ফনফনে বায়ু, থইথই জল। কর্দমাক্ত ড্রেন, আদিগঙ্গার বক্ষ ভাসাইয়া বহতা স্রোতধারা যেমত অক্ষয় নারায়ণ, বালক শ্যাম তাহার দশমবর্ষীয় জীবনে এ প্লাবমান দেখে নাই। নগরীর অট্টালিকা সমূহ তরণীর ন্যায় ভাসমান, অনেকানেক হইয়াও নিঃসঙ্গ, চরাচরকে রিক্ততা প্রদান করিয়াছে। শ্যামের পদদ্বয়ের উপরিভাগ স্পর্শ করিয়া জল নামিয়া যাইতেছে সম্মুখের উন্মুক্ত ম্যানহোলের গহ্বরে, যাহার অন্তস্থ অন্ধকার দেখিয়া তাহার ভয় লাগিল, বিচারহীন অপ্রস্তুতি তাহাকে মায়ের হাত দৃঢ় মুষ্টিতে ধরাইল, শ্যাম অস্ফুটে বলিল– ‘বাবা, কত জল! আমাদের সেখেনে এমন বান আসে না কেন মা?’ (Story)
নগরীর অট্টালিকা সমূহ তরণীর ন্যায় ভাসমান, অনেকানেক হইয়াও নিঃসঙ্গ, চরাচরকে রিক্ততা প্রদান করিয়াছে।
‘চুপ করো বাবা, বলতে নেই ওসব। আমাদের গ্রামে এমন বান আসলে কেউ বাঁচব না।’ মা কাল্পনিক বন্যা ভাবিয়া শিহরিত হইলেন। উহাদের দলটিতে সংখ্যায় পাঁচজন, প্রৌঢ় কালাচাঁদ ব্যাপারী যাহার নেতা। তাঁহার পরণের লুঙ্গিটি মলিন, গণ্ডে শুষ্কতা, কৃষ্ণ বর্ণের উপর অক্ষৌরিত শ্মশ্রু একটি রুক্ষতা বহন করিয়া আনে। তাঁহার স্থিরতার পাশে যদু হাজরার চাপল্য এক কৌতুককর বৈপরীত্য আনে, কিন্তু তরুণ যদু কীই বা করেন, তাঁহার তো কলিকাতা আগমন এই প্রথম। ঊষার সমাগমের পূর্বেই বাহির হইয়াছেন তাঁরা। আছেন শ্যামের বাপ বৃষস্কন্ধ জনার্দনও, যদিও ক্ষণে ক্ষণে বিরক্তির সহিত জ্ঞাপন করিয়াছেন এরূপ ত্রাণে তাঁহার অনিচ্ছা। গতরাত্রের চোলাই মদ্যের খোঁয়াড়ি কাটে নাই, তদুপরি আসিবার সময়কালে দেখিয়াছেন প্রতিবেশী বলাই সামন্তর গরুটি সেই শেষ আঁধারেই বাহির হইয়া তাঁহার ক্ষেতের উপর হামলা চালাইতেছে। সেটিকে ধরিয়া আনিতে, খোঁটায় বাঁধিতে যেটুকু শ্রম, তাহাতে পরণের ধুতি কিঞ্চিত অগোছালো ও কর্দমাক্ত, যাহাতে বিরক্তি বাড়ে।
রক্তবর্ণ চক্ষু ঘুরাইতেছেন চারিপাশ, আর ক্ষণে ক্ষণে ভ্রুকুঞ্চন করিতেছেন পুত্রের প্রতি। সেই সুদূর গ্রাম হইতে এতসকল দ্রব্যাদি বহন করিয়া কলিকাতা নগরীতে আগমন বড় সহজ কার্য নহে, তদুপরি শ্যাম বায়না ধরিল সেও কলিকাতা যাইবে। ত্রাণে তাহার নির্লিপ্তি, বালকের অজ্ঞানতা ব্যতীত কীই বা বলা যায় ইহাকে, তথাপি কলিকাতার ফর্সা মানুষ সে দেখে নাই, জানে না উহারা কী খায়, কত কষ্ট উহাদের। এমত আমোদকে চোখ ঠারাইয়া মুখমণ্ডল আনত করিবার, ছদ্ম ব্যথাভারাতুর ওষ্ঠযুগল কুঞ্চনপ্রয়াস প্রৌঢ়ের সহজাত। লোক চরাচর যেমত ভ্রমর বিরহিত বৃহৎ পদ্মবনের ন্যায় সমাহিত, উহাতে বালকের প্রগলভতা কটু, সকলপ্রকার হিতৈষণা বিমূঢ় যাহাতে, তথাপি কেহই শ্যামকে ভর্ৎসনা করিলেন না। তাঁহারাও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা অবলোকনে মূক, এবং যদু হাজরা বলিলেন, ‘যেন বায়রনের ডার্কনেস কবিতা দেখছি কালাচাঁদদাদা! এ যে সত্যিকারের অ্যাপোক্যালিপ্স!’

