আমি আবার কাঁদব হাসব
– হেমন্তকাল কাকে বলে দাদু?
– যখন ধান কেটে নেওয়ার পর খাঁ খাঁ পড়ে থাকে ক্ষেত, কুয়াশায় মুড়ে যায় রাত্তির। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে তখন। সেই বিষণ্ণতার মধ্যে একটা করুণ সুর বাজতে থাকে।
– কেন?
– তুমি বুঝবে না দাদুভাই। চোদ্দো বছর বয়সে হেমন্ত আর কী বুঝবে। বছরটা যা যাচ্ছে। এক এক করে কত মানুষ চলে গেল।
– দাঁড়াও তোমার চা এনে দিই। আজ বাবা চা বানাচ্ছে।
– তুমি বরং এক কাজ কর নাতিবাবু। আগে চশমাটা দাও।
নাতি দৌড়িয়ে চশমা আনতে গিয়ে দেখল বাবা একহাতে চা অন্যহাতে মোবাইল ফোন নিয়ে দাদুর কানে দিচ্ছেন।
– কে রে?
দাদুর চোখে প্রশ্ন।
– ধরো বাবা। আকাশবাণী থেকে তোমার এক বন্ধু ফোন করেছেন।
– কে বল তো?
কথা বলতে বলতে দাদুর চোখমুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অর্ঘ্য শুনতে পেল দাদুর খোলা গলার হাসি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অর্ঘ্য। আজ তিনমাস স্কুল বন্ধ। বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দাদু লুডো আর দাবা নিয়ে তাকে ডাকেন। মা সারাদিন রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সেরে আর গল্প করার সময় পান না। অর্ঘ্য দেখতে পায়, মা ঘুমিয়ে পড়েছে তার আগে। অনলাইন ক্লাস করতে আর কত ভাল লাগে? বেশিক্ষণ ডেস্কটপের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ কটকট করে। ঘর থেকে দাদু মোবাইল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। শেষের কথাটুকু শুনতে পাচ্ছে অর্ঘ্য।
– এখনই লাইভ হবে? এই শোনো আমার কিন্তু লজ্জা করছে। সঙ্কোচ লাগছে।
দাদুর ইশারাতে দৌড়িয়ে রেডিও আনল অর্ঘ্য। চ্যানেল অন করতেই একটা গমগমে গলা শোনা গেল।

আজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। বাঙালির স্বর্ণযুগের এই গায়কের গান আমরা সারাদিন ধরে চ্যানেলে শোনাতে থাকব আপনাদের। এখন আমাদের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছেন শ্রী সুশান্ত সিংহ। আশি বছর বয়স্ক এই মানুষটি সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন, এমনকী সেসময় যে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাও দেখেছেন। আজকের মহামারীর থেকেও ভয়ানক কঠিন ছিল সেই পরিস্থিতি। অর্ঘ্য চটজলদি দাদুর দিকে তাকাল। আরে, শ্রী সুশান্ত সিংহ তো অর্ঘ্যর ঠাকুরদা। তবে কি দাদুই গাইবেন এখন? বাবা মাকে একদৌড়ে ডেকে নিয়ে এল অর্ঘ্য। দাদু মোবাইল কানে নিয়ে বললেন,
– আপনাদের সবাইকে নমস্কার। শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। উনি তো প্রবাদপ্রতিম গায়ক। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন না যে হেমন্তবাবু কত বড় মনের মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর পর ওঁর স্ত্রী বেলাদেবী জানতে পেরেছিলেন যে কত কত মানুষকে উনি টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করতেন। অথচ কোনও প্রচার ছিল না। প্রচণ্ড সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন হেমন্তবাবু। আপনারাই বলুন, একজন শিল্পী যদি বড় মনের মানুষ না হন, তবে তাঁর শিল্প কি অমরত্ব পেতে পারে?
