banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

রাক্ষসের ঘরবাড়ি

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

এপ্রিল ২৯, ২০২১

Bengali short story on mother and son by Sakyajit
আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার হাতের মুঠি খুলে নিঃসাড়ে চলে যেত মা
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

তারপর সত্যি সত্যি একদিন মা-কে উদ্ধার করবার সংকল্প নিয়ে আমি রাক্ষস মারতে বেরোলাম। 

সে ছিল আমার ছোটবেলা, অনেকানেক নির্জন দুপুরে ঘোষেদের বিরাট দিঘিতে ব্যাংবাজি করবার সময়ে নির্দোষ ভগ্ন প্রাসাদটিকে নিরীহ ধ্যানস্তূপ মনে হলেও রাত্রিবেলা সেটাকেই নির্দয় রহস্যে ভরে ওঠা প্রেতপুরী ভাবাত যে বয়েস। আমার বাবা ছিল সেই প্রাসাদের কেয়ারটেকার, আগাছা ভরা বিশাল বাগান, জঙ্গুলে অন্ধকারের হিম চোখ আর অসংস্কৃত দীঘির গম্ভীর কুচকুচে জলকে কোনওরকম পরিমার্জন করবার দায় না নিয়েও যে বৃত্তিতে নিয়মিত মাসমাইনেটুকু জুটেই যেত, বুড়ো রাগেন্দ্রনারায়ণ ঘোষের সৌজন্যে। তিনি ছিলেন এই প্রাসাদের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি, তাঁর প্রচণ্ড ভয়াল ছয়ফুটের অবয়বে আহ্লাদ-ভগ্ন কণ্ঠস্বরের জায়গা ছিল না। তাঁর দেখার মধ্যে ছিল একটা পাকানো গোঁফ, আর রগচটা মেজাজ। শোনা যায়, পাটনাতে চাকুরিরতকালে একবার এই চণ্ডরাগের বশবর্তী হয়ে অধীনস্থ একটি গরীব দেহাতি ভৃত্যকে তিনি গুলি করে মেরে দিয়েছিলেন। ওপরতলার হস্তক্ষেপে সে কেস ধামাচাপা পড়লেও চাকরিটি বাঁচেনি। তারপর তিনি এখানে চলে আসেন এবং রুগ্ন কাহিল জন্তুর মতো পূর্বপুরুষের প্রাসাদ শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগের কয়েকটা ধুকপুক মুহূর্তে তাঁকে গিলে খেয়ে নিয়েছিল। তিনি বাড়ি থেকে বেরতেন না খুব একটা, তবে না বেরলেও তাঁর চণ্ডালের মত ক্রোধ প্রসিদ্ধ ছিল এ অঞ্চলে। আশেপাশের ছেলেরা  বুড়োকে ‘রাগবাবু’ বলে ডাকত। বড় হবার মর্মন্তুদ এক মুহূর্তে বুঝেছি, তিনি অতটা বুড়োও ছিলেন না। 

 

এরকম এক বাড়িতে কেয়ারটেকার হয়ে দৈনন্দিন বাজার, ব্যাঙ্ক, টুকটাক করতে করতেই আমার বাবা বয়ে ও ক্ষয়ে গেল, কিন্তু ঘোষবাবুর জন্য সারাদিন রান্না করবার পরেও মায়ের হাসিতে ঝলকে উঠত অমলতাস চাঁদ। মায়ের বিশাল চুল ধরে আমি তখন ঝুলতাম, তার ভরাট চোখের ভেতর খুঁজে নিতাম নিজস্ব পুকুর। বস্তুত, মায়ের চওড়া কাঁধ, পিঠ আর কোমরছাপানো গভীর চুল ছিল আমার ক্রীড়াভূমি, আর মা-ও সারাদিন কাজের পর একবিন্দু বিরক্ত না হয়ে সেই প্রতিটা সন্ধ্যা আমার সঙ্গে খেলেছিল, একসঙ্গে খুঁজেছিল হিমেল মাটির ভেতর জমে যাওয়া আশ্চর্য বাদাম, দীঘির জলে ব্যাংবাজি করেছিল পাল্লা দিয়ে, বাগানের ভেতর আলুখ শালুখ কুড়িয়ে গিয়েছিল অনাদৃত কচি আম ও ঝরা পাখির বাসা। বাবা আমাদের ঘরের ভেতর মৃদু বাল্বের আলোতে শুয়ে থাকত তখন, আর বিদ্বেষভরা চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যেত, ‘নষ্ট মেয়েমানুষ! নষ্ট গর্ভ!’

