প্রায় প্রতিদিনই রবিনবাবুর বাড়ি থেকে টেকো লোকদের বেরোতে দেখা যায়। অথচ যে চুলওয়ালা লোকগুলো ঢোকে, তারা যে কোথায় যায়, কেউ জানে না।
তবে এসব খুব গোপন কথা, সচরাচর কারও চোখে পড়ে না। মানে, সবকিছু সকলের সামনে ঘটছে অথচ কেউ বুঝতে পারে না। (Short Story)
কুট্টিদাদুর মিস্ট্রি : অরূপ দাশগুপ্ত
রবিনবাবু অর্কদের পাড়াতেই থাকে। অর্কদের পুরনো পাড়া। ভেল্টু পাঁচিল ডিঙোয়। দোতলার বারান্দা থেকে অর্ক দেখে ওদের বাড়ির দেওয়াল টপকে ভেল্টু ঢুকছে। ভেল্টুর মা গঙ্গামাসি, অর্কদের বাড়িতে ঘর মোছা বাসন মাজার কাজ করে। অর্ক ভাবে, ভেল্টু বোধহয় ওর মা-র সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, কিন্তু তা তো নয়। সবাই খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করছে। গঙ্গামাসি সকালে এসে কাজ সেরে চলে গেছে। এখন দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি। এই সময় বাড়ি নিঝুম। অর্ক একাই জেগে থাকে। অর্কদের বড় বাড়ি। ওপর, নিচ, বাগান ঘুরে ঘুরে একা একাই খেলা করে। ভেল্টু প্রায় অর্কর বয়সী। কালোঝুলো জামা-প্যান্ট পরে আছে। ওকে দেখে অর্ক খুশি হয়। একজন খেলার সঙ্গী পাওয়া গেল। ওপর থেকে গলা তুলে বলে, “কীরে? খেলবি?”

গলা শুনে ভেল্টু চমকে যায়। ওপরে তাকিয়ে বলে,
“আমি সাইকেল নিতে এসেছি।”
“সাইকেল!” অবাক হয়ে বলে অর্ক। গতকালই অর্কর বাবা ওর জন্য অনলাইনে সাইকেল কিনেছে।”
“তুই জানলি কী করে?”
ভেল্টু চোখ ঘুরিয়ে বলে, “আমি মন্তর জানি।”
“উরিব্বাস! তাই নাকি? আমায় শিখিয়ে দে।”
“এসব মন্তর বড়লোকদের জন্য না।”
“মন্ত্রের বড়লোক গরীব হয় নাকি?”
“না তো কী? আমি এমনি বলছি?”
“কিন্তু আমি তো সাইকেল চালাতে জানি না।”
“আমি জানি।”
অর্ক অবাক হয়, “আমায় শিখিয়ে দিবি?
“তুই কি এখন খেলবি?”
“কেন খেলব না? তুই উপরে আয়।”
“না ওপরে যাব না। তুই নিচে আয়।”
ফেসবুকের বেড়াল : সৌরভ হাওলাদার
ভেল্টু নিচে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়। পাড়ার কুচকুচে কালো রঙের বিড়াল, মেনি এসে ওর পায়ের কাছে গা ঘষে। ভেল্টু বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করে। মেনি রোঁয়া ফুলিয়ে গলা দিয়ে আহ্লাদের পররর ফরররর শব্দ করে। ওপর থেকে অর্ক বলে, “কালো বিড়াল দেখে ভয় করে না?”
“ও তো মেনি। ওকে ভয় করবে কেন?”
