আর কখনও অস্মিতা এমন প্রসঙ্গ তোলেনি। ইদানীং শুধু একবার বলেছে— “অপুকে তুমি মাঝে মাঝে কলকাতায় পাঠিও। আমরা যাই ভাবি, ওর তো মা।” বিরক্ত হয়ে অভীক বলেছে— “স্টুডেন্ট ভিসায় যারা এদেশে পড়তে আসে, তারা কজন বছর বছর দেশে যায়। প্রথমবার এসে আমি আড়াই বছর কলকাতায় যেতে পারিনি তখন ফোন করা এত সস্তা ছিল না। ই-মেইল ছিল না। আমারও তো সেখানে বাবা মা ছিলেন, নাকি? অপু যদি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অ্যাডমিশন পায়, হয়তো ওকে সামারে ক্লাস করতে হবে। অ্যাটলিস্ট বছর দুই ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রশ্ন নেই। তুমি সামারে ওমি, শমীকে নিয়ে ঘুরে আসবে। দ্যাটস ইট।” অভীক মনে মনে সেটাই ভেবে রেখেছে।
কলকাতায় অপুর স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরল। এন আই টি তে ভর্তির সুযোগও পেল। ততোদিনে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাডমিশনের চিঠি এসে গেছে। রওনা হওয়ার আগে হাতে আর মাত্র দেড়মাস সময়। অপুকে নিয়ে মহুয়া একদিন শান্তি ভবনে গেল। সন্ধ্যের পর হঠাৎ কারেন্ট চলে গেছে। নীচে বসার ঘরে টিমটিমে আলোয় শীলা ওদের দেখে বললেন– “তোদের এত দেরি হল? বলেছিলি যে বিকেল বিকেল আসবি? এখন তো ছাই ভাল করে দেখতেও পাচ্ছি না।
অপু হাসল- “এই তো কাছে বসলাম গায়ে হাত দিয়ে দেখো! তোমার সামনের দাঁত পরে গেল কবে?” শীলার গলায় অভিমান- “তুই কোনওদিন দেখতে আসিস যে জানবি?”
মহুয়া ব্যাগ থেকে মিষ্টির বাক্স বার করে রাখল- “কখন বেরিয়েছি! শেষ মুহূর্তে হাজারটা কাজ সারতে হচ্ছে। অপু তো আজ দুদিন পরে ফিরল”
“কেন? ও আবার কোথায় গিয়েছিল?”
“ওর জ্যাঠার বাড়ি।” (Short story)
নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাডমিশনের চিঠি এসে গেছে। রওনা হওয়ার আগে হাতে আর মাত্র দেড়মাস সময়।
শীলা মুখ বিকৃত করলেন- “হুঁঃ বাড়ির ছেলে আমেরিকা যাচ্ছে বলে এখন খুব আদিখ্যেতা! দরকারের সময় তো একটা পয়সা দিয়েও সাহায্য করেনি। তুই ওবাড়িতে যেতে দিলি কেন?”
মহুয়া অপুর মুখ দেখে প্রমাদ গুনল –“তুমি থামো তো মা! শুধু শুধু ওদের সম্পর্কে বলো না। দরকার আবার কী? আমি ওদের কাছ থেকে টাকা নেবোই বা কেন? অপুর জন্য ওর বাবা এপর্যন্ত কম টাকা পাঠিয়েছে? এলাম ছেলেটাকে নিয়ে দেখা করতে। ওর সঙ্গে দুটো কথা বলো!”
মেয়ের মেজাজ বুঝে শীলা ধাতস্থ হলেন- “বুঝিস তো, মনটা ভাল নেই। হ্যাঁ রে অপু, এই যে পড়তে যাবি, পাশ টাশ করে আবার ফিরে আসবি তো? নইলে মাকে দেখবে কে?”
