“আপনি ফিরনি খাননি? ইস ইট?” ‘ফি’এর ওপর সামান্য ঠোক্কর দেওয়া বেশি জোর। ফিরনি না খাওয়া এত বিস্ময়ের বিষয় গৌতমীর কাছে! বিস্মিত চোখের ওপর নিখুঁত একজোড়া ডানামেলা ভ্রু। ওরকম হয়তো প্রকৃতিদত্ত ছিল না, পার্লারের সৌন্দর্যবিদের অনেক মেহনতের ফল। তবু সেই কাজল কালো চোখের মায়া অদৃশ্য তরঙ্গস্রোতে যেন চার পাশের বেরঙা অসৌন্দর্যের ওপর স্নিগ্ধতার তুলি বুলিয়ে দেয়। দৃষ্টি ছুঁয়ে শারীরিক পাকদণ্ডী বেয়ে নামতে নামতে নিঃশ্বাসের তালে আন্দোলিত একটা ছোট্ট ডলফিন লকেট শাঁখের মতো ফর্সা বুকে, যার চোখে এক টুকরো লাল পাথর বসানো। পাঁচ বছর আগের কথা তো কী! আজও স্পষ্ট স্মৃতি। অভ্রমেশানো আইশ্যাডো ছোঁয়া কালো চোখদুটো আজও গাঁথা হয়ে আছে মনের কংক্রিট পাঁচিলে। পাঁচ বছর পরেও ম্লান হয়নি একটুও।
একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস পড়ে কৌশিকের। ও এখন বসে আছে পার্কস্ট্রিটের একটা নিরালা রেস্তোরাঁয়। সামনে ধোঁয়াটে রঙের টেবিলের ওপর কাচের রেকাবিতে ফিরনি। শিশিরবিন্দু চারপাশে জমে উঠছে ক্রমশ। টেবিলের ওপারে নবমিতা ফোনে ব্যস্ত। ওর অনামিকার আমেরিকান ডায়মন্ড থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে ফোন ধরা হাতটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে। কৌশিক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। (Story)
মেয়েটার মুখে খেলা করা আবেগ মন টেনেছিল। কালো কাজল ঘেরা আনত চোখদুটো নিবিষ্ট ছিল মেরুন ডায়েরির পাতায়।
নবমিতাকে সামনে বসিয়ে গৌতমীর কথা ভাবা ঠিক হচ্ছে কি! অবশ্য নয় কেন! নবমিতার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাকরণ একেবারেই আলাদা। রেস্তোরাঁয় একজন যুবতীর সঙ্গে এলেও, কৌশিকের মতো লাজুক ছেলের নবমিতাকে ভাল বন্ধুর বেশি ভাবার সাহস নেই। ওকে বলাও হয়নি গৌতমীর কথা। দরকার কী!
একটা কবিতা বাসরে পরিচয় হয়েছিল গৌতমীর সঙ্গে। কৌশিক অবশ্য কবিতার বিশেষ কিছু বুঝত না। এক উঠতি কবি বন্ধুর মন রাখতে যাওয়া। বাগবাজারের পুরোনো পাড়ায় সাবেকি ধাঁচের কালচে কাঠের চেয়ারে সাজানো ঘরে বসে কবিতা শুনছিল। গৌতমী সেদিন যে কবিতাটা পড়ছিল তার মধ্যে “মন খারাবিয়া লালরঙ”, “নীলচে আলোর মতো অভিমান” এরকম দু’চারটে শব্দবন্ধ ছাড়া আর বিশেষ কিছু কানের টানেল দিয়ে মাথা অবধি পৌঁছায়নি। কৃষ্ণনীল শাড়ি, আর মেয়েটার মুখে খেলা করা আবেগ মন টেনেছিল। কালো কাজল ঘেরা আনত চোখদুটো নিবিষ্ট ছিল মেরুন ডায়েরির পাতায়।
একটা কবিতা বাসরে পরিচয় হয়েছিল গৌতমীর সঙ্গে। কৌশিক অবশ্য কবিতার বিশেষ কিছু বুঝত না। এক উঠতি কবি বন্ধুর মন রাখতে যাওয়া।
যাই হোক, বাঙালিদের মজলিসের শেষে রসনায় সব রসের অন্ত। চা আর পকোড়া খেতে খেতে শুরু হল খাওয়ার গল্প। তখনই হঠাৎ কী একটা প্রসঙ্গে কৌশিক নেহাৎ বোকার মতো বলে ফেলল, “ফিরনি? না, ওটা খাইনি কোনও দিন”। বাদামি মণির দীঘি-চোখ থেমেছিল কৌশিকের মুখের ওপর। মনে হয়েছিল ভাগ্যিস ফিরনি খাওয়া হয়নি। ফিরনি কোন দোকানে ভাল তার লম্বা লিস্ট সাথে সাথেই চলে এসেছিল। সঙ্গে রেসিপিও। এখন কৌশিক নবমিতার সঙ্গে যে রেস্তোরাঁয় বসে আছে সেটার নাম কী যেন বলেছিল! কৌশিক মনে করতে পারল না।
গৌতমীর সঙ্গে কোনও দিন কোনও হোটেলে যায়নি কৌশিক। রাজপথে হেঁটেছে হাত ধরে। ফুটপাথে বড় হয়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছের রাঙাফুল বসন্ত হাওয়া মাখামাখি হয়ে দুলেছে, বিকেলের কমলা রসে ডোবানো ময়দানের ক্যাসুরিনা এভিনিউ দিয়ে দ্রুতবেগে ঝাঁকে ঝাঁকে গাড়ি গেছে ধুলোর আবির উড়িয়ে। ক্লান্ত ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পুরোনো অফিসপাড়ার বাতিল টাইপরাইটারের মতো ক্রমশ মিলিয়ে গেছে দূরের ধোঁয়াশায়। বিকেলের নিভু নিভু আলোর গাল বেয়ে টুপটাপ গড়িয়ে পড়েছে টাটকা অভিমান। ক্রমশ ব্যাকড্রপ কালচে হয়ে গেছে। নিকষ কালো। একটাও আলোর কণা ভুল করেও সেই ফ্রেমে চিকচিক করার ঔদ্ধত্য দেখায়নি।
“আরে কী ভাবছ এত?”
