— স্যার, আমি কমল।
— কী ব্যাপার? তোমার পেট কেমন আছে?
— একটু ভাল। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন স্যার?
— কেন, অমল, তোমার ভাই যে এসে বলল।
— কী বললেন? আমার ভাই? আমি তো বাবা-মার এক ছেলে স্যার। আমার কোনও ভাই-টাই …
কমলকে শেষ করতে না দিয়েই ঘটাং করে ফোন রেখে দিলাম। দরজা খুলে রেখেই লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে ছুটতে ছুটতে নীচে নামলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে সিকিওরিটি সদাশিবকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, মেমসাহেবকে দেখেছ? মেলাম করে সদাশিব বলল, হ্যাঁ স্যার। উনি তো এইমাত্র গাড়ি করে বেরিয়ে গেলেন।
দাঁড়িয়ে আছি, সদাশিব বলল, দুখানা বড় বড় সুটকেস ছিল স্যার। ড্রাইভারটাও নতুন। আপনাদের কমল ছেড়ে দিয়েছে?
সদাশিবকে বললাম, শোন গাড়ি ফিরলে ড্রাইভারকে বলবে, আমার সঙ্গে যেন দেখা করে তবে যায়। আলো না জ্বালিয়ে আচ্ছন্নের মতো বসেছিলাম, ঘন্টাখানেক কি তারও বেশি সময়। বেল বাজতেই ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। সদাশিব।
আমার দিকে গাড়ির চাবি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি অনেক করে বলেছিলাম স্যার, কিছুতেই আসতে চাইল না। বলল, ভীষণ জরুরি দরকার, এখনি যেতে হবে। চাবিটা আমার হাতে দিয়ে গেল। এই নিন।
আলো জ্বালাইনি। সবিতার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, ঢুকে অন্ধকারে আমাকে বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
— আলো না জ্বালিয়ে বসে আছেন দাদাবাবু? শরীর খারাপ?
— না, কিছু নয়, একটু চা করো সবিতা।
সবিতা চা করতে গেল। আমি টিভি অন করে নিউজ চ্যানেলে দিলাম। টিভির পর্দা জুড়ে তখন রাজধানী এক্সপ্রেস। ছিন্নভিন্ন শরীরগুলো গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে বের করে আনছে।
প্রয়োজন ছিল না। তবু টিভিতে যে নম্বরগুলো দেখাচ্ছিল তার একটায় ফোন করলাম। পরের ফোনটা করলাম দিল্লিতে, বাবুইকে।
আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যে আমার ভেতরে স্থির হয়ে তাকিয়েছিল অমল, তার অদ্ভুত নীল দৃষ্টি মেলে।
বাবুই ফোন করে জানিয়েছিল ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, দেশে ফিরবে না। ওর স্বামী অনুভব ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটায় ফ্যাকাল্টি পজিশন পেয়ে গেছে। বাবুইও একটা প্রজেক্ট-এ কাজ করছে, শিগগিরই কোথাও না কোথাও অ্যাবসরবড হয়ে যাবে। আর ফিরে আসার কোনও মানে হয় না।
তারপরেই ইমেইল — জানি, তোমার একা থাকতে খুব কষ্ট হবে। তাই রোজ রাতে একটা করে মেইল পাঠাব। আর পাপড়িকে বলেছি, এভরি সানডে ও ফোনে দাদাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে, ওকে?
জবাব দিইনি। কী বলব? তাছাড়া ও তো অনুমতি চায়নি। সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা কমিউনিকেট করেছে। কষ্ট হবে পাপড়িটার জন্যে। এখন তিন। হয়তো এর পরে যখন দেখা হবে, কে জানে কত বছর পরে, তখন চিনতেই পারবে না। ছোটদের স্মৃতি খুব পাতলা, দ্রুত বদলায়। দাদাই বলে কেউ আছে, তাই হয়তো ভুলে যাবে।
দাদাইও কি থাকবে ততদিন পর্যন্ত?
