বাদল দাস দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্চসঙ্গী। না, অভিনেতা নন। বাদলবাবু আলোকশিল্পী। নাটক মঞ্চায়নের অন্যতম মূল কারিগর তিনি। আশির দশক থেকে সৌমিত্রবাবুর অভিনয়জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত একভাবে তাঁর কাছে থেকে মঞ্চে আলোকসজ্জার কাজ করেছেন বাদলবাবু। সৌমিত্রবাবুর প্রয়াণের পর যখন যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গে, স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন বাদলবাবু মনেই করতে পারছিলেন না কবে বা কোন নাটকে প্রথম কাজ করেছিলেন সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে। তাঁর কাছে গোটাটাই এক সুদীর্ঘ যাত্রাপথ, এক বৃহৎ শিক্ষাঙ্গন, যেখানে এক মহীরূহের ছায়াতলে থেকে তিনি একটির পর একটি ফুল ফুটিয়ে গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন পল্লবী মজুমদার।
কেমন দেখেছেন সৌমিত্রবাবুকে, এ প্রশ্নের জবাবে গোড়াতেই বিনীতভাবে নিজের অপারগতা জানিয়ে দেন আলোকশিল্পী বাদল দাস। স্পষ্ট করেই বলেন, “অতবড় মানুষের সম্পর্কে কোনও কিছুই বলার ক্ষমতা আমার নেই। আমি যে এত বছর ওঁর মতো মানুষের কাছাকাছি থেকে কাজ শিখতে, করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে এক পরম প্রাপ্তি। ওঁর ব্যাপারে বলার মতো ক্ষমতা নেই আমার। শুধু এটুকু বলতে পারি, উনি সকলের চেয়ে আলাদা।”

এই ধরতাইটুকুই যথেষ্ট ছিল। প্রশ্ন করলাম, কোনখানে আলাদা? বাদলবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘সবটাই।’ তারপর স্মৃতি হাতড়ে বলে চললেন, ‘সকালে হয়তো কোনওদিন ফোন করে বললেন, বাদল চলে এস। বুঝলাম, নতুন নাটক আসছে। চলে গেলাম টেকনিশিয়ানস স্টুডিওতে। নিজের মুখে নাটক পড়ে শোনালেন। তারপর শুরু করলেন বোঝানো। কোন দৃশ্যে কী বলতে চাইছেন, কী ধরনের বক্তব্য উঠে আসছে নাটকের মধ্যে দিয়ে পুরোটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাদল, এবার তুমি তোমার মতো কর। হোমাপাখি অভিনয়ের কথা খুব মনে পড়ে। লন্ডন-নিবাসী চিকিৎসক পরিচালক অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের লেখা সেই নাটক সৌমিত্রবাবুর অন্যতম সেরা কাজ। নাটক পড়ে শুনিয়ে মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, বল বাদল, ডাক্তারকে এবার কী ওষুধ দেবে তুমি!’
