ছেলেমেয়েরা জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেল বই লিখে, নাটক করে, গান গেয়ে, পত্রিকা সম্পাদনা করে এবং রান্না নিয়ে গবেষণা করে। কিন্তু কে সেই রত্নগর্ভা জননী? জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথের সেজপুত্র হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ী দেবী (Nipamayi Devi)। যিনি প্রজ্ঞাসুন্দরী সহ মোট এগারো সুসন্তানের জননী। আর সেই মা অনালোচিত। বরং চিরকালই প্রচারের অবগুণ্ঠনে। স্ত্রী শিক্ষার অগ্রসরের পুরোধায় ছিলেন তাঁর স্বামী হেমেন্দ্রনাথ। নীপময়ীও কম যান না। একদিকে সঙ্গীতজ্ঞা, অন্যদিকে ছবি আঁকা ও নানাভাষায় বইপড়া রপ্ত করার পাশাপাশি নিজের হেঁশেল ঘর সামলাতে রীতিমত দক্ষ রন্ধনে দ্রৌপদী। তাঁর মূলে অবিশ্যি স্বামী হেমেন্দ্রনাথ। অথচ কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে পিরালী বামুনের সে বিয়েতে পরিবারে নানা ওজর-আপত্তি উঠেছিল। তোলঘোল হয়েছিল। নবদম্পতি জোড়াসাঁকোতেই আলাদা থাকলেন। আর সেই ফাঁকে স্ত্রী কে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ। মোদ্দা কথা ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তখন নারী জাগরণের উন্মেষ।
কুলীন ব্রাহ্মণঘরের মেয়ে আর পিরালি বামুনঘরের ছেলে। মেয়ের বাড়ি হিন্দু। ছেলেরা কট্টোর ব্রাহ্ম। সেই নিয়েই আত্মীয়পরিজনের আপত্তি, বিস্তর চাপানউতোর সামলিয়ে সস্ত্রীক জোড়াসাঁকোয় এসেই হেমেন্দ্রর মাথায় শীঘ্রই নববধূটির গ্রুমিং নিয়ে চিন্তার শুরু।
১৮৬৩ সালের অঘ্রাণে ১৯ বছরের বিজ্ঞানমনস্ক সুদর্শন পাত্র হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু সাঁতরাগাছির হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কিশোরী কন্যা নীপময়ীর বিয়ে হল। গঙ্গার এপার ওপার। কিন্তু বিয়েতে অনিশ্চয়তা প্রচুর। কুলীন ব্রাহ্মণঘরের মেয়ে আর পিরালি বামুনঘরের ছেলে। মেয়ের বাড়ি হিন্দু। ছেলেরা কট্টোর ব্রাহ্ম। সেই নিয়েই আত্মীয়পরিজনের আপত্তি, বিস্তর চাপানউতোর সামলিয়ে সস্ত্রীক জোড়াসাঁকোয় এসেই হেমেন্দ্রর মাথায় শীঘ্রই নববধূটির গ্রুমিং নিয়ে চিন্তার শুরু। গড়েপিটে নিতে হবে ঠাকুরবাড়ির আদবকায়দায়। তাকে সর্বদিক থেকে বিদুষী না করা অবধি শান্তি নেই হেমেন্দ্রর। চৌকশ হতে হবে না? ঠাকুরবাড়ির বৌ বলে কথা।
অন্তঃপুরে শিক্ষা বিস্তারে গভীর আগ্রহ তাঁর। ঠাকুরবাড়ি যে শিক্ষা, সঙ্গীত ও নাট্যসংস্কৃতির ক্রমাগত উত্থানে সেসময়কার অন্যান্য বাড়ি থেকে স্বতন্ত্র, পরিমার্জিত ও উজ্জ্বল। বিয়ের পরদিন থেকেই উঠে পড়ে লাগল হেমেন্দ্র। জ্ঞানদানন্দিনী, নীপময়ী সহ আরও সব অন্তঃপুরচারিণীদের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য পড়াতে লাগলেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসার যে খুব জরুরি। যখন চারিদিকে খুব ইংরেজি পড়াবার ধূম তখন সাহস করে সকলকে বাংলা শেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। বৌদি তাঁর সামনে মাথায় কাপড় দিয়েই যদি পড়তে বসতে পারেন তাহলে নিজের বউই বা বাদ যায় কেন?