আকাশ আড়াল করে মেঘ জমে থাকে, নীলটুকু আর দেখাই হয়ে ওঠে না। দিন যতখানি, রাত্রি এখন তার চেয়েও অনেক বেশি দীর্ঘ, দিনের বেলা জীবনের চলমান জলছবি চোখের সামনে দিয়ে গড়িয়ে যায়, দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যায়। মাথা তুলে আকাশ দেখার কথা মনেও থাকে না। তিন-চারখানা ওষুধ খেয়েও যখন ঘুমকে বশে আনতে পারি না, তখন চেয়ার টেনে ব্যালকনিতে গিয়ে বসি। আকাশের দিকে তাকালে অন্ধকার দেখতে পাই। কালো আকাশ, বারো ঘন্টা আকাশ তো কালোই থাকে, তবু বাকি ঘন্টার পরিচয়ে আকাশ নীল। আকাশে ফুটে আছে অজস্র আলোর বিন্দু। জ্যোতির্বিজ্ঞানীর চোখের তাদের পরিচয় গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকা। আমার কাছে তারা বহু দূরের, অনাত্মীয়।
আত্মীয়, এখন অনুভব করি, একজনই ছিল। হেঁটে লিফটে উঠে চলে গেল। বাবুই আইডেন্টিফাই করে এসেছিল। আমি দেখতে যাইনি। এখনও ওর সেই চলে যেতে যেতে ফিরে দেখার দৃশ্যটাই আমার ভেতরে গাঁথা আছে। ওটুকুই আমার।
কখনও, মেঘ সরে গিয়ে যখন আকাশ উদোম হয়ে যায়, হঠাৎ তার তীব্র নীল এসে আমাকে নাড়িয়ে দেয়। আকাশ নয়, সমুদ্র তো নয়ই, অন্য এক নীল আমার অবচেতন থেকে মুখ বাড়ায়।
সেই দিনটা বারবার স্মৃতিতে ফিরে আসে। কমল এল না, তার বদলে এল অমল। ট্রেন ধরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, ড্রাইভার পৌঁছে গেছে, খুশি হবারই তো কথা। অথচ কী এক অস্বস্তি আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। তখন বুঝিনি। পরে চিন্তা করে দেখেছি, ভেতরে কোথাও একটা ঘন্টা বাজছিল। মনে পড়ছিল অন্য একটা দিনের কথা। সেদিনও একজনের জায়গায় অন্য একজন কাজটা করে দিয়েছিল।
এবং আরও কিছু। প্রথম দিনটার কথা মনে পড়তেই স্মৃতির উজান বেয়ে উঠে আসছিল একটা চোখ। সেই চোখের রং নীলাভ। সেই চোখে কোনও ভাষা ছিল না। প্রথম দিন সেই চোখে দেখে কৌতুহল হয়েছিল। দ্বিতীয় দিন, যখন মনে পড়ল এই চোখ আমি আগেও দেখেছি, তখন এক তীব্র ভয় আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। যেন সিদ্ধান্তে আমি পৌঁছেই গিয়েছিলাম। টিভি খুলে শুধু মিলিয়ে নেবার অপেক্ষা। টিভি আমাকে নিরাশ করেনি।
আকাশে চোখ মেলে দিই, সমুদ্রেও চোখ পেতে রাখি। সেই নীল কোথাও খুঁজে পাই না। মানুষেও। নতুন মানুষ, অচেনা কেউ, এলেই আলাপ হলেই, তার চোখের ভেতরে শুরু হয় আমার অন্বেষণ। সকলেই আমাকে নিরাশ করে।
তাহলে কি আমি মৃত্যুবিলাসী হয়ে উঠেছি? জীবন কি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে? বাকি কটা দিন কি শুধু মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেই আমাকে কাটিয়ে দিতে হবে?