বাবা ছিল দূরতর এক দ্বীপ, যার কপালের ঘামটুকু আমার অচেনা, বাগানের এককোণে আমাদের ছোট্ট ঘরের ওপর গেঁড়ে বসা যার বিরক্তি ও ঔদাসীন্যের পাহাড়টিকে কেটে কেটে মা কোনওদিনই তার ভেতর মখমলের কোমলতা বইয়ে দিতে পারেনি। বাবা সহ্য করতে পারত না আমাদের। মাঝে মাঝে বিকেলবেলাই মদ খেয়ে ফিরত, এবং সেদিন আমাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে বন্ধ করে দিত ঘরের দরজা। আমি শুনতাম মায়ের আর্তনাদ, কান্না, অথবা নৈঃশব্দ শুনতাম। গন্ধ পেতাম মায়ের ঠোঁটের কষে কালসিটের, কোমরে পল্লবিত লাথির। কিন্তু কান্না পেত না, কারণ জানতাম আমার মায়ের সঙ্গে খেলাধুলো অথবা বাবার মারধোর, এসবেরই আয়ু আর কিছুক্ষণ মাত্র। 

বাবার অক্ষম আস্ফালন পেরিয়ে লুকিয়ে আছে এক উন্মাদ অন্ধকার, যে রূপকথার শাপভ্রষ্ট রাজকন্যার মতো মা-কে টেনে নেবে অন্ধকূপের অজানাতে, যেরকম রোজ নেয়। বাবাকে দেখে আমার কষ্ট হত ওই বয়সেও–রোগা, আধবুড়ো, মাথার চুল আর্ধেক পড়ে গিয়ে টাক বেরিয়ে পড়েছে, ঘোলাটে দৃষ্টি আর ময়লা দাঁত, আমি শুনেছি, গ্রামের দিকে বাবাকে লোকে ‘ভেড়ুয়া’ বলে ডাকে, রসিকতা করে, খ্যা খ্যা  করে হেসে গড়িয়ে পড়ে এর ওর গায়ে। কিন্তু শব্দটার মানে আমি জানতাম না, আর না জেনেও বাবাকে মায়া লাগত। সে যেন এক হতভম্ব দৈত্য যে নিজের বাগানটুকুও রক্ষা করবার মতো পরিপূর্ণ কর্মঠ আর স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারল না। 

এই ভগ্নপ্রাসাদ যে ঘোষেদের, বহুযুগ আগে তারা ছিল ঠ্যাঙাড়ে রাজার বংশ। দিনেরবেলা রাজ্যশাসন ও রাত্রিবেলা পথেঘাটে নিরীহ পথিককে মেরে তার সর্বস্ব লুঠ, রক্তের মধ্যে এ নেশা ঢুকে গিয়েছিল। আর এখন অবসিত গরিমার এই বাড়ি, যার ইট কাঠ পাথর বেরিয়ে পড়েছে, ভাঙা সিঁড়ির খোপেখাপে বিষাক্ত গোখরো প্রহর গোনে, দেওয়াল ফাটিয়ে মাথা তুলছে অবাধ্য বট, তবু কয়েকটা ঘর এখনও আস্ত, যাদের ছাদের ফ্রেসকো আর কয়েকটা ভাঙা ঝাড়লণ্ঠন মনে করিয়ে দেয় সেই সামন্তরাজ, ফাঁসুড়ে ও করাল, তাদেরই একটা ঘরে রাগবাবু থাকেন। তিনি বাইরের কারওর সঙ্গে মেশেন না। মাঝে মাঝে পেছনের বাগানে পায়চারি করেন। বাগানে অবাঞ্ছিত অতিথি দেখলে তিনি ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়েন। কিন্তু আমাকে কখনও কিছু বলেননি, শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছেন, রক্ত জল করবার পক্ষে যথেষ্ট যেটুকু।