খানিক আদরের পর কোল থেকে নামিয়ে দেয়। মেনি ভেল্টুর পায়ে দু’বার লেজ বুলিয়ে এক লাফে পাঁচিলে উঠে পড়ে।
রবিনবাবুর টাক মাথা ফর্সা রঙ। লোকজন বলে, সে নাকি পরচুলা নিয়ে গবেষণা করছে। প্রতিদিন দুপুর বেলায় রবিনবাবু চুল খুঁজতে বেরোয়। যে সে চুল নয়, মানুষের গাঢ় ঘন মেঘের মতো চুল, রবিনবাবু তাদের সন্ধানে জাল ফেলে। যেমন একজন পাকা জেলে ঠিক জানে, কেমন জলে মাছ আসে। কতটা ইলশেগুঁড়ি পড়লে নদীর ত্বকের ওপর ইলিশের গন্ধ পাওয়া যায়, তেমনি রবিনবাবু চুলের গন্ধ পায়। সে তুমি সাবান শ্যাম্পু রিঠা যাই লাগাও, রবিনবাবুর নাককে ফাঁকি দেওয়ার যো নেই। শুঁকে শুঁকে ঠিক পৌঁছে যাবে, সেই চুলের মালিকের কাছে। তারপর তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে এমন করে দেবে, সে সুড়সুড় করে রবিনবাবুর পিছন পিছন চলে আসবে। রবিনবাবু তখন তার মাথায় ক্ষুর চালিয়ে চুল সংগ্রহ করবে, ঠিক যেন “বা বা ব্ল্যাক শিপ।”
রবিনবাবু গত দুইদিন ধরে একটা চুলের গন্ধ পাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই চুলের মালিকের কাছে পৌঁছতে পারছে না। রবিনবাবু তার চুল খোঁজার জাল নিয়ে বেলগাছিয়া থেকে বেহালা আবার হাবড়া থেকে হাওড়া ঘুরে এসেছে, কিন্তু সেই চুলের মালিকের দেখা নেই। বড় মুশকিলে পড়েছে।
রূপকথার রাপুনজেল বা কেশবতী রাজকন্যা, কুঁচ বরণ কন্যা তার মেঘ বরণ চুল! উহুঁ এমনটা এখন কোথায়? এখনকার রাজকন্যেদের তেমন সময় নেই, লম্বা চুলের যত্ন করবে। তাই ডাক পরে রবিনবাবুদের মতো পেশাদারদের।
বালক বীরের মহাপ্রয়াণ : শরণ্যা মুখার্জী
এই দুপুরে রাস্তায় গাড়ি কম। নতুন সাইকেল নিয়ে ভেল্টু আর অর্ক দুজনে চড়তে বের হয়। অর্ক আসনে বসেছে, পিছনে ভেল্টু ঠেলছে। কিছুদূর গিয়ে অর্ক কাত হয়ে পড়ে। ভেল্টু সাইকেল সহ অর্কর ভার ধরে রাখতে পারে না। দু’জনে ধড়াস করে রাস্তার পাশে নর্দমায় পড়ে যায়। হাঁটু কনুই ছড়ে গেছে। নতুন সাইকেলটাও ঘষা খেয়েছে কয়েক জায়গায়।
অর্ক কেঁদে ওঠে, “তুই ফেলে দিলি আমায়?”
ভেল্টুও পড়ে গিয়েছিল। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “সাইকেল শিখতে সবাই একটু আধটু পড়ে। আবার ওঠ।”
অর্ক গোঁজ হয়ে থাকে, “না আর উঠব না। আমার খুব লেগেছে।”
“বেশ, তুই এখানে বোস এবার আমি চালাই।”
অর্ক বলে, “তুই আমায় মন্ত্রটা শিখিয়ে দিবি না?”
ভেল্টু একটু ভাবে, “ও মন্তর তোরা পারবি না।”
“কেন? পারব না?”
নতুন সাইকেল নিয়ে ভেল্টু পক্ষীরাজের মতো উড়াল দেয়। এ গলি সে গলি ঘুরেই চলে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। অর্ককে এভাবে মলিন হয়ে নর্দমার ধারে একা বসে থাকতে দেখে, রবিনবাবু অবাক! অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে, “কী রে! এখানে বসে আছিস কেন?”
অর্ক মুখ কাচুমাচু করে জবাব দেয়, “পড়ে গেছি।”
“যাঃ পড়ে গেছিস তো এখানে বসে কী হবে? ঘরে যা, ওষুধ লাগা।”
“সাইকেল নেই।”
“সাইকেল?” রবিনবাবু অবাক চোখে দেখে।
অর্ক বলে, “চালানো শিখছিলাম। তাই তো পড়ে গেছি।”
“ওঃ তাই বল। তো সাইকেলটা কোথায়?”
“ভেল্টুর কাছে।”
“ভেল্টু? সে কে?”
