আগের পর্বের লিংক- জীবন তো একটাই, জমায়েত
বছর কুড়ি আগে এরকম একটা ব্যাপার শুনে তো হেসেই মরি। ক্লাবের নাম ‘খাই খাই’? আরও মজা এই যে, মেম্বার হতে গেলে কিন্তু ষাট পার হতেই হবে। কারণ প্রৌঢ় অবস্থা থেকে বার্ধক্যে না পৌঁছলে নাকি বোঝা যায় না যে, এরপর নতুন কোনও অবস্থায় যাবার আর সুযোগ নেই। মুখে না বললেও এটাই জীবনের শেষ পর্ব এবং কঠিনতম এই জীবন নির্বাহ। এই রকম একটা ব্যখ্যা সামনে রেখে, দক্ষিণ কলকাতার একদল বৃদ্ধ যাঁদের বয়স ষাট থেকে নব্বই, প্রতিদিন ভোরে ঢাকুরিয়া লেকের ধারে হাঁটেন। হাঁটা সাঙ্গ হলেই নির্দিষ্ট একটি বেঞ্চিতে বসেন এবং আগে থাকতে অর্ডার করে রাখা, গরম গরম সিঙ্গাড়া জিলিপি আনিয়ে মহাসুখে খেয়ে, ঠোঁট থেকে গুঁড়োগাঁড়া রুমালে মুছে ভালোমানুষের পো-টি হয়ে বাড়ি ঢোকেন। এরপর সারাদিনের বাকি খাওয়া দাওয়া সুগার প্রেশার মেনেই গিন্নীর তদারকিতে চলে। গিন্নীর সঙ্গে এই চাতুরিটুকুই মনে হয় তাঁদের জীবনীশক্তি যোগাত। এই ক্লাবের গরিষ্ঠতম মানে বিরানব্বই পার করা মানুষটি হলেন প্রেসিডেন্ট। আর সাতাশি পার করা আমার বন্ধুর বাবা যিনি দ্বিতীয় গরিষ্ঠ, তিনি হলেন সেক্রেটারি। মাঝে আরও আরও নাম-ভারিপদ ছিল; যেমন জেনারেল ম্যানেজার বা ফাইন্যান্স সুপার ভাইজার। এ দলের এই সেক্রেটারি মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত রসিক এবং যুক্তিবাদী। ফলে মাঝে মাঝেই গোলপার্কের আশেপাশে নানা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চের ব্যবস্থা করতেন, অন্তত মাসে একবার। মূলত বিরিয়ানি, চিকেন-চাঁপ, মাটন-কষা আর মিষ্টি দই। বাড়ির লোক জানতেও পারত না। কারণ বাকি সময় নিয়ম করে ঘুম, বিশ্রাম এবং মেডিকেল চেক-আপ। এই ক্লাবের সদস্যরা যে দু’টি থেরাপিতে বিশ্বাস করতেন তা হল লাফ থেরাপি (laugh therapy) আর স্লিপ থেরাপি (sleep therapy)। কোনও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই এ দু’টিই এঁরা নিজেরাই চালু করেছিলেন এবং মেনেও চলতেন, নিজেকে ভাল রাখার এক আদর্শ পথ হিসেবে। এঁদের সংসারে বিচিত্র সব সমস্যা এবং ব্যবস্থা ছিল। তেমন অর্থাভাব ছিল না। কিন্তু গড়পড়তা জীবন যেমন হয় তেমন নয়। ফলে নিজেদের সমস্যাগুলিকে এক জায়গায় পাশ কাটিয়ে এঁরা একটা নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন– ‘খাই খাই ক্লাব’। খাই খাই শব্দটার মধ্যে দিয়েই ইচ্ছেপূরণের এক মজাদার ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাঁরা। ডাক্তার, গিন্নী এবং ছেলে-মেয়েদের শাসন– এই তিন উৎসকেই বেশ ডেঁটে রেখেছিলেন তাঁরা।
আমি এখন এই বয়সে পৌঁছে ভাবি কী অসাধারণ প্রাণশক্তি ছিল ওই বয়স্ক মানুষগুলির! আমরা মর্নিং ওয়াক করি আর বাড়ি ফিরে আসি। স্বাস্থ্য-চর্চা! সেও তো ভয়ে ভয়ে। রোগ বা মেদ কোনওটাই চাইনা বলে। কিন্তু ওই মজাটা কোথায়! ভোরবেলা উঠে ফুল চুরি করার মজার মতো ক্লাব তৈরি করে বুড়ো বয়সে নিষিদ্ধ খাাবার খাওয়া! ভাবলাম, তাহলে কি মেয়েরা পারে না! ছেলে হলে কি পারতাম! ছেলেরা যেমন বাজার গেলেই আগে চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খেয়ে তবে বাজার সারে; বা বাজার সারতে সারতেই একটা ডাব। এটা হয়তো খানিক সত্যি। তবে এও ঠিক যে ক’জন ছেলেই বা পারে জীবন যাপনে দেওয়াল ভেঙে এই রকম একটি জানলা ফোটাতে?