ফাঁকা প্লেটটা সরিয়ে রেখে ওয়েটারের এনে দেওয়া বিল মেটাতে মেটাতে হাত ধুয়ে চলে এসেছে নবমিতা। একটু কাছ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল, “এখানে অটোমেটিক কল লাগানো বেসিন ছিল। কী ভাল রেস্টুরেন্ট বল। আমার জন্মদিনের ট্রিট, ভাল জায়গাতেই হল।”
সামনে প্লেটে বিল সমেত ছোট্ট মৌরির বাটি এসে গেছে। দু’চারটে মৌরি আর মিছরি গালে ফেলে কৌশিক অল্প হাসল।
বিকেলের নিভু নিভু আলোর গাল বেয়ে টুপটাপ গড়িয়ে পড়েছে টাটকা অভিমান। ক্রমশ ব্যাকড্রপ কালচে হয়ে গেছে। নিকষ কালো।
নবমিতার সঙ্গে আলাপ কৌশিকের কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে। আড়ে বহরে তিন ফুট বাই দু’ফুট এই দোকানটা কৌশিকের মাতামহের। ট্রাম রাস্তার ওপরে। মামা চালাতেন, এখন একমাত্র উত্তরাধিকারী কৌশিক। মূলত চাকরির পরীক্ষার বই, স্কুল কলেজের বই এসবই পাওয়া যায়। যা থাকে না, আনিয়ে দেয় কৌশিক। ফদা বলে ছেলেটা বেশ কাজের।
“একটু দাঁড়ান”, বলে দুটো লাফ দিয়ে নেমে বেরিয়ে পড়ে সন্ধানে।
সেদিন ওয়েদার অল্প ভিজে। ফদা আসেনি। টিপ টিপ বৃষ্টি আর প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে বই কিনতে এসে অনর্গল প্রশ্ন করছিল মেয়েটা। কৌশিক বই রাখার তক্তার ওপর পেরেক ঠুকতে ঠুকতে টুকটাক উত্তর দিচ্ছিল। হঠাৎ বেকায়দায় হাতুড়িটা পড়ে গেল ঠিক হাতের উপর। কঁকিয়ে উঠতেই ”কই কী হল?” বলে আচম্বিতে আহত হাতটার ওপর একটু ঝুঁকে পড়েছিল নবমিতা, “ইস আমার সাথে কথা বলতে গিয়েই এমন হল।” নবমিতার গলার স্বর একটু ভাঙা ভাঙা, রাণী মুখার্জির মতো। কিন্তু অদ্ভুত আন্তরিকতা আছে কথা বলার ভঙ্গিতে।
তারপরও নবমিতা এসেছে, বন্ধুদের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়েছে মাত্র পাঁচ বছর আগে। এখন চাকরির চেষ্টা করছে। কেনার আগে খুব মন দিয়ে বইয়ের নাম ধরে খুঁটিয়ে পড়া ওর সিরিয়াস ভাবভঙ্গি দেখে ওর বন্ধুরা হেসে উঠেছিল, “তুই বি.সি.এসে যাচ্ছিসই যাচ্ছিস।”
নবমিতার সঙ্গে আলাপ কৌশিকের কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে। আড়ে বহরে তিন ফুট বাই দু’ফুট এই দোকানটা কৌশিকের মাতামহের। ট্রাম রাস্তার ওপরে।
ব্যাগ দিয়ে দুমদাম বন্ধুর মাথায় হালকা ঘা বসিয়ে দিয়েছিল নবমিতা। উল্টোদিকে বিক্রেতার আসনে বসা কৌশিকের মুখে হাসি। ওদের সজীব খুনসুটিতে বেশ মজা লাগছিল।
কত বই জোগাড় করে আনিয়ে দিয়েছে কৌশিক। সেই সূত্রেই ফোন নম্বরের আদান প্রদান। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে চলত প্রাসঙ্গিক থেকে অপ্রাসঙ্গিক কথা। কৌশিকের চোখ অকারণে গৌতমীর সঙ্গে তুলনা করত নবমিতার। গৌতমী বেশ ফর্সা ছিল, নবমিতা ফর্সা নয়, কিন্তু ওর ঈষৎ কোঁকড়া চুলে ঘেরা শ্যমবর্ণ মুখে একটা আলগা শ্রী। চোখ দুটো স্থির। কৌশিক লক্ষ্য করে, কথা শোনার স্থির চোখ মেলে রাখে সে। যত সাধারণ কথাই হোক মন দিয়ে শোনে। কেজো কথার সুতোর শেষে শুরু হত ব্যক্তিগত কথা।
“আপনি একা থাকেন? কেউ নেই আপনার?” কৌশিককে শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল নবমিতা।
“হ্যাঁ একাই।”
নবমিতার মুখটা ভীষণ নরম হয়ে উঠেছিল।
“তাহলে রান্না বান্না?”
