ডাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা মা সাবু সবাই মিলে জায়গাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। সত্যিই ওর কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না। বাবা ডাকল, সাবু ডাকল, মা কেঁদে ফেলল। কিন্তু ডাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাত বছরের দস্যি ছেলে, নিজে নিজে একা চলে যায়। ওকে নিয়ে সবার দুশ্চিন্তা।
লং উইকেন্ডে বাবা-মা-র সঙ্গে বেড়াতে এসেছে সাবু ডাবু। পুজো আসতে এখনও কিছু সময় বাকি। তার আগে এমন ভ্রমণে সবাই খুব খুশি। জায়গাটা জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা। লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, পাহাড়ের মাথায় একটা পুরনো মন্দির আর রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ, ঘিরে চারিদিকে ঘন জঙ্গল। মূলতঃ শাল, সেগুন, পলাশ, অর্জুন জাতীয় গাছে ভরা। ভাঙা রাজবাড়ির পাশে পুরাতত্ত্ব বিভাগের কয়েকটা নোটিশ টাঙানো, সেখানে রাজরাজড়ার সন তারিখ লেখা। তেমন পর্যটক আসে না। আশেপাশে বাঁশের বেড়ার দুয়েকটা চায়ের দোকান। কয়েকটা ছাগল আর কুকুর অলসভাবে শুয়ে বসে আছে।
সাবু ডাবুদের গাড়ি এসে দাঁড়াতেই, প্রায় ওদের বয়েসের আরও কয়েকটা ছেলে মেয়ে এসে হাজির। সবারই পরনে জীর্ণ বেশভুষা আর করুণ মুখ। হাতে ধরা খেজুর পাতায় বোনা নানারকমের ফুল পাতার নক্সা। কেউ কেউ ঘ্যানঘ্যানে সুরে বলে, “বাবু, আমার কাছ থেকে দুটো ফুল নেন।”
কেউ বলে, “আমায় কটা টাকা দিবেন? কিছু খাবো।”, কেউ বলে “পুজোর জামা কিনব, টাকা দেবেন?”
সবাই গাড়ি থেকে নামে। ডাবুর হাতে একটা ট্যাব। গত জন্মদিনে মামা দিয়েছে। সারা রাস্তা এই ট্যাবে-ই নানা রকমের গেম খেলতে খেলতে এসেছে। সাবুর হাতে একটা বই। সে সব নিয়ে ওরা এগিয়ে যায়।
ছেলেমেয়েগুলো পিছন পিছন আসতে থাকে আর বলতেই থাকে, “বাবু, আমার কাছ থেকে দুটো ফুল নেন।”
সাবু ডাবুর বাবা বলে, “আগে জায়গাটা ঘুরে দেখি। তারপর নেব?” (Story)

পাশেই বাঁশের বেড়ার ছোট দোকান। তার ওপর বৃষ্টির ছাঁট লেগে আছে। ভাদ্র মাস এসে গেছে। এখনও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে উনুনে চায়ের সরঞ্জাম, কালো হয়ে যাওয়া হাঁড়ি, পাতিল, কেতলি, কয়েকটা কাচের গ্লাস। একটা পুরানো তেলচিটে আলমারিতে বিস্কুটের বয়াম, ইন্সটান্ট নুডল আর আলুভাজার প্যাকেট। অন্যদিকে দড়ির খাটিয়া পাতা। সেখানে শুয়ে আছে একটি বছর ছয়েকের ছেলে, গণা। হাতে একটা স্মার্ট ফোন নিয়ে মনযোগ দিয়ে কিছু দেখছে। তার মা ভবানী উনুনে চা বসিয়েছে।
গাড়ি দেখে ফোন ফেলে লাফিয়ে ওঠে। দড়ির খাটিয়ার নীচে, তারও খেজুরের পাতায় বোনা কিছু ফুল রাখা ছিল। সেগুলো নিয়ে এক ছুটে গাড়ির দরজার কাছে।
সাবু গম্ভীর হয়ে বলে, “বাবা তো বললেন, পরে নেবে।”
গণা কিছু বলে না। নিঃশব্দে ওদের পিছন পিছন যেতে থাকে।
আরও পড়ুন: গল্প: হোটেল রজার্স স্টে
সাবু, ডাবু, বাবা মার সাথে ওই ভাঙাচোরা ঘর-বাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিল। বাবা বুঝিয়ে দিচ্ছিল এটা কোন সময়ের। রাজার বাড়ি এদিকে, ওদিকে তাদের মন্দির, ওখান দিয়ে ঘোড়ার পিঠে সৈন্যরা আসত, ওই ওপাশে লম্বা ভাঙা মিনার, তার ওপর উঠে নজর রাখত, কোনও শত্রু আসছে কিনা।
সাবু মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। সব ইতিহাসের কথা। সাবুর ইতিহাস পড়তে খুব ভালো লাগে। এই রাস্তা দিয়ে রাজকন্যা পুজো দিতে যেত, ওই পাশে গুমঘর, সেখানে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত।
আর ডাবু দেখছিল এখানকার মাটি, গাছ, কুকুর, ছাগল। ডাবুর আজকাল ভূগোলে মন হয়েছে। একটা সাদা রঙের ছাগলছানা কেমন নেচে নেচে হাঁটছে। ডাবু তার পিছনে পিছনে যেতে থাকে। গণাও সাথে আসতে থাকে।
গণাকে দেখে ডাবু জিজ্ঞেস করে, “ওদিকে কী আছে?”