“আমার বন্ধু। গঙ্গামাসির ছেলে।”
“অ” রবিনবাবু আর কিছু বলে না। অর্কর কাছে ঝুঁকে এসে ওর মাথায় হাত বোলায়।

অর্ক প্রথমে ভাবল, রবিন দাদু বোধহয় ওকে আদর করে দিচ্ছে। তারপরে বুঝতে পারে দাদু ওর চুলগুলো দেখছে।
রবিনবাবু বলে, “তোর চুলগুলো তো খুব সুন্দর! তুই আমার সঙ্গে আয়।” ধুলো ঝেড়ে অর্ককে উঠতে সাহায্য করে। ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে ভেল্টু আবার পাড়ায় ফেরে। এসে দেখে অর্ক নেই। কী হল? ছেলেটাকে তো এখানেই রেখে গেছিল। ঠিক তখন চোখে পড়ে, একটা নেড়া মাথা ছেলে এদিকেই হেঁটে হেঁটে আসছে। “অর্ক-কে দেখেছিস?” ভেল্টু ওকে জিজ্ঞেস করতে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে চোখ ছানাবড়া! আরে এই তো অর্ক! ভেল্টু জিজ্ঞেস করে, “কীরে এইটুকু সময়ে ন্যাড়া হলি কখন?”
অর্ক টাক চুলকোতে চুলকোতে বলে, “কি জানি? হঠাৎ দেখছি চুল নেই।”
দুই বন্ধু সাইকেল ঠেলে ঠেলে ঘরে ফিরে আসে।
রবিনবাবু আজ তাজ্জব হয়ে গেছে। ক’দিন ধরেই তার নাকে এমন এক অদ্ভুত চুলের ঘ্রাণ আসছিল। কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিল না। সারা শহর দৌড়ে শেষে কী না বাড়ির কাছেই চুলের মালিককে খুঁজে পেল!
তার কাছে এমন চুলেরই অর্ডার আছে। ঠিক যেন পুরোন পাঁচিলের ওপর পুরু গালচে হয়ে থাকা গাঢ় সবুজ মস। হাত দিলে শিরশির করে। অর্কর চুলটা ঠিক তেমনই। অর্ক পাড়াতেই থাকে। তার জন্য ভালো খারাপ দুটো ব্যাপার হল। হাতের কাছে থাকার জন্য, ওর কাছ থেকে আবার সংগ্রহ করতে পারবে, অন্যদিকে বারবার হাত বাড়ালে ধরা পড়েও যেতে পারে।
ভেল্টু ঘরে ফিরে মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকে। সব বাড়ির কাজ সেরে গঙ্গা ঘরে ফিরে ছেলেকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়, “তোর কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“কিছু তো হয়েইছে। আমার কাছে লুকোস না।”
মায়ের কথায় ভেল্টু সব বলে ফেলে। গঙ্গা চিন্তিত মুখে বলে, “ওই মোড়ের মাথায় হলুদ বাড়িটাই তো রবিনবাবুর?”
ভেল্টু মাথা নাড়ে।
পরদিন গঙ্গা রবিনবাবুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। রবিনবাবু তখন কোথাও বেরচ্ছিল। গঙ্গা বলে, “আপনার ঘর ঝাড়পোঁছ করার লোক লাগবে শুনেছি।”
রবিন চোখ কুঁচকে তাকায়, “তোমায় কে বলল?”
“আমি এ পাড়াতেই কাজ করি, কত লোক আসে যায়, তাদেরই কেউ বলেছে।”
“ঠিক আছে, কাল সকালবেলায় এস, এখন আমি কাজে যাচ্ছি।”
“বাড়িতে কতজন লোক?”
“কেউ নেই।”
“অ”
অর্ক বাড়ি ফিরতে হইচই শুরু হয়ে গেল। ভেল্টুকে ডেকে জিজ্ঞাসাও করা হল। ভেল্টু বলে, “ওই রবিনদাদুর বাড়িতে চুলওয়ালা লোক ঢোকে, আর ন্যাড়া হয়ে বের হয়।”
অর্ক-র বাবা শুনে অবাক! তবে তো এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন। অর্কর বাবার পুলিশ মহলে চেনা জানা আছে। সেই সূত্রে স্থানীয় থানায় গিয়ে দেখা করে। দারোগা গোপালবাবু হেসে ফেলে, “ন্যাড়া হওয়া তো কোনও অফেন্স নয়, স্যার।”
“কিন্তু যদি কাউকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ন্যাড়া করা হয়?”