অপু যেন দায়সারা ভাবে উত্তর দিল- “দেখ। আগে পড়াশোনা শেষ করি।”
মহুয়া ছেলের নিরুত্তাপভাব লক্ষ্য করেছিল- “আমার জন্য কেরিয়ার নষ্ট করে ফিরে আসার কী আছে? হাজার হাজার এন আর আই এর মা এদেশে একা থাকে। আমেরিকায় নিয়ে যেতে চাইলেও যায় না। আর, আমার তো কোনও মোহ নেই।”
অপুর আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না, মিমির সঙ্গে কদিন দেখা হয়নি। ও দিল্লীতে সোশিওলজী নিয়ে পড়তে চলে যাচ্ছে। আজ ও ফিরে গিয়ে ফোন করতে রাত হয়ে যাবে। অপু মা’কে তাড়া দিল – “আমার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে মা। কাল সকালে এজেন্টের অফিসে যেতে হবে। এখন তো এখান থেকে একটা ট্যাক্সিও পাবো না। অপু শীলাকে প্রণাম করল- “চললাম দিদা। ভাল থেকো। যদি নেক্সট ইয়ারে আসতে পারি, তখন দেখা হবে।”
ওরা শান্তি ভবনের গেট পার হয়ে চলে যাচ্ছে। শীলা জানালা দিয়ে চেয়ে আছেন। মনে মনে বলছেন-ছেলেটা বড় দুঃখী। লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। জীবনে সুখ শান্তি পাক।
আজ ও ফিরে গিয়ে ফোন করতে রাত হয়ে যাবে। অপু মা’কে তাড়া দিল – “আমার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে মা।
অর্পণ ঘোষ লেখা পাসপোর্ট নিয়ে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক অপু অগাষ্টের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছল। অভীকদের লার্চমন্টের বাড়িতে কয়েকদিন থেকে কলেজ খোলার আগে বিংহ্যামটনের ক্যাম্পাসে চলে যাবে। বাড়ি থেকে গাড়িতে কয়েক ঘণ্টার পথ। অভীক ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। অপু এরকমই আশা করেছিল। বাবার কাছে থাকলেও সম্পূর্ন অচেনা একটা ফ্যামিলির সঙ্গে সারাক্ষণ মানিয়ে চলা সহজ কথা নয়। অস্মিতা অবশ্য খুবই ভাল ব্যবহার করছে।

অপুকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে গিয়ে ওর জামাকাপড়, জ্যাকেট, জুতো থেকে শুরু করে কলেজের জন্য যা যা দরকার, কিনে আনছে। কলেজ ডর্মে তিনবেলা অপু মিল প্ল্যান এ খাবে। সময় মতো ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে যত ইচ্ছে খাওয়া। তাও অস্মিতা ওকে একটা ছোট্ট মাইক্রোওয়েভ কিনে দিয়েছে। বিংহ্যামটনে শীতকালে ভীষণ বরফ পড়ে। ঘরে একটু খাবার গরম করে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে টিনের খাবারের লিস্ট লিখে দিয়েছে। এদিকে অভীক উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে কলেজ কোর্সের বিষয়ে। অপু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। অপু যে বিংহ্যামটন কলেজে অ্যাডমিশন পেয়েছে, অভীক যে বন্ধুবান্ধবদের কাছে ছেলের পরিচয় দিতে পারছে, এতেই তার অনেকদিনের আশা পূর্ন হয়েছে। ওমি, শমীকে এতদিন না জানালেও অভীকের প্রথম বিয়ে, ডিভোর্স, অপুর কথা চেনা শোনা বাঙালিরা মোটামুটি জানে। কৌতূহল দেখায় না এখন তারা অপুকে দেখে। কলেজে যাচ্ছে বলে কংগ্রাচুলেট করছে।