বলতে বলতে মেদুর হয়ে আসে বাদলবাবুর গলা। মনে হয় যেন চিত্রতারকা নন, ছোট ছেলের কথা গল্প করছেন। স্নেহের ছোঁয়া কণ্ঠস্বরে – ‘অতবড় মানুষটা কাজ করতে গেলে যেন একদম শিশুর মতো হয়ে যেতেন। সে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। উনি যে তারকা, কিংবদন্তী, কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না তখন। সকলের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছোট ছেলেটির মতো হইহই শুরু করে দিতেন কাজ নিয়ে। আমি অমনটি আর কাউকে দেখিনি।’
স্মৃতির আগুন আরও একটু উস্কে দিতে চেয়ে বিদেশে নাটক করতে যাবার গল্প শুনতে চাইলাম। হেসে ফেললেন বাদলবাবু। বোঝা গেল, অনেক অনেক সুখস্মৃতি তাঁর ঝুলিতে। বলতে লাগলেন, “হোমাপাখি করতে গিয়েছি ইংল্যান্ডে। লন্ডনে অমিতদার বাড়িতেই রয়েছি। সৌমিত্রদা বরাবরই বেশ সকালে ওঠেন। একদিন সকালে উঠে আমার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, বাদল চল। আজ আর ঘরের মধ্যে নয়, নদীর ধারে ঘুরব। ওমা! সত্যিই বেলা দশটা না বাজতে সেজেগুজে আমাকে, শান্তিদাকে, পৌলমীকে, দ্বিজেনবাবুকে (মুখোপাধ্যায়) নিয়ে চললেন নদীর ধারে বেড়াতে। সেখানে গিয়েই বললেন চল আইসক্রিম খাই। কে বলবে ওঁর বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে? মনে হচ্ছে যেন তরুণ! হাতে আইসক্রিম নিয়ে নদীর পাড় ধরে বেড়াতে বেড়াতে চলল নাটকের আউটডোর ক্লাস।”
তারকা পরিচয়টা তাহলে ফেলে রেখে আসতেন স্টুডিওতেই? বাদলবাবুর গলায় বিস্ময় মেশানো অভিব্যক্তি। বললেন, “সত্যিই বোধহয় তাই। অতবড় মানুষটা, ওরকম ব্যক্তিত্ব, সামনে দাঁড়াতে তো ভয়ই লাগত। কিন্তু একটিবার কথা বললেই সেসব কোথায় উধাও। তখন যেন উনি আমাদের ঘরের লোক। এমনভাবে গল্প করতেন, আড্ডা দিতেন। কুরবানি, একটি দিন, সবজান্তা, আরোহণ, হোমাপাখি, ছাড়িগঙ্গা, আত্মকথা এসব নাটকের কথা ভুলতে পারি না। ছাড়িগঙ্গার ন্যারেশন খুব মনে পড়ে। নাটকটা পড়ে শুনিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাখ্যা করলেন। ক্লান্তি নেই। তারপর পুরোটা বুঝিয়ে বলে দিলেন, নাও বাদল, এবার তুমি যেমন করবে।”

তাহলে কাজের ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীনতা থাকত? বাদলবাবু বললেন, “আসলে উনি কখনও কোনও ধোঁয়াশা রাখতেন না আমাদের মনে, এমনই ছিল ওঁর ব্যাখ্যা। কত নাটক তো আমরা করি, সব যে একবার পড়েই বুঝে ফেলি, তা তো নয়। অনেক অভ্যন্তরীণ অর্থ থাকে, ভাঁজ থাকে, লুকনো কথা থাকে সরাসরি সংলাপের অন্তরালে। সেগুলো সবসময় ন্যারেশন শুনেই স্পষ্ট হয়তো বোঝা যায় না। কিন্তু উনি সেখানে ছেড়ে দিতেন না। প্রতিটি দৃশ্য ধরে ধরে ব্যাখ্যা করে যেতেন, যাতে তার অন্তর্লীন অর্থের ব্যঞ্জনা আলোর খেলায় ফুটিয়ে তোলার সময় মনে কোনও দ্বিধা না থাকে। পুরোটা প্রাঞ্জল করে দিতেন পড়তে পড়তেই। কখনও বলতেন না, আমি যা বলছি তাই কর। বুঝিয়ে দিয়ে বলতেন, নিজের মতো করে কর। তাই করেছি সবসময়। হয়ে গেলে দেখতে চাইতেন। শুনতে চাইতেন, কী ভেবে কোন আলো সাজিয়েছি। হোমাপাখিতে, মনে পড়ে, একটা নাচের দৃশ্য ছিল প্ল্যাটফর্মের উপর। খুব গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। তার আলো করার সময়েও আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।”