বৃদ্ধ বয়সের মানুষগুলির সম্পর্কে সবচেয়ে বড় নালিশ যে তাঁরা ‘লোভী’। তাঁরা নাকি ফ্রিজ থেকে মিষ্টি চুরি করে খান; তাঁদের বাদ দিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে এলেই বাড়ির ছোটদের কাছে জানতে চান- ‘হ্যাঁরে, কী খেলি রে তোরা!’ আয়াদের কাছেও না কি চেয়ে খান তাদের বাড়ি থেকে রেঁধে আনা চচ্চড়ি, থোড়, মোচা, বড়ির ঝাল ইত্যাদি ইত্যাদি…। আর যাঁদের পান-জর্দার নেশা তাদের ওসব বন্ধ। ফলে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় হল রাগারাগি আর পরস্পরে দোষারোপ! একপক্ষের থেকে তিন পক্ষে বিভাজন। ডাক্তার-গিন্নী-আয়ামাসি। তিন পক্ষের কেউই হয়তো কোনও বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছেন না। মানে একটা কিছু এগিয়ে দিয়ে তবে অন্যটাকে বন্ধ করা। আসলে খাওয়া এবং তৃপ্তি এটাও জীবনের একটা অন্যতম সম্মানজনক শর্ত! এক্ষেত্রে বারণ যেমন প্রযোজ্য তেমনি দরকার মন দিয়ে ভাবা; মানে ওই জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে। ইদানীং বেশ কয়েকটা বিকল্প চোখে পড়ে মজাই লাগছে।

শহরে থাকা মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত বেশ অধিক সংখ্যক বুড়ো-বুড়িরা সে অর্থে সংগতিহীন নয়; তাঁদের মূল অভাব সহায়হীনতা; মানে লোকবলের অভাব। একদলকে দেখছি সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে পুলিশ দপ্তরের ‘প্রণাম’ পরিষেবায় নাম লিখিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। ‘প্রণাম’ বেশ তদারকি এবং যত্ন করে তাঁদের নিয়ে আসছে, সচেতনতা-সভায়। সেখানে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও থাকছে। খাবার ও ফ্রুটজুসের প্যাকেট ব্যাগে না ভরে টপাটপ উদরস্থ। আর সে কী পরিতৃপ্তি, নিজের হকের সম্মানসূচক বরাদ্দ- প্যাকেটটি পেয়ে!