দারোগা গোপালবাবু কতকটা নিমরাজি হয়ে রবিনবাবুর বাড়িতে তদন্ত করতে রাজি হয়। “সে আপনি ওপর মহল থেকে সুপারিশ করেছেন, তাই যাচ্ছি। নইলে এই কেস-এ কোনও মেরিট নেই।”
পুলিশের সঙ্গে অর্কর বাবা, অর্ক আর ভেল্টুও এসেছে। রবিনবাবু দরজা খোলে, কোলে একটা কালো রঙের মোটাসোটা পার্সিয়ান কালো বিড়াল। রবিনবাবু সবাইকে চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করে। ভেল্টু আর অর্কর হাতে একটা করে চোকোবার ধরিয়ে দেয়।
পুলিশের আসার কারণ শুনে উনি হেসে ফেলেন, “দেখুন পরচুলা নিয়ে আমি কাজ করি। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা নিজে থেকে চুল দিয়ে যান। বিনিময়ে তাঁরা দক্ষিণাও পান।”
এই বলে, ফাইল খুলে চুল দেওয়ার হিসেব, রসিদ আর সই করা অনুমতিপত্রও দেখায়।
গোপালবাবু মন দিয়ে চা-এ বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। দেখে অর্ক-র বাবা খুব বিরক্ত হল। একটা কাজে এসেছে, সেদিকে মন না দিয়ে, চা-বিস্কুট খাচ্ছে।
হঠাৎই আধখানা বিস্কুট ভেঙে চা-এর মধ্যে পড়ে যায়। গোপালবাবু অপ্রস্তুত, অর্কর বাবা বিরক্ত। গোপালবাবু ভেজা বিস্কুটটা চামচ দিয়ে তুলে, রবিনবাবুর কোলে থাকা বিড়ালটার মুখের কাছে তুলে ধরে। বিড়ালটাও চকাস করে ভেজা বিস্কুট চেটে খেয়ে নেয়।
কান্ড দেখে রবিনবাবু ছিটকে ওঠে, “আপনি ওকে দেশি বিস্কুট দিচ্ছেন? জানেন ও ইমপোর্টেড ছাড়া খায় না।”
গোপালবাবু একটু যেন লজ্জিত, “সেকী? এ বিস্কুট তো ভাল!” অর্কর বাবা ভাবে, কাকে নিয়ে তিনি তদন্ত করতে এসেছেন? ইনি তো চা-ভেজা বিস্কুট নিয়েই পড়ে আছেন!
দারোগা গোপালবাবু নিজের অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে, গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এত চুল নিয়ে কী করেন?”
রবিনবাবু ওদের সবাইকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে নানা রকমের যন্ত্র, সে সবের ভেতর কাটা চুল পরিস্কার করা হয়। তারপর সে চুল, সুতোর রিলের মতো পাকিয়ে, প্যাকেট করে নম্বর লাগিয়ে রাখা হয়।
রবিনবাবু, সমস্ত পদ্ধতি ওদের বুঝিয়ে বলে, “এই প্যাকেটগুলো বিভিন্ন পরচুলা প্রতিষ্ঠানে, প্রয়োজন অনুসারে কুরিয়ার করে দেওয়া হয়।”
ঘরগুলো ঘুরতে ঘুরতে, ভেল্টুর শুধু রবিনবাবুর কোলে থাকা কালো বিড়ালটার দিকে চোখ। ইশারা করে অর্ককে দেখায়। অর্ক ভয় পেয়ে বলে, “কালো বিড়াল! খুব ভয়ানক!”
সে কথা শুনে রবিনবাবু বলে, “পার্সিয়ান বিড়াল। খুব যত্ন করতে হয়। খোরাসান, তুর্কমেনিস্থান, আফগানিস্থান হয়ে এই দেশে আসে।”

দারোগাবাবু চা-বিস্কুট খেয়ে খুব তৃপ্ত, “বাবা! বিড়ালের এত গুণপনা! আমাদের এখানেও তো কত বিড়াল!”
চুল নিয়ে খুব বেশি চুলচেরা অভিযান করতে হয়নি, এ জন্য দারোগা গোপালবাবু যেন একটু বেশিই খুশি। অর্কর বাবাকে বলে, “দেখলেন তো! আমি তখনই বললাম, এই কেস-এ কোনও মেরিট নেই। চলুন।”
এ ঘর থেকে সকলে বাইরের ঘরের দিকে যায়। রবিনবাবুর কোল থেকে বিড়ালটা নিচে নেমে দাঁড়ায়। ভেল্টু এগিয়ে গিয়ে পার্সিয়ান বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে ফেলেছে, “এ তো আমাদের পাড়ার মেনি!”