“ওটা একটা কাজ হল? নিজেই করি।”
“কিন্তু অসুখ করলে?”
“নিজেই” কথাটা বলার সময় গলাটা খুব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিল কৌশিক। যাতে উল্টোদিকের চোখজোড়ায় একটুও মমতার ঢেউ না খেলে। কিন্তু, উত্তরটা শোনার পর নবমিতা একই রকম শীতলপাটির শান্ত আতিথেয়তা চোখে নিয়ে তাকিয়েছিল।
পরে বাড়ি ফেরার পথে স্টেশন থেকে যেটুকু হেঁটে ফিরতে হয় সেটুকু নবমিতার কথাই ভেবেছে সেদিন। ভাল লাগছিল ভাবতে। নবমিতার চোখের দিকে এরপর তাকালে কিছু কি খুঁজতে ইচ্ছে করবে? একটুখানি মায়া? এক চামচ বেশি তাপ! কথায় আরও একটু শুশ্রূষা! কৌশিক মুখটা শক্ত করে রাখবে, তারপর এই আজকের মতো একাপথে হাঁটতে হাঁটতে ভাববে…
“বাবা বাইরে, আসবে আজ?”
“আসছি।”
একটুখানি মায়া? এক চামচ বেশি তাপ! কথায় আরও একটু শুশ্রূষা! কৌশিক মুখটা শক্ত করে রাখবে, তারপর এই আজকের মতো একাপথে হাঁটতে হাঁটতে ভাববে…
কৌশিককে বসিয়ে রেখে ফ্ল্যাটের এটাচড বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেরোনো গৌতমীর ভিজে চুলে তোয়ালে জড়ানো। নাইটির ওপর বোতাম লাগানো হাউস কোট পরছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সাদা মোমের মতো পিঠ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিল। গাঢ় ল্যাভেন্ডার বেগুনি দেওয়ালের ফ্রেমে একটা তুলিতে আঁকা ছবি যেন।
কৌশিকের গা বেয়ে ঘন হয়ে উঠেছিল গৌতমী। উফফ কেন যে! টিক টিক করে এগিয়ে চলছিল ঘড়ির কাঁটা, আর সময়ের এক একটা অনুপলে কৌশিকের শান্ত লাজুক খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছিল এক হিংস্র পশু। হ্যাঁ, পশু হয়ে গিয়েছিল কৌশিক।
“আহ, কী করছ তুমি!”, ত্রস্ত গৌতমীকে ধাক্কা মেরে আসুরিক শক্তিতে দলে মথে দিতে চেয়েছিল কৌশিক। আর একটু সময় দিলে যে সুখ আপনিই ধরা দিত, সেটুকু সময় দিতে দেয়নি কৌশিকের ভেতরের পশুটা। গৌতমীর আবরণ ফালা ফালা করে ছিঁড়ে সমস্ত বল প্রয়োগ করে ও শিকারের নেশায় মেতেছিল, মাংসল গন্ধে পাগল হয়ে উঠেছিল।
“জানোয়ার”, একরাশ থুতুর মতো কথাগুলো ছড়িয়ে গিয়েছিল ঘরের দামাল উষ্ণ বিষ বাষ্পের গায়ে। চিরবিড়ে জ্বলুনি খাঁজে খাঁজে বসিয়ে দেওয়া একটা চড় সপাটে এসে পড়েছিল গালে। কৌশিকের সম্বিৎ ফিরেছিল।
“তুমি একটা রেপিস্ট। একটা পাভার্ট! ছিঃ। ফাঁকা বাড়িতে একা পেয়ে!”

