শঙ্কর বসে আছে গ্রিনরুমে, একা একা। দলের বাকি ছেলেমেয়েরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মুখের মেক-আপ চামড়ায় টান মারছে, থেকে থেকে গলাটা শুকিয়ে আসছে।
–অ্যাই, একটু চা নিয়ে আয় না রে… দলের একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে বলে।
আজ শঙ্কর বেশ নার্ভাস। যদিও তার মত পোড়খাওয়া অভিনেতার এতটা নার্ভাস হওয়ার কোনও সঙ্গত কারণ হয়তো নেই। আসলে ওরা আজ বিসর্জন করছে। শঙ্কর রঘুপতি। আমেরিকাতে এটাই ওদের প্রথম রবীন্দ্রনাথ। দর্শকরা কী ভাবে নেবে, সেটাই ভাবাচ্ছে শঙ্কর কে।
শঙ্কর নিজের থিয়েটার-ভাগ্যকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। আমেরিকায় জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ কাটিয়ে দিয়েছে, অনেক জায়গায় থেকেছে। সে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। থিয়েটার নেশা। এখানে থিয়েটার করার সুযোগ শুধু পুজো-পার্বণে। কিন্তু সে থিয়েটার শঙ্করের জন্য নয়। সে করতে চায় অন্যরকম নাটক, যে নাটক অনেক পরিশ্রমের ফসল, যে নাটক স্ক্রিপ্টের বাইরে বেরিয়ে পরিচালকের গল্প হয়ে ওঠে, যে নাটকে আলো, সুর আর অভিনয় এক নিখুঁত সিম্ফনির ছন্দ আর লয়ে বাঁধা পড়ে। কিন্তু এমন থিয়েটার করা মুখের কথা তো নয়! তার জন্য সমমনস্ক কিছু ডেডিকেটেড লোক চাই, যারা নাটকটাকে ভালবাসবে, তার জন্য কিছু দিতে রাজি থাকবে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পিছপা হবে না। সেখানেই শঙ্কর সৌভাগ্যবান। জুটে গেছে তেমন ছেলেমেয়ে, সে যেখানে গেছে সেখানেই। তাদের নিয়ে সে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ে নাট্যমেলায় যোগ দিতে, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। এখানে নাটক করে মেলে তার প্রাণের শান্তি, মনের আরাম।
তুই একজন অ্যাক্টর, ক্যারেক্টারে ঢোক। এখন ভুলে যা তুই শঙ্কর, ভাব তুই নাট্যকার,
আজকের নাটকের প্রধান চরিত্র।
বিদেশের নাট্যোৎসবগুলোর একটা সমস্যা, সময়ের কোনও মা-বাপ নেই। শঙ্করদের প্রোডাকশন আজ সন্ধ্যের শেষ, ফলে ডমিনো এফেক্টের মত দিনের শুরুর দেরিটা বাড়তে বাড়তে বিরাট একটা চেহারা নিয়েছে এখন। ধুস্, মেজাজটাই খিঁচড়ে যায়।
–ফোকাস, শঙ্কর ফোকাস। নিজেকে ধমকে ওঠে সে। আর ঠিক তখনই… পঞ্চাশ বছরের ওপার থেকে অন্য একটা গলা ভেসে আসে।
–রাজীব, কী হচ্ছে কী! আজ তোমার ফোকাস কোথায়?
–কী করব দিদি, যতবার ফোকাস করতে যাচ্ছি, আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটের জানলাটার দিকে চোখ পড়ে যাচ্ছে। দেখুন না, বাচ্চাটা কেমন ড্যাবড্যাব করে দেখছে।
শঙ্কর ঝট করে সরে যায় জানলার সামনে থেকে। এটা তার কাছে একটা নেশা। সবাই স্কুল থেকে ফিরে দৌড় লাগায় বন্ধুদের সাথে খেলতে যাবে বলে। শঙ্কর কোনওমতে নাকে মুখে কিছু গুঁজে এক ছুট্টে চলে আসে তার পড়ার ঘরের জানলাটায়। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে তখন জোরকদমে রিহার্সাল চলছে। সে জানে ওই ফ্ল্যাটে যে ভদ্রমহিলা থাকেন, তিনি বাংলা নাটকের কোনও কেউকেটা অভিনেত্রী। সে দেখেছে মাঝে মাঝেই প্রেসের গাড়ি আসে। ফোটোগ্রাফার, রিপোর্টারে বাড়ি গিজগিজ করে। মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত পার্টি হয়। খুব সেজেগুজে অনেক লোক আসে। তারা হয়তো কেউ কেউ খুব নামকরা, ও জানে না। ওর তো এখনও হলে নাটক দেখতে যাওয়ার বয়সই হয়নি। এই রিহার্সালই তাই ওর গোপন আনন্দ। গুটি গুটি জানলার সামনে আসে আবার। হতাশ হয়, ও বাড়ির পর্দাটা টেনে দেওয়া।
পরের দিন রবিবার। দশটার সময় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে বন্ধুরা খেলতে যাবার জন্য ডাকতে এসেছে ভেবে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে থমকে যায় শঙ্কর। সেই অভিনেত্রী!