কালাচাঁদ ব্যাপারী, যাঁহার জোতজমি নৌকো ও মাছধরার জালের প্রাচুর্যে স্থির গাম্ভীর্য, উত্তরে কহিলেন, ‘সডোম ও গোমোরা এভাবেই ধ্বংস হয়েছিল। যাকগে, সাউথ সিটি সামনেই, বুঝলি! তাড়াতাড়ি কাজগুলো সেরে ফেলি। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে জল থেকে হাজা ধরে যাবে পায়ে। আর শোন, ওরা হয়তো খেয়ে যেতে বলবে। না করিসনি, বুঝলি? যা দেবে, সোনামুখ করে খেয়ে নেব। নয়তো ভাববে, বেশি গুমোর দেখাচ্ছি, ভিক্ষে দিতে এসেছি। মানুষকে অপমান করে তো লাভ নেই, ঠিক কী না!’ ‘কী যে সব বলো না! ওদের ওই প্রিজার্ভেটিভ দেওয়া প্যাটিস আর জাংকফুড খেয়ে আলসার বাধাব না কী!’ বিরক্ত স্বরে কহিলেন জনার্দন।
জলনিমগ্ন সাউথসিটির অভ্যন্তরে দলটি প্রবেশ করিয়া দেখিল, হোন্ডা সিটি, ওয়াগনার ও বিএমডব্লিউ গাড়িগুলি শিশুহস্তের খেলনাসদৃশ ভাসমান, তাহাদের ছাদে উপবেষ্টনরত হাবা ও বুভুক্ষু নগরবাসী, ফেডেড জিনস কোনওক্রমে জলস্পর্শ নিরত, ভ্যাপা করুণতা উহাদের সর্বাঙ্গে। তাহাদের সে শূন্য দৃষ্টির অভ্যন্তর ফোঁড় দিয়া ভ্রমণ করিতে পারে বৎস্যহারা গাভীর স্বর, নিরন্ন গণ্ডদেশে পুষ্পের শুষ্কতা, অবসন্ন জটলাগুলি যাহারা গাড়ির ছাদে, ফ্ল্যাটবাড়ি গুলির কার্ণিশে, এবং ত্রাসিত সজাগ। কালাচাঁদদের দেখিয়া সকলে চকিত হইল। শ্যাম দেখিল, ক্রমে ক্রমে অস্পষ্ট কলরব কূজনের ন্যায় সঞ্চরণশীল, তাহাদের ত্রাণের বস্তা যেন বা একটি মনোরম মনোটোনাস দিবাভাগকে শস্যের সজীবতা প্রদান করিয়াছে। শ্যামের মা, তাঁহার হস্তে বালক ধৃত হইয়াই ছিল, পাছে এ বিজন অসভ্যতার প্রপাতস্রোতে ছিটকাইয়া পড়ে, অস্ফুটে বলিলেন, ‘দি ইন্সালটেড এন্ড দ্য হিউমিলিয়েটেড!’
শ্যাম দেখিল, ক্রমে ক্রমে অস্পষ্ট কলরব কূজনের ন্যায় সঞ্চরণশীল, তাহাদের ত্রাণের বস্তা যেন বা একটি মনোরম মনোটোনাস দিবাভাগকে শস্যের সজীবতা প্রদান করিয়াছে।
মানুষজন জল তাড়াইয়া তাঁহাদের দিকে অগ্রসর, পরণের ডেনিম শার্ট সিক্ত, শ্যাম্পুলাঞ্ছিত বীলিনপ্রায় কেশভাগ চকচকে মস্তকের লজ্জা পরিবর্ধন করিয়াছে, উলুক শালুক দৃষ্টি ফিরাইয়া ভয়ার্ত চোখে অনুভব করে নৈকট্য ও ত্রাতা–যাহার একপার্শ্বে মৃত্যু ও অপরপার্শ্বে অপমান, তবু হায়, ইহাদের কেহই নাই! প্রতি বৎসর বন্যায় করুণাহীন আদিগঙ্গা উপচাইয়া আসে, অনন্তর স্রোতধারা বহিয়া আনে পতনের বেদনা, সমগ্র নগরী যেন বা আপন গুরুভারে বহমান, অনন্তর কিছুমাত্র ক্লেশনিবারণের অবকাশ থাকিল না। তখন আকাশে মেঘ ছিল, তাহার ছায়া পড়িয়াছিল শ্যামের সম্মুখে, এবং একটি কৃষ্ণবর্ণ গুরুভার সমগ্র কলিকাতার বায়ুকে ক্রমে কর্দমাক্ত করিল, শ্যাম বুঝিল বৃষ্টি আসন্ন।

