অফিস থেকে বাড়ি ঢুকে জুতো খুলতে খুলতেই কানে এল কচি বালক কণ্ঠের কিচিরমিচির। বাইরে থেকে কে হতে পারে আন্দাজ করে মুচকি হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে দেখি যা ভেবেছি ঠিক তাই! রান্নাঘরের কিচেন আইল্যান্ড মানে মার্বেলের টেবিলের ওপর উঠে বসে পা দোলাচ্ছে ইথেন- একহাতে চিপসের প্যাকেট আর এক হাতে একটা আইসক্রিমের স্টিক। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটুও সময় নষ্ট না করে চলেছে বাণী বর্ষণ। মুখ্য শ্রোতা আমার স্ত্রী রুচি। ডিনারের জোগাড় করতে করতে হাসিমুখে শুধু ঘাড় নাড়ছে। (Short Story)
আমি ঢুকেই রুচিকে বললাম, “বাঁদরের বাণীবর্ষণ আর চিপসভক্ষণ?” রুচির ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ পড়া, তাই মন্তব্যটা শুনে হেসে ফেলল খিলখিলিয়ে।
আংরেজ বিবির অসম্পূর্ণ উপাখ্যান : সাদিক হোসেন
বলাই বাহুল্য ইথেন এসব কিছুই না বুঝেও শুধুমাত্র আমায় দেখে বেজায় খুশি। একলাফে মেঝেতে নেমে চিপস, আইসক্রিম আর ঢলঢলে প্যান্ট সব কোনওরকমে সামলে নিয়ে বলে ওঠে, “এই যে তুমি এসে গেছ, খুব ভালো হয়েছে! তোমার ওয়াইফ তো কোনও আনসারই দেয় না যা কোয়েশ্চেন করি শুধু হাসে!”
এমন সার্টিফিকেট এর আগে রুচিকে কেউ দেয়নি, তাই ফিক করে হেসে ফেললাম! রুচি চোখ পাকালো আমার দিকে। আমি তাড়াতাড়ি ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইথেনকে বললাম, “মনে হয় তোমার কোয়েশ্চেনগুলো খুব শক্ত, ও বলতে পারেনি তাই হয়তো হেসেছে বোকার মতো!”

“ক্যান ইউ ট্রাই?”
আমি ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়তেই ধেয়ে এল প্রশ্ন।
“তুমি কি জানো দিদির দুটো বেড়ালের সঙ্গে আর একটা বেড়াল এসে খেলছে?”
ইথেনের দিদি ওর থেকে অনেকটা বড়। সামনের বছর কলেজে যাবে।
উত্তর দেবার আগেই কানে এল পরবর্তী ঘোষণা।
“নতুনটা সাদা। ওটা মেয়ে।”
একটু ফাঁক পেয়ে যেই না বলে ফেলেছি, “তাই বুঝি?”
সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞের মতো জবাব, “হ্যাঁ! তুমি কি জানো না কালো বেড়ালরা সবাই ছেলে হয়?”
সাদা কালোর লিঙ্গ বিভাজনতত্ত্বে প্রায় হেসে ফেলব ফেলব, ধেয়ে এল আবার তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ।
“তুমি কি জানো, দিদির পুরোনো বয়ফ্রেন্ড আর নেই? নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। তারই এই সাদা বেড়াল।”
বিড়াল রহস্যের সুষ্ঠু সমাধান করে ইথেন গা ঘেঁষটে দাঁড়াল রুচির।
“জল দাও তো আমাকে! বরফ বেশি জল কম, আমাদের ফ্রিজে বরফ জমছে না!”
আমরা এই নতুন বাড়িতে এসেছি বছর দুয়েক। এর আগে ছিলাম সানফ্রান্সিস্কোয়। এই বাড়িটাও ক্যালিফোর্নিয়াতেই, আগের বাড়ি থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে। বছর দুই আগে মেয়ে কলেজ যেতেই ঠিক করে নিয়েছিলাম এই এলাকা ছাড়তে হবে। তার কারণ বিরাট পরিমাণ ট্যাক্সের বোঝা। তা বলে কি এই বাড়িতে ট্যাক্স নেই? আছে বইকি, তবে তা আগের বাড়ির তিনভাগের এক ভাগ প্রায়। মার্কিন মুলুকের নিয়ম হচ্ছে যে এলাকায় আপনি থাকছেন সেই এলাকার পাবলিক স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়তে পারবে। এখন সমস্ত স্কুল বা এলাকা তো আর একই মানের নয়। তাই ভালো এলাকার স্কুলের খোঁজ করেছ কী মরেছ – দাও কাঁড়িকাঁড়ি ট্যাক্স!