কৌশিক কী করে বলত ওর শিরায় শিরায় বিষ। ওর চোখের সাদার নীচে বিপজ্জনক থকথকে নীলাভ জেলি লুকিয়ে আছে। আঙুলের তলায় নখ লুকিয়ে রাখা থাবা। বিষের কামড়ে ও আর মানুষ নেই। বা থাকলেও সুপ্ত রোগের মতো কোষে কোষে বয়ে চলেছে শৈশবে আস্তানা গেঁড়ে থাকা মাংসলোলুপ সেই সরীসৃপটা। সেই বিষাক্ত মানুষটা কৌশিক নয়, কৌশিকের মতো দেখতে আরেকজন কেউ, অবিকল একই রকম করে লোকটা দাঁড়ায় বসে, সারাদিন খাটে, শুধু বিকৃত কামনা লেপ্টে রাখে খুব গোপন অন্তরমহলে, কেউ জানে না, কেউ না!
“ঘেন্না করি, ছিঃ, তুমি ঘেন্না করারও যোগ্য নও। কামুক! সব মেয়েকে প্রথমেই খাটে চাও তাই না? নোংরা!”
ঘূর্ণিঝড়ের হাওয়ায় পাক খেতে থাকা ভাঙা পাখির বাসার মতো গৌতমীর কথাগুলো পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়েছিল কৌশিকের চেতনার আনাচে কানাচে।
ভাগ্যিস সেদিন গৌতমী ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। সরিয়ে দিয়েছিল জীবন থেকেও। বেশ করেছিল। লোকজন ভরা রাস্তার মাঝখানে টেনে আরও কটা থাপ্পড় মারলে ঠিক করত।
হাতের তলাটা ঘেমে চটচটে হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। জ্বলন্ত সিগারেটটা মাটিতে ফেলে জোরে পায়ে ডলতে লাগল কৌশিক। পাঁচ বছর আগের বিশ্রী স্মৃতিটা মনের মধ্যে চরে বেড়াতে দেয় মাঝে মাঝে। যদি ঐ ভুলটা না হত, যদি অন্যভাবে ব্রেক আপ হত, নবমিতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত কৌশিক। কিন্তু আর না, কক্ষণও না।
নবমিতাকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে কৌশিক স্টেশনে এসে ট্রেন ধরল প্রায় দৌড়েই। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। তিনটে স্টেশন পরেই নামবে। চলন্ত ট্রেনে একটা পোড়া ইঞ্জিন তেলের গন্ধ পাওয়া যায়। সেই গন্ধটার সঙ্গে রেল লাইনের পাশের বুনো ঝোপঝাড়ের গন্ধ, আর বিকেলে হওয়া এক পশলা বৃষ্টিতে ভেজা মাটির গন্ধের মিশেলে একটা হালকা ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা দিচ্ছে মুখে। সামনের চুল উড়ে এসে পড়ছে ঘাম শুকোতে থাকা কপালে।
এয়ার কন্ডিশনে আর পুশ ব্যাক সিটের আরামে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। সিনেমা শেষের পর ডেকে তুলেছিল নবমিতা।
বিকেলে যখন বৃষ্টি হয়েছে তখন ওরা এস্প্ল্যানেডের একটা সিনেমা হলে সিনেমা দেখছিল। নবমিতার উৎসাহে আসা। ওর আরও দু’জন বন্ধুর আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে তারা এল না। বেশ একটা ভাল লাগা ঘিরে ছিল এতক্ষণ। শেষের দিকে সিনেমার পর্দায় কী যে হচ্ছিল ভাল করে দেখেইনি কৌশিক। এয়ার কন্ডিশনে আর পুশ ব্যাক সিটের আরামে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। সিনেমা শেষের পর ডেকে তুলেছিল নবমিতা।
“ইস, সরি সরি।” ধড়মড় করে উঠে বলেছিল কৌশিক। মনে মনে সঙ্কোচ, ঘুমানোর সময়ে নির্ঘাৎ মুখটা বিশ্রী হাঁ হয়ে গিয়েছিল। প্রেস্টিজ এক্কেবারে পাংচার এই ঝকঝকে মেয়েটার সামনে।
“ডাকোনি কেন?”
“মনে হল তুমি খুব ক্লান্ত।” নবমিতার ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি।
বাড়ি ফিরে ইমার্শন হিটার দিয়ে জল গরম করে বাথরুমে স্নানে ঢুকল কৌশিক। বরাবরের অভ্যাস, ফিরে স্নান করা। হাঁ করে নিঃশ্বাস ছাড়তেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে হলুদ বাল্ব ঝাপসা। আরও কয়েকবার বাষ্প ছাড়ল মুখ দিয়ে। বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে এবার নভেম্বরের শেষেই। শরীর নিঃসৃত বর্জ্য জল ফোয়ারার মতো ছিটিয়ে দিল বাথরুমের দেওয়ালে। কেউ যদি এখন বাথরুমে একটা সি সি ক্যামেরায় তার এই কাজ দেখে, নির্ঘাৎ পাগল ভাববে। নিজের মনেই হেসে উঠল কৌশিক। ছোটবেলায় এসব মানায়!