সম্মুখে দাঁড়াইল, যাহার নাম পরে জানা যাইবে মিস্টার বোস, তাহার চকচকে আফটারশেভ ক্ষুধার মালিন্যকে ঢাকিয়াছে। পরিধানের বহুমূল্য টাইটি অবিন্যস্ত। কালাচাঁদ উহাকে দেখিয়া নিজ লুঙ্গি হাঁটুর উপর কষিয়া লইলেন। বোসবাবু হাতজোড় করিল, ‘আসুন স্যার। আমিই আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। কীভাবে রয়েছি গত দুই তিন দিন, নিজের চোখেই তো দেখছেন। গ্রাউন্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাটগুলোতে জল ঢুকে গেছে। গাড়ির মাথায়, ফ্ল্যাটের কার্নিশে জায়গা নিতে হচ্ছে। দুদিন ধরে পেটে কিছু যায়নি, জলটুকু অবধি দিতে পারিনি বাচ্চাদের। তার ওপর মরা মাছ ভেসে আসছিল আদিগঙ্গা থেকে, খিদের চোটে গ্যাস জ্বালিয়ে সেগুলো ভেজে খেয়েছে কেউ কেউ। তারপর থেকেই, ইয়ে, ডায়রিয়া। ড্রেন উপচে গু-মুত- ইয়ে, সাবধানে, হ্যাঁ?’ নিরন্তর বাক্যস্রোতে অধিক মনোযোগ যেন বা শ্যামের মায়ের প্রতি, ফলত তিনি আপনার আকাচা শাড়িটুকু গুটাইয়া জড়সড় হইলেন। জনার্দন বিরক্ত হইয়াই ছিলেন, অতঃপর নাক হইতে ঘোঁত শব্দ করিয়া সঙ্গিনীর কানে কহিলেন, ‘বানে ভেসে গেছে সব, এদিকে ফ্লার্ট করবার অভ্যেসটুকু যায়নি।’
দুদিন ধরে পেটে কিছু যায়নি, জলটুকু অবধি দিতে পারিনি বাচ্চাদের। তার ওপর মরা মাছ ভেসে আসছিল আদিগঙ্গা থেকে, খিদের চোটে গ্যাস জ্বালিয়ে সেগুলো ভেজে খেয়েছে কেউ কেউ।
‘তুমি এত সিনিক কেন! শহরের লোক একটু সরল টাইপ হয়। অত বুঝে কথা বলে না।’
‘এবার এই স্টিরিওটাইপগুলো কাটাও বাপু ! জগদীশ গুপ্ত তো পড়েছ, জীবনানন্দের উপন্যাসগুলোও। শহরকে কম কুটিল বলে মনে হয়েছে কোথাও?’
‘বাদ দাও ওসব কথা। এদের দেখে কেমন করছে বুকের ভেতরটা। ভাবো তো, আমাদের ওই মাটির রান্নাঘর যদি জল ভেসে যায় এরকম? বা মূলী বলদদুটো যদি স্রোতের টানে ছিটকে যায়, কেমন লাগবে?’
‘কষ্ট হবারই কথা। ওই জন্য আসতে চাইনি। তোমদের এই উইকেন্ড ট্রিপে শহর দেখার বায়নাক্কা নিতে নিতে আর ভাল লাগে না।’ বিরক্ত জনার্দনের হাই উঠিল।
‘কেন? শীত পড়লেই তো তুমি নিজে বলো, কাকদ্বীপে সার্কাস পার্টি এসেছে, বেলাবেলি গিয়ে টিকিট কেটে আনি। আমার অতটা রাস্তা হাঁটতে ভাল লাগে না, তাও জোর করে নিয়ে যাও। আর এবেলা আমি ঘুরতে চাইলেই দোষ?’
কালাচাঁদকে বেষ্টন করিয়া পিপীলিকার ন্যায় মানুষ। শ্যামকে দূর হইতে লক্ষ্য করিতেছে কয়েকটি শিশু। একস্থানে জল কিছু কম, সেথায় বসিয়াছিল তাহারা, হাতে মোবাইল। ভিডিওগেম খেলিতেছিল বোধ হইল। খেলিতে খেলিতেই শ্যামকে দেখিল, ইতস্তত জটলায় নিবদ্ধ থাকিল নিজমধ্যে, সাহস হইল না নিকটে আসিবার। শ্যাম ফিসফিসাইয়া কহিল, ‘মা!’
‘যাও না বাবা, ওদের কাছে যাও। ভয় কী! কিচ্ছু বলবে না। ওরাও ইশকুলে পড়ে। তবে দেখো, রাজ্যের কাদা লাগিয়ে এসো না যেন! যা নোংরা চারদিকে!’
জগদীশ গুপ্ত তো পড়েছ, জীবনানন্দের উপন্যাসগুলোও। শহরকে কম কুটিল বলে মনে হয়েছে কোথাও?