“ওদিকে পাহাড়, জঙ্গল। আরও মন্দির আছে, অনেক উঁচুতে। ওখানেও বোর্ড লাগানো আছে।”
“কী বোর্ড?”
“জানি না, সবাই ছবি তোলে।”

গণার প্রথম প্রথম যে আড়ষ্টভাব ছিল, সেটা কেটে যেতে থাকে। ডাবুর বয়স ওরই কাছাকাছি মনে হয়। ডাবু, বাবা মা আর সাবু মন্দিরের চৌহদ্দি দেখতে থাকে। রাস্তার অন্যপাশে পাহাড়ে ওঠার পথটা ক্রমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে উপরের দিকে চলে গেছে। দুটো ছাগল সেখানে চরে বেড়াচ্ছিল। ডাবু মন্দিরের দিকে না গিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। গণা পিছন পিছন এসে বলে, “ওদিকে আরও ছাগল আছে, দেখবে?”
দুজনে বনের পথে এগোতে থাকে। পথের বাঁক ঘুরতেই, ডানদিকে রাস্তা থেকে নীচের দিকে ঢালু জমি। বড় বড় গাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে, সেদিকে এগোতেই একটা ছোট জলাশয় চোখে পড়ে আর তার চারপাশে নরম সবুজ ঘাস। সত্যি! অনেক ছাগল তাদের পরিবার সহ মনের সুখে চরে বেড়াচ্ছে।
এদিকে ডাবু সাবুর মা-র খুব খারাপ অবস্থা। ওদের বাবা ওকে ধরে ধরে এনে ভবানীর চায়ের দোকানে বসায়। জল দেয়। ভবানী আশ্বস্ত করে “দেখুন, এদিক ওদিক আছে। এখানে তো ভিড় নেই, গাড়ি ঘোড়াও নেই যে হারিয়ে যাবে।”
মা বলে, “তুমি কী গো! জঙ্গল আছে তো। যদি সেখানে চলে যায়? যা দস্যি আমার ছেলে! জানো না তো?”
ভবানী তখন গণার নাম করে ডাক দেয়। কিন্তু তারও কোনও সাড়াশব্দ পায় না। ডাকাডাকিতে আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে এসে জড়ো হয়। সাবু জানে, এরাই একটু আগে ওই খেজুর পাতার ফুল বিক্রি করতে এসেছিল। কেউই ডাবুকে বা গণাকে কোথাও যেতে দেখেনি। সবাই বলে, “এখানেই তো ছিল।”
বাবা তখন মোবাইল খুলে পুলিশে ফোন করতে চায়। ভবানীকে জিজ্ঞেস করে, “লোকাল থানার ফোন নম্বর জানেন?”
ভবানী অবাক হয়ে যায়, “সে তো টাউনে! অনেক দূর! তারা কী করবে?”
মা কেঁদে বলে, “আমরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকব?”
ভবানী বলে, “একটু চা করে দেবো দিদি?”
মা যেন ফেটে পড়ে, “আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি চা খেতে বলছ?”
“ছেলে ফিরে আসবে। চিন্তা কোর না।”
সাবু খানিক গোয়েন্দার মতো আশেপাশে দেখতে থাকে, যদি কোনও ক্লু পায়? বোঝার চেষ্টা করে, শার্লক হোমস থাকলে ঠিক কী খুঁজত?