শুধু ওমি, শমী প্রথমদিকে অপুর ধারে কাছে আসছিল না। অপু বুঝতে পারছিল, বাবা যতই চেষ্টা করুক, ওরা এত তাড়াতাড়ি ওকে অ্যাকসেপ্ট করতে চাইবে না। কাজ হল খাবার টেবিলে বসে তাসের ম্যাজিক দেখিয়ে। ট্রিকস শেখার উৎসাহে ওমি অপুর কাছাকাছি ঘুরতে লাগল।
বিংহ্যামটনে শীতকালে ভীষণ বরফ পড়ে। ঘরে একটু খাবার গরম করে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে টিনের খাবারের লিস্ট লিখে দিয়েছে।
আমেরিকায় ভাইবোনদের কেউ দাদা, দিদি বলে না। অপুকে ওমি শমী “আপু” বলে ডাকে, অস্মিতা বলেছে ওকে ‘মাসি’ ডাকতে। ড্যাড, বাবা, মাম্মা, মাসি, আপু – এমন সব সম্বোধনের মধ্যে দিয়ে ওদের সঙ্গে অপুর নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল। ছেলে মেয়েরা ছোট বলে অস্মিতাও চাকরি করে না। ইন্ডিয়া ট্রিবিউন নামে একটা ইংরিজি পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ লেখে। দুপুরে লেখালিখি, বাকি সময় সংসার আর বাইরের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। বাবা বলে অস্মি ভীষণ অর্গানাইজড। কলেজে পৌঁছে দেখবি তোর প্রত্যেকটা জিনিস গুছিয়ে লিস্ট করে দিয়েছে। অস্মিতা সম্পর্কে অভীকের প্রশংসার ব্যাপারটা অপুর কাছে প্রচ্ছন্ন থাকে না। ক্রমশ অপু নিজেও অনুভব করছিল এ বাড়ির জীবনযাত্রায় একটা ধরাবাঁধা ছন্দ আছে। স্নেহ, ভালোবাসা, রুটিন আর ডিসিপ্লিনের সহাবস্থানে উদ্বেগহীন এক নিরাপত্তাবোধ। দিল্লীতে মিমিকে অপু ই-মেইল এ লিখেছিল- “আই নেভার হ্যাড দিস কাইন্ড অফ চাইল্ড হুড। বাবা থেকেও নেই। ভাইবোন আত্মীয়সজন নেই। মা’র নেগলিজেন্স। দিদার রাগ মেজাজ। ছোটবেলায় অ্যাফেকশন আর পেলাম কার কাছে! ডিসিপ্লিন যেটুকু শিখলাম হস্টেলে থেকে।
মিমি উত্তর দিয়েছিল- এত পুরানো কথা লিখিস কেন? নতুন খবর জানাস। ছোট ভাইবোন দুটোর ছবি পাঠাস। তোর রুমমেট কি আমেরিকান?”
আরও পড়ুন: অপুর ঠিকানা…[১] [২] [৩]
অপু কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মিমিকে ওমি, শমীর ছবি পাঠাল। লিখল রুমমেট আমেরিকান। তোর এর মধ্যেই এত বন্ধুবান্ধব হয়ে গেছে? আমাকে মিস করছিস না? কলকাতাকে? আমি মিস করছি, শুধু তোকে নয়, আমাদের পচা পাড়াটাকেও।