আরও একটি যে ব্যবস্থা বেশ রমরমিয়েই চলছে তা হল বিভিন্ন নামে এল্ডার (elder care) কেয়ার সেন্টার। দূরে থাকা অর্থবান ছেলেমেয়েরা এঁদের সাহায্য নিচ্ছে একলা হয়ে যাওয়া বাবা মায়ের দেখভাল করতে।। প্রবাসী ভাই বা বোন অকুস্থলে এসে পৌঁছনোর আগেই, প্রয়োজনে আমার মাসি এবং মেসোকে বার বার হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে যাবতীয় যা দৈনিক ও প্রাথমিক পরিষেবা সব তারাই করেছে। অপছন্দের দু’একজনকে বদল করার পর শেষকালে যাকে পেয়েছিলেন, সুকুমার নামে সেই ছেলেটি এককথায় অনবদ্য। ডাক্তার, আয়া এবং ওষুধের ফিরিস্তি সামলে মাসি মেসোর আরও নানা প্যাখনার ধকল নিত সে। মেসোর জন্য প্রতি সপ্তাহে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোটা মোটা ফিস ফ্রাই, কবিরাজি কাটলেট, মাংসের চপ ছাড়াও, টাটকা পাবদা, পুকুরের বেলে, মাঝারি বোয়াল। মাসির জন্য ছাঁচি-পান, জর্দা, তালমিছরি। এমনকি তার ভরসায় এসো-জন বসো-জন- বন্ধুদের জুটিয়ে পার্টি। গোল টেবিলে পাতার জন্য বিশেষ দোকানের নতুন টেবিল ক্লথ, রানার, ম্যাট ইত্যাদি। আমি বলতাম, ‘বুড়োবুড়ির সুকুমার সংসার’। অনেককে আবার দেখি এই ধরনের পরিষেবা নিতে চান না খাওয়া দাওয়ার স্বাধীনতা বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে। গিন্নীর বুকে একাধিক স্টেন্ট বসতে না বসতেই কর্তার মাথায় সার্জারি। কিন্তু মাংসটা নিজে না কিনলে কর্তার মনখারাপ; আর খুন্তি নেড়ে সেই মাংসের সদ্গতি না করলে গিন্নীর অরুচি। খাওয়া মানে তো আর গেলা বা গত্ত বোজানো নয়– রীতিমতো আয়েশ আরাম মন-খুশ।
আর একদলকে দেখি ধরাবাঁধা ট্র্যাভেল এজেন্টদের সঙ্গে বছরে অন্তত দু’বার বা পারলে তিনবারও লম্বা ট্যুরে বেড়াতে যেতে। দিন দশেক সঙ্গ করে দেখেছি যে তা সে হাম্পি, রনথমবোর, কুর্গ, ঊটি, রাজস্থান, কাশ্মীর, নৈনিতাল বা বকখালি– যে মুল্লুকেই যাওয়া হোক না কেন বেড়ানোটা কোনও গ্রাহ্যের বিষয়ই নয়; আসল উদ্দেশ্য হল ভালো ভালো হোটেলে থেকে চুটিয়ে খাওয়া দাওয়া; বিশেষত সকালের সেই কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট (complimentary breakfast)। থরে থরে সাজানো টোস্ট-অমলেট, সবজি-পুরি, ইডলি, ধোসা, পোহা, রুমালি রুটি, টেংরির ঝোল; এবং নিষেধহীন চা, কফি, মিল্কশেক, দুধ-হলদি, ফ্রুট-জুস; আর বাঘা বাইনের ভোজ্য সেই ঝুড়ি ঝুড়ি টাটকা ফল। সকাল সাতটায় ঢুকে এগারোটা অবধি শুধু– আমার পেট বলছে কী খাই! কী খাই! এখানেই শেষ নয়। গাড়ি যেখানেই দাঁড়াবে সেখানেই ডেকে হেঁকে ভাইয়া ভাইয়া; এমন কি বান্দরকে লিয়ে কেলা ছোলাও ‘অসম্ভব পুষ্টিকর’ বলে সাবাড় করে দিতে দেখেছি। লাঞ্চে নিরামিষ হলেই খান কয়েক এক্সট্রা ‘পাঁপ্পড়ের’ জন্য হুকুমদারি। রাতে অন্য হোটেলের ঘরে ঢুকেই একটু ভাজাভুজি মানে কাটলেট, ফ্রাই, চিকেন-উনিংস, ফিস ফিঙ্গার এবং গরম স্যুপ। একটু গড়িয়ে নিয়েই গালা ডিনার, একেবারে কব্জি ডুবিয়ে। হজমের সুবিধে করতে, শেষ পাতে একের জায়গায় চার স্কুপ আইস্ক্রিম।