বাবা ফিসফিস করে মায়ের কানে কানে বলল,
– বাবা কিন্তু ইমোশনাল হয়ে গেছেন। গান আদৌ গাইতে পারলে হয়।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দাদু ফের বলে উঠলেন,
– আমি আসলে নিরাশার কিছু দেখছি না। মহামারী কিংবা মন্দা, একটু ধৈর্য ধরলে ঠিক জয় করতে পারব। মনে সাহস রাখুন। লড়াই করতে হবে। ঝড় সামলাতে হবে। জীবন একটাই। ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ হেমন্ত।
হঠাৎ দাদুর গলায় সেই গানটা রেডিওতে শুনতে পেল অর্ঘ্য–
‘আমি আবার কাঁদব হাসব
এই জীবনজোয়ারে ভাসব
আমি বজ্রের কাছে মৃত্যুর মাঝে রেখে যাব নিশানা।
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।’
অর্ঘ্য দেখল বাবা মা দুজনেই হাসিমুখে ঠোঁট মেলাচ্ছে। পাশের বাড়ির দীপুজেঠু, রিনা আন্টি সবাই উঁকিঝুঁকি মারছে রেডিওতে দাদুর গান শুনে। অর্ঘ্য জিভ কাটল মনে মনে। ইস, আগে যদি এই গানটা সে তুলে রাখত গিটারে, তাহলে এখন দাদুর সঙ্গে বাজাতে পারত। দাদু প্রায়ই বলেন, শিকড় ভুলো না দাদুভাই। যতই পপ রক শোনো, বাংলাগানের চর্চা রাখতেই হবে। নাহ্, ফের গিটারটা নিয়ে বসতে হবে। গুলি মারো মনখারাপে। পাত্তাই দেব না একদম। মনে মনে বলল অর্ঘ্য।
– ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ হেমন্ত। ঠিক বলিনি খোকা বল?
দাদু উঁকি মেরে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অন্যদিন নাতি চুপচাপ বসে থাকে। আজ কিন্তু গিটারের তারে ঝংকার তুলেছে। দাদুর চোখে জল। মুখে হাসি।

এপিটাফ
– তোর মনে আছে কোথায় কোথায় লুকোতিস?
খিলখিল হাসির শব্দ।
– মনে থাকবে না! ও জিনিস ভোলার নয়। জলের ট্যাঙ্কের পিছনে, মণি কাকিমাদের বাগানে, পার্কে দোলনার সামনে লিলির ঝোপে।
– তাও খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে ফেলতাম।
– সে আবার করবি না! আচ্ছা শয়তান ছিলি তুই! প্রথম থেকেই কুমতলব…
– অ্যাই, ফালতু বকিস না। তখন আমি জাস্ট দশ বছরের নিষ্পাপ ছেলে।
– হেল ইওর ইনোসেন্স। বদমাইশ ছিলি।
– তুমিও কত সরলমতি বালিকা ছিলে জানা আছে। চোখ মারতে শিখিয়েছিলি তুই। লুকিয়ে মায়ের লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে সানগ্লাস পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কে ঢঙি পোজ় দিত?
– শোন, দশ বছরে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি পাকে। ন্যাচারাল ডাইভার্শন। তাও তো তখন ইন্টারনেট আসেনি। ২০০০ সালে প্রথম মোবাইল এল। আমরা তখন বারো।
– দ্যাটস নাইস। পাড়ায় প্রথম মোবাইল কিনছিলেন তোর বাবা। বাই দ্য ওয়ে কেমন আছেন উনি?