ছোটবেলা কি কোনওদিন তার ছিল? মাকে মনেই পড়ে না। বাবা আর পিসির কাছে এগারো বছর অবধি কেটেছে। তারপর বাবাও মারা গেলেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর বিডন স্ট্রিটের সোনামামার বাড়িতে আসা। তার আগে অবধি কোনও যোগাযোগ ছিল না। যেদিন ও-বাড়িতে প্রথম যাওয়া, সোনামামী সেদিন কোথায় বেরোচ্ছিল। শ্যাওলা ধরা উঠোন, রঙচটা ক্যালেন্ডার সাঁটা দেওয়াল, চুন খসা দেওয়ালের সাথে মামার কালো ভুঁড়ি ওয়ালা চেহারা, আর পানের কস গড়ানো ঠোঁটের কালচে দাঁতের হাসি যতটাই মানানসই, ততটাই বেমানান ছিল সোনামামী। টকটকে ফর্সা রঙ আর ননীর মতো চকচকে মসৃণ ত্বক। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময়ে কৌশিকের মনে হয়েছিল এমন সুন্দর পা শুধু সে ঠাকুর মূর্তিরই দেখেছে।
ঘরের রাত আলোয় বিছানার ঠিক সামনে সোনামামী। কাঠ হয়ে বিছানায় পড়েছিল কৌশিক। একটা নির্লোম সাদাটে হাত বুকের ওপর অলস সাপের মতো এসে পড়েছিল।
মামা অবশ্য বলত, “কলকাতা শহরে এই জায়গার দাম জানিস?” কৌশিক কী করে জানবে! মামী রোজ দুপুরে কোথায় যেন যেত, খুব সেজে। অবশ্য তার জানার কথাও নয়। একদিন শুধু দুপুরে দোতলায় গিয়ে দেখেছিল, মামীর ঘরের দরজা অল্প খোলা। উঁকি দিতেই হাত পা ঠান্ডা। সাদা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে শ্বেত পাথরে গড়া মূর্তির মতো সোনামামী। তার ওপর একজন পুরুষ উবু হয়ে বসে। নির্দিষ্ট ছন্দে আন্দোলিত হচ্ছে দুটো শরীর। এক টুকরো সুতোও নেই কারোর গায়ে।
“ওহ সিট”, অচেনা পুরুষটি হিংস্র চোখে তার দিকে সটান তাকিয়ে। সোনামামীর চোখ দুটো যেন বিদ্রূপে হাসছে করি বরগা কাঁপিয়ে।
ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে জ্বরো রোগীর মতো কাঁপতে শুরু করেছিল কৌশিক। রাতে খেতেও যায়নি ওপরে।
“খুট”, মাঝরাতে দরজা খুলে গিয়েছিল। ঘরের রাত আলোয় বিছানার ঠিক সামনে সোনামামী। কাঠ হয়ে বিছানায় পড়েছিল কৌশিক। একটা নির্লোম সাদাটে হাত বুকের ওপর অলস সাপের মতো এসে পড়েছিল। হাতটা ক্রমশ বুকের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন খেয়ালে। গালের ওপর গাল নেমে এসেছিল নরম ওম ছড়িয়ে, “খেলে না যে? জ্বর?” ফিসফিস করে মিষ্টি সুরের সেতার বেজে উঠেছিল কানে। ভালোলাগার আবেশ তৈরি হওয়ার আগেই কৌশিক অনুভব করেছিল, আরেকটা হাত আরও গভীরে আরও নীচে নেমে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছিল কৌশিক। ছুঁচের মতো তীক্ষ্ণ কিছু ফুটে যাচ্ছে শরীরের নরমতম উপত্যকায়। কী ওটা? খোলা সেফটিপিন?
“চু-উ-উ-প।”
ক্রমশ অভ্যেস, যেন আফিমের নেশা। মামী ইচ্ছামতো ওষুধ দিয়ে একটা পশুকে ঘুম থেকে তুলত। কখনও তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে চিরে দিয়ে কৌশিককে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতে দেখে বিকৃতভাবে হেসে উঠত।
সেটাই প্রথম। তারপর আরও অনেক রাত। কাঠ হয়ে পড়ে থাকত কৌশিক। একটা ক্ষুধার্ত প্রাণী অদ্ভুত আক্রোশে ছিঁড়ে ফালাফালা করত তাকে। তারপর কাজশেষে কানের পাশে গরম নিঃশ্বাস ফেলে বলত, “খুউব ভালোবাসি তোকে। আর তুই?”