যখন শুটিং-এর জন্য এ বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়, তখনও রাগবাবু বেরন না, দোতলার একটা ঘরে শুয়ে বসে থাকেন সারাদিন। শুটিং পার্টি সারাদিন হৈহল্লা করে, বাবাকে দিয়ে মদ আনায়, মা যখন তাদের লুচি খাবার ময়দা মাখতে বসে তখন মায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে সাদা পুঁজের মত ময়দার ডেলা ঠিকরে উঠতে দেখেছি। মা-এর পাশে বসে কোনও সিনেমাকাকু গল্প করে, সিগারেট খায়, মাঝে মাঝে একটু ঢলে পড়ে, বুঝেছি মায়ের হেসে ওঠা দেখে। তখন বারবিকিউতে ধকধক জ্বলে দেশি মুরগির তেজি বুক, উদ্ধত পাছা, উন্নত গ্রীবা।

bengali short story on mother and son
মা ডাক দিল যখন--'রাজু, ওই দেখ বুনোকুল গাছটায় মৌচাক হয়েছে

কিন্তু এসবই সন্ধ্যে অবধি। ওটুকুই বরাদ্দ। রাত হলে আমাদের জন্য রাঁধাবাড়া করে, আমাকে খাইয়ে আর বাবার খাবার ঢাকা দিয়ে, এরপর বিছানায় আমাকে শুইয়ে মা চলে যায় প্রাসাদের ভেতর। আর ফেরে না। আমি আগে কান্নাকাটি করতাম, আঁচল চেপে রাখতাম মায়ের, যেতে দেব না। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার হাতের মুঠি খুলে নিঃসাড়ে চলে যেত মা, আর আমার অন্যপাশে পোড়া কয়লার মতো বাবা সারারাত এপাশ ওপাশ করত। অনেকদিন ভোরবেলা আমার ঘুম ভেঙে গেছে, যখন বুঝেছি মা আবার নিঃসাড়ে ঘরে ঢুকল। চোরের মতো চুপিচুপি যেত, ফিরতও তেমনভাবেই। সদ্য স্নান করেছে, তাজা মাটির গন্ধ পাব বলে মায়ের চুলে আমি মুখ গুঁজে দিতাম। 

কেন রোজ রাত্রে প্রাসাদে চলে যায়, অনেকবার মা-কে জিজ্ঞাসা করেও যখন উত্তর পাইনি, না কোনও ব্যাখ্যা, তখন একদিন উত্তরটা আচমকাই উদ্ভাসিত হল চোখের সামনে। আমি সেই দুপুরবেলা বাড়ির পাশের জামরুলগাছ থেকে কষটা ফল পাড়ছি আঁকশি দিয়ে। সেদিন মায়ের রান্নাও তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তাই সোৎসাহে আমার খেলায় যোগ দিয়েছিল কিছু আগে থেকে। নির্জন চরাচরে ঘন উজ্জ্বল নীল বৃষ্টিধোয়া আকাশ থেকে রোদ পিছলে যাচ্ছে, আমার পায়ের নিচের ভেজা মাটিতে একটি শামুক শুঁড় বাড়িয়ে আলতো ছুঁয়ে দিচ্ছে গোড়ালি, কাশকুশের ঝোপে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি, আর আমি মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখছিলাম দূরের দীঘির কালো জলে পাখির ডানার রঙ লেগেছে কি না। থিকথিকে উইপোকার দল আমার হাতের স্পর্শে  ঝরে গেল, মা ডাক দিল যখন–‘রাজু, ওই দেখ বুনোকুল গাছটায় মৌচাক হয়েছে। কিছুদিন যাক, তারপর ভাঙব’। 

আমি মাথা তুললাম, আর অকস্মাৎ একঝলক রক্ত যেন গলা দিয়ে ওপরে উঠে এল আমার। দেখলাম, প্রাসাদের উঁচু ছাদ থেকে একটা বিকটদর্শন মুখ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আ’ করে চেঁচিয়ে উঠে চোখে হাত চাপা দিলাম, মা ছুটে এসে হাত ধরল আমার–‘কী হয়েছে বাবা?’ 

‘ওপরে। রাক্ষস। তাকিয়ে ছিল আমার দিকে’। 

মা ওপরে তাকাল। ‘কই, কেউ নেই তো?’ 