তাই মেয়ে কলেজে যেতেই আমরা পাততাড়ি গুটিয়েছি। আমার অফিস আগের আর এই জায়গার মাঝামাঝি – আর রুচির কাজ পুরোটাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তাই অসুবিধা হয়নি। তবে আগের বাড়ির চারপাশে ভারতীয়দের বসবাস ছিল প্রচুর। বলতে গেলে এ বাড়িতে এসে মার্কিন মুলুকে যে রয়েছি সেটা টের পাচ্ছি – ভারতীয়রা থাকেন বেশ দূরে দূরেই। ওই স্কুলের চক্করে আর কী। এদেশের লোক ওই সব ভালো মন্দ স্কুল এসব ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামান না। এগুলো এশিয়ানদের মধ্যেই বেশি।
ইথেন থাকে আমাদের দুটো বাড়ি পর। ওর সঙ্গে আমাদের ভাব হওয়ার গল্পটা খুব মজার।
আমাদের বাড়ির পেছনে একটা দোলনা আর লাফানোর জন্য ট্র্যাম্পোলিন আছে। আগে যিনি থাকতেন তাঁরই সেগুলো। ওঁর ছেলেমেয়েরাও বড় হয়ে গেছে তাই এসব নিয়ে যাননি। আমার কন্যা দিয়া কলেজের ছুটিতে যখন বাড়িতে আসে তখন মাঝে মাঝে দোলে বা লাফায়।

সবে সবে এসেছি তখন। সামারের দিন। কন্যা বাড়ি এসেছে কলেজ থেকে। খুব লাফাচ্ছিল ট্র্যাম্পোলিনে- ঘেমেনেয়ে মুখ মুছতে মুছতে দিয়া দেখে একটু দূরে এসে দাঁড়িয়েছে বছরচারেক বয়েসের একটা গাবলু গুবলু ছেলে।
চোখে চোখ পড়তেই কাঁচুমাচু মুখ করে সে জিজ্ঞেস করে, “হাই! এক্সকিউস মি! তোমার দোলনায় চড়তে দেবে?”
পুঁচকেটার এমন সরাসরি প্রশ্নে হেসে ফেলেছিল দিয়া।
“সিওর? তোমার নাম কী?”
দিয়ার মুখ থেকে কথা খসার সঙ্গে সঙ্গেই সে সোজা চড়ে বসেছে দোলনায় – উত্তর এল সেখান থেকেই, “ইথেন!”
একটু দোলনায় দুলেই তারপর তরতর করে কাঠবেড়ালির মতো উঠে গেল ইথেন ট্র্যাম্পোলিনে।
দেখা গেল দোলার থেকে লাফানোতেই তার আনন্দ বেশি।
গরমের দিন। ইথেন লাফিয়েই যাচ্ছে সমানে। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে।
দিয়া ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল জল খেতে চায় কী না।
“আই অ্যাম ফাইন!” পিপাসা নাকি তার পায়নি।
দিয়া তারপর জানতে চেয়েছিল, “আইসক্রিম? চাও না?”
কথাটা বোধহয় শেষও হয়নি- ইথেনের লাফানি থেমে গেছিল।
একগাল হেসে প্রশ্ন করে চলেছিল।
ফেরা, উৎসে : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
“কোন কোন আইসক্রিম আছে তোমার? অরেঞ্জ স্টিক, চকলেট বার, কোন নাকি…?”
হাসলে টোল পড়ে ইথেনের গালে। দেখে দিয়া হেসে জবাব দিয়েছিল, “আছে কয়েকটা। অত মনে নেই। তুমি দেখতে চাও?”