শ্যাম ইতস্তত করিল। কালাচাঁদ ও যদু হাজরা ইতোমধ্যে বাক্যালাপ আরম্ভ করিয়াছেন মৃদুমন্দ- ‘বাঁদিকের প্যাকেটগুলোতে শুকনো খাবার, চিঁড়ে গুড় পাঁউরুটি ডিম। তার সামনে মহিলাদের, ইয়ে, স্যানিটারি ন্যাপকিন, যদি কাজে লাগে। খাবার জলের পাউচগুলো ঠেলাগাড়ি থেকে নামাতে হবে একটু কষ্ট করে, অনেক আছে। পঞ্চায়েত থেকেই নানা জায়গাতে অ্যারেঞ্জ করেছে ত্রাণ, বুঝলেন কী না! আমাদেরও তো দায়িত্ব আছে একটা। আমাদের গাঁ গঞ্জ থেকে আরও অনেকগুলো টিম বেরিয়েছে একসাথেই। মানিকতলা, বেহালা, চিতপুর গেছে। আমরা তেমন বুঝলে আবার আসব। ডাক্তার নিয়ে আসতে পারি। সবথেকে ভাল হয়, হাউজিং সোসাইটি থেকে যদি একটা ক্যাম্প করেন। ফ্রি-তে চেকআপের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
কৃতার্থ ভঙ্গীতে হাত কচলাইতেছিল বোসবাবু, আর চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট রুংতা সাহেব। বোসবাবু কহিল, ‘সবই তো দেখছেন স্যার। এবার আপনারা যা ভাল বুঝবেন। সরকার তো কিচ্ছুটি করেনি। কর্পোরেশন বেপাত্তা। বড় অফিসগুলোতে ত্রাণের খোঁজে গেছিলাম, দেখলাম তালাবন্ধ। আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনে জল ঢুকে গেছে। কাউন্সিলরকে বলতে গেছি, উলটে বলে- ইঞ্জিন আগে থেকে খারাপ ছিল না তার সার্টিফিকেট লাগবে। ভাবুন একবার! শহরের লোকেদের কেউ মানুষ বলে ভাবে না দাদা! হাইরাইজে থাকি তো, তাই আমরা কুকুর ছাগল। শুধু ভোটের আগে মনে পড়ে।’
সরকার তো কিচ্ছুটি করেনি। কর্পোরেশন বেপাত্তা। বড় অফিসগুলোতে ত্রাণের খোঁজে গেছিলাম, দেখলাম তালাবন্ধ।
বিপ্লবী যদু হাজরা, যিনি একদা কৃষকসভার নেতা, তদুপরি খেতমজুরদের লইয়া জঙ্গী আন্দোলনে জেল দেখিয়াছেন বহুবার, তেমন যদু, তাঁহার স্কন্ধোস্থিত গামছাখানি পাক মারিয়া মাথায় বাঁধিলেন, ‘আপনারা ভোট দেন কেন! আপনারা কি ভাবেন যে রিলিফ দিয়ে সব কিছু হবে? স্টেটের ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রামগুলোকে কার্যকর করবার জন্য চাপ দেওয়াটাও তো আপনাদেরই দায়িত্ব! আন্দোলন করানোটাও! শুধু রিলিফ দিয়ে–পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড ব্যাপারটা যদি না বোঝেন, যাকগে বাদ দিন, কাকে কী বলছি! মোদ্দা কথা যেটা, আপনারা স্থায়ী সমাধান, যেমন আদিগঙ্গার সংস্কার, নিকাশি ব্যবস্থা, এগুলোর দাবীতে কেন কাউন্সিলরকে ঘেরাও করছেন না?’
‘পেডাগজি– কী বললেন স্যার? বুঝলাম না’। ফ্যালফ্যালে প্রশ্ন করিল টাওয়ার বি-র অনিন্দ্য চ্যাটার্জি।
‘বুঝবেন না। যেটা বলছি করুন। এভাবেই উন্নয়ন আসে। রিলিফ দিয়ে আসে না। গাছ ফাছ লাগান, কলকাতার পূর্ব দিকটা গড়ানে, জল দাঁড়ায় না, ওখানে ছোট ছোট ক্ষেতখামার করতে পারেন, ভেড়িগুলোকে সংস্কার করান, আর ওখানকার ড্রেনগুলোকে মেরামত–ক্ষেতগুলো জল বইয়ে দেবে সোজা বিদ্যেধরীর দিকে, বুঝলেন?’

‘এসব কথা তুলে আর কষ্ট কেন দেবেন দাদা!’ ম্লান হাসিল বোসবাবু, ‘জানেন তো সবই। পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করা হচ্ছে ই এম বাইপাসের হোটেল আর হাইরাইজগুলোকে অধিগ্রহণ করে চাষের জমি করবার। কেউ শুনলে তো! দেখছেন না, বাবুবিবিরা আন্দোলনে নেমেছে! হাইরাইজ নাকি আমাদের পাঁজরার হাড়, সেগুলো ভেঙে দিয়ে উন্নয়ন করা চলবে না! কী আর বলব এদের! এই বিপ্লব ফিপ্লবের জন্যই আমাদের ছেলেমেয়েদের চাকরি হবে না, অন্য স্টেটে চলে যাবে।’
পশ্চাতে জবুথবু আদিগঙ্গা, সম্মুখে মৃত অজগরের ন্যায় প্রিন্স আনওয়ার শাহ রোড, নিমজ্জিত বাসটির উপর ভাসিয়া যাইতেছে পচা গাঁদার মালা, সারমেয়র শব ও পলিথিনের প্যাকেট। শ্যাম দেখিল, উহাদের প্রতি চাহিয়া চাহিয়া এক যুবাপুরুষ শ্বাপদ আক্রোশে থুথু নিক্ষেপ করিল। যুবার ক্লেশদীর্ণ পরিধান, মুখমণ্ডলে বুভুক্ষার চিহ্ন একটি দ্যুতি বহন করিয়া আনে, এবং মূল্যবান গাড়ির ছাদ হইতে সে নামিল না, যেন বা প্রাণপণে অগ্রাহ্য করিতেছে ইহাদের উপস্থিতি। ঝাঁপফেলা সারিবদ্ধ দোকানঘর, ঘুমন্ত বাসগাড়ির কংকাল ও কালাচ ছোপ হাইরাইজগুলির প্রেক্ষাপটে বিষণ্ণ যুবককে ক্রুদ্ধ দেবতা মনে হইল। শ্যাম ধীরপদে তাহার নিকট যাইল। যুবক বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাহাকে দেখিল, কিন্তু অবরোহণ করিল না।
সম্মুখে মৃত অজগরের ন্যায় প্রিন্স আনওয়ার শাহ রোড, নিমজ্জিত বাসটির উপর ভাসিয়া যাইতেছে পচা গাঁদার মালা, সারমেয়র শব ও পলিথিনের প্যাকেট
‘এটা কী গাড়ি?’
