টানা দেড় সপ্তাহ বৃষ্টির পর আংরেজ বিবি যখন মারা গেলেন তখন সারা গ্রামের মুখ চুন। মাঠ, ঘাট, উঠোন মায় সারা গ্রাম পানিতে তমতম করছে। কোনটি রাস্তা আর কোনটি পুকুর সহজে তা অনুমান করা যাচ্ছে না। এই তো, গতরাতে শেষ-দেখা দেখতে আসবার সময় মুরুব্বিরা দিক ভুল করে সটান নেমে পড়েছিলেন পুকুরে। হায় আল্লা, সকলে তাই মাথায় হাত দিয়ে ভেবেছিল, কতদিনকার বুড়ি মরবার আগে কেমন খেল দেখিয়ে যাচ্ছে দেখো!
তবে আংরেজ বিবি বেশিক্ষণ তেমন খেল দেখাতে পারেনি। ভোরের বেলা তার ইন্তেকাল হয়ে গেল। এখন হামিরুদ্দিনের ভাবনা তাই অন্য লেভেলে চলে গেছে। সে ভাবছে, এত পানিতে আংরেজ বিবিকে গোর দেওয়া হবেই বা কোন উপায়ে! যতই মাটি কাটা হচ্ছে, খালি পানি বেরিয়ে আসছে। খড় বিছিয়ে তাতে বালি ফেলেও সেই পানি আটকানো যাচ্ছে না। (Story)
আংরেজ বিবি বেশিক্ষণ তেমন খেল দেখাতে পারেনি। ভোরের বেলা তার ইন্তেকাল হয়ে গেল।
৯৫ বছরের আংরেজ বিবিকে খাট থেকে নামিয়ে মেঝেয় চাদর পেতে শোয়ানো হয়েছে। তার চোখ বন্ধ, মুখ ঈষৎ খোলা। দেখলে মনে হবে, এই কদিনের যতসব কালো কালো মেঘ ঐটুকু খোলা গালের ভেতর দিয়ে অনবরত আসা-যাওয়া করছে মন্থর গতিতে।
ঘরের মধ্যে পাখা চলছে। টানা বৃষ্টিতে কাহিল মানুষেরা ফোঁৎ ফোঁৎ করে সর্দি টানছে। এই সমবেত নাক টানার শব্দে একধরণের মরা-বাড়ি মরা-বাড়ি ব্যাপার তৈরি হয়েছে বটে। তবে যেহেতু আংরেজ বিবি একজন বুড়ি এবং তার তিন কূলে কেউ নেই – তাই সকলে মুখ চুন করে ভাবতে বসেছে বুড়িকে গোর দেওয়া হবে কোন উপায়ে?
এদিকে কবর কাটা তো দূরের ব্যাপার, এখন লাশকে গোসল করানোও কম ঝক্কির নয়। গোসলের পানি গড়িয়ে গিয়ে পড়বে তো সেই উঠোনের জমা পানিতেই। তারপর সেই নাপাক পানি কোথায় মিশে গিয়ে কতদূর অব্দি ঘাপচি মেরে থাকতে পারে – তা কেই বা জানে!
যার জন্য এত চিন্তা, সেই আংরেজ বিবির এসবে কোন চিন্তা নেই। সে টান টান হয়ে শুয়ে আছে। হাত-পায়ের কোমলতা, যতখানি দেখা যায়, তা আর নেই। তা বুড়ির মধ্যে কোমলতা ছিলই বা কবে?
হামিরুদ্দিন বরফ কিনে আনবার প্রস্তাব দিল। দেড় সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি বিয়ানোর পর আকাশ এখন খানিক ক্লান্ত। তবে ঘোর কাটেনি আসমানের। যেকোনও সময় আবার বৃষ্টি নেমে আসতে পারে।
মুরুব্বিরা বিবেচনা চালায়। এই লাশ কতদিন এইভাবে গোরের অপেক্ষায় শুয়ে থাকবে, তার কোনও মিমাংসা পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।

একবার দমকা হাওয়া এসে জানলার পাল্লা নাবিয়ে দিল। সকলেই তটস্থ হয়ে উঠেছিল সেই হাওয়ায়। তবে এই হাওয়ার মধ্যে নিশ্চয় কিছু একটা ছিল, তা না হলে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে মুরুব্বিরা গোর দেওয়াকে আল্লার ওয়াস্তে ছেড়ে দিয়ে এখন আংরেজ বিবির নামের ব্যুৎপত্তি নির্মাণে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল কোন আছিলায়? মৃতদেহের কাছ থেকে অনুমতি আদায়ের রীতিনীতি আমাদের নেই। তাও মুনির আলি চোরা চোখে একবার আংরেজ বিবিকে দেখে নিয়ে টুপিটা খুলে নিলেন। তারপর দাঁতের ফাঁকে আঁটকে যাওয়া সুপুরির টুকরোটাকে ম্যানেজ করে ঘোর লাগা আসমানের দিকে তাকালেন। আসমান যেহেতু কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো এবং অপরিবর্তনীয়, ফলে আসমানকে সাক্ষী হিসাবে ধরে নিতে পারলে তার সব দাবীই যে একপ্রকারে প্রমাণিত হয়ে যাবে – তা তিনি ভালোই জানেন।
সেইসব কতদিনকার আগের কাহিনি!