সঙ্গে সঙ্গে নেমে এসে ঘাম টাম হাতের তালু দিয়ে মুছে সে একেবারে আমাদের অন্দরমহলে এসে হাজির।
আমি তখন অফিসে, রুচি বাড়িতেই ছিল। এমন ঘেমে নেয়ে আসা মূর্তি দেখে রুচি তো কিছুতেই আইসক্রিম দেবে না।
“আগে তুমি বাড়ি গিয়ে জামা কাপড় চেঞ্জ করে এসো, তারপর আইসক্রিম!”
সে নাকি নড়ছিল না কিছুতেই। তারপর দিয়া ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম দেখাতে নিমরাজি হয়ে বাড়ি গেছিল, ফিরে এসেছিল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই।
সেই শুরু। এরপর থেকে ইথেন প্রায়ই আসে, আর ক্রমে তার কথার ফুলঝুরি বাড়ে।
দিন কাটে। তারপর একদিন ইথেন স্কুলে যেতে শুরু করল আর ইথেনের মা আমার ওপর গুরুদায়িত্ব দিলেন তাঁর ছেলেকে পড়ানোর।
এমনিতে রোজই মোটামুটি একবার আসে ইথেন, শনি রবিবার পড়ে আমার কাছে, এছাড়া স্কুল থেকে ফিরেই মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে যায় নতুন কী চিপস, বা বিস্কুট বা কেক আইসক্রীম এল সেসব দেখতে। আমরা দুজনে এসব বেশি খাই না, আনা থাকে ইথেনের জন্যই। দিয়া যখন থাকে বলে ইথেন স্টক চেক করে নাকি নিয়মিত।
আমাদের ব্যস্ততামাখা একঘেয়ে জীবনে ইথেন একটা খোলা জানলা।
এই গোটা সপ্তাহটায় কাজের চাপ ছিল প্রচুর। অফিস থেকে ফিরতে রোজই দেরি হয়েছে। রুচিরও একগাদা মিটিং চলে সারাদিন। রাতে ডিনারের সময় রুচি বলল, “কাল পরশু ইথেন আসেনি, ভাবলাম আজ আসবে। কিন্তু আজও এল না। এমন তো হয় না!”
“তাই? আমার আসলে ক’দিন এত রাত হয়ে গেছে ফিরতে – তাই ভেবেছি আমি আসার আগেই চলে গেছে!”
“না গো! কী হল বলো তো! শরীরটরীর খারাপ নয় তো!”
“আজ রাত হয়ে গেছে এখন আর ওর মা’কে ফোন করব না!” বলেই আমার খেয়াল পড়ল যে কাল শনিবার। শনি রবিবার সে এবাড়িতে সারাদিন থাকে। পড়া উপলক্ষ্য মাত্র, সারাদিন চলে তার জ্ঞানগর্ভ বাণী আর ভোজন।
“শরীর টরীর টুকটাক খারাপ হয়তো, ভেবো না, কাল সে সক্কালবেলা হাজির হবে। স্টক চেক করতে হবে না! কাল আমার গ্রসারি যাওয়ার দিন!”
বলে হাসতে হাসতে আমি মুখ ধুতে গেলাম।

আমার ভবিষ্যৎবাণী কিন্তু ফলল না। শনিবার বিকেলের মধ্যেও যখন এল না, রুচি ফোন করল ইথেনের মাকে। ইথেনের মা জানালেন যে ইথেন ভালো আছে, কিছু পারিবারিক সমস্যার জন্য আজ যেতে পারছে না কাল নিশ্চয়ই যাবে। রবিবার একটু বেলার দিকে ইথেন এল দিদির সঙ্গে। দিদি ওকে দিয়ে চলে গেল। ইথেন কিন্তু লাফালাফি করল না। চিপস খেতে চাইল না। একটাও কথা না বলে চুপচাপ বসে হোমওয়ার্ক করতে শুরু করে দিল।
“এনিথিং রং ইথেন? কী হয়েছে?” রুচি জিজ্ঞেস করল। উত্তর এল না।
“নতুন চিপস এনে রেখেছি, তুমি যেটা চেয়েছিলে, খাবে?”
আমার প্রশ্নের জবাব এল নেতিবাচক। আমি আর রুচি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। হল কী ছেলের, মুখে হাসি নেই, কথার ফোয়ারা বন্ধ!