‘তা দিয়ে তোমার কী?’ খেঁকাইয়া প্রশ্ন করিল যুবক।
‘আমি কখনও এমন দেখিনি, তাই–‘
‘এসব তোমাদের দেখার জন্য না। এর নাম ব্রেজা। ডিজেলে চলে। তোমরা এসবের খবর আর কী রাখবে!’
শ্যাম বুঝিল না, উহার ক্রোধের উৎস কী! তবু একটি অদ্ভুত আকর্ষণ তাহাকে ধরিয়া রাখিল। সে প্রশ্ন করিল, ‘তুমি রাগ করে আছ কেন?’
কীয়ৎ নীরব রহিয়া যুবক বলিল, ‘তুমি বুঝবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ তুমি এখনও ছোট। শহর দেখতে এসেছ, বাবা মায়ের সাথে উইকেণ্ড ট্যুর করছ ত্রাণ দেওয়ার নাম করে, সেসব করে ফিরে যাবে তোমরা। গেটেড কমিউনিটি যে অন্ধকারে ছিল, সেখানেই থাকবে। তোমরা তো আর বুঝবে না, আদিগঙ্গা ভেসে যখন কাচা ড্রেন উঠে আসে, ময়লা জঞ্জাল, সাতদিন আগেকার ভাত তরকারি ভেসে বেড়ায়, লরি বাস মেট্রো সব বসে যায়, সিইএসসি সাতদিন অফ করে রাখে কারেন্ট–সেসব তোমরা দেখোনি। তোমরা শুধু দূর থেকে আহা উহু করবে।’
শহর দেখতে এসেছ, বাবা মায়ের সাথে উইকেণ্ড ট্যুর করছ ত্রাণ দেওয়ার নাম করে, সেসব করে ফিরে যাবে তোমরা
এ বাক্যে শ্যাম মন্ত্রমুগ্ধ, বোধের অপার এক অনুভূতি তাহাকে চলৎশক্তিহীন করিল, যেথায় অক্ষি বিস্ফারিত, ওষ্ঠাধর বিভক্ত, সময় দিকবিরহিত, এক অপার্থিব বিভূতি শ্রবণের ভাব তাহাকে আবিষ্ট করে। সে অস্ফুটে বলে, ‘আমি ইশকুলে পড়েছি। পড়ার বইয়ে। তোমাদের খুব কষ্ট। ওখানে ছবি আঁকতে দেয়, শহরের দৃশ্য। আমাদের বলেছে, গিয়ে বানভাসি শহর দেখে এসে সে ছবি আঁকতে। যার ছবি ফার্স্ট হবে, সে প্রাইজ পাবে।’
ঠোঁট বেঁকিয়া উঠিল যুবকের–‘সে জন্যে এসেছ?’
‘নাহ, আমি তো ভিক্টোরিয়া দেখব, হাওড়া ব্রিজ দেখব–‘
‘সব ভেসে গেছে, সব। ভিক্টোরিয়ার পুকুরের হাঁসেরা জলে ডুবে মরে গেছে, বুঝলে?’ ধমকাইয়া উঠিল খানিক, শ্যাম ত্রস্ততায় দুই পা পিছাইল, ‘যাও গিয়ে থইথই জল এঁকে এসো। তারপর তোমাদের বাবা কাকারা এখানে এসে আমাদের জ্ঞান দেবে, আরবান ডেভেলপমেন্ট কীভাবে হতে পারে। জোসেফ নিডহ্যাম ঝাড়বে, নয়তো অমর্ত্য সেন। ওসব নাম আমরাও কিছু কিছু শুনেছি, বুঝলে? আমাদের অত বোকা ভাবার কিছু নেই।’
‘তুমি আমাকে বকছ কেন?’ কাঁদো কাঁদো হইয়া প্রশ্ন করিল শ্যাম, এবং যুবক নরম হইল।
‘আচ্ছা আর বকব না। তোমার নাম কী?’