আর ভুলত্রুটি হলে কী করতেন? একটুও না ভেবে বাদলবাবুর জবাব, ‘খুব রেগে যেতেন। তখন বকুনির হাত থেকে কেউ রেহাই পেত না। তবে ওই বকুনি যেমন আর কেউ দেবে না, ওই বোঝানোটাও আর কেউ কখনও বোঝাবে না। নাটকে আলো দিয়ে দৃশ্যকল্প কীভাবে রচনা করতে হয়, কেউ শেখাবে না ওভাবে। ছাড়িগঙ্গার মতো একটা কঠিন নাটক। সেটাও যেন জলের মতো সহজ করে দিতেন। হোমাপাখির সময়ে চিকিৎসকের মনঃস্তত্ব এমন সরল করে বোঝাতেন, কখনও খটোমটো লাগত না।’
বাদলবাবুর মনে বারবারই উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল কিংবদন্তীর সঙ্গে বিদেশে নাটক করতে যাবার নানা অভিজ্ঞতা। বাদলবাবুর অভ্যেস খুব ভোরে উঠে হাঁটতে যাওয়া। কী শীত কী গ্রীষ্ম। লন্ডনে নাটক করতে এসেও, যাঁর বাড়িতেই থাকুন না কেন, সৌমিত্রবাবু স্নেহধন্য বাদলকে বলে রাখতেন, ‘বাদল আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে হাঁটতে যাব।’ যেতেনও। ঘড়ি ধরে। কখনও ক্লান্ত হয়ে পড়লে বলতেন, ‘বাদল তুমি আর একপাক দিয়ে নাও। আমি ততক্ষণ একটু বসি।’ তারপর বাদলবাবু হাঁটা শেষ করে ফিরে এলে বেঞ্চিতে বসে শুরু হত আড্ডা। ‘কতকিছু যে বলতেন, কত পুরনো থিয়েটারের গল্প, সিনেমার গল্প… ওঁর অভিজ্ঞতার তো শেষ নেই। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। উনি সত্যিই বিশ্বাস করতেন ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়’ কথাটা। যতদিন চলৎশক্তি ছিল, ব্যায়ামের অভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন। শরীরকে ভাল না বাসলে যে ভাল অভিনয় করা যায় না, নিজের জীবন দিয়ে যেন সেই শিক্ষাই দিতে চাইতেন।’ বলতে বলতে সে সব দিনের স্পর্শে-গন্ধে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন বাদলবাবু।

আর মানুষ সৌমিত্র? একান্ত কথনে কেমন ছিলেন কিংবদন্তী মানুষটি? নাট্যপরিচালক নন, কবি নন, চিত্রতারকা নন, কেমন ছিলেন সেই ব্যক্তি মানুষটি? সকলের সৌমিত্রদা? এবার সত্যিই বাদলবাবুর গলা ধরে আসে। একটু চুপ করে থেকে শুধু বার দুয়েক বলেন, ‘খুব ভাল, খুব ভাল। একটা মানুষের শরীরে একসঙ্গে এত গুণ ঈশ্বর কী করে দিয়েছিলেন জানি না। একটা গল্প শুনবেন?’ এ প্রশ্নের জবাব হয় না। বাদলবাবু তাই জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে লাগলেন, ‘আমি কিন্তু জানেন তো এমনিতে তেমন বিড়ি-সিগারেট খাই না। সকলে সে কথা জানেও। খালি রোজ ভোরবেলা একটা করে সিগারেট আমার চাইই চাই। সেটা খেয়ে আমি খানিকক্ষণ হাঁটাচলা করি। তারপর সকালের কাজকর্ম শুরু করি। সেরকমই একদিন আমি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছি। সে তারিখটা ছিল আমাদের লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার প্লেন ধরার তারিখ।