বছর শেষ হল। থ্যাংকস গিভিং ক্রিসমাসের ছুটিতে অপু লার্চমন্টের বাড়িতে এল। আমেরিকায় প্রথম শীতের ধাক্কায় নতুন বছরের শুরুতেই অপুর ব্রংকাইটিস। আপস্টেট নিউইয়র্কে বরফ পড়ারও শেষ নেই। ক্যাম্পাসে ফিরে আবার পড়াশোনা, মিডটার্ম, ফাইনাল পরীক্ষার চাপ। মে মাসে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গরমের ছুটি হবে। অভীক এখন থেকেই অপুর জন্য নিজেদের অফিসে তিনমাসের সামার জব এর ব্যবস্থা করছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে চাকরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপুর কিছু রোজগার হবে। অপু ফোনে মহুয়াকে আশা দিল হয়তো সামনের ডিসেম্বরে কলকাতায় যেতে পারে।
চাকরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপুর কিছু রোজগার হবে। অপু ফোনে মহুয়াকে আশা দিল হয়তো সামনের ডিসেম্বরে কলকাতায় যেতে পারে।
ওমি ও শমীর গরমের ছুটি থাকে প্রায় আড়াই মাস। অভীক অস্মিতা ওদের নিয়ে দেশে যায়। এ বছর হঠাৎ সেই নিয়ে অশান্তি বাঁধল। অভীক ঠিক করেছে এবার আর নিজে যাবে না। অস্মিতা ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘুরে আসুক। অস্মিতা কারণটা বুঝেছে। তবুও জিজ্ঞাসা করল- “এবার হঠাৎ না যাওয়ার কী হল? বলেছিলে কদিনের জন্য পুরীতে যাব।”
“না, তোমরা ঘুরে এসো। জুন থেকে অপুর সামার ইন্টার্নশিপ শুরু হবে। আমাদের অফিসেই জয়েন করছে। আই থিংক আই শুড স্টে হিয়ার।”
“তুমি দেশে গেলে ওর অসুবিধেটা কী? এখানে সবাই কি বাবার অফিসে সামার জব করে?”
অভীক বোঝাতে চেষ্টা করল- “স্টীল, হি নিডস সাম গাইডেন্স। ছ’মাস হল মাত্র এসেছে। এখনও ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়নি। এখান থেকে রোজ নিউইয়র্কে কমিউট করবে। এ বছরটা ওকে একা রেখে নাই বা গেলাম।”
“যা তোমার ইচ্ছে। তার মানে তোমার দাদাদের সাথে দেখা হবে না? আমার বাবা মাও তো এক্সপেক্ট করেন…”
“কিছু করার নেই। অপুর কেরিয়ারটা আমার কাছে বেশি ইম্পর্টেন্ট। তার চেয়ে ক্রিসমাসে আমরা সবাই মিলে ফ্লোরিডা যাব।”
জুন থেকে অপুর সামার ইন্টার্নশিপ শুরু হবে। আমাদের অফিসেই জয়েন করছে। আই থিংক আই শুড স্টে হিয়ার।
“আজকাল ট্রাভেল করা যে কী হ্যাসল।”
“তার ওপর দেশে গেলেই তো একজনের ভাইরাল ফিভার, একজনের পেট খারাপ। তুমি সঙ্গে গেলে অত চিন্তা থাকে না। অপু একটা অ্যাডাল্ট ছেলে। মাস খানেক নিজে ম্যানেজ করতে পারবে না?”
“দ্যাটস নট দ্য পয়েন্ট। আমি এ বছর ওকে একা রেখে যেতে চাই না। ওর সঙ্গে একটু সময় কাটাতেও ইচ্ছে করে।”
“কেন? আমরা তোমাকে সেইটুকু স্পেস দিই না? তারজন্যে বাড়ি খালি করে দেশে চলে যেতে হবে? ওমি, শমী তোমাদের ডিস্টার্ব করে?”