আমি দেখলাম, সব শুনশান, ধোয়াপাতলা। তবু আমি জানলাম সে আছে। মায়ের আকাশের মতো চোখজোড়া, ঘন নাকের পাটা, করুণ সাদা আঙুলে চাপ দিলে টিপ বসে যাবে, মায়ের গলায় দুটো গভীর খাঁজ যার ভেতর লুকিয়ে রাখা আছে এক মাঠ রহস্য, এই সমস্তকিছুই যখন একযোগে হেসে ওঠে, রাক্ষস মিথ্যে হয়ে যায়। মা তেমনই হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় পেয়েছে ! হাঁদা ছেলে কোথাকার !’ আমি জানি, সে হাসিতে ত্রিসন্ধ্যা একত্রিত হয়, নিখিল বিশ্ব একযোগে আবর্তন করে একটি শুভ প্রণামে, রাক্ষসের সাধ্য কী তাকে অগ্রাহ্য করবে! কিন্তু মা যখন থাকবে না, আবার যদি দেখা দেয়? 

রাত হলে আমাদের জন্য রাঁধাবাড়া করে, আমাকে খাইয়ে আর বাবার খাবার ঢাকা দিয়ে, এরপর বিছানায় আমাকে শুইয়ে মা চলে যায় প্রাসাদের ভেতর। আর ফেরে না। আমি আগে কান্নাকাটি করতাম, আঁচল চেপে রাখতাম মায়ের, যেতে দেব না। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার হাতের মুঠি খুলে নিঃসাড়ে চলে যেত মা

এবং দিল। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই নির্জন দুপুরে ছাদের মাথা থেকে একমনে ও নিঃশব্দে দেখে যেতে লাগল আমকে। কিছু বলে না, শুধু বিশ্রী হলুদ একটা মুখ আর কয়েকটা ধারালো ছুরির মতো দাঁত বার করে আমাকে লক্ষ্য করে। মা বিশ্বাস করবে না, বাবা বকবে, তাই কাউকেই কিছু বলতে পারিনি। আমার কোনও বন্ধু ছিল না, কারণ আমাকে দেখলেই ছেলেদের দল ‘ভেড়ুয়ার বাচ্চা’ বলে খ্যাপাত, টেনে খুলে দিত প্যান্ট। সেই হাবা সোহাগহীন শৈশবে আমাকে যদি কোনও রাক্ষস একমনে লক্ষ্য করেও যায়, তেমন কোনও অক্ষয়বটের শান্ত আশ্বাস কোথায় পাব, যার ভেতর বিলোল নিঃশ্বাসে নিজেকে আবিল ও ভয়হীন এলিয়ে দেওয়া যেত? রাত্রিবেলা ভয়ে ভয়ে ছাদের দিকে তাকালেও কিছু দেখতে পাইনি ঘন অন্ধকারে, আর মা ততক্ষণে প্রাসাদের ভেতর ঢুকে গিয়েছে। তবু আমি জানতাম, সে আছে, আমারই আশেপাশে কোথাও। আর এভাবেই বুঝেছিলাম, এ সেই রাক্ষসের প্রাসাদ, যার ভেতরে আমার কেশবতী মা-কে ঢুকে যেতে হয় নিরুপায়, রোজ। এটাই রাক্ষসের শর্ত। হয়ত ঘোষেদের দীঘি, অথবা অন্য কোনও গোপন কক্ষে সে মা-কে বন্দিনী রাজকন্যা বানিয়ে রাখে, কালান্তক রূপোর কাঠির স্পর্শে যার সর্বাঙ্গ নীল।