মুনির আলি যেন নিজের ভেতরই নিজে ছিপ ফেলে এখন ফাতনাটার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। ফাতনাটা জলে ভাসছে। হাবুডুবু খাচ্ছে। বর্শিতে মাছ কখন মুখ লাগাবে, তা জানবার জন্য সকলেই অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
তখন তিনি সবে প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েছেন। টিনের বাক্সের ভেতর বইখাতা নিয়ে, বগলে মাদুর চেপে স্কুলে যেতে হয়। সুদীর্ঘ দীঘির পাশ দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে স্কুল যাওয়ার সময় মুনির আলি বারবার দীঘিটার ওপারে তাকাতেন।
দীঘিটার ওপারে একটা প্রকান্ড আমগাছ। আমগাছটার আড়ালে একটা ঘুপচি মতো ঘর সবসময় লুকিয়ে থাকে যেন। ঐ ঘরটাই আংরেজ বিবির আস্তানা।
তখন তিনি সবে প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েছেন। টিনের বাক্সের ভেতর বইখাতা নিয়ে, বগলে মাদুর চেপে স্কুলে যেতে হয়।
আংরেজ বিবি কে? এই সম্পর্কে মুনির আলির কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবু এই ঘর, ঐ গাছ, ঐ দীঘির অস্তিত্ব তার মধ্যে অনেক পুরনো দিনের, যে সময়ে তার জন্ম হয়নি, সেই সময়ের বাতাবরণ তৈরি করত। তবে কি মুনির আলি আংরেজ বিবির মধ্যে নিজের অনুপস্থিতিটাকেই টের পেত? সে-যা-হোক, অত সকালে কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটলে পরে সে দেখা পেত আমগাছটার তলায় একটা শিয়াল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে।
আবার কখনও, হয়তো বা একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছে সে, বইয়ের পৃষ্ঠার দিকে তাকালে টের পেত, চাল ফোটানো জলের মতো ঘোলাটে শাড়ি পরে ভারতবর্ষের ফ্ল্যাগ নিয়ে এগিয়ে চলেছে আংরেজ বিবি। ইংরেজদের গুলি খাওয়ার পরেও শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়িয়ে থাকবার কারণেই যে আংরেজ বিবির নাম আংরেজ বিবি রাখা হয়েছিল – এই নিয়ে তার মনে তখন কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ ছিল না।
কিন্তু এই গ্রামে সাদা চামড়ার মানুষেরা এলোই বা কবে? আর কখনই বা, ঘোড়ার পিঠে চাবুক ঘোরাতে ঘোরাতে নীলকর সাহেবরা ছুটে গিয়েছিল – তার কোনও হদিশ দিতে সকলেই অপারগ।
মুনির আলি যেন খেই হারিয়ে ফেললেন।
অতএব, আংরেজ বিবি কানে মোরগফুল গুঁজে দীঘির পার ধরে একা একা ঘুরে বেড়ায়, স্বপ্নে ও বাস্তবে।
দমকা হাওয়া এল। উঠোনের পানিতে ব্যাঙাচিরা বুদবুদ তুলল। আর মুনির আলি সমেত সারা গ্রাম বুড়ির লাশ নিয়ে বসে থাকল আসমানের তলায়।
একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছে সে, বইয়ের পৃষ্ঠার দিকে তাকালে টের পেত, চাল ফোটানো জলের মতো ঘোলাটে শাড়ি পরে ভারতবর্ষের ফ্ল্যাগ নিয়ে এগিয়ে চলেছে আংরেজ বিবি।