অস্মিতা অভিমান করে উঠে যাচ্ছে দেখে অভীক ওর হাত ধরে বসাল “কী যে পাগলের মতো বলো! আমি তো জানি তুমি অপুকে যেভাবে অ্যাকসেপ্ট করেছো, সকলের সেই কম্প্যাশন থাকে না। অস্মি, ইচ্ছে হলে দেশে ঘুরে এসো। নয়তো, এবার কাছাকাছি কোথাও শর্ট ট্রিপ নিতে পারি। অপু না হয় শেষের দিকে একটা উইক অফ নিয়ে নেবে। এসে পর্যন্ত কোথাও তো যায়নি।”
অস্মিতা মাথা নাড়ল “না গো, বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না। আশা করে বসে থাকেন। সিঙ্গাপুর থেকে সুস্মিতারাও আসছে। সামারে ঘুরেই আসি।”
তুমি অপুকে যেভাবে অ্যাকসেপ্ট করেছো, সকলের সেই কম্প্যাশন থাকে না। অস্মি, ইচ্ছে হলে দেশে ঘুরে এসো।
বিংহ্যামটনের ক্যাম্পাসে অপুর দু’বছর পার হয়ে গেল। থার্ড ইয়ারে উঠেও গরমের ছুটিতে কলকাতা যাওয়া হল না। প্রত্যেক সামারে চাকরি করছে। রেজাল্ট ভাল হচ্ছে। কাছাকাছি কোম্পানিতে দু’আড়াই মাসের কাজ পেয়ে যাচ্ছে। অভীক একরকম নিশ্চিন্ত যে এদেশে ছেলের মন বসে গেছে।
অপু স্পষ্ট করে অভীককে কিছু জানায় না। মহুয়াকে ফোন করলে দেশে আমার কথা জিজ্ঞেস করে। অপু মাকে বোঝায়- পড়া আর চাকরির মাঝে একদম ব্রেক পাচ্ছে না। এবার ক্রীসমাসে বোধহয় বাবার সঙ্গে দু-তিন উইকের জন্যে যাব।
মিমি মাঝে দিল্লী থেকে দিওয়ালির ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে অপুকে ফোন করেছিল। বলল “তোদের বাড়িটা প্রোমোটারকে দিচ্ছে। বাড়িওয়ালা তোর মাকে ফ্ল্যাট ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে। ভাড়া নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আগেও নাকি ভাড়া-টাড়া বাকি ছিল। বেশ ঝামেলা করছে।”

অপু চিন্তিত হল “নোটিশ দিলেই হল? এতবছর থাকার পর মা যাবে কোথায়? টেনেন্টদের জন্য রাইট আছে না?”
“যে জন্য উকিল টুকিল দরকার। কেস চালানোর খরচ আছে। উনি তোকে কিছু জানাননি?”
অপু বলল “আমার সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি। তুই খবর পেলি কী করে?”
ফোন রাখার আগে মিমি জানাল “একদিন ওঁর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়েছিল, তখন বলছিলেন। ওষুধের দোকানের ভদ্রলোক নাকি বুঝিয়েছেন এভিক্ট করতে চাইলে পার্টির হেল্প নেবেন। কে জানে? তুই একবার মা’কে কন্ট্যাক্ট কর। দেখাও তো কতদিন হয় না। এ-বছর আসবি না?”
অপুর একবারও মনে হয়নি মা এতরকম সমস্যায় আছে, মার হাতে টাকাপয়সা কেমন আছে, সে বিষয়েও কোনও ধারণা নেই। গান শেখানো ছাড়াও মা দক্ষিণাপনে একটা টেকস্টাইলের দোকানে চাকরি নিয়েছে। অপু ভেবেছিল মা’র সময় কাটে না বলে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। প্রয়োজনের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। মিমির কাছে ফোনে মা’র খবর শুনে অপু একদিন অভীককে জানাল। আমরাও তো কেস করে কলকাতার বাড়ির ভাড়াটে ওঠালাম।
অপু বলল “বাট অ্যাট দিস স্টেজ হ্যোয়ার উইল শি গো? ওখানে মার গানের স্কুল। ঢাকুরিয়ার শপিং সেন্টারে কাজ করে। এখন কোন পাড়ায় গিয়ে ফ্ল্যাট খুঁজবে?”