তাতো নয়। এখনও আমি হাসপাতালে যাই, রোগী দেখি, কনফারেন্স আ্যাটেন্ড করি, বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারে আমার সমান আগ্রহ। তার বাইরেও ভাল লেখা, ভাল সিনেমা, ভাল ছবি পড়লে বা দেখলে আমার তৃপ্তি হয়। বেঁচে থাকার সমস্ত লক্ষণই আমার মধ্যে অটুট। ভাবতে ভাবতে এক সময় মনে হয় আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, অনুসন্ধিৎসাই আমার চালিকাশক্তি। জীবনের দু দুটো দিনে আশ্চর্য এই ঘটনা ঘটেছিল। একটি মানুষ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তারপরেই ঘটে গিয়েছিল এক দুর্ঘটনা। এটা কি কেবলই কাকতালীয়, এক বিচিত্র সমাপতন? নাকি কেউ এসে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল, যা ঘটতে চলেছে, যা অবশ্যস্তাবী, তার সম্ভাবনা। সে কি আমাকে সতর্ক করতে চেয়েছিল? নাকি আমাকে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের জন্য?
সিঁড়ি ভাঙতে হাঁফ ধরছিল; কিংশুক আমার ছাত্র, ওর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস, দেখে বলল, অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা দরকার স্যার। চিন্তা নেই, ব্যাপারটা এখন জলভাত। কবে আসবেন বলুন, আমি সব রেডি রাখব।
বাবুইকে মেইল করলাম। ও সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, আমার এখন মিডসেশন চলছে, যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাও চেষ্টা করছি। তোমার ওটা কি ডেফার করা যায় না?
জবাবে বললাম, অ্যাঞ্জিওগ্রাফি এখন একটা আউটপেশেন্ট প্রসিডিওর, অনেক জায়গায় সেই দিনই ছেড়ে দেয়। সামান্য ব্যাপার, আমার কোনও দরকার নেই। পরে অপারেশন টপারেশন লাগলে জানাব, তখন আসিস।
রাত্তিরে পাপড়িকে ফোনে ধরিয়ে দিল বাবুই। অনেকক্ষণ কথা বলল, এ তো চমৎকার ফোন করতে পারে, তিন বছরের বাচ্চা, ভাবাই যায় না।
ভারি ডোজের ওষুধ খেয়েও রাত্তিরে ঘুম এল না। বারান্দায় বসে সারারাত তারা গুণলাম। ভোরের হাওয়ায় চোখ বুজে এসেছিল, গায়ে রোদ পড়তে ঘুম ভেঙে গেল। কিংশুক আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সামান্য যেটুকু প্রস্ততি লাগে আগের রাতেই আমার নেওয়া ছিল। অন্যদের আগের রাতটা হাসপাতালেই কাটাতে হয়। আমার জন্যে বিশেষ ছাড়। প্রেসার পালস এসব দেখে ও নার্স কে বলল প্রিপেয়ার করে আমাকে ক্যাথ-ল্যাব-এ পাঠিয়ে দিতে।
ট্রলিতে শুইয়ে নার্স নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমিই জোর করে নিজে হেঁটে গেলাম। ওটির ভেতর ঢুকে দেখলাম সবাই রেডি। টেবিলে শোয়াতে শোয়াতে কিংশুক বলল, এতদিন অন্যদের করেছেন, আজ নিজে শুতে কেমন লাগছে স্যার?
— অন্যরকম, বেশ অন্যরকম। বলে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম।
একজন আলো ঘুরিয়ে আনছিল আমার ওপরে। হঠাৎই কিংশুক বলল, স্যার, আলাপ করিয়ে দিই, আমাদের নতুন টেকনিশিয়ান, অনিন্দ্যবাবু, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত। খুব কোয়ালিফায়েড লোক, ভাস্ট এক্সপিরিয়েন্স। আজই জয়েন করলেন।
আলোর আড়াল থেকে একটা মুখ এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই নীল চোখের তারায় চোখ রেখে আমি হেসে ঘাড় নাড়লাম। চোখ ঢেকে দিল নার্স ।
স্বনামধন্য চিকিৎসক | তবে সাহিত্যের জগতেও অতি পরিচিত নাম | লেখা প্রকাশিত হয়েছে বহু অগ্রণী পত্র পত্রিকায় |