রাগবাবু তখনও অন্ধকার নীলচে কুয়াশায় দুলে দুলে পায়চারি করেন, মাঝে মাঝে ক্রুদ্ধ চিৎকার করেন বাবার ওপর, বাগানে কেন সাপের খোলস। বাবা মাথানিচু করে নীরবে গালাগালি হজম করে। রাগবাবু আমার দিকে নিস্তব্ধ তাকিয়ে থাকেন, সে দৃষ্টির মানে আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু রাক্ষসের ভয়ের কাছে সেসব নস্যি, বেচারা বুড়ো জানেও না তার এই ভাঙা প্রাসাদ কোন জাদুকাঠির ছোঁয়াতে রোজ রাক্ষসপুরী হয়ে যায়। আমি রোজ দুপুর আর বিকেল একইভাবে খেলি, প্রজাপতির ডানা ধরতে গেলে হাতে এসে লাগে পরাগরেণু, খরগোশের গর্তের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তুলে আনি শুকনো জামবিচি, দীঘির পাড়ে দেখি খলশে আর পুঁটিদের অবাক সম্মোহন, যাদের শরীরে একবার ছুঁয়ে দিলেই রোদালো রামধনু ছিটকে যাবে। খেলতে খেলতে মাথা উঁচু করে দেখি, রাক্ষসের মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। ছাদে যাবার উপায় ছিল না কারণ সিঁড়ি ভেঙে গেছে অনেকদিন। ছাদও ভেঙে গেছে কোনও কোনও জায়গাতে। রাত্রে যখন মাঝে মাঝে নির্জন চরাচর স্পন্দিত করে রাগবাবুর কাশির আওয়াজ ভেসে আসে দোতলা ঘর থেকে, তখন মনে হয়, অন্তত ওই ঘরটার ছাদ অক্ষত আছে। তাহলে কি রাক্ষসের জীবনযাপন ওইটুকু অংশেই? কিন্তু সে তো আমাকে দেখা দেয় বিভিন্ন জায়গা থেকে, এমনকি যেটুকু ভাঙা অঞ্চল, সেখান থেকেও। সারাদিন লুকিয়ে থাকে, আর সন্ধে নামলেই পাতালপুরীতে টেনে নিয়ে যায় ভাগ্যাহত রাজকন্যাকে, এ কেমন রাক্ষস? তাহলে কি আমারই দায় নয়, সে রাক্ষসকে হত্যা করা? মা-কে বাঁচানো? 

কিছুদিন গেল এসব ভাবতে ভাবতে। বাগানের একটি ভুঁড়ো শেয়াল আমাকে জানিয়ে গেল, দীঘির ভাঙা পাথর ওলটানো যে ঘাট, তার নিচ দিয়ে ধাপ ধাপ নেমে গেছে সিঁড়ি। সে সিঁড়ির একদম তলদেশে গেলে হীরে জহরতে মোড়া পাতালপুরী, যাকে পাহারা দেয় বিষাক্ত সাপেদের দল। তাদের নিঃশ্বাসে জমে যায় পথভুল মাছেদের শরীর। সে পাতালপুরী সোজা গিয়ে মিশেছে প্রাসাদে। একটি খরগোশ, যে আমার বন্ধু ছিল, সে দেখাল একটি লম্বা সুতো, শিশিরভেজা ঘাসের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বহুদূর চলে গিয়ে নেমে গেছে দীঘিতে। সে সুতোয় কাঁথা বোনে মহাকালের বুড়ি, যার বাস জলের নীচে। আর দেখাশোনাগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি আরও বেশি করে বুঝতে পারছিলাম, রাক্ষসের প্রাণ আছে ভ্রমরের ডানায়, নতুবা কালকেউটের শরীরে, অথবা অদেখা ফলের মারণবীজের ভেতর। তাই মায়ের পিছু নিয়ে আমাকে জানতেই হবে, সে প্রাণবীজ কোথায় গচ্ছিত। 

সারাদিন লুকিয়ে থাকে, আর সন্ধে নামলেই পাতালপুরীতে টেনে নিয়ে যায় ভাগ্যাহত রাজকন্যাকে, এ কেমন রাক্ষস? তাহলে কি আমারই দায় নয়, সে রাক্ষসকে হত্যা করা? মা-কে বাঁচানো? 

তারপর সত্যি সত্যি একদিন মা-কে উদ্ধার করবার সংকল্প নিয়ে আমি রাক্ষস মারতে বেরলাম।

সেদিন রাত্রিবেলা বাবা আবার মদ খেয়ে এসেছিল। মায়ের ওপর চড়াও হয়ে প্রহার, ধাক্কাধাক্কি, ক্রুদ্ধ গর্জন। কিন্তু সেসব আমাকে স্পর্শ করেনি। রাত্রে মা যখন চুপিচুপি বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে, আমি পকেটে আমের খোসা ছাড়াবার ছোট্ট ছুরিটা নিয়ে নিঃসাড়ে মায়ের পিছু নিলাম। বাবা দেখেও দেখল না, আসলে তার কিছুতেই কিছু এসে যেত না। 