“ফার্স্ট অফ অল, সেটা আমার ভাবার কথা নয়। তুমিও কোনও সলিউশন করতে পারবে না। তোমার মা যদি কেসের ঝামেলায় না যেতে চায়, শি শুড নেগোশিয়েট ফর সামথিং। বাড়িওয়ালা বা প্রোমোটারের কাছে কিছু ডিম্যান্ড করুক। টাকাকড়ি পেলে নিজের মার কাছে ওল্ড-এজ হোমে চলে যাক। এই বয়সে অন্যের ফ্ল্যাট দখল করে রেখে হবেটা কী? ভাল কথায় বাড়ি না ছাড়লে ওরা হ্যারাস করবে।”
মা’র সময় কাটে না বলে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। প্রয়োজনের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। মিমির কাছে ফোনে মা’র খবর শুনে অপু একদিন অভীককে জানাল।
অপুর হঠাৎ ঐ মুহূর্তে বাবাকে ভারী নিষ্ঠুর মনে হল। যেন মা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে বাবা খুশি হয়। হতে পারে, মা একসময় বাবাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। তবু, বাবা জীবনে প্রায় সবকিছু ফিরে পেয়েছে। অপুও চলে এসেছে। ওখানে মা একা। মিমির কথায় বুঝতে পারল মা ওকে কিছু জানাতেও চায় না। বাবার যুক্তিগুলো অস্বীকার করা যায় না। অপু এতদূর থেকে কী সলিউশন করবে? মা’র পক্ষে কেস করার ঝামেলাও কি কম?
অপু মাকে ফোন করে বাবার কথাগুলো বলল।
মহুয়া বোঝাল— “আমার জন্য ভাবিস না অপু। যদি কোথাও যেতে হয় তো যাব। গানের টিউশন কমে গেছে। তুইও ফিরবি না। ফ্ল্যাটটা রাখার জন্য কেস-এর ঝামেলায় যাব কেন? সে ক্ষমতাও নেই। তার চেয়ে যাদবপুর, গড়িয়ার দিকে কোথাও পেইং গেস্ট হয়ে চলে যাব।” অপু মানতে পারছিল না— “এখনই ডিসিশন নিচ্ছ কেন? এভিকশনের কেস তো বছরের পর বছর ধরে চলে। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পলিট করতে আর একটা বছর। এখানে রিসেশন হোক। যাই হোক, আমাদের জব মার্কেট ভাল। হয়তো ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাব। তোমাকে টাকার জন্য কোনও কম্প্রোমাইজ করতে হবে না। আই উইল টেক কেয়ার অফ ইউ।”
যদি কোথাও যেতে হয় তো যাব। গানের টিউশন কমে গেছে। তুইও ফিরবি না। ফ্ল্যাটটা রাখার জন্য কেস-এর ঝামেলায় যাব কেন? সে ক্ষমতাও নেই।
মহুয়ার গলার স্বর কান্নায় বুজে এল— “বাবার সঙ্গে অশান্তি করিস না। সেরকম অবস্থা হলে তোকে নিজেই জানাব।”
ওমি জুনিয়র হাইস্কুলে যাচ্ছে। নতুন ক্লাসে হায়ার ম্যাথ গ্রুপে ঢুকতে পারেনি। অপু ছুটির মধ্যে বাড়িতে এলে ওমিকে অঙ্ক করায়। ওমিকে সামার স্কুলে পাঠানোর জন্য অস্মিতারা এবার দেশেও যায়নি। ক্রিসমাসের ছুটিতে অভীকের সঙ্গে অপু শেষপর্যন্ত কলকাতায় গেল। দিল্লী থেকে নিউইয়র্কে ফ্লাইটে অভীকের সঙ্গে লার্চমন্টে ফিরে এল। মিমির সঙ্গে অপুর বন্ধুত্বের খবর এখন অস্মিতাও জানে। অভীকের সঙ্গে এবার দিল্লি এয়ারপোর্টে মিমির আলাপ হল। প্লেনে আসতে আসতে অভীক জিজ্ঞেস করেছিল— “ইজ শী ইয়োর গার্লফ্রেন্ড? নাকি পাড়ার বন্ধু?”