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ব্যতিক্রমী। অন্তঃপুরের অনেকেই গান গাইতে পারলেও এর আগে ঠাকুরবাড়িতে কেউ নিজের স্ত্রীকে গান শেখাবার জন্য উঠে পড়ে লাগেনি। বাইরে বাংলার পরিমন্ডল তখন নিতান্তই পৃথক ধ্যানধারণায় পুষ্ট।
“শোনো আমাদের দিদি স্বর্ণকুমারী আর বৌদিদি জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুরবাড়ির যে ঘরোয়া ইশকুলে পড়েছেন সেখানেই তোমায় স্পেশ্যাল ক্লাস করতে হবে”
দ্বাদশী নীপময়ীও যেন হাতে চাঁদ পেলেন। পড়াশোনায় ছোট থেকেই বড় আগ্রহ তাঁর।
সঙ্গীতচর্চাতেও সমান উৎসাহী। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ব্যতিক্রমী। অন্তঃপুরের অনেকেই গান গাইতে পারলেও এর আগে ঠাকুরবাড়িতে কেউ নিজের স্ত্রীকে গান শেখাবার জন্য উঠে পড়ে লাগেনি। বাইরে বাংলার পরিমন্ডল তখন নিতান্তই পৃথক ধ্যানধারণায় পুষ্ট। রক্ষণশীলতার বেড়াজাল সরিয়ে, সেই প্রথম দেশাচার, কুলাচার ভেঙে হেমেন্দ্রই নীপময়ীকে গান শেখাবার জন্য মহর্ষির অনুমতি নিয়ে জোড়াসাঁকো বাড়ির গানশিক্ষক বিষ্ণু চক্রবর্তীকে নিয়োগ করে ফেললেন। মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেগুলো বাস্তবায়িত হওয়ায় নীপময়ী বেজায় খুশি তখন। গানের পাশাপাশি বেণীমাধববাবুর কাছে তবলা ও করতালও বাজাতে শিখল সে। মেয়েরা এদ্দিন গান শেখার শখ মেটাতেন বৈষ্ণবীর গান শুনে। দিদি, বৌদিদিরা তেমন সঙ্গীতজ্ঞের কাছে গান না শিখলেও তাঁর স্ত্রী গানের চর্চা করবেন। নতুন বৌয়ের মন যেন কানায় কানায় তখন। ইংরেজির পাশাপাশি সংস্কৃততেও যথেষ্ট দখল হল নীপময়ীর। ওদিকে স্বামীর খুব শখ বৌ রান্নাতেও সমান পারদর্শী হোক। ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলে তখন ফরাসী যুবক কাঁথ্রাকে কাজ দিয়েছেন হেমেন্দ্র, নিত্যনতুন বিদেশি রান্না করার জন্য। বৌকে করবে নজরদারি। “শোনো, দেশি রান্না জানলেই হবে না। আমাদের বাড়িতে বিলিতি রান্নাও হয় কিন্তু” স্বামীর এরূপ মনোভাবে দমে যাবার পাত্রী নন নীপময়ী। দিশী রান্নার পাশাপাশি বিদেশি রান্না নিয়েও বিস্তর গবেষণা চলল তাঁর। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে এ নিয়ে বেশ কানাঘুষো চলতে থাকল। ভোজনরসিক হেমেন্দ্রর রাঁধাবাড়াতেও যথেষ্ট আগ্রহ।
এসব কথা কানে গেলেও সেসবে কান দিতেন না নীপময়ী। খুব দুঃখ হত। কিন্তু স্বামী যে বলেছেন “সাতেপাঁচে না থেকে, কারও সঙ্গে না মিশে শুধু নিজের কাজটা করে চল মন দিয়ে।”
কেউ বলল, “বিয়ে যেন কারও হয় না, নতুন বউকে স্কোয়ার করেই ছাড়বে হেম”
কেউ বলল,
“জানা আছে সে কেমন একালষেঁড়ে ঘরের মেয়ে আর কেমন সাদামাটা জীবন যাপন করত। ওদের হাওড়ার চাটুজ্জে পরিবারের জন্মে নামডাক ছিল না। ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়ে এসে তো বর্তে গেল”… তবে এসব কথা কানে গেলেও সেসবে কান দিতেন না নীপময়ী। খুব দুঃখ হত। কিন্তু স্বামী যে বলেছেন “সাতেপাঁচে না থেকে, কারও সঙ্গে না মিশে শুধু নিজের কাজটা করে চল মন দিয়ে।”
তবে ধীরে ধীরে নীপময়ীর গুণের বিকাশ লক্ষ্য করল সবাই। স্বয়ং শ্বশুরবাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নীপময়ীর দেওর রবির বিয়ের পরেপরেই যশোরের ফুলতলির কিশোরী ভবতারিণীকে যখন ঠাকুরবাড়ির আদবকায়দা শিখিয়ে গড়েপিটে নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করলেন, নীপময়ী সে দায়িত্ব পেয়ে যেন আহ্লাদে আটখানা। ক্ষীণতনু ভবতারিণীর শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতির ভার নিলেন তিনি ঠাকুরবাড়িতে।
সবাই হতবাক। এত প্রতিভা একজন মেয়ের! নিজের বিশাল পরিবার সামলেও এত অবকাশ পায় কখন সে? এগারোটি সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করেও এত অনুরাগ শিল্প-কলার প্রতি?