প্রাসাদের বিশাল দরজা মায়ের পেছনে বন্ধ হয়ে যেত রোজ, কিন্তু এবার আমি টুক করে ঢুকে পড়লাম। অন্ধকারে মা বুঝল না, ছায়ার মতো আমি তার পেছনেই। আমার কাঁধের ওপর দিয়ে শেষ আলোটুকুও মুছে গেল, যখন ভারী কবাট আবার লেগে গেল একে অন্যের সঙ্গে যথাস্থানে। 

দিনের বেলা অনেকবার ঢুকলেও রাত্রে এই প্রথম, কারণ রাগবাবুর কড়া  হুকুম ছিল, সূর্যের আলো ডোবার পর আমি বা বাবা যেন প্রবেশ না করি। অন্ধকারে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল, তাই দেওয়াল ধরে ধরে হাঁটছিলাম। একটু দূরে মা, যেন কোনও তাড়া নেই, এমনভাবে হেলতে দুলতে সরু প্যাসেজ দিয়ে হাঁটছে। অন্ধকার জলের ভেতর লবণের মতো গলে যাচ্ছিল মায়ের অবয়ব, আমাকে সাবধানে ঠাওর করে করে চলতে হচ্ছিল। 

হঠাৎ মা ডানদিকে ঘুরল, আর আমি টাল সামলাতে পারলাম না। সোজা গিয়ে ধাক্কা খেলাম নিরেট দেওয়ালে। মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদে মা চমকে পেছন ফিরল। অন্ধকারে হাতড়ে আমার সামনে এসে বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল চোখ, দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলল। ‘তুই? তুই কেন এসেছিস?’ 

‘আমি—মানে–রাক্ষসকে মারতে’, তুতলিয়ে বললাম। 

মায়ের চোখে ত্রাস ফুটে উঠল। আমার হাত ধরে দ্রুত কিন্তু চাপাস্বরে বলল, ‘তুই চলে যা রাজু, চলে যা! বিপদ হবে। কেন এসেছিস তুই?’ 

আমার জেদ চেপে গেল, এবং চিরকালের ভীতু আমি রুখে দাঁড়িয়ে পকেটের ভেতর ছুরি চেপে ধরলাম, ‘যাব না, তুমি আমাকে নিয়ে চলো রাক্ষসের কাছে।’ 

‘কেন?’ 

‘মারব। তোমাকে আর কখনও রাত্রে কোথাও যেতে দেব না।’ মাথা নিচু করে ফেললাম। 

মা-ও চুপ করে গেল। তারপর হাসল অস্ফুটে, ‘রাক্ষসকে মারবি?’ 

‘হ্যাঁ’। 

একটু চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মা। ওপরের দিকে তাকাল সতর্কভাবে। রাক্ষস কি ওখানেই থাকে? ‘আয় আমার সঙ্গে। চল, একটু ঘুরি বাড়িটার ভেতর’। 

তারপর অনেক অজানা নিষিদ্ধ গলিপথে এবং অন্দরে কন্দরে আমি মায়ের সঙ্গে ঘুরলাম। যখন রাস্তা হারিয়ে ফেলছিলাম, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম, সামনে মায়ের ঘন অন্ধকার চুল আমার হারিয়ে যাবার মালিন্য ঘুচিয়ে দিচ্ছে কি না। মায়ের শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধ আমাকে ঘিরে রাখছিল, আর আমি ঘুরতে ঘুরতে জানলাম ভয়াল মুখোশ, বর্শা, জীর্ণ তলোয়ার, বাঘের ছাল, মহিষের মাথা। এই বিশাল বাড়িটির অন্দরের সমস্ত রহস্য আমার সামনে নগ্ন হচ্ছিল একটু একটু করে, যখন মা আমাকে হাতে ধরে চিনিয়ে দিচ্ছিল খসে পড়া বালিস্তূপের ভেতর দিয়ে অজানা সুড়ঙ্গ, বিপজ্জনক গলিপথ, হতযৌবন ঘরদুয়ারের খাঁ খাঁ। আমি দেখলাম সকালবেলার পরাগরেণু মাখা সেই প্রজাপতিটি এখন ঠাণ্ডা অকরুণ মেঝের উপর মরে পড়ে আছে। কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু পেছন ফিরে মা-কে দেখতে পেলাম না। 

‘মা?’ দুইবার ডাকলাম। ভয় করল। 

হঠাৎ  আমাকে চমকে দিয়ে ডান পাশ থেকে এগিয়ে এল মা, হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় পেয়ে গেলি?’ 