উঠেই আমি পেছনের বাগানে গেছি। দেখি সৌমিত্রদা আগে থেকেই উঠে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বললেন, এই নাও, সিগারেটটা ধর। আমি তো ভয়ে লজ্জায় সঙ্কোচে আধমরা হবার দাখিল। কোনওমতে বললাম, ছিছি এ সব আপনি কী বলছেন দাদা। উনি পাত্তাই দিলেন না। বললেন, ধর তো। আমি জানি রোজ সকালে উঠে তুমি একটা সিগারেট খাও। কী আর করি, আমি কোনওমতে হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিলাম। নিতেই পকেট থেকে বেরল দেশলাই। ফস করে জ্বালিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন আমার দিকে। মানে নিজে জ্বালিয়ে দেবেন সিগারেটটা। আমার হাত পা কাঁপছে। কিন্তু উনি নির্বিকার। খালি মাঝে মাঝে বলছেন, আরে এতে লজ্জার কী আছে? আমি তো জানিই তুমি সকালে একটা করে খাও।’
অতঃপর সৌমিত্রদার সামনেই সিগারেটে টান দিতে হল বাদলবাবুকে। আর তখনই মিটি মিটি হেসে সৌমিত্রবাবু বললেন, ‘বাদল, আজ কিন্তু যাওয়া হচ্ছে না। আমাদের ফ্লাইট ক্যানসেল।’ বলতে বলতে হোহো করে হেসে উঠলেন বাদলবাবু, যেন সামনে ঘটছে সে ঘটনাটা। বললেন, ‘ভাবুন একবার, কেমন দুষ্টুমি মানুষটার! যাওয়ার উড়ান বাতিল হওয়ার খবরটা দেবেন বলে খানিকটা দুষ্টুমি করে নিলেন। যদিও সকলের সাহায্যে পরের দিনই আমরা ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলাম, তবু ওই এক সকালের ঘটনায় ওঁর স্নেহের স্পর্শ যেভাবে অনুভব করেছিলাম, আমৃত্যু ভুলতে পারব না। আমি কে বলুন? ওঁর দলের সামান্য কর্মী বই তো কিছু নই। তবু আমার ছোটখাটো সুবিধে অসুবিধে অভ্যেস অতবড় মানুষটার নজর এড়াত না। সকলের খোঁজ রাখতেন। নাটকের দলে যাঁরা ওঁর সহ-অভিনেতা, হয়তো তেমন বিখ্যাত নন, তাঁদের প্রত্যেকের প্রতিটি খুঁটিনাটি ওঁর মনে থাকত। কে কী পারবে, না পারবে উনি হাতের তালুর মতো জানতেন। হাতে ধরে শেখাতেন। কিন্তু কোনওদিন বলতেন না আমাকে অনুকরণ কর। ওঁর ধরনই ছিল না সেটা। দেখিয়ে দিয়ে বলতেন নিজের মতো কর।’

শেখানোর কথা বলতে বলতে ফের একবার স্মৃতির অতলে ডুব দিলেন বাদলবাবু। বললেন, ‘একদিন বললেন, চল বাদল তোমাকে লন্ডনের থিয়েটার দেখিয়ে আনি। ব্রডওয়ে-তে তখন চলছে হ্যামিলটনের পৃথিবীবিখ্যাত নাটক গ্যাসলাইট। তুমি দেখ, আন্তর্জাতিক মানের আলো কেমন হয়। পৌলমীকে ডেকে বললেন, ওকে নিয়ে চল একদিন গ্যাসলাইট দেখাতে। শান্তিদাকে বলতেই টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে গেল। ওঁর সঙ্গে বসে গ্যাসলাইট দেখলাম। এ শিক্ষা কোনও স্কুল, কোনও কলেজ কি আমাকে দিতে পারত? আমার নাট্যশিক্ষাটাই এভাবে ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন উনি। মঞ্চের প্রতিটি খুঁটিনাটি ওঁর কাছ থেকে শেখা। আজও যখন কোথাও ঠেকে যাই, মনে মনে ভাবার চেষ্টা করি, সৌমিত্রদা থাকলে এখন কী বলতেন, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করতেন! ওঁর পুরনো কাজ থেকে যা কিছু শিখেছি, এখনও তার প্রয়োগ করে করে দেখি, নতুন করে কী শিখতে পারি।’
ছবি সৌজন্য: আন্তর্জাল
মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial
One Response
একজন কমপ্লিট শিল্পী। শুধু অভিনেতা নন, আবৃত্তি , সিনেমা , সাহিত্য , সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা একজন মানুষ , পত্রিকা প্রকাশনা এই সবগুলো ক্ষেত্রে বিচরণ ছিল ওনার। এই মাপের প্রতিভা আর আসবে কি??