নীপময়ী যে ব্যতিক্রমী। হেমেন্দ্রনাথের কড়া শাসন। বৌ মেয়েরা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা করার সুযোগ পান না। বাড়ির মধ্যে তাঁরা তো আলাদা মহলেই থাকেন। তাঁরা সবাই এক মনে নিজের কাজ করে চলেন। বাড়ির সবার সঙ্গে এই দূরত্বের জন্যই নীপময়ীর প্রতিভা সকলের সামনে প্রকাশিত হয়নি। কিছুটা যেন গুটিয়েই রাখতেন তিনি নিজেকে। এরই মধ্যেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা “মানময়ী” নাটকে শচীর ভূমিকায় অভিনয় করে ফেললেন। সবাই হতবাক। এত প্রতিভা একজন মেয়ের! নিজের বিশাল পরিবার সামলেও এত অবকাশ পায় কখন সে? এগারোটি সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করেও এত অনুরাগ শিল্প-কলার প্রতি? প্রথম জীবনে হেমেন্দ্রনাথের কড়া শাসন এবং স্বামী অকালে চলে যাওয়ায় কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন তিনি। মন খুলে মেলামেশাও করার সুযোগ জীবনে তেমন আসেনি।
এর ফাঁকে ফাঁকে চলল নিজের পড়াশোনা। তাঁকে মিল্টনের “প্যারাডাইস লস্ট” এবং কালিদাসের “অভিজ্ঞান শকুন্তলম্” পড়তে দেখে আশেপাশের সবাই থ তখন। বুদ্ধিমতীর দক্ষতা ছিল ছবি আঁকাতেও।
বাড়ির বৌ আবার অবসরে ছবিও আঁকে? এসব দেখেশুনে ঠাকুরবাড়ির বাকি মেয়েরা যেন একটু বেশিই ঈর্ষা করতে শুরু করল তাঁকে। বক্রোক্তি শুনতে শুনতে ক্লান্ত হলেও নিজের কাজে নীপময়ী অটল। কালিদাস পালের কাছে তখন ছবি আঁকা শিখছেন। এমনকি ক্লিওপেট্রার ছবিও আঁকছেন। বাড়ির পত্রিকায় আঁকা “হরপার্বতী”র ছবি সাড়া ফেলে দিয়েছে।
নীপময়ীর ছেলে ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলেন, “হ্যাঁ, আমার মায়ের আঁকা ছবি বাঁধিয়ে ঘরে রাখার মতো। হোয়াইট সাহেবের শিক্ষকতায় দিদির ছবি এঁকেছিলেন মা”। মায়ের জন্য কত গর্ব ছেলের! পরে তিন ভাইয়ের ঘরে মায়ের আঁকা ছবি বাঁধিয়ে ঝুলিয়েছিলেন তিনি।
এত কিছু ভালোর পরেও হেমেন্দ্রর যেন ইহলোকের সব কাজ ফুরিয়ে গেল নিমেষেই। ১৮৮৪ সালে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন। দেবেন্দ্রনাথ পুত্রের সন্তানদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।
প্রজ্ঞাসুন্দরীরা তিন ভাই, আট বোন। সবাই যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য। এমন বাবা-মা ভাগ্যে থাকা চাই। এমন জুটির যেন রাজযোটক মিল। তাই সব ছেলেমেয়েরাই শিক্ষাদীক্ষায়, সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল।
নীপময়ী-হেমেন্দ্রনাথের ভরভরন্ত সংসার। এত কিছু ভালোর পরেও হেমেন্দ্রর যেন ইহলোকের সব কাজ ফুরিয়ে গেল নিমেষেই। ১৮৮৪ সালে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন। দেবেন্দ্রনাথ পুত্রের সন্তানদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। কিন্তু তিনি বেশিরভাগ সময় কাজের সূত্রে জোড়াসাঁকোর বাইরে। অতএব নিজপুত্র কন্যাদের দেখভাল করতে হল নীপময়ীকেই। তখন কেবলমাত্র বড় মেয়ে প্রতিভাসুন্দরীর বিয়ে হয়েছে। বাকি দশজনকে সবদিক দিয়ে যোগ্য করে তোলার কাজে অটল রইলেন নীপময়ী।
তাঁদের তিন ছেলেই ঠাকুরবাড়ির যোগ্য উত্তরসুরী হয়ে উঠেছিলেন নীপময়ীর সাহচর্যে, অভিভাবকত্বে। আর প্রতিভাসুন্দরী, প্রজ্ঞাসুন্দরী সহ বাকী ছয় কন্যাও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এমন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী যাঁদের মা, তাঁরা যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এভাবে বলীয়ান হবেন তা বলাই বাহুল্য।
তাঁদের তিন ছেলেই ঠাকুরবাড়ির যোগ্য উত্তরসুরী হয়ে উঠেছিলেন নীপময়ীর সাহচর্যে, অভিভাবকত্বে। আর প্রতিভাসুন্দরী, প্রজ্ঞাসুন্দরী সহ বাকী ছয় কন্যাও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এমন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী যাঁদের মা, তাঁরা যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এভাবে বলীয়ান হবেন তা বলাই বাহুল্য। তবে প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান যেমন অনস্বীকার্য ঠিক তেমনি প্রত্যেক নারীর উত্তরণেও একজন সফল পুরুষের ভূমিকা থাকে হয়তো নেপথ্যে। স্বামী হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুচারু গ্রুমিংই নীপময়ীকে সঠিক পথে চালনা করেছিল।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।