–শঙ্কর, তুই রিহার্সাল দেখবি?
শঙ্কর কী বলবে ভেবে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মা রান্নাঘরে ছিল, কথা শুনে বেরিয়ে আসেন।
–কে এসেছে রে শঙ্কু? ওঃ! আপনি! আরে কী সৌভাগ্য আমাদের, আসুন আসুন।
–না দিদি, বসব না। আমি একটা অনুমতি চাইতে এসেছি। আজকে শঙ্করকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারি রিহারসাল দেখাতে? রোজ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে পা ব্যথা হয়ে যায় বেচারার। আজ একটু আরাম করে বসে দেখুক।
কিছুদিন পর নীল আর্মস্ট্রং যখন চাঁদে পা রাখলেন, তার মনের অবস্থাটা কী রকম হয়েছিল, সেদিন তার কিছুটা আন্দাজ পেয়েছিল শঙ্কর।
তবে মঞ্চে পা দেওয়াটা শীতলদার হাত ধরে, পাড়ার ক্লাবে। শীতলদা ছিল পাড়ার সবারই শীতলদা। চাকরিবাকরি করত না। পৈতৃক ব্যবসা ছিল শুনেছে। স্কুলের পরীক্ষাতেও বেশ কয়েকবার গাড্ডা খেয়ে, কলেজে টেনেটুনে একটা পাশ মেরে পাড়ার রকের স্টার হয়ে জীবন কাটানোতেই মন ছিল শীতলদার। শুধু একটা জিনিস নিয়ম করে করত। প্রত্যেক পুজোয় ম্যারাপ বেঁধে নাটক, পাড়ার ছেলে মেয়েদের নিয়ে। শীতলদাই নির্দেশক এবং প্রধান অভিনেতা। মানে শীতলদা সবাইকে জড়ো করত, তারপর “যে যাহা পারও কর” জাতীয় একটা ব্যাপারের মধ্যে দিয়েই তাদের রিহার্সাল চলত। সবরকম নাটক, টেনিদা থেকে শাহজাহান, রবীন্দ্রনাথ থেকে শৈলেশ গুহনিয়োগী। শীতলদা নিজে অভিনয়ের ‘অ’ অথবা নির্দেশনার ‘ন’-ও জানত না। নিজে পার্টও মুখস্থ করত না। ফলে সব নাটকই লম্বায় দু’গুন হত, একবার প্রম্পটারের বলা, একবার অভিনেতাদের। পাড়ার লোক বাধ্য হয়ে এই নাটক দেখত, কারণ শীতলদার বাবা পুজোর প্রায় অর্ধেক খরচ যোগাতেন!
এ সব ছাড়াও আর একটা জিনিস হত। প্রতিবছর অষ্টমীর রাতে মেক আপ করে শঙ্কর যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখে আলো নিত, তখন কী যেন একটা ঘটে যেত। দর্শকদের চেহারাগুলো, বাইরের কোলাহল কোথায় হারিয়ে যেত। মনে হত একটা নিকষ কালো ব্ল্যা্ক হোলের মধ্যে শুধু এই মঞ্চটা দাঁড়িয়ে আছে। এটাই যেন পৃথিবীর শেষ সীমা, আর এগোবার উপায় নেই। নাটকের চরিত্র আর চরিত্র থাকত না। সেটা তখন একটা সত্ত্বা, তার একমাত্র সত্য, একমাত্র গন্তব্য।
সেই শুরু। মঞ্চ পালটে গিয়েছে, ভালোবাসাটা রয়ে গিয়েছে একই রকম। শীতলদা না থাকলে এই ভালোবাসাটার কথা কোনওদিন জানাই হত না।
–শঙ্করদা, এই নাও চা।
একটা কণ্ঠিলের গুলি নিয়ে মুখের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল অনেকক্ষণ, গিলে ফেলে চায়ে চুমুক দ্যায়। টি ব্যাগের চা। আর কী করা, যস্মিন দেশে যদাচার। এখানে আর লেবু চা কোথায় পাবে?