সেবার হল কী, বছর দুয়েক ধরে ফলন না হওয়ায় আমগাছটার ডালপালা ছেটে দেওয়া হয়েছিল। ন্যাড়া গাছটা কেমন চুলছাঁটা বালকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এতদিন ধরে নিজেকে গাছটার আড়ালে রেখে দেওয়া আংরেজ বিবির আস্তানাটা হঠাৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ল।
আংরেজ বিবির ওঠা-বসা, চলন-গমন সব দীঘির ওপাশ থেকে নজরে এল।
আংরেজ বিবি তখন যুবতী। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় দীঘির জল চকচক করে উঠল।
রাত গভীর। শুনশান গ্রামের ভেতর দিয়ে কার পায়ের শব্দ আসে।
পাতলা ঘুম আংরেজ বিবির। ঘুম ভাঙলে শুনতে পায় তার ঘরের পাশে শুকনো পাতা মড়মড় করে ভাঙছে। দূর থেকে, কত দূরের কোন জঙ্গল থেকে বুঝি শিয়ালের ডাক এল। তারপর আবার নিশ্চুপ। যেন কেউ দাঁড়িয়ে থেকে নিঃশ্বাস ফেলছে। তারপর ধীরে ধীরে, অতি ধীরে রাত্রি ফর্সা হয়ে এল।
মাঝে মাঝেই আংরেজ বিবির এমন করে ঘুম ভেঙে যেত। শিয়াল ডাকছে – কী অদম্য সেই ডাক। সে কান পাতে – বুঝতে পারে, অন্ধকারে মিশে আছে যে মানুষ, তার ইশারা পেলে তবেই জঙ্গলের জীবজন্তু রাতের বেলায় অর্ধগোলাকার চাঁদের দিকে তাকিয়ে এমন করে ডেকে উঠতে পারে অনায়াসে।
এমনকি দিনের বেলাতেও, হয়তো সে দীঘির জলে স্নান করতে নেমেছে, আচমকা খোলা পিঠের উপর মানুষটির নিঃশ্বাস টের পেত।
থাকতে থাকতে সে চমকে উঠত।
কে? সে চারদিকে তাকাত।
কোনও উত্তর আসত না।
অন্ধকারে মিশে আছে যে মানুষ, তার ইশারা পেলে তবেই জঙ্গলের জীবজন্তু রাতের বেলায় অর্ধগোলাকার চাঁদের দিকে তাকিয়ে এমন করে ডেকে উঠতে পারে অনায়াসে।
মোনয়ারার বিয়ের আগের দিন। সন্ধ্যেবেলা তাকে ডালিম গাছের তলায় বসিয়ে মেহেন্দি পরানো হচ্ছে। পাশেই হ্যাজাক জ্বলছে। হ্যাজাকের আলোয় মোনয়ারার ঠোঁট দুটোকে কাঁপতে দেখা যায়। তাকে ঘিরে আছে যে পাঁচ-ছয় জন সই, তাদের মধ্যেও বুঝি মোনয়ারার অস্থিরতা ছোবল মারল।
মেয়েটির মাথায় জবজবে তেল লাগান হয়েছিল। সেই তেল থেকে বেরনো জুঁইয়ের গন্ধে চারদিক মাতোয়ারা। তখনি কামিনীদের মধ্যে থেকে কেউ একজন গান গেয়ে উঠল –
মেহেন্দির হারা পাতারে, মেহেন্দির ঢোলাপাতা
মেহেন্দি কেবা তুলেরে, মেহেন্দি কেবা বাটে
মেহেন্দি ছেলেলাল তুলেরে, মেহেন্দি কামিনী বাটে
মেহেন্দি শিলে ফেলেরে, মেহেন্দির বাপ-মা কান্দে
মেহেন্দি হাতে দিয়েরে, মেহেন্দি ঝাঁপান খেলে।

গান শেষ হল না, হ্যাজাকের আলোয় ছাওয়াটা প্রকাশিত হল।
বজরু ডাকাত!
কে যেন চাপা স্বরে নাম উচ্চারণ করল।
মানুষটা এগিয়ে এল। আংরেজ বিবি আবার তার ঘাড়ে পরিচিত নিঃশ্বাস টের পেল।
মানুষটা চলে গেলেও আংরেজ বিবি তার ঘাড়ে ও বুকে নিঃশ্বাসের অনুভূতিটা বয়ে বেড়াল কতক্ষণ!