‘শ্যাম।’
‘আচ্ছা শ্যাম, চলো তোমাকে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই। কোল্ডড্রিনক্স খাবে? আর তো কিছু দেবার মতো নেই! ফ্রিজও বন্ধ, ঠান্ডা হবে না। সসেজ ভেজে দিতে পারি, এখনও নষ্ট হয়নি। আর নয়তো কর্নফ্লেক্স ইন ইওগার্ট। খাবে? মুখ দেখে তোমার মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে।’
‘এগুলো কী খাবার? আমি নাম শুনিনি।’
আরবান ডেভেলপমেন্ট কীভাবে হতে পারে। জোসেফ নিডহ্যাম ঝাড়বে, নয়তো অমর্ত্য সেন। ওসব নাম আমরাও কিছু কিছু শুনেছি, বুঝলে? আমাদের অত বোকা ভাবার কিছু নেই।
‘ভয় নেই, অসুখ করবে না। একদিন দেখোই না, আমরা কী খেয়ে বেঁচে থাকি। পরে না হয় স্কুলে গিয়ে রচনা লিখবে।’ হাসিল যুবক এই প্রথম, শ্যাম শুনিল সে হাস্যে ঝিকাইয়া উঠিয়াছে গুমোট মেঘ। শ্যাম অগ্রসর হইল, তাহার পশ্চাতে মা-কে ঘিরিয়া একপাল মেয়েবউ সেলফি তুলিতেছে। উহাদের পরণের পাজামা, কিমোনো ও স্কার্ট কিছুবা উজ্জ্বল, উহাদের মুখমণ্ডলে প্রত্যাশা, হন্তারক–প্রত্যাশার মধ্যে যেমন অবিশ্বাস, অবিশ্বাসের মধ্যে যেমন আনন্দ, আনন্দের মধ্যে যেমন আর্তি–সে আর্তি প্রকীর্নরত এক জ্যোতির্বলয়ই বা। প্রতীক্ষার অন্তে আছে খাদ্য, বস্ত্র, স্যানিটারি ন্যাপকিন–এহেন ভাব একটি সুপ্রযুক্ত বাস্তবতা, ভিড়টিকে উষ্ণতা প্রদান করিল। শ্যামের ভাল লাগিল না, সে যুবকের দিকে তাকাইল, ‘চলো’।
অপরপ্রান্তে, কমিউনিটি হলের অভ্যন্তরে তখন বণ্টন চলিতেছে, খাদ্য, পাঁউরুটি, ডিম, জলের প্যাকেট, শুষ্ক বস্ত্র। এক বালিকা একটি বস্ত্রখণ্ড লইয়া চক্ষুসম্মুখে উন্মুক্ত করিল, এবং মৃদু স্বরে কহিল ‘ছেঁড়া।’
‘বলতে নেই এসব। যা দিচ্ছে নিয়ে নাও।’ চাপাস্বরে ধমক দিল এক বয়োজ্যেষ্ঠা।
তীব্র আলোকের ঝলকানির সহিত ছবি উঠিল। কালাচাঁদ ব্যাপারীকে অনুরোধ করা হইল কিছু বলিবার জন্য। তিনি আপনার লুঙ্গিটি রোমশ হাঁটুর উপর গুটাইয়া স্কন্ধের গামছা টানটান করিলেন, ‘আমি এসব ব্যাপারে পাবলিকলি কিছু বলতে পারি না। বুঝলেন না! থতমত খেয়ে যাই। আমাদের যদু হাজরা মাঠেঘাটে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। ও কিছু বলুক।’
‘কালাচাঁদদাদাকে ছাড়বেন না। জোতজমি ব্যবসার থেকে সময় বার করে এখনও নিয়মিত পড়াশোনা করে। কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন নিয়ে বাড়িতে লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছে একটা। ম্যাক্সমুলার থেকে সুরেন দাশগুপ্ত ওর কণ্ঠস্থ। ওকে বরং বলুন একটা উপনিষদের ত্রোস্ত বলতে।’ হাসিয়া বলিলেন যদু হাজরা।
‘ওসব তো আমরা বুঝব না, কলকাতার মানুষ। আপনি আমাদের বোঝার মতো সহজ ভাষায় কিছু বলুন। আমরা ভিডিও করে রাখি। তবে এরপর যখন আসবেন স্যার, আমাদের ছেলেপুলের জন্য কিছু ভাল বই আনবেন। যাতে শিক্ষা হয়, জ্ঞান বাড়ে। বুঝতেই তো পারছেন, মাল্টিপ্লেক্স হাইরাইজ শপিং মলের ভিড়ে বইপত্রের বড় অভাব।’
‘আপনারা কিন্তু খেয়ে যাবেন। যা কিছু হয়, আমরা তো আর বেশি কিছু জোগাড় করে উঠতে পারিনি। আমাদের সঙ্গে বসেই একটু খেয়ে যাবেন। দুটো বার্গারই নাহয় খেলেন। না বললে শুনছি না কিন্তু।’
আমাদের সঙ্গে বসেই একটু খেয়ে যাবেন। দুটো বার্গারই নাহয় খেলেন। না বললে শুনছি না কিন্তু
জনার্দন বিড়বিড় করিলেন, ‘এ শালা অ্যান্টাসিড না খাইয়ে থামবে না।’