– বিন্দাস। মা মারা যাওয়ার পর থেকে শুধুই পার্টির কাজ। পুরোপুরি সমাজসেবা। রিটায়ার করতে আর দু’বছর। অবশ্য আমার তাতে এখন কী যায় আসে! সারাজীবন মেয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে গেল। আই জাস্ট ওয়ান্টেড হিজ কমপ্যানি, হিজ টাইম।
– আবার দু:খ করছিস ? বলেছি না , এসব নিয়ে ভাববিনা! সবকিছু তোর কন্ট্রোলে নেই, ছিল না, থাকবে না।
– আই নো। দূর থেকে সিমপ্যাথি দেখানো অনেক সহজ। বাবার সঙ্গে থাকলে বুঝতিস।
– তোর বিয়েটা ভাঙল বাবার জন্য! প্লিজ ডোন্ট ব্লেম ইয়ার। আমি তোর সব খবর রাখতাম পিকলুর মারফত। তোর বিয়ে, ডিভোর্স।
– পার্সোনাল ইন্টারফেয়ার করতে একটা মিনিমাম সম্পর্ক লাগে সুমন্ত্র। জানতিস যখন জিজ্ঞাসা করছিস কেন?
– আমিও ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। আমেরিকা দেশটাকে বাইরে থেকে স্বর্গ মনে হয়। এখানে এসে জীবনযুদ্ধ সাংঘাতিক। তুই হয়তো জানিস না, আমি একটা সময় ট্যাক্সিও চালিয়েছি। বাড়িতে জানত সফোর চাকরি করি। এশিয়ার প্রচুর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এখানে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়।
– বিয়ে করলি না কেন ক্যাটরিনাকে?
– ও চাইল না। এখানে লোকজন লিভ টুগেদারে অভ্যস্ত।
– সে তো খেলা! ইচ্ছে হলে থাকা, নয়তো চলে যাওয়া।
– লুক, রিনি, আমাদের মহাভারতের সময়েও কিন্তু লিভ টুগেদার ছিল। জীবনটাই তো পেশেন্সের খেলা।

– বাবা কেমন আছে বললি না?
– আজ জ্বরটা নেই। কিন্তু শ্বাসকষ্ট আছে। ভেন্টিলেশনে দিতে হতে পারে। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে সুমন্ত্র। কাকারা আছে, মাসতুতো দাদারা এসেছে। কিন্তু…
– আর কত অভিমান করে থাকবি বাবার উপর! এখনও জ্ঞান আছে যখন ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নে। এরপর যদি আরও খারাপ কন্ডিশন হয় এটুকুও চান্স পাবি না রিনি।
– একদম ঠিক। সেটাই ভাবছিলাম । তুই বলে দিলি। আসলে…
– কী আসলে? রিনি? চুপ কেন? বল…
– নাহ…
– একা হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিস? জানিস, ছোটবেলায় হাইড অ্যান্ড সিক খেলার সময় যখন তুই হারিয়ে যেতিস, কিছুতেই খুঁজে পেতাম না, বেদম ভয় হত।
– ফালতু গুল দিস না। মুড ভাল নেই।
– বিলিভ মি। বিশ্বাস করবি কিনা তোর মর্জি।
– সুমন্ত্র এতো বছর বাদে ইনস্টাগ্রামে তোকে খুঁজে বার করলাম আমি। বেকার ঢপ দিচ্ছিস কেন? ফ্লার্টিং একটা চমৎকার খেলা আমি জানি। কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।
– তুই এখন কোথায় রিনি?
– কোয়ারেন্টাইনে। বাবা করোনা পজিটিভ জানার পর থেকে পাড়ার সবাই আমাক বয়কট করেছে। কাকারা রেগুলার বাবার খোঁজখবর নিচ্ছে হসপিটালে। ভিডিও কনফারেন্সে।
– তুই একবার ভিডিও কলে কথা বলিস ওঁর সঙ্গে। আমাকে যেভাবে অ্যাভয়েড করেছিস, ফর গডস সেক ডোন্ট ডু দ্যাট।
– আমি? তোকে?
– ছুঁতে দিয়েছিলি কখনও? ছোটবেলার ছোঁয়াছুয়ি খেলা বড় হয়ে একবারও খেলেছিলি? কতদিন একসঙ্গে কাটিয়েছি, কফি হাউজ, ভিক্টোরিয়া, ময়দান। মনে করে দ্যাখ রিনি, একবার শুধু একটা চুমু ভিক্ষে করেছিলাম। তুই এতো পিউরিটান!