সবাই মিলে যখন হাঁফিয়ে উঠেছে, ঠিক তখন দূর থেকে ডাবুর চিৎকার শোনা যায়, “দাদা, এই দেখ!”
সকলে লাফিয়ে ওঠে। দেখে পাকদণ্ডী বেয়ে ডাবু নেমে আসছে কোলে একটা সাদা ছাগলছানা। পিছনে পিছনে ট্যাব হাতে গণা।
এক মুহূর্তে সবার যেন ধরে প্রাণ এল। বাবা বলল, “আসুক একবার! উচিত শিক্ষা দেব।”
মা এখন একটু শান্ত। বলে, “কিছু বোলো না।”
কাছে আসতে সবাই প্রশ্ন করতে থাকে, “কোথায় ছিলি?” “না বলে কেন গেছিলি?” “যদি কিছু হয়ে যেত?”
ডাবু ধীরে ধীরে জবাব দেয়, “কী হবে? আমি কি ছোট্ট নাকি?”
“দেরি করলি কেন?”
“গণাকে ল্যাটিচুড লঙ্গিচ্যুড বোঝাচ্ছিলাম। মা বলেছে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ।” তারপর মা-র দিকে ফিরে বলে, “তাই না মা?”
মা এবার চোখের জল মুছে হেসে ফেলে, “এখানে এসে ভূগোল পড়ছিস?”
“ওর তো গ্লোব নেই।” তারপর বাবাকে বলে, “ওকে একটা গ্লোব কিনে দেবে?”
বাবা গম্ভীর হয়ে বলে, “সে দেখা যাবে। তা তুমি ওদিকে গেলে কেন?”
“বাঃ রে! গণা বলল তো, ওদিকে আরও বোর্ড আছে, সবাই ছবি তোলে। সেই বোর্ড দেখতেই তো গেলাম।”
“বোর্ড?” বাবা অবাক! “কোন বোর্ড?”
“গণা ছবি তুলেছে।” ছাগলটা রেখে ট্যাব হাতে নেয় সাবু। সবাইকে মেলে ধরে দেখায়।
সত্যিই একটা সাইন বোর্ডের ছবি। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার নাম লেখা। সেখানে বড় হরফে জ্বলজ্বল করছে, “ট্রপিক অফ ক্যান্সার পাসেস থ্রু দিস পয়েন্ট।”
এবার সাবু হাততালি দিয়ে ওঠে। “বাঃ কর্কটক্রান্তি!”

ধীরে সুস্থে সবাই চা বিস্কুট খায়। গাড়িতে ওদের সঙ্গে অনেক বিস্কুট, চিপস ছিল। ডাবু গণাকে সে সব দিল। গণা ওর বানানো খেজুরপাতার ফুল দিতে চাইল। মা যেন এখনও গণার ওপর রাগ করে আছে। বলে, “ফুল ছাড়া, অন্য কিছু বানানো থাকলে দাও। আমি নকল ফুল ঘরে রাখি না।”
গণা একটা ছোট পাখিও বানিয়েছিল। ভবানী সেটা বার করে দেয়। ওরা সবাই গাড়িতে ওঠে। হঠাৎ গণার কিছু মনে পড়ে, “একটু দাঁড়াও!” বলে ছুট্টে চলে যায় জঙ্গলের দিকে।
খানিক পরেই ফিরে আসে, হাতে ধরা একগুচ্ছ শিউলি ফুল। ডাবুর মায়ের হাতে দিয়ে বলে, “এই নাও সত্যি ফুল।”
মুহূর্তে ওদের গাড়িতে যেন শরৎকাল এসে গেল। সবাই একসাথে বলে ওঠে “পুজো আসছে।”
এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।
4 Responses
ছোটদের জন্য লেখা সৌরভের গল্পগুলি ভীষণ মিষ্টি। ছোটদের অনুভূতিগুলো অসাধারণ দক্ষতায় লেখক প্রকাশ করতে পারে। এই গল্পেও একটা ভালো লাগা জড়িয়ে আছে। অনেক ধন্যবাদ
Khub bhalo…
একদম অন্যরকম । মনের গহীন ছুঁয়ে যায় ।
খুব ভাল লাগল গল্পটা । বেশ সাবলিল গল্প বলা ।