সেদিন পেয়েছিল। শীতের মোরাম বিছনো ডিসেম্বরের সেই সকালে। এক আশ্চর্য দিনে। তার স্বপ্নপূরণের দিনে। শঙ্কর তার দলের সঙ্গে আমেরিকা থেকে গিয়েছিল কলকাতায় শো করতে, বিশেষ আমন্ত্রণে। সকালে স্টেজ রিহার্সালের সময় গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সে। একটা পুরনো বাড়ি, ততোধিক পুরনো একটা প্রেক্ষাগৃহ। সেই ষাটের দশকে জন্ম। বিশেষ পাল্টায়নি কিছু। চেয়ারগুলো শুধু আগের চেয়ে একটু বেশি আরামদায়ক হয়েছে। ভিতরে এসি বসেছে এখন। কিন্তু ওই কথাগুলো তো সেই কবে থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেয়ালের কোনায় কোনায়, ঘরের আনাচে কানাচে, মাটির বুকের উপর। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কথা, নাটকের কথা। যে কথা মানুষকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, ভাবিয়েছে বছরের পর বছর। ভাসিয়েছে, উঠে দাঁড়িয়েছে রঙ্গমঞ্চের উপর।
শঙ্কর দেখেছিল। কেমন করে মূর্তি তৈরি হয়, কেমন করে হয় প্রাণ প্রতিষ্ঠার আয়োজন। একটা তিনতলা মইয়ের উপর উঠে মঞ্চের আকাশে আলো বাঁধছে একজন, জ়োনগুলো মেপে নিচ্ছে। মিউজিক চেক্, মার্কিংয়ের কাজ চলছে। কাঠের পাটাতনে পেরেক ঠুকছে দুটো ছেলে, দেয়াল বানানো হচ্ছে। বুক কেসে বই, একটা বারে নানা পানীয়ের বোতল, টেবিল, চেয়ার, সোফা।
–প্রপ্সগুলো সব এসেছে তো রে? একবার মিলিয়ে দেখে নে…। চেঁচিয়ে বলল কেউ একটা।
এ সবের মাঝখানে স্টেজের এক কোনায় দাঁড়িয়ে এক কিশোর একটা জ্বোরো শিহরণে থরথর করে কাঁপছে। তার চোখের সামনে পরপর উল্টে যাচ্ছে একটা অ্যালবামের পাতা – চার অধ্যায়, রক্তকরবী, শোয়াইক, ফুটবল, বেলা অবেলার গল্প, খড়ির গণ্ডি, ভালোমানুষের পালা, মারীচ সংবাদ – আরও কত কী। মাঝের এতগুলো বছর নিমেষে উধাও! এই মঞ্চ, যে বুকে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো পায়ের ছাপ! শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, মায়া ঘোষ, তৃপ্তি মিত্র, আরও কত কত নাম – নাম নয় …এক একটা প্রতিষ্ঠান। কোনও দিন কি ভেবেছিল স্বপ্নের সেই মঞ্চে আজ সে দাঁড়াবে দর্শকের মুখোমুখি?