অপরদিকে শ্যামের সহিত যুবাপুরুষ ঘুরিল, তাহার ফ্ল্যাট, সুইমিং পুলের ভগ্নাবশেষ, জলমগ্ন সাউথ সিটি মলের অন্ধকার অভ্যন্তর, দেখাইল নিঃসঙ্গ টিভি টাওয়ার, মৃত মিনিবাসের কংকাল, কারখানার বন্ধ অর্গলের মরা শ্যাওলা দেখাইল, শ্যাম স্পর্শ পাইল ন্যাড়া হাসপাতাল, লুটোপাটি গথিক ফ্রেমের কারুকার্য। সে দেখিল, একটি শহর ধ্বংস হইয়া যাইতেছে। তখন অন্ধকার নামিল। ঘন হইল মেঘের দল। শ্যাম বাস্তবতা পাইল, তাহার অবোধ কোমলাঙ্গের কৌমার্য রসময়, বীজবত শুষ্ক ও পাণ্ডুর নিভিয়াছে, রম্য নহে, তাহাতে অমোঘতা ছিল। সময় সেস্থানে নিষ্ঠুর স্রোতস্বিনী, শ্যামের বিষণ্ণতা তাহাকে রুদ্ধ করিতে পারে না। শ্যাম বলিল, ‘আমি বাড়ি যাব’।
যুবক হাসিল, ‘চলো। কারোরই এসব জায়গা ভাল লাগে না বেশিক্ষণ। ঘুরতে আসে, ফটোশুট করতে আসে একবেলার জন্য। তারপর গোছগাছ করে বেলা পড়তে চলে যায়। কত কত লোক আসে, জানো! কেউ কালনা থেকে, কেউ নামখানা, কেউ রাণাঘাট। আসে, পিকনিক করে, বা ত্রাণ দেয়, যেমন তোমরা দিলে, ছবি তোলে আমাদের সাথে, তারপর চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, আবার আসবে। কেউ আমাদের বাচ্চাদের হাতে বইপত্র দিয়ে যায়, কেউ বা টাকাপয়সা, কী চিঁড়ে খইয়ের নাড়ু, তিলের মোয়া। তারপর আর ফিরে আসে না’। যুবকের কণ্ঠে ছায়া ছিল, এক অন্তঃস্থিত হিম উহার অভ্যন্তরে করুণতা লেপন করিল।
শ্যাম বলিল, ‘আমি আবার আসব। এখন না, যখন বড় হব।’
‘এসে কী করবে? কিছুই তো নেই এখানে!’
কেউ আমাদের বাচ্চাদের হাতে বইপত্র দিয়ে যায়, কেউ বা টাকাপয়সা, কী চিঁড়ে খইয়ের নাড়ু, তিলের মোয়া। তারপর আর ফিরে আসে না
‘থাকব। বাড়ি বানাব। আমার বাবা মা, আমাদের গ্রামের লোকেরা, সেখেনে কী সব ভারী ভারী কথা বলে সারাদিন! আমাকে জোর করে পড়তে বসায়। রোজ ইশকুলে পাঠায়। ভাল লাগে না। আমার বাবা মাঝে মাঝে মদ খেয়ে এসে মা-কে পেটায়। মা বাবাকে লুম্পেন প্রলেতারিয়েত বলে গালাগালি দেয়। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। মা পঞ্চায়েতে মেয়েদের নিয়ে দল বানিয়েছে, তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে খোঁজ রাখে কার বর কাকে পেটায়। সেগুলো নিয়ে থানায় জানায়। বাবার তাই মায়ের ওপর রাগ। ফেমি কী যেন একটা বলে গাল দেয়। আমার ভাল লাগে না ওখানে। সবাই কাজ করে, চাষ করে, পড়ে, গম্ভীর। আমার ভাল লাগে, এরকম জায়গাতে, কী সুন্দর সারাদিন শপিং মলে ঘুরব, উঁচু ফ্ল্যাটের ছাদে শুয়ে কানে তার গুঁজে গান শুনব, শাঁই শাঁই গাড়ি চালাব। ভাল না, বলো? আচ্ছা, প্রলেতারিয়েত মানে কী?’
‘ঠিক জানি না। খারাপ কিছু হবে হয়তো। চলো, তোমাদের ফিরতে হব। দেরি করলে আবার বৃষ্টি নামবে, আটকে যাবে।’
ঝুপঝুপ বৃষ্টির সহিত অন্ধকার নগরীর রাজপথ স্তব্ধতায় ভৌতিক, আলোকরশ্মি ধ্বংসপ্রাপ্ত, পারিপার্শ্বিক দিকসমূহে শূন্যতা মেঘনিহিত, কেবল অন্ধকার সপ্রভা জীবিতের সর্বাঙ্গে আদিম জলছবি প্রদান করিল, যাহাতে রাত্রির শকুনের কাকলীকণ্ঠ জীবন্ত হয়, প্রকাশ থাকুক এই পাখী তরুণ, জীবনোল্লাসে দর্পী, নিকষ হিমপ্রতিমায় চক্ষুদান করে। সেই জল ভেদ করিয়া ছপছপ শব্দে ফিরিয়া যাইতেছে ত্রাণের দল, উহাদের পিছে অন্ধকার তরঙ্গে গলন্ত লবণের ন্যায় মিশিয়া যাইবে বিদায় দিতে আসা নগরবাসীদের প্রতিচ্ছবি, যাহারা আর আগাইবে না। উহারা পরাভবী বৃদ্ধের ন্যায় দারূভূত, সীমানায় সচেতন, সুতরাং শূন্যতায় নিখোঁজ তাই অশরীরী, একটি রম্য নির্জন উহাদের ছায়াশরীরকে আবৃত করিয়া দিল। ফিরিয়া চাহিতে নাই, শুধু কালাচাঁদ ব্যাপারী স্কন্ধের উপর দিয়া পিছে নিক্ষিপ্ত করিলেন একমুঠো খই।
শ্রান্ত শ্যামের চোখে নিদ্রা, সে জড়ানো কণ্ঠে বলিতে লাগিল, ‘সঞ্জয়দাদা কী সুন্দর মা! আমাকে জোগার্ট খাইয়েছে, কত ঘুরিয়েছে। বলেছে, জল নামলে আবার যেতে, এবার ময়দানে নিয়ে ঘোড়া দেখাবে, মোগাম্বোতে খাওয়াবে। আবার আসব তো, বলো?’