‘আমি হারিয়ে গেলে কী হত?’ রেগে গেলাম আমি । 

‘আ রে বীরপুরুষ আমার !’ মা হাসতে হাসতে গড়িয়ে গেল। তারপর হাত তুলে দেখাল কড়িকাঠের দিকে, ‘দেখ রাজু, এখানে ফাঁসি হত। এখন কালকেউটের বাসা ঘুলঘুলির ভেতর’। 

ভয়ে ভয়ে ওপরে তাকালাম। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবে কান পাতলে হিশহিশ শুনতেও পারি। পেছন ফিরে দেখলাম, মা আবার নেই। আবার ডাকাডাকির পর অন্ধকার থেকে বেরল হাসতে হাসতে। 

ক্রমে ক্রমে আমাদের দুজনের একটা খেলা হয়ে গেল এটা। মা মাঝে মাঝেই লুকিয়ে পড়ছে, আমি খোঁজার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে রেগে উঠছি, তখন দুম করে বেরিয়ে আসছে ভাঙা থামের আড়াল থেকে, কী দূরের নাটমঞ্চ থেকে এগিয়ে আসছে। আমিও এই বিভ্রমের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে অন্ধকারের মধ্যে নিজের চোখকে অভ্যস্ত করে ফেলছিলাম, এবং হাঁফিয়ে উঠছিলাম। শেষটায় দেওয়াল ঘেঁসে বসে পড়লাম। 

কোথাও কোনও শব্দ নেই। থমথমে চারধার। কিছুক্ষণ পর আমি হাঁক দিলাম ‘মা !’ 

কেউ উত্তর দিল না। আমি আবার বললাম, ‘বাড়ি যাব। ঘুম পাচ্ছে।’ 

একটা খরখরে হাওয়া আমার হাড়ের ভেতর ঢুকে ঘুরপাক খেল কিছুক্ষণ। মাথা ঝিম লাগছিল, গলাও শুকনো। হাওয়াটা কিছু অস্বস্তি দিয়ে গেল, চারপাশ হয়ে গেল আরও কিছু চুপচাপ। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল আমার। আস্তে আস্তে গলি দিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। এখানে কেউ কখনও এসেছিল বলে বিশ্বাস হয় না, এমনকি রাক্ষসপুরী রূপেও কখনও সাজেনি। পায়ের কাছে কিছু একটায় ঠোক্কর লাগল। নিচু হয়ে চোখ ধাতস্থ করে বুঝলাম, একটা মৃত খরগোশ। সেই বন্ধু, যে আমাকে মহাকালের বুড়ি চিনিয়েছে। আমার বুকের কাছে ফাঁকা লাগল, দুইবার মায়ের নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু না মা, না রাগবাবুর কাশির শব্দ, না রাক্ষস, কেউ এগিয়ে এল না। পকেট থেকে ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে আমি ছুটতে ছুটতে এই গলি ও গলি নাচঘর বলির বারান্দা গুপ্ত কক্ষ সমস্তই ঘুরলাম, তবুও মায়ের চেনা সুগন্ধ খুঁজে পেলাম না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসল, আর গলার ভেতর দলাপাকানো ব্যথা। অন্ধকার মোষের মুণ্ডুর দিকে তাকিয়ে আমার বুক ভারী আর অবসিত হয়ে উঠল, কারণ কীভাবে ফিরে যাব আমি জানতাম না। মা-কে আর কখনও খুঁজে পাব কিনা জানতাম না। এ-ও জানতাম না, সে হারানো সুগন্ধ আমার অন্তরে চারিয়ে গিয়ে শিশিরের ফোঁটার মতো রহস্যের নিষ্ঠুরতাগুলিকে ভিজিয়ে দেবে, না কি সারাজীবনের জন্য আমাকে এই আদিমের মধ্যে বৃথা চরকিপাক খাওয়াবে। 

কিন্তু আজও আমি বিশ্বাস করি, আমার ঘুমন্ত রাজকন্যা মা অন্ধকারের ভেতরেই সারাজীবনের মতো থেকে গিয়েছিল, আর রাক্ষস তার আজীবন সঞ্চিত ভালবাসা ঢেলে সেই লুপ্ত মায়ার সমস্ত শরীর নীল করে দিয়েছিল। 

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com