–শঙ্করদা, লাস্ট সিন চলছে এখন। আর পনেরো মিনিটের মধ্যে স্টেজ পাব। তুমি রেডি তো? সম্বিত ফেরে শঙ্করের।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, রেডি।
— তোর মধ্যে আছে। এটা তোর কলিং। তোর কাছে সুযোগ আসবেই। কথা হল, যখন আসবে তখন তুই রেডি কিনা। রজতদা বলেছিল সরু করে পাকানো গাঁজা ভরা সিগারেটে টান দিতে দিতে।
রজতদা আইআইটি-তে শঙ্করের দু’বছরের সিনিয়ার ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করার পর কলেজে পুরো সময়টা থিয়েটার করে মাস্টারমশাইদের বিরাগভাজন হয়েছিল। কোনওমতে ধুঁকতে ধুঁকতে পাস করেছিল। রজতদার কাছ থেকে সিগারেট, মদ, গাঁজার নেশায় হাতেখড়ি শঙ্করের। আর রজতদাই খুলে দিয়েছিল একটা অজানা জানলা, যে জানলা দিয়ে ঢুকেছিল নতুন আলো– ব্রেশট্, ওয়েস্কার, আয়ানেস্কোর হাত ধরে।
সেটা সত্তর দশক। দেশ তখন উত্তাল। আগুন জ্বলছে ঘরে ঘরে। রাতের অন্ধকারে খুন হয়ে যাচ্ছে অনেক স্বপ্ন। নাটক লিখলেন ডারিও ফো, “অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ অফ অ্যান অ্যানারকিস্ট।” রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল সে নাটক। এ যেন তাদের জন্যই লেখা, সেই সময়ের জন্যই। আইআইটির এক প্রফেসর অনুবাদ করলেন “জনৈক সন্ত্রাসবাদীর অপমৃত্যু।” রজতদার সাথে শঙ্করও লেগে গেল অভিনয়ে। শেষমেষ নাটকটা হয়নি। পুলিশের চাপে কর্তৃপক্ষ অভিনয় বন্ধ করে দেয়। কিন্তু রজতদার হাত ধরে সেই তার প্রথম পুরোপুরি ভাবে নিজেকে আবিষ্কার। সেই তার প্রথম বোঝা, যে মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেই সে বলতে পারে “হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে।” বহু নাটক করেছে শঙ্কর রজতদার সঙ্গে। মহলা চলত অনেক রাত পর্যন্ত হোস্টেলের ছাদে। সংলাপের সঙ্গে মিশে যেত সিগারেটের ধোঁয়া, মদের গন্ধ, আর কিছু অপরিণত মনের সুখ, দুঃখ, অভিমান। নাটকের সেটে জন্ম নিত নতুন সম্পর্ক, সে সম্পর্ক ভেঙেও যেত আবার।
অতসীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা যেদিন ভাঙল, সেদিন তাদের “নাটকবধ পালার” প্রথম শো। আয়ানেস্কোর ‘শেপারড্স ক্যামেলিয়ান’-এর অনুবাদ। তারই লিড রোল। গ্রিন্রুমে তার গড়িয়ে পড়া চোখের জলটা যাতে কেউ দেখতে না পায়, তাই দরজার দিকে পিঠ করে বসেছিল। খেয়াল করেনি রজতদা কখন ঢুকে তাকে লক্ষ করছে। বন্ধুরাই রজতদাকে বলেছিল নিশ্চয়ই।
–কান্নাটাকে ঢাকিস না, ওটা একটা অ্যাক্টরের সম্পদ। যে কাঁদতে পারে না, সে ভালবাসতে পারে না। আর যে ভালবাসতে পারে না, সে অভিনয় করবে কী করে?
–আমি আজকে ঝোলাব রজতদা।
–তুই একজন অ্যাক্টর, ক্যারেক্টারে ঢোক। এখন ভুলে যা তুই শঙ্কর, ভাব তুই নাট্যকার, আজকের নাটকের প্রধান চরিত্র।
শঙ্কর চুপ।
— ভাব চরিত্রগুলো এক একটা পোশাক। অভিনেতা প্রতিদিন মঞ্চে ওঠার আগে সেগুলো পরে, আবার মঞ্চ থেকে নামার সময় সেগুলো ছেড়ে রাখে। প্রতিদিন তার চরিত্রের সঙ্গে তার দেখা হয়, যে সে নয়। প্রতিদিন চরিত্রের সুখ, দুঃখ তাকে অনুভব করতে হয়, যা তার সুখদুঃখ নয়। চরিত্রের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়, প্রতিদিন নতুন করে। এসব আমার কথা নয়। এ বইটা রাখ। এটা তোর জন্য। এতে সব লেখা আছে।

শঙ্কর তাকিয়ে দেখল একটা মলাটের রঙ উঠে যাওয়া বই। ‘অ্যান অ্যাক্টর প্রিপেয়ারস’। লেখকের নাম কন্সতান্তিন স্তানিস্লাভস্কি। সেদিন নাটকটা যে ভাল হয়েছিল সেটা রজতদার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল শঙ্কর। বুঝেছিল, ও পেরেছে নিজের থেকে বেরিয়ে চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে।
এই স্কিলটা আরও একবার দরকার হয়েছিল, কুড়ি বছর আগে। সেদিনও মেক আপ করে অপেক্ষা করছিল সাজঘরে বসে। তখনই ফোনটা আসে। বোনের ফোন। কলকাতা থেকে। বাবার ম্যাসিভ অ্যাটাক, ঘুমের মধ্যে। কেউ জানতেও পারেনি। ফোনটা নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল সে।
–কী হয়েছে তোমার? কার ফোন?
