ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারতাম আমায় ক্রিম মাখানো হচ্ছে। মা সব কাজ সেরে ঠান্ডা হাতে আমার ফাটা গালে চেপে চেপে ক্রিম মাখিয়ে দিচ্ছে। নাকের কাছটা সেই ক্রিমের গন্ধ এবং সাদা প্রলেপে প্রায় বন্ধ। কাঁইমাই করে উঠতাম ঘুম ভাঙিয়ে এই প্রবল অত্যাচারের জন্য। কিন্তু একটু পরেই চারমিস ক্রিম আর তুহিনা মাখা মায়ের গন্ধে লেপের মধ্যে আশ্চর্য উষ্ণতায় ডুব দিতাম। শীত কাল এলে মা আরও সুরভিত হয়ে উঠত। গ্লিসারিন সাবান, ত্রিম আর লোশনের আদরে। মা ঘোরাফেরা করলে নিশ্চিন্তির শীতকাল থাকত চারপাশ ঘিরে। অন্য ঘরে থাকলেও মায়ের সুরভিত গন্ধের চাদর মিঠে রোদের মতো ছড়িয়ে থাকত আমার আর দিদির ওপর। এ আমার ক্রিম-লোশনের মা। স্নো-মাখা মা ছোট ছিল। তার গল্প শুনেছি কেবল।
দাদু না কি হাঁটু অবধি মোজা পরাতেন মেয়েদের। ফার কোট বরাদ্দ শীতকাল জুড়ে, সঙ্গে এক এক বোনের আলাদা-আলাদা স্নো-এর কৌটো, আর গায়ে মাখার লোশন।বিদেশি হবে বোধ হয়। কী ভাগ্যবতী সে সময়ের মা। মাত্র দশ-এগারো বছর বয়সে একান্ত সুগন্ধিতে পূর্ণ অধিকার, যখন-তখন ব্যবহার করার এক্তিয়ার! উফফ ভাবা যায় না! আসলে নিজেকে অল্প অল্প করে মখমলের মতো করে তোলার যে সব আনুষঙ্গিক, সে সব যে অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত হবেই, এ আর নতুন কী! তবে, সে কালে এ সবের কদর আরও বেশি ছিল, কারণ সেই সকল দ্রব্যাদি অপ্রতুল ছিল।
আমি যে বড় হয়ে স্নো দেখিনি তা নয়। আমার জেঠিমার কাছে দেখেছিলাম। কিন্তু খুব ভাল লাগেনি। কেমন যেন রেশম-রেশম, পেছল-পেছল। কিছুতেই যেন ত্বকের আয়ত্তে আসে না। সম্পর্কে যেন একটা ফস্কা-গেড়ো ভাব। মাখলেই কেমন একটা মোলায়েম মসলিন হয়ে চামড়ায় থিতু হয়।গালে একটা বাহারি ভাবও আসে। সঙ্গে সুগন্ধি ছড়িয়ে আসর-আকর্ষণীর উপস্থিতি জানান দেয়। তবু এ কালের সঙ্গে তার ঠিক বনিবনা হয় না।
সেই-ই বোধ হয় ঠিক। সব কালের জন্য তো সব জিনিস নয়। অনেক সময়কালে অনেক কিছু বেমানান লাগে। সাদা-কালোয় উত্তম-সুচিত্রা বা রাজ কপূর-নার্গিসকে দেখলে যেমন হৃদয় চলকে ওঠে, এ কালে রণবীর-দীপিকাকে দেখলেও ঠিক যেমন তেমনটা হয় না। তাই স্নো বরং তোলা থাক সে কালের আধো-স্বপ্ন, আধো-বাস্তব বেণী দোলানো সাদা-কালো সুচিত্রা সেনেদের জন্য। কিছু কিছু জমকালো সে কালকেই মানায়। তবে, একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, স্নো-মাখা প্রেমিকার গাল নিশ্চয়ই অনের বেশি স্নিগ্ধ ছিল, এ কালের বিবি-সিসি ক্রিম মাখা প্রেমিকাদের গালের চেয়ে।