কৌশিক ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ত। ওর কানের ছড়ানো পাতা জ্বলে পুড়ে লাল হয়ে উঠত।
ক্রমশ অভ্যেস, যেন আফিমের নেশা। মামী ইচ্ছামতো ওষুধ দিয়ে একটা পশুকে ঘুম থেকে তুলত। কখনও তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে চিরে দিয়ে কৌশিককে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতে দেখে বিকৃতভাবে হেসে উঠত। একেক দিন কান্নায় ভেঙে পড়ত সোনামামী, “খুব কষ্ট হচ্ছে না রে? আমারও হয় জানিস?”
কৌশিক ভয়ে কাঁটা হয়ে তাকিয়ে থাকত।
মামীর ছুরিবেঁধা লাশ উদ্ধার হয়েছিল দীঘার কোনও একটা হোটেল থেকে। অনেক দূর জল গড়িয়েছিল। উঠে আসে সোনামামীর একাধিক সহচরের নাম। খুনী কে তা ধরা যায়নি। কৌশিক অবশ্য বড় রকম স্বস্তি পেয়েছিল। তবে অনেকদিন পর্যন্ত সে ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারত না। মনে হত শরীরে একটা শীতল ক্লেদাক্ত স্পর্শ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। এমনকি এখনও সেসব স্মৃতি মাঝে মাঝে ফিরে আসে দুঃস্বপ্ন হয়ে। একটা কাটা ফর্সা নরম হাত ঘুমন্ত সাপের মতো পড়ে আছে বুকের ওপর। একটু নড়লেই সেটা ফনা তুলে ছোবল মারবে। চমকে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠে বসে মাঝরাতে।

গৌতমীর ঘটনাটার পর কৌশিক বুঝেছে একটা যৌনবিকৃতি তার মধ্যেও শেকড় গেড়ে আছে। এটার জন্য চিকিৎসা হয়তো আছে। হয়তো কেন, নিশ্চয় আছে। একটা বড়মাপের ‘কিন্তু’ আছে সেখানে। সব কথা অন্য আরেকজনকে বলতে হবে, তৃতীয় কাউকে, যার সঙ্গে তার জীবনের যোগ নেই। কৌশিক গৌতমীকে বলতে পারেনি, সেই অবকাশই পায়নি। নবমিতাকেও প্রশ্নই নেই। কিংবা মানসিক শান্তি পেতে অন্য কাউকে! নাহ! মনের মধ্যে তল্লাশি করে সমর্থন খুঁজে পায় না কৌশিক। অনেকগুলো কার্ড ডায়রিতে রাখা আছে। মনোবিদের। যাওয়া হয়নি।
“কাঁদালে তুমি মোরে, ভালোবাসারই ঘায়ে…”
ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। এই রিংটোনটা নবমিতা নিজের নম্বরে সেট করে দিয়েছে। না, কৌশিক ফোনটা ধরবে না। দোকানে এলেও সেভাবে কথা বলবে না নবমিতার সঙ্গে। এড়িয়ে যাবে, দূরে সরে যাবে ক্রমশ।
শাওয়ারটা চালিয়ে দিল কৌশিক। ঠান্ডা জলধারা সূচের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বিঁধে যেতে লাগল শীতে কণ্টকিত চামড়ার ওপর। ধুয়ে যেতে লাগল শরীর আর মনের ভাপ।
“আগে বিডন স্ট্রিটে থাকতে? অমন খাস কলকাতা ছেড়ে এই দক্ষিণ শহরতলীর ধ্যরধ্যরে জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছ?”
নবমিতার প্রশ্নে একটু হাসল কৌশিক। রান্নাঘর থেকে ডিমের ঝোল ফোটার খিদে চাগাড় দেওয়া গন্ধ ভেসে আসছে। এক সপ্তাহের ওপর দোকানে যায়নি কৌশিক। নবমিতার উৎকণ্ঠা ফোনে ভেসে এসেছিল, “কী হল? দোকানে আসছ না?”
“ওই জ্বর একটু।” যথেষ্ট কমিয়েই বলেছিল কৌশিক। ধুম জ্বর, সঙ্গে বেদম রাত জাগানি কাশি, বুকে চাপ হয়ে থাকা শ্বাসকষ্ট এসব কিছুই বলেনি। অবশ্য এন্টিবায়োটিক খেয়ে এখন একটু ভাল আছে। ঋতুবদল এতটা কাবু অনেকদিন করেনি।
“আমি যাচ্ছি। তোমার আস্তানায় কীভাবে যাব বলো?”