সুস্মিতা সাজঘরে ছিল। তখনও তাদের সম্পর্কটা টিকে ছিল। বোধহয় শঙ্করের মুখ দেখে কিছু একটা আঁচ করেছিল।
–বাবা নেই। প্রায় যন্ত্রচালিতের মত বলেছিল শঙ্কর।
–ও মাই গড। কী করে? চিৎকার করে ওঠে সুস্মিতা। “দাঁড়াও, আমি সবাইকে বলছি। আজকের শো ক্যানসেল।” সুস্মিতা গ্রিন্রুমের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
–ওয়েট। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। শো করব আমি। বাড়ি ফিরে কলকাতা যাবার টিকেট দেখব।
শঙ্করের গলায় কিছু একটা ছিল। সুস্মিতা থমকে যায়।
–আর ইউ শিওর?
–হ্যাঁ।
ওর পরিচিত, বন্ধুবান্ধব যারা সেই নাটক দেখেছিল, বলেছিল তাদের দেখা ওটাই শঙ্করের সেরা পারফরম্যান্স।
–শঙ্করদা, স্টেজ পেয়ে গেছি। আমরা সেট রেডি করছি। আর পাঁচ মিনিটে উই উইল বি রেডি ফর দ্য হাডল্।
–আসছি।
শঙ্কর উঠে দাঁড়ায়। আজ সকালে খবর এসেছে রজতদা চলে গেছে। রজতদার সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে গিয়েছিল অনেকদিন। কানাঘুষোয় শুনেছিল মদ আর সিগারেট ওর লিভার আর লাং ঝাঁঝরা করে ফেলেছিল একেবারে। রজতদা থিয়েটারের খুব কাছাকাছি পৌঁছতে চেয়েছিল। তাই কি থিয়েটার ওকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল? ভ্যান গঁ-কে যেমন করেছিল তাঁর ছবি?

–ফোকাস, শঙ্কর, ফোকাস। নিজের থেকে বেরও। আজ তোর জীবনের সব থেকে চ্যালেঞ্জিং রোল। চরিত্রে ঢোক্। আয়নায় মেক-আপটা ঠিক করে নিতে নিতে রজতদার গলাটা পরিষ্কার শুনতে পায়।
–না, রজতদা না। শঙ্কর স্বগতোক্তি করে। “ওই চরিত্রগুলো তো শুধু পোশাক নয়। ওগুলো তো খানিকটা আমিও গো। আমার করা প্রত্যেকটা চরিত্রের ভগ্নাংশ আমার মধ্যে আছে, যত অল্পই হোক। তারা আমাকে ছেড়ে কখনও যায়নি কোথাও। আমার সব সুখদুঃখ, আমার প্রেম, আমার প্রথম সন্তান, সুস্মিতার সঙ্গে আমার ডিভোর্স, আমার বাবার মৃত্যু, সব সব কিছুর মধ্যে ওরা জড়িয়ে থাকে আমায়, ভালবাসার ওমে। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোয়, আমার সঙ্গে হাসে, কাঁদে। থার্ড বেল পড়ে গেছে, এবার পরদা সরে যাবে। তুমি অডিয়েন্সে গিয়ে বোসো রজতদা। দ্যাখো কেমন করে সবার মুখোমুখি হই। আমার রঘুপতি, আর আমি।”
ডঃ আনন্দ সেনের জন্ম কলকাতায়। হিন্দু স্কুল ও পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে স্নাতকস্তরের পড়া শেষ করেই পাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই বাসা। পেশায় ডেটা সায়েন্টিস্ট হলেও কবিতা লেখা আজও প্যাশন। আরও এক প্যাশন বাংলা থিয়েটার। প্রবাসে থেকেও নিয়মিত থিয়েটারের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ। নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন ই-পত্রপত্রিকাতেও।
4 Responses
বেশ ভাল লাগল পড়তে
Very nice
ছেলেবেলার মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম নাটকে অভিনয় করছি।
কিন্তু জীবনে তা করা হয় নি। আজ বুঝলাম কেন আমার জীবনে সুযোগটা আসে নি। চাইবার তীব্রতা ছিল না বলেই হয়তো। অভিনেতার অন্তর্জগতের ছবিটা দেখতে খুব ভালো লাগল।
ভাল লেগেছে, খুব ভাল লেগেছে।