আরও একটি যে ব্যবস্থা বেশ রমরমিয়েই চলছে তা হল বিভিন্ন নামে এল্ডার (elder care) কেয়ার সেন্টার। দূরে থাকা অর্থবান ছেলেমেয়েরা এঁদের সাহায্য নিচ্ছে একলা হয়ে যাওয়া বাবা মায়ের দেখভাল করতে।। প্রবাসী ভাই বা বোন অকুস্থলে এসে পৌঁছনোর আগেই, প্রয়োজনে আমার মাসি এবং মেসোকে বার বার হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে যাবতীয় যা দৈনিক ও প্রাথমিক পরিষেবা সব তারাই করেছে। অপছন্দের দু’একজনকে বদল করার পর শেষকালে যাকে পেয়েছিলেন, সুকুমার নামে সেই ছেলেটি এককথায় অনবদ্য। ডাক্তার, আয়া এবং ওষুধের ফিরিস্তি সামলে মাসি মেসোর আরও নানা প্যাখনার ধকল নিত সে।
এরকমই খাওয়ার জন্যই বাঁচা হল, মহিলাদের কিটি পার্টির আয়োজন; নড়েচড়ে গন্তব্যে পৌঁছতে না পৌঁছতেই শুরু হয়ে গেল খাওয়া। দু’এক পদ হয়তো হোমমেড। বাকি সবই সুইগি আর ইন্সটা মার্টে অর্ডার দিয়ে আনা। মোচার চপ, ফ্রায়েড মোমো, শওয়ার্মা রোল, কবিরাজি কাটলেট………। ‘বাড়ি গিয়ে আর নো ডিনার নো ডিনার’ বলতে বলতে গাত্রোত্থান করলেও রাতের টেবিলে কর্তা কি আর একা খাবেন! তাই ওই যা হোক একটু চিকেন, রুটি আর শেষপাতে ডায়েবেটিস সন্দেশ।
আর এক ভোজের বাহার দেখি মহিলা পরিচালিত বিভিন্ন মেলায় যেখানে তাঁরাই স্টল দেন এবং এ ওর স্টলে গিয়ে দেদার কিনে কিনে খান। মিসেস চ্যাটার্জির মালপোয়া তো, মিস ভড়ের চিকেন কাবাব। সুমির কাজের মেয়ের বানানো স্টাফড কিমা পটল, তো মালবিকার আনা কিমা মটরের ঘুগনি। এই তো পুজো আসছে; মণ্ডপের পাশেই বাঁশ পড়েছে স্টল সাজানোর মাচার। পুজোর পাঁচদিন বিকেল থেকে রাত – শুধু খাওয়া আর গপ্পো আর আইঢাই।
আমাদের আবাসনটাকে বৃদ্ধাশ্রম বললেই ভাল হয়। সাজানো গোছানো ঘরে এক জোড়া করে বুড়ো-বুড়ি। কোথাও আবার জোড় ভেঙে একা। এখানেই একজন মহিলা আছেন যিনি তাঁর সমবয়সী এক পরিচারিকাকে নিয়ে থাকেন। নিজে একটি বুটিক চালান ; আর পরিচারিকাটি বানায় খাবার। প্রতিদিন সকালে মেসেজ আসে আজকের মেনু। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাছ বা মাংসের চপ। নিরামিষ হলে কর্ন– চিজ বা কড়াইশুঁটি বা পনির চপ। সন্ধে লাগতে না লাগতে তিন নম্বর ব্লকের নীচে লাইন পড়ে যায়। হাতে গরম এই সব খাবার জন্যে। অতিথি আসুক বা না আসুক নিজেদেরই অতিথি জ্ঞানে নিত্য সেবার আরাম।

অবাঙালি বাড়িতে যেমন নাস্তা, বাঙালি বাড়িতে তেমন ভাজাভুজি দিয়ে জলখাবার। এই স্বাধীনতা কেড়ে নিলেই তুলকালাম। ফলে ছেলে মেয়েরা যে ক’দিন আসে এবং বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে সে ক’দিন এঁরা নিপাট নিখাগি হয়ে কাটিয়ে দেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোমে মেতে থাকা ছেলে, মেয়ে, বউ, নাতি, নাতনি – সকলেই বাড়িতে তৈরি মাসির রান্না খাচ্ছে, সোনা মুখ করে। মাথা ঘামাতে হচ্ছে না এই সুখে। ভাবছে তাঁরা না থাকলে বাবা-মাও বোধহয় বাড়িতে তৈরি এমনই সব ঘরোয়া পাঁচপদ খেতেই অভ্যস্ত! বাড়ি খালি হলেই, বামুন গেল ঘর তো লাঙ্গল তুলে ধর; বুড়ো-বুড়ির সংসারে আবার সেই হেঁইয়ো বলে, এটা খাই আর সেটা খাই। ফেদার এবং লেদার দুইই।