অপু উত্তর দিয়েছিল— “ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু। অ্যান্ড নাও উই হ্যাভ আ স্টেডি রিলেশনশিপ।”
অভীক হেসে ফেলেছিল— “তুই থাকিস বিংহ্যামটনে। ও থাকে দিল্লীতে। ইউ ডোন্ট সি ইচ আদার।”
অপু হাসি মুখে মাথা নেড়েছিল— “ইয়া দ্যাটস আ প্রব্লেম।”
দিল্লী থেকে নিউইয়র্কে ফ্লাইটে অভীকের সঙ্গে লার্চমন্টে ফিরে এল। মিমির সঙ্গে অপুর বন্ধুত্বের খবর এখন অস্মিতাও জানে।
অভীকের কাছে শুনে অস্মিতা বলেছিল— “হয়তো মেয়েটা খুব কেয়ারিং। ছোটবেলা থেকে অপুর সিচ্যুয়েশনটা জানে। ওর পক্ষে দেশের চেনা শোনা মেয়ে বিয়ে করাই ভাল।
অভীকের ধারণা অপুর এখন কোনও কমিটমেন্টে যাওয়ার বয়সই হয়নি। আগে ভালভাবে সেটল করুক।
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রী নেওয়ার পরপর তিনটে চাকরির সুযোগ এল। অভীকের ইচ্ছে ছিল অপু নিউইয়র্ক, নিউজার্সি অথবা বস্টনের দিকে চাকরির অফার নেয়।
অপু চলে গেল সানফ্রান্সিসকো। অভীক ভাবতেই পারছিল না চার বছরে অপু এত ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেল যে ক্যালিফোর্নিয়ার চাকরিটা নেওয়ার আগে একবার বাবার মতামতও নিল না। তখনও ওর অপুর চাকরির শর্তটা জানা ছিল না। অপু ফোন করে বলল— দু’বছরের অ্যাসাইনমেন্টে ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছে। যদিও প্রায়ই সানফ্রান্সিসকোয় আসতে হবে।
অভীক অবাক— “দু’বছরের জন্য ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছিস? আগে থেকে কথা হয়েছিল?”
অপু উত্তর দিল— “এরকম একটা পসিবিলিটির কথা জানতাম।”
অভীক আশাহত হল— “আমাকে বলিসনি তো! তোর কি এ দেশে থাকতে ভাল লাগছে না?”
অপু বলল— “তা কেন হবে? অফিসটা তো এখানেই। বলতে পারো আমি একটা সুযোগ খুঁজছিলাম।”
—কীসের সুযোগ? ইস্ট কোস্টে এত ভাল ভাল অফার অফার পেয়েছিলি…।”
—বাবা, আই নীড টু টেল ইউ সামথিং। মা’র শরীর ভাল নেই। মাঝে চেস্ট পেইন হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল।

ফ্ল্যাটটাও এবার ছেড়ে দিতে হবে। আমার একবার যাওয়া দরকার। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে থাকতে মায়ের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা, তারপর সল্টলেকের সিনিয়র সিটিজেন হোমে মাকে রাখার ব্যবস্থা, অনেক কাজ করে আসতে পারব।”
অভীক কেমন অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করল— “দু’বছরের মধ্যে ফিরে আসবি তো অপু? নাকি ওখানেই চাকরি নিয়ে থেকে যাবি?”
অপুর মনে হল একদিন মা-ও এই প্রশ্ন করেছিল। পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট, ওর কাছে আরও বিস্তারিত হয়ে চলেছে। তবু একটা স্থায়ী ঠিকানা আছে।
পাসপোর্টে অর্পণ ঘোষের মনোহর পুকুর সেকেন্ড বাই লেনের ঠিকানাটা মুছে গিয়ে লার্চমন্টের বাড়ির নতুন ঠিকানা। সানফ্রান্সিসকো আছে। ব্যাঙ্গালোর আছে। কলকাতা আছে। দিল্লিতে মিমি আছে। অপু অভীককে উত্তর দিল— “যখন যেখানেই থাকি, ফিরে আসব।”
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।