‘হ্যাঁ, আবার ঘুরতে আসব। তোমার পরীক্ষাটা হয়ে যাক। আমরা সবাই মিলে একদিন পিকনিক করতে আসব এখানে।’
‘আমাকে বাদ দিও। আমার শহর দেখার শখ মিটে গেছে বাবা!’ বলিলেন জনার্দন।
‘লোকগুলো বেশ সরল আর ভাল, তাই না?’ যদু হাসিলেন, ‘এত দুঃখ কষ্ট পেয়েও মানবিকতা ভোলেনি। ভাবছি, এই ট্রিপটা নিয়ে ইপিডবলিউ-তে একটা চিঠি পাঠাব। একটা এম্পিরিকাল সার্ভে ধরণের। এদের দুর্দশাগুলোও আর্কাইভড থাক, কী বলো কালাচাঁদদাদা?’
‘শালার ভাইপোটা গোয়ালে ডিমের খোলা পুড়িয়ে রাখছে কী না কে জানে! নাহলে সারারাত মশায় ছিঁড়ে খাবে অবলা জীবগুলোকে।’
‘বাস কখন আসবে?’ শ্যাম প্রশ্ন করিল।
ট্রিপটা নিয়ে ইপিডবলিউ-তে একটা চিঠি পাঠাব। একটা এম্পিরিকাল সার্ভে ধরণের। এদের দুর্দশাগুলোও আর্কাইভড থাক
‘বাস তো আসবে না !’
‘তাহলে আমরা ফিরব কীসে?’
‘কোথায় ফিরব?’ হাসিলেন কালাচাঁদ, স্নেহভরে হাত রাখিলেন শ্যামের স্কন্ধে।
নিষেধ সত্ত্বেও শ্যাম পিছে ফিরিল। ছায়ামানুষেরা মিলাইয়া যাইতেছে ক্রমে ক্রমে। আর তাহারা, আদিগন্ত জলের মধ্যিখানে নিঃসঙ্গতা-আহত ডিঙিনৌকোর ন্যায়। ভরপুর মেঘমালার সখেদ ক্রন্দন এ চরাচরে প্রাণের সবুজতা আনিবে না, শোনিতস্রাবী কৃষ্ণ ইহাতে নিশ্চঞ্চল শ্মশান অঙ্কন করিয়াছে। শ্যাম প্রত্যক্ষ করিল, হাইরাইজ, শপিং মল ও ফ্লাইওভারের কোলাহল কঙ্কালে পর্যবসিত, অস্থিনিচয় প্রকট যাহার, শুধু জলে ভাসিতেছে মরা শব।
‘রাত কখন কাটবে, মা?’
‘কাটবে না।’
‘তাহলেও হাঁটতে হবে?’
কেহ উত্তর দিল না। তাহারা হাঁটিতে লাগিল এক অমর স্তব্ধতার অভ্যন্তর ভেদ করিয়া, অপর স্তব্ধতার অভিমুখে। তাহাদের সাক্ষী থাকিল মূক শবদেহ, অনির্বাণ রক্তিম আকাশ, ভগ্ন স্কাইস্ক্র্যাপার। সম্মুখে সমগ্র চক্ষুষ্মান, সমগ্র অন্ধ, সমগ্র যুবা ও সমগ্র প্রৌঢ় যে মূঢ় গহন, লক্ষ মাণিক্যের বিভা যে অন্ধকারে, উহাতে স্নিগ্ধতা, অনির্বাণ উহাতেই। ইহার অন্তে আছে প্রত্যুষনাশিনী হিম, যা মহতী মায়ায় আরূঢ়, যাহার অন্তরে সুষুপ্তি গাঢ় মনোরম আনিয়াছে। মায়ের হাত শক্ত করিয়া ধরিল শ্যাম। কালাচাঁদ চক্ষু বুজিয়া প্রণাম করিলেন মনে মনে, ‘সবাইকে দেখে রেখো ঠাকুর। কেউ যেন কষ্ট না পায়’।
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
One Response
Dao phire se Aranya, lao e Nagar.