপিসের কথায়, রথ না আনলে এই গচ্চাটা যেত না।
একেবারেই ঘরোয়া এবং আটপৌরে রথ। সত্যিকারের রিয়েলিটি শো। বালক বালিকাদের বদলে, সরকারি চিহ্নে দেগে দেওয়া এক দঙ্গল ‘সিনিয়র সিটিজেন’। রথের সামনে একজন দাদু চলেছেন থালায় প্রদীপ সাজিয়ে। তাঁর পিছনে দুজন দিদুর হাতে, প্রসাদের থালায় সাবেক বাতাসা ও নকুলদানা। হাত পাতলেই তাঁরা বিতরণ করে যাচ্ছেন অকাতরে। লম্বা দড়িটি জুঁই-বেলের মালা দিয়ে সাজানো; বাদবাকি সাজানোয় মালিকে বলে, ক্যাম্পাস থেকেই জোগাড় করা দেবদারু আর ক্রোটনের পাতা এবং পাঁচমেশালি ফুল – কল্কে, রঙ্গন , গন্ধরাজ সন্ধ্যামণি ও চাঁপা। রথের দড়ি টানায় কোনও তাড়া নেই; যেন যত দেরি হয় ততই ভাল; ভেঁপু, কাঁসি, শাঁখ সব একসঙ্গে বাজাচ্ছেন হাত বদলা বদলি করে।
মনে পড়ল, বুড়ো সুবলদার কথা। সে আমাদের ক্যাম্পাস ঝাঁট দেয়। রিটায়ার হয়ে গেছে, তবু রোজ ভোরবেলা ঝাঁট সে দেবেই। এবারে রথের কদিন আগে দেখি, একটা ব্লকের নীচে পড়ে থাকা, লাল রাংতায় মোড়া একটা সাজানো রথ, রাবিশ থেকে কুড়িয়ে, সে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, ফ্ল্যাটটা যারা কিনল, আগের মালিকের সব কিছু ফেলে দিয়েছে। এই রথটাও পড়ে আছে জঞ্জালের মধ্যে। হয়তো গত বছরের, কিন্তু একেবারে নতুন; নাতিকে নতুন করে সাজিয়ে দেব। সুবলদা সেই সময়কার মানুষ যখন, রথ টানা হয়ে গেলে আবার তা যত্ন করে তুলে রাখা হতো, পরের বছরের জন্য। মাথায় আমরা যত লম্বা হতাম এবং বয়সেও যত বড় হতাম, রথটাও তত খানিই ছোট হয়ে যেত। তারপর কবে যে একদিন বড় হয়ে গেলাম কে জানে!
কিন্তু এখন এই নিয়মিত চেকাপ, জীবনদায়ী তেজী ওষুধপত্র এবং শরীর সচেতনতার জোয়ারে এবার দেখছি দ্বিতীয় শৈশবে ফিরতেই হবে; এবং তা হৈ হৈ করে। জীবন তো একটাই। বয়স বাড়লে তা যে আর কমানোই যাবে না – এ আবার কেমন কথা! তাই, এবার একটা নতুন দরজাওয়ালা, নতুন ঘর সাজিয়ে নিতেই হবে, নিজের মতো করে; সেখানে মাঠ থাকবে, কাদাজলে বৃষ্টি হবে, বিকেল হলেই খেলা আর রাজকন্যের গুলি সুতো গড়াবে তো গড়াবেই………।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
One Response
boro sundar likhechen. pore bhari anando pelam.