“না, আসবে না” আর্তনাদের মতো শুনিয়েছিল কৌশিকের আপত্তি।
“আচ্ছা”।
শাওয়ারটা চালিয়ে দিল কৌশিক। ঠান্ডা জলধারা সূচের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বিঁধে যেতে লাগল শীতে কণ্টকিত চামড়ার ওপর। ধুয়ে যেতে লাগল শরীর আর মনের ভাপ।
দোকানে গিয়ে ফদার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সোজা চলে এসেছিল নবমিতা। এতটা বাড়াবাড়ি কৌশিক আশা করেনি। কিংবা হয়তো করেছিল ভেতর ভেতর।
একার জন্য উঠে ভাত করতে ইচ্ছে হয়নি এ কদিন। যেদিন ভোররাতে মাথা যন্ত্রণা করে আর মুখ চোখ জ্বালা করে জ্বর এল সেদিনটা শুধু জল আর বিস্কিট ছাড়া কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। বিকেলে ধুঁকতে ধুঁকতে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধ কিনে আনার সময়ে রাতে রুটি তরকারিও কিনে এনেছিল। একটা রুটি খাওয়া হয়েছে। বাকি পড়েছিল টেবিলের ওপরেই। এ কদিন বিস্কিট মুড়ি আর ফ্রিজে থাকা মিষ্টির ওপরই চলছে।
নবমিতা ঘরে পা দিয়ে প্রথমেই ঝাঁট দিয়ে ধুলো, ওষুধের ব্যবহৃত ফয়েল, পচা আধ খাওয়া রুটি তরকারি সব এক জায়গায় করে একটা প্লাস্টিকে ভরে দরজার পাশে রেখেছে, “কাল কোনও একসময়ে ভ্যাটে ফেলে এস”। বেশ অভ্যস্ত হাতে রান্নাও বসিয়ে দিয়েছে। ফ্রিজে অবশ্য ডিম আর আলু ছাড়া কিছুই ছিল না।
নবমিতা রান্না শেষ করে পান্নাসবুজ ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে ঘরে এল। একটু হেসে বলল, “আমার মা বলে রান্নায় শাঁখা ধোয়া জল পড়লে সোয়াদ হয়। খেয়ে দেখো আমার রিস্টলেট ধোয়া জলের গুণে তোমার চেয়ে ভালো রান্না হয়েছে কী না।”
ছায়াছবির মতো নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে প্রথাগতভাবে কেউ কাউকে প্রেমের প্রস্তাব না দিলেও সম্পর্কটা যে সেদিকেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে সেটা দু’জনের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যেত, যাওয়ার কথা ছিল।
নবমিতার কাঁধের কাছে সাদা অন্তর্বাসের ফিতে সামান্য উঁকি দিচ্ছে বেখেয়ালে। কৌশিক দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে একঝলক তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “তুমি শুধু শুধুই এলে। এখন তো আমি অনেকটাই ভাল আছি।”
“যখন খারাপ ছিলে তখন আমায় ডেকেছিলে?”, নবমিতা ভাসা ভাসা চোখে হালকা অভিমানের নকশা।
কৌশিকের মনের ভেতরটা একবার পাক খেয়ে দুলে উঠল। প্রায় ছ’মাস নবমিতার ডাকে সে অনেক জায়গায় গেছে। ছায়াছবির মতো নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে প্রথাগতভাবে কেউ কাউকে প্রেমের প্রস্তাব না দিলেও সম্পর্কটা যে সেদিকেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে সেটা দু’জনের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যেত, যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা কৌশিকের জন্য নয়। সেটা বুঝতে হবে, আর এই মেয়েটাকেও বোঝাতে হবে। জ্বরে যখন মাথা তোলার ক্ষমতাও ছিল না, তখন অনেকবার কৌশিকের মনে হয়েছিল নবমিতাকে একবার ডাকবে। কিন্তু ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারা বড্ড কঠিন। গৌতমীর দৃষ্টি সে নবমিতার চোখে দেখতে পারবে না। যদি আবার ভুল হয়!