এই কী সেই বজরু ডাকাত যার ইশারায় জঙ্গলের শিয়ালেরা ডেকে উঠতে পারে রাতেবিরেতে?
এই কী সেই বজরু ডাকাত যে ওয়াগন লুঠ করবার পর গৃহস্থের কুঁয়োয় লুকিয়ে ছিল সাতাশ দিন?
তারপর কুঁয়ো থেকে উঠে এসেছিল যখন, দেখা গেল – একজন আদিম পুরুষ, প্রখর রৌদ্রে, বিবস্ত্র দেহে হেঁটে চলেছে একা – তাকে ছুঁয়ে দেখবার সাহসটুকুও কারো নেই!
এই কী সেই বজরু ডাকাত যে ওয়াগন লুঠ করবার পর গৃহস্থের কুঁয়োয় লুকিয়ে ছিল সাতাশ দিন?
আংরেজ বিবির তখন নিজের ঘরটাকে ফানুসের মতো মনে হত। মনে হত বজরুর নিঃশ্বাসের তোড়ে তার ঘুপচি মত ঘরটা কোথায় কতদূর উড়ে যাবে কে জানে! এই ঘর ছেড়ে সে যাবেই বা কোথায়। তাছাড়া শিয়ালের ডাক শুনতে সে কি নিজেই উদগ্রীব নয়?
বর্ষা নেমেছে। এই সময় দীঘির পাড়ে কলমি শাক হয়। সেই শাক জলে ফুটিয়ে, ভাতের সঙ্গে মেখে নিয়ে দিন গুজরান চলে আংরেজ বিবির। ঘরের সামনে একফালি মতো জমি ছিল। সেইখানে মাচা বেঁধেছিল সে নিজ হাতে। এখন সেই মাচায়, লাউপাতার ফাঁকে ফাঁকে দুটো-তিনটে পুরুষ্টু লাউ ঝুলতে দেখা যায়।
দুপুরের রোদ মাচার নিচে নেমে এলে আর অতটা সপ্রতিভ থাকতে পারে না। তখন হয়তো, ঠান্ডা আলোয়, সেইখানে কোনদিন জিরোচ্ছিল আংরেজ বিবি। আচমকা সে দেখতে পেয়েছিল, একটা লাউ-ডগা সাপ লিকলিকে ডাঁটির সঙ্গে মিশে গিয়ে পুরুষ্টু ফলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সন্তর্পণে।
সাপের এমন ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণকে অস্বীকার করতে পারেনি আংরেজ বিবি। সে সারা বিকেল জুড়ে দীঘির পাড়ে ওৎ পেতে বসে থাকে। তারপর কোনওক্রমে কাছিমের ডিমগুলোকে সংগ্রহ করতে পেরে দিগ্বিদিক শূন্য দেখে। ঘরে ফিরে সেগুলো সযত্নে জানলার পাশে এমন ভাবে সাজিয়ে রাখে যাতে দেখলে মনে হবে কোনও এক অতিথির জন্য সেগুলি অপেক্ষা করছে।
এই সময় দীঘির পাড়ে কলমি শাক হয়। সেই শাক জলে ফুটিয়ে, ভাতের সঙ্গে মেখে নিয়ে দিন গুজরান চলে আংরেজ বিবির।
রাতের বেলা সেই ডিম গুলোর উপর চাঁদের আলো এসে পড়ত।
দুটো রাত, তিনটে রাত কেটে গেল। কোনও শিয়াল ডেকে উঠল না।
ডিমগুলো তেমনই শান্ত ও নিরুপদ্রুপ রয়ে আছে।
তারপর একদিন, মধ্যরাত তখন, শিয়ালেরা ডেকে উঠল। আংরেজ বিবি সবে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল। সে চোখ খুলতেই বুঝতে পারে জানলার পাশেই মানুষটি অপেক্ষমাণ। মানুষটির উষ্ণতা এসে পড়ছে ডিমগুলোর গায়ে। এত উত্তাপে, তবে কি, ডিম ফুটে কাছিমের বাচ্চাগুলো কিলবিল করতে করতে বেরিয়ে আসবে দুনিয়ার মাটিতে?
আংরেজ বিবির তখন বয়স কম। তার চোখটিও যুবতী। ফলে দু-চোখ দিয়ে পানি নেবে এল অনায়াসে।
সে জানলার কাছে গেল। একটা কণ্ঠ তাকে নির্দেশ দিল, এসো।
কোথায়?