– সাত বছর ধরে কথাটা তোকে লুকিয়ে গেছিলাম। ইয়েস, সেভেন ইয়ার্স ব্যাক, হোয়েন আই ওয়াজ টুয়েন্টি ফাইভ…
– থামলি কেন? বল…
– আমি এইচ আই ভি পজিটিভ। ব্লাড নিতে গিয়ে হয়েছিল। তোর মনে আছে নিশ্চয়ই আমি যেবার বাথরুমে পিছলে পড়ে মাথা ফাটিয়েছিলাম, প্রচুর ব্লিডিং হয়েছিল।
– আলবাত! সব মনে আছে। সেই স্মৃতিগুলোই তো সম্বল রিনি। আমাদের বন্ধুত্বের এপিটাফ।
– বিরাট নার্সিংহোম ছিল। ঝাঁ চকচকে। তোরা নিয়ে যাওয়ার পর ব্লাড দিয়েছিল আমাকে। বেশ কয়েক বোতল। প্রাণে বেঁচে গেলেও বুঝিনি যে ওই রক্ত বেয়ে ঢুকে পড়েছিল যমদূত।
– সে কী?
– হ্যাঁ, কাউকেই কিছু জানাতে পারিনি। হাসপাতাল প্রথমে খবরটা চেপে যাওয়ার জন্য ভয় দেখিয়েছিল। পরে বাবার পার্টি ফান্ডে কিছু টাকা খেসারত দিয়েছিল। বিয়েটা কেন টেঁকেনি নিশ্চয়ই বুঝলি এতক্ষণে। সুমন্ত্র?
– রিনি!
– বাবার সঙ্গে বিরোধ আরও বেড়েছিল এই কারণে। খবরটা লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছিল। বাবার অসহায়তা কুরে কুরে খাচ্ছিল। নিজের মেয়েকে কোন বাবা চায় একা রেখে যেতে?
– এইজন্য তুই ছুঁসনি আমায়? এতবড় খবরটা চেপে গিয়েছিস?
– আমি ভাল আছি সুমন্ত্র। ট্রিটমেন্ট চলছে। সহজে মরব না। তবে হ্যাঁ, এখন আমি সত্যিই অস্পৃশ্য।
– জানলা দিয়ে তাকিয়ে দ্যাখ একবার! মণিকাকিমাদের বাগানের পিছনে…
– হোয়াট আ সারপ্রাইজ! ইজ দিস ট্রু! সুমন্ত্র তুই কীভাবে…
– মার্চে এসেছিলাম দেশে। তিন সপ্তাহের জন্য। আর ফিরতে পারিনি। ইনফ্যাক্ট, ফিরব না।
– তুই এখনই চলে যাস না। একবার আমার জানলার সামনে আসবি? কত বছর তোকে দেখিনি। আমি মাস্ক পরে আছি, ভয় নেই।
– তুই বেরিয়ে আয় রিনি। এই যে আমাদের ছোটবেলার মাঠ, গোলপোস্ট।
– তোর কি মাথাখারাপ? এখনই লোকজন চেঁচামেচি করবে! তাছাড়া, ভাইরাস আমার সর্বাঙ্গে। যে কোনও সময় আমাকে কাবু করে ফেলতে পারে।
– তুই বেরবি রিনি?
– না।
– তাহলে আমি কিন্তু চেঁচাব। মাঠের মাঝখানে এসে একবার দাঁড়া আগের মতো। আকাশে কালো মেঘ। কত ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেছি দুজনে। আজ একবার, আবার।
– সুমন্ত্র প্লিজ, বোঝার চেষ্টা কর…
– বন্ধুত্বের এপিটাফ হয় না রিনি। ভাইরাস মরে যাবে। ভালোবাসা নয়।
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।