কৌশিক নির্বাক দৃষ্টিতে নবমিতার দিকে তাকিয়ে রইল। নবমিতা এগিয়ে এসে তার অল্প ফোলা ফোলা নরম আঙুলগুলো কৌশিকের চুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিল, “এখনও অল্প তাপ আছে গায়ে।” কৌশিক শিউরে উঠল। তার শরীর জাগ্রত হতে শুরু করেছে। মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সরীসৃপটা এবার যদি আবার একটা ধর্ষকামী জন্তুকে টেনে বের করে আনে! কৌশিক চোখ বন্ধ করে কাঠের মতো নিস্পন্দভাবে মাথায় সেই নরম হাতের সেবাস্পর্শ উপভোগ করতে লাগল। হাত বাড়িয়ে ওই সেবাপরায়না হাত দুটোকে একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করল ভীষণ।
“তোমার মুখটা খুউব ইনোসেন্ট।” তরল সুরে বলল নবমিতা। কৌশিক চমকে উঠল। তাহলে নবমিতা কি ওই বিষাক্ত মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না! সে কি তাহলে এতদিন ঘুমিয়ে থেকে ঘুমের মধ্যেই মরে গেছে। মরা মানুষের মুখটা খুব সুন্দর হয়ে যায়। সোনামামীর রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মৃতদেহের মুখটা অবিকল প্রতিমার মতো। একটু বিকৃত হয়ে গিয়েছিল দেহটা। পচা গন্ধ আসছিল আতরের গন্ধ ছাপিয়ে। কিন্তু অল্প হাঁ করা কালচে ঠোঁটে সেই বিষাক্ত হাসি একটুও লেগে ছিল না।
কৌশিক খুব সন্তর্পণে নবমিতার হাতটা টেনে নিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখল। কৌশিকের শরীর এখন পূর্ণ জাগ্রত। চোখ খুলে সে দেখল নবমিতা গাঢ় চোখে চেয়ে আছে। কৌশিক নিষ্পলকে সেই হরিণীর মতো আয়ত সুন্দর চোখের মায়ায় আর্দ্র হয়ে উঠতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “চল এবার তোমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। বিকেল হয়ে গেছে। তোমার ফিরতে রাত হয়ে যাবে।”
নবমিতার চোখে হালকা অতৃপ্তি মুহূর্তের জন্য ছায়া ফেলে মিলিয়ে গেল। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ, বাড়িতে বলে এসেছি বন্ধুর বাড়ি গ্রুপ স্টাডি করতে যাচ্ছি। দেরি হলে চিন্তা করবে মা।”
কৌশিকের বুকের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিল নবমিতা। কৌশিকের মনে হল একটা ভার নেমে গেছে বুক থেকে। বুক ভরে স্বাভাবিক নির্বাধ ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে পরে থাকা পোশাকের ওপর একটা চাদর জড়িয়ে নিল সে। নবমিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এরপর আবার কবে আসবে?”
ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নবমিতা মৃদু হাসল।
একটু পরে পরতে পরতে কালির পোঁচে ঘন কালো হয়ে উঠবে রাত্রি। সেই গাঢ় কালোর মধ্যে কড়ির মতো সাদা চোখওয়ালা বিষধর বিবর থেকে বেরিয়ে এসে চেরা জিভ দিয়ে বিষদাঁত শানাবে।
বিকেলটা লালচে আলোর মিহি পর্দার আড়ালে চলে গেছে। একটু বাদেই শিরীষ গাছের ওপরে লেগে থাকা সিঁদুরে লাল সূর্যটা রেল স্টেশনের ছাউনির নীচে নেমে যাবে। দুপুরের কয়েক ঘণ্টা যেন একটা সুন্দর ঘোরমাখা স্বপ্নের মতো ছিল। তার কপালছোঁয়া চুলে এখনও নবমিতার স্পর্শ লেগে আছে। নবমিতাকে ফেরার ট্রেনে তুলে বিকেলে একা হেঁটে ফাঁকা ফ্ল্যাটে ফিরতে গিয়ে মনের মধ্যে একটু ব্যথিয়ে উঠল যেন। সানাইয়ের সুরের মতো নোঙর ফেলা অদ্ভুত মন খারাপ। বিকেলের লজ্জারুন মুখটা বড্ড বিষণ্ণ। এটাই হয়তো সেই ‘মনখারাবিয়া লাল রঙ’। তারিয়ে তারিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। ধুলোমাখা পিচের রাস্তা, পথের ধারের পাতা ছড়ানো অশ্বত্থগাছ, সব কিছুর ওপরেই নরম করে সেদ্ধ করা ডিমের কুসুমের মতো লালচে রঙের মায়া ছড়িয়ে আছে। রঙ বেরঙের আকাশে কালো উড়ন্ত বিন্দু তৈরি করে পাখিরা বাসায় ফিরছে।
একটু পরে পরতে পরতে কালির পোঁচে ঘন কালো হয়ে উঠবে রাত্রি। সেই গাঢ় কালোর মধ্যে কড়ির মতো সাদা চোখওয়ালা বিষধর বিবর থেকে বেরিয়ে এসে চেরা জিভ দিয়ে বিষদাঁত শানাবে। সব রঙিন স্বপ্নকে রক্তাক্ত করে দুঃস্বপ্নে বদলে দেবে। কিন্তু কৌশিক এবার তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করবে, সর্বশক্তি দিয়ে। এতদিনের বয়ে বেড়ানো অভিশাপ থেকে এবার মুক্তি হবেই।
অস্তরাগের লাল আলো গায়ে মেখে কৌশিক নির্জন রাস্তা দিয়ে দ্রুত পায়ে ফেরার পথ ধরল।
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

হৈমন্তী ভট্টাচার্য
হৈমন্তী ভট্টাচার্য, পেশায় শিক্ষিকা। মূলত নিবিড় পাঠক। রঙের বাহারে প্রকৃতির ছবি আঁকা এবং কলমে ভাবনাকে রূপ দেওয়া তার প্যাশন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও বিভিন্ন সংকলনে তার লেখা প্রকাশিত।