আর কোনও উত্তর আসল না।
আংরেজ বিবি ধীর পায়ে দরজা পেরল।
আংরেজ বিবির তখন বয়স কম। তার চোখটিও যুবতী। ফলে দু-চোখ দিয়ে পানি নেবে এল অনায়াসে।
জ্যোৎস্নার আলোয় বেগুন ক্ষেত ভেসে যাচ্ছে। দীঘির খানিকটা অংশ জুড়ে পানিফল চাষ করা হয়েছিল। পানি ফলের কাঁটাগুলো জীবিত জন্তুর মতো ভেসে আছে যেন।
সে পায়ের তলায় ভেজা ভেজা মাটির স্পর্শ পেল। একটা লক্ষ্মী পেঁচা তার ঘড়ের উপর দিয়ে উড়ে গেল। উড়ে গিয়ে দূরের গাছটায় গিয়ে বসল।
কোথায় এসেছি আমি? আংরেজ বিবি তার এতদিনের গ্রাম, গাছপালা কোনওকিছুকেই আর চিনতে পারল না।
সে খালি চারদিকে তাকায়। ক্ষেতের ওপাশে বুঝি কীসের এক অবয়ব দেখতে পেল।
কে? সে নিজের মনেই ডেকে উঠল।
এদিকে জ্যোৎস্নার আলোয় চারপাশ হাউইবাজির মতো উড়ে যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কে?
কোনও উত্তর এল না।
অনেক দূরে শিয়ালেরা ডেকে উঠল। তারপর অবয়বটা ক্রমশ স্পষ্ট হল।
ক্ষেতের ওপারে, রুপালি আলোয়, ঝকঝক করছে একটা কালো ঘোড়া। সেই ঘোড়ার উপর যে পুরুষটি বসে আছে – সে কী বজরু ডাকাত নয়?

মুনির আলি মুচকি হাসলেন এবার। এইসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না। আংরেজ বিবি বজরু ডাকাতের সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য হলেও গায়েব হয়েছিল কী না, তা যেন অমিমাংসিতই থাকুক – এই তার ইচ্ছা।
আংরেজ বিবিকে গোসল করানো হয়ে গিয়েছিল আগেই। এখন মসজিদ থেকে খাট এনে তাকে সেই খাটে শোয়ানো হয়েছে। খাটের নিচে দুটো বরফের স্লাব রাখা। যাতে দেহটির পচন মন্থর গতিতে ঘটে।
মাঝে মাঝেই দমকা হাওয়া দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই সকলে আসমানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মেঘের গতিপ্রকৃতি।
আর এই সব কিছুকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কখন যে কোন এক আদিম পুরুষ আংরেজ বিবির কানে মোরগফুল গুঁজে দিয়ে চলে গিয়েছে তা কেউ খেয়াল করেনি।
হাওয়ায় ফুলটি ধীরে ধীরে, অতি ধীরে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

সাদিক হোসেন
লেখক পরিচিতিঃ
সাদিক হোসেন - ১৯৮১ সালের ১১ই ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগণার মহেশতলায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইনফর্মেশন টেকনলজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে ছিলেন। কিন্তু এই পড়াশোনা ব্যবহারিক অর্থে বৃথা যায়। পরবর্তীকালে মাল্টিমিডিয়া চর্চা করে বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।
দেবতা ও পশুপাখি (কবিতা সংকলন, ২০০৭) সম্মোহন (গল্প সংকলন, ২০১১), মোমেন ও মোমেনা (উপন্যাস, ২০১৪), গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময় (গল্প সংকলন, ২০১৪), রিফিউজি ক্যাম্প (গল্প সংকলন, ২০১৭), মোন্দেলা (উপন্যাস, ২০১৯), হারুর মহাভারত(গল্প সংকলন, ২০১৯), আনন্দধারা (গল্প সংকলন, ২০২২) – এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকায়।
‘সম্মোহন’ বইটির জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি যুবা পুরস্কার (২০১২) ও ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার। ‘গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময়’ বইটির জন্য পেয়েছেন নমিতা চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০১৫)। ছোটোগল্পের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সোমেন চন্দ পুরস্কার(২০২৪)।
One Response
খুব ভাল বুনট এবং গতিতে গল্প পৌঁছলো শুরুর শেষে — আর কিছু বলছি না।