ওর কথা শুনে সবাই পিছন ফিরে তাকায়। রবিনবাবু হাঁ হাঁ করে বলে, “আরে! কামড়ে দেবে! কোলে নিও না। বিদেশি বিড়াল তো, নামিয়ে দাও, নামিয়ে দাও।”
“কামড়াবে কেন? ও তো আমাকে চেনে।”
সত্যই দেখা গেল, বিড়ালটা ভেল্টুর আদরে পররর ফরররর করছে আর ভেল্টুর হাতের ওপর লেজ ঘষছে।
অর্ক বলে, “কিন্তু মেনি তো অত মোটা নয়!”
ভেল্টু প্রতিবাদ করে, “আমি বলছি মেনি! বিশ্বাস হচ্ছে না?”
লোমের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে বলে, “ওর গায়ে সোয়েটার চাপানো। তাই মোটা লাগছে।”
দারোগা গোপালবাবু এবার উৎসাহী হয়ে চায়ের কাপ-প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে, এগিয়ে এসে বলে, “মানে?”
রবিনবাবু বিড়ালটাকে ভেল্টুর হাত থেকে কেড়ে নিতে চায়। দারোগা ওকে আটকায়, “দাঁড়ান! আগে আমিও একটু দেখি। কোথায় সোয়েটার দেখলে, খোকা?”
একটু পরীক্ষা করতেই দেখা গেলো বিড়ালটার গায়ে নেট দিয়ে একটা পরচুলা পরানো। দারোগা প্রশ্ন করে, “ওকে পরচুলা পরিয়েছেন কেন?”
রবিনবাবু একটু অপ্রস্তুত, “আসলে, আমার পার্সিয়ান বিড়ালের খুব শখ। এখানে তো পাই না, তাই ওকেই সাজিয়ে রাখি।”
“তাই কী? আপনি বিড়ালের পরচুলাটা খুলে আমায় দিন।”
“কেন?”
“ফরেনসিকে পাঠাব।”
রবিনবাবু প্রায় কেঁদে ফেলে, “সেকী? কেন?”
দারোগা গোপালবাবু তখন নিজের রূপ ধারণ করে বলে, “আমাকে না জানিয়ে, কোথাও যাবেন না। প্রতিদিন সকালে থানায় একবার করে, হাজিরা দেবেন।”
“আমি কী করলাম?”
“আগে ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট আসুক, তারপর বলব, আপনি কী করলেন।”
অর্ক-র বাবার মুখ দেখে এবার বোঝা যাচ্ছে, গোপালবাবুর আচরণে তিনি বেশ খুশি।
দারোগাবাবুর সন্দেহ, সত্যি প্রমাণিত হল। বিড়ালের পরচুলার সঙ্গে অর্কর চুল হুবহু মিলে গেছে। তারপরেই রবিনবাবুকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। রবিনবাবু বলার চেষ্টা করে, “চুল কাটা তো অপরাধ নয়।”
দারোগা গোপালবাবু আজ একদম রণমূর্তিতে। রেগে বলে, “একটি ছোট বাচ্চাকে অজ্ঞান করিয়ে, তার অজান্তে চুল কেটে নেওয়া, ভয়ঙ্কর অপরাধ। আর সারা দেশে পরচুলা নিয়ে একটা বড় কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে। আপনিও তার সঙ্গে কতটা জড়িত, দেখতে হবে।” পাড়ায় পুলিশ ঢুকতে, দেখে ভেল্টু অর্ক সমেত আরও অনেক মানুষ রবিনবাবুর বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে।
দারোগা গোপালবাবু তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই পরচুলা চোরাপথে বাংলাদেশ আর মায়ানমার হয়ে চীনে পৌঁছোয়। প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বাৎসরিক কেলেঙ্কারি। সেখানে রবিনবাবুর কতটা যোগ, আমরা তদন্ত করে দেখছি।”
রবিনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের গাড়িগুলো বেরিয়ে যায়।
অর্ক, ভেল্টুকে জিজ্ঞেস করে, “তুই মেনিকে কী করে চিনলি?”
ভেল্টু চোখ পাকিয়ে উত্তর দেয়, “মন্তর!”
অলংকরণ: আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।