ভাল লাগছিল না আমাদের একটুও।
বেশ খানিক সময় কেটে গেল। মাস্টার আর ছাত্র কেউ কোনও কথা বলছি না।
রুচি চুপচাপ আস্তে আস্তে ওর সামনে ছোট্ট একটা বাটিতে ক্যারামেল পুডিং রাখল। উপরে সুন্দর করে স্ট্রবেরিকুচি দেওয়া, পাশে ছোট একটা চামচ আর ন্যাপকিন। ক্যারামেল পুডিং খেতে ইথেন অসম্ভব ভালোবাসে, ওপরে কতটা স্ট্রবেরিকুচি দিলে ঠিকঠাক হয় সেই সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান দেয় অন্যদিন।
আজ বাটিটা দেখে রুচির দিকে তাকিয়ে বলল শুধু, “থ্যাংক ইউ!”
“খাও সোনা!”
রুচি বলতেই বাটিটা টেনে নিয়ে এক মুহূর্তে প্রায় পুডিংটা শেষ করে ফেলল ইথেন। বুঝলাম খুবই খিদে পেয়েছিল বেচারির।
“আর একটু নেবে?” বলতে ঘাড় নেড়ে না বলল।
খাবার পর দেখলাম একটু যেন চাঙ্গা।
“বরফ দিয়ে জল দিই?” রুচি জিজ্ঞেস করল।
ইথেন কিছু না বলে উঠে এল রান্নাঘরে। আমার বাড়ির নাড়িনক্ষত্র ওর জানা।
ক্যাবিনেট খুলে গ্লাস বের করে ফ্রিজ থেকে জল নিয়ে গ্লাসে ঢালল।
জল খেয়ে মুখ মুছে নিজের ফর্মে ফিরল ইথেন।
ধেয়ে এল প্রশ্ন। আমার দিকে।
“তুমি কি জানো কেন বাবা আজ সকাল থেকে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে?”
আমার জানার পরিধি সীমিত। তাই ঘুরিয়ে প্রশ্ন করি, “কোথাও যাচ্ছেন বুঝি অফিসের কাজে?”
“তুমি দেখছি কিছুই জানো না। বাবা তো কাল থেকে অন্য বাড়িতে থাকবে। বেশ দূরে সেই বাড়িটা।”
আমি চুপ মেরে গেলাম। অন্যদিকে মুখ লুকোতে গিয়েই দেখি রুচির চোখের কোণে জল চিকচিক। দুজনের কাছেই এখন সবটা পরিষ্কার।
“বাবা বলেছে সামনের শুক্রবার আমাকে যেতে, দিদি নিয়ে যাবে!”
ইথেনের দিদি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে কয়েক মাস। এদেশে চারচাকা, দেশের গ্রামের সাইকেলের মতন। না থাকলে জীবন অচল।
হঠাৎ ইথেন উঠে এসে আমার কোলে বসল। মুখ তুলে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, “বাবা আর কোনওদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে না, তাই না গো?”
একমুহূর্ত সব চুপচাপ। তারপরই পরিস্থিতি সামলাতে আমি ইথেনের স্ট্রাটেজিই কাজে লাগাই।
“তুমি কি জানো তোমার এখন দু’দুটো বাড়ি হবে থাকার?”
উত্তরটা বুঝতে সময় লাগল খানিকটা। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ। ধীরে ধীরে মেঘ কেটে মুখে হাসি।
“ঠিক বলেছ তো! ঠিক ঠিক!”
বলতে বলতেই একলাফে রান্নাঘরে গিয়ে রুচিকে জড়িয়ে ধরে হুকুম জারি।
“শোনো, আমি নেক্সট ফ্রাইডে বাবার কাছে যাব। স্যাটার ডে রাতে ফিরব। সানডে মরনিং এখানে আসব। যাবার আগে লিস্ট দিয়ে যাব! সব বাজার করিয়ে রাখবে কিন্তু! আর পুডিং মাস্ট!”
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
অদিতি ঘোষ দস্তিদার পেশায় গণিতের অধ্যাপিকা। নেশা লেখালিখি। নিউজার্সিতে থাকেন। সারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' পত্রিকার সম্পাদক। মিশিগান থেকে প্রকাশিত 'উদ্ভাস' এবং কলকাতার 'কাফে টেবিল' প্রকাশনার 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতেও রয়েছেন। ছোটগল্প ও অণুগল্প লেখা বিশেষ পছন্দের।