আর হয়েছে জবরদস্ত সব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। বিশেষত ইশকুল আর কলেজ বন্ধুদের জমায়েত। বুড়ো– থুড়ি ছেলেদের জমায়েত মানেই ক্লাবে বা কোন হোটেলে গিয়ে খ্যাঁটন। আর বুড়িরা! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনও একজনের বাড়ি। কারণ বাইরে বসায় ঘন ঘন বাথরুম যাওয়ার সমস্যা। মানে বাতিক আর কী! আড্ডা এবং গান শেষ হলেই খাওয়া শুরু। লোকাল ক্যাটারার লাগিয়ে গলদা, মাটন-কোরমা আর ইলিশ। কিছু রসিক বুড়োকে অবশ্য চিনি যারা থাকে একলা কিন্তু তাদের সম্পদ হল এক একজন দুর্দান্ত কুক। সেখানে প্রায়ই পঁচাত্তর পার কর কলেজ বন্ধুদের আড্ডা বসে। উৎকৃষ্ট পানীয় এবং এক নম্বর ভেটকি ফ্রাই সহযোগে। জমিয়ে যেমন বিজ্ঞান চর্চা করেন এঁরা, সেই একই উৎসাহে বন্ধুদের ডাক দেন ইলিশ উৎসবেও।
ফেসবুক উপচেও সেই ছবি। পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ক্যাফেতে সমানেই এটা ওটা খেয়ে চলেছেন কেউ না কেউ। বিশিষ্ট কেতায়, জগঝম্প সেজে। সেইসব খাবার সহ হাসি হাসিমুখের খান পঞ্চাশেক ইমোজির সঙ্গে ব্যাকুল প্রশ্ন– কোথায় কোথায়? এসব জায়গায় চা কফি ছাড়াও, মেশিনে বানানো ফেনা ওঠা দুধ-হলদি, বেলপানা, মাঠার ঘোল এবং নানা স্বাদের ডি-টস্ক ওয়াটার পাওয়া যায়। শুধু কি খাওয়া? সঙ্গে সাজুগুজু, মনে বেড়ু বেড়ু ভাব, কোমল আলো, আবহে টুংটাং এবং সুন্দর সুন্দর সব বাসন। সত্যিই তখন বুড়ি! থুড়ি থুড়ি।
এরকমই খাওয়ার জন্যই বাঁচা হল, মহিলাদের কিটি পার্টির আয়োজন; নড়েচড়ে গন্তব্যে পৌঁছতে না পৌঁছতেই শুরু হয়ে গেল খাওয়া। দু’এক পদ হয়তো হোমমেড। বাকি সবই সুইগি আর ইন্সটা মার্টে অর্ডার দিয়ে আনা। মোচার চপ, ফ্রায়েড মোমো, শওয়ার্মা রোল, কবিরাজি কাটলেট………। ‘বাড়ি গিয়ে আর নো ডিনার নো ডিনার’ বলতে বলতে গাত্রোত্থান করলেও রাতের টেবিলে কর্তা কি আর একা খাবেন! তাই ওই যা হোক একটু চিকেন, রুটি আর শেষপাতে ডায়েবেটিস সন্দেশ।
আরও একটা শান্তির জায়গা হয়েছে নামকা ওয়াস্তে বৃদ্ধাশ্রম। নামকা অয়াস্তে কারণ এগুলো আসলে ওল্ডেজ রিসর্ট। সুরক্ষিত এবং ভালোভাবে থাকার আবাস। তাই এখন আর ছেলেমেয়ের সিদ্ধান্তে বাবা-মাকে নির্বাসনে পাঠানো নয়। তাঁরা নিজেরাই চলে যাচ্ছেন চিন্তামুক্ত হয়ে একটু স্বাধীন থাকবেন বলে। এরকম দু-একটি আবাসনের খবর কানে এসেছে যেখানে সব বন্দোবস্তই ভীষণ প্রফেশানাল। আয়া-মুক্তি, কাজের লোক-মুক্তি তো বটেই; সঙ্গে আবার চমকদার ক্যাফেটেরিয়া। রাত দশটা অবধি গেস্ট নিয়ে বসে থাকা যায় , এটা ওটার অর্ডার দিয়ে। কয়েকজন সেখানে গিয়ে বসবাস করে যে বেশ খুশি এও শুনেছি। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে সে জানাল যে রিটায়ার করেই সে সেখানে চলে গেছে। তার প্রিয় বই, শাড়ি আর কিছু গাছ নিয়ে। সকাল থেকে দফায় দফায় লোক এসে জেনে যায় আজ শরীর কেমন– কী খেতে চায়। বাকিটা ক্যাফেতে বসে আর বিভিন্ন সভা-সমিতিতে গিয়ে পুষিয়ে নেয়। তার কথা এই যে, খাওয়া নিয়ে চয়েস আছে কিন্তু ঝক্কি একেবারেই নেই। অন্যের মর্জি নির্ভর হয়ে অপরাধবোধে ভোগা– মানে খাওয়ার খোঁটা থেকেও মুক্তি।
আগে ঠাকুমা দিদিমারা বলতেন ,ওরে, বুড়ো বয়সে নোলা যে বাড়ে। তায় আবার কত্তা এখন রিটায়ার; একটু ‘মুখরুচি’ খাবার না দিলে মেজাজ ঠিক থাকবে কেন! ফলে, শেষ আঁচে তৈরি হতো নারকেলের নোনতা বিস্কুট বা সেদ্ধ ছোলার টিকিয়া। মুড়িটাও মাখা হতো শুখনো লঙ্কা কালোজিরে দিয়ে কড়ায় টেলে নিয়ে। ঘি-চিনি দিয়ে মুড়ি মাখাও জম্পেশ হতো। বাড়ির কাউকে খাই- খাই করে চরে বেড়াতে হত না এদিক সেদিক। বালিকাবেলায় খড়দা থেকে কলকাতায় থাকতে এসে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, মিষ্টির দোকানে কচি বেলের রং দেওয়া মোরব্বা বিক্রি হচ্ছে দেখে। এখন ভাবি, কতো কী যে ঘরে ঘরে রোজই বানানো হতো! সংসারে এখনও হোম মেকার থাকলেও তাঁদের কাজের ধরণ বদলে গেছে। হোম-কর্নার অ্যাপটি ডাউন লোড করলেই অনবদ্য আচার বড়ি মোরব্বা পাঁপড়। নিজের বানানোর থেকে যা শতগুণ ভাল।
আর তাছাড়াও আমরা যারা ষাট পেরিয়ে সত্তরের দিকে এগোচ্ছি, তাঁদের বেশির ভাগই তো চাকরি বা ব্যবসায় থাকা মানুষ। ফলে তাঁরা তো দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে কাটানো বুড়ো-বুড়ি। কবে থেকেই তো অভ্যেস হয়ে গেছে ইচ্ছে হলেই এটা সেটা কিনে মুখ চালানো। আগে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে হত; এখন তার জায়গায় এসে গেছে পার্সেল। এমন কি কাগজের পটে দার্জিলিং টি-ও। তাছাড়া ছেলে মেয়েরাই তো স্মার্ট ফোনের জাদু ধরিয়েছে। ফলে অন লাইন অর্ডারের সুযোগ নিতে বাধা কোথায়! অবসর নেবার আগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গেছি পঁচিশ থেকে পঞ্চান্নদের সঙ্গে। তাই শুধু মা ঠাকুমা কেন! এদেরও তো কাছ থেকেই দেখেছি। কয়েকটা অ্যাপ টিপেই কেমন ছবির মতো জীবন চালাতে। ফলে অবসর নিলেই বুড়ি এমন মনোভাব কাটিয়ে ‘গেল’ ‘গেল’ না করে একটু ‘এলো’ ‘এলো’ করলে কেমন হয়! চেনা কমফোর্ট জোনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে দেখিই না ঊর্মি, শিউলি, পিউ, উদিতা, দেবীরূপা বা সুবীর, ময়ূখ এরা কেমন করে চেকনাই আনে সংসার যাপনে!
ফলে একথাটাই সার বুঝেছি যে বয়স মানে শুধুই অসুখ আর ওষুধ খাওয়া নয়। মন ভাল রাখতে তার সঙ্গে বেশ আয়োজন করেই নিজের শর্তে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য এবং পেয়। মানে শেষ পর্বের চাটুপুটু আর কী!
ছবি সৌজন্য: Rawpixel, 60pluscare.in
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।