আমরা ‘লক আউট ‘কথাটা অনেক বেশিবার শুনেছি বা পড়েছি। ‘লক আউট কারখানায় তামাদি মজুরী আর কেড়ে নেওয়া রুটি ‘ আমাদের কাছে ছিল সুমনের গানের একটা লাইন মাত্র। সেই মজদুরদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশা, অবসাদ এই লক ডাউনের সুবাদে আজ আমাদের ঘরের মধ্যে। কোথায় যেন আমরা সবাই কোনও না কোনওভাবে এক নৌকার যাত্রি হয়ে গেছি। সৌজন্যে এক অদৃশ্য কিন্তু অসীম ক্ষমতাশালী শত্রু COVID-19.।
প্রথম পর্যায়ে যখন লক ডাউন ঘোষণা হল মানুষ ভাবল যেভাবেই হোক খাবার সংগ্রহ করতে হবে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বাজার করা শুরু হল যাকে বলা হয় প্যানিক বাইং অর্থাৎ অনিশ্চিতভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটা করা। যে যা পারে কিনছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত। যাদের কাছে অত টাকা নেই তারা পড়ল আতান্তরে। জিনিসের দাম বাড়তে শুরু করল, হল চোরাগোপ্তা কালোবাজারি। পরে সরকারি আশ্বাস পেতে এই জিনিস কেনার হিড়িক খানিকটা হলেও কমেছে। খাবারের জোগান আছে জেনে জনসাধারণের উদ্বেগ কমেছে।
দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হল অন্য সমস্যা। আজ তের দিন হল লক ডাউনে চলছে (২২ শে মার্চ থেকে আজ ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত ধরলে)। যে ভাবনা গুলো সাধারণের মনে কাজ করছে সেগুলো হল।
যারা লকডাউনে আছে।
১. জীবিকার অনিশ্চয়তা – স্কুল কলেজ কারখানা অফিস সমস্ত কাজের জায়গা বন্ধ। ভবিষ্যৎ কী হবে, চাকরি থাকবে কিনা, সঞ্চিত অর্থে কতদিন চলবে এই ধরণের নানা দুশ্চিন্তা এখন মানুষে মনের অলেকটা জুড়ে রয়েছে।
২. ফেক নিউজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব – লকডাউনে একাকিত্ব কাটাতে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন সোস্যাল মিডিয়াতে বেশি সময় দিতে। এর ফলে চোখে আসছে নানারকম ভুয়ো এবং ভুল খবর। এছাড়াও রয়েছে একের পর এক সংক্রমণ এবং মৃত্যুর খবর যেগুলো মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করছে।
৩. বিচ্ছিন্নতাবোধ – এটা পরীক্ষিত সত্য মানুষ সবথেকে ভালো থাকে একে অপরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করতে পারলে। কিন্তু এই অন্তরীণ অবস্থা তাকে আলাদা করে দিয়েছে। এটা তার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
৪. সংক্রমণের ভয় – করোনার সংক্রমণও দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরে বেরলে রোগ হতেই পারে অথচ দৈনন্দিন প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বেরতে হবেই। ঘরে থেকেও এই ভয়ের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন।
৫. নিকটজনেদের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা – অনেকেরই আত্মীয়বন্ধু বিদেশে বা এদেশেরই অন্য রাজ্যে রয়েছেন, যেখানে রোগটা বেশি করে ধরা পড়ছে। এতে তাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে।
৬. কোরান্টাইনে থাকার চাপ – যারা বাধ্যতামূলক করেন্টাইনে আছেন… বাড়িতে বা অন্য কোনও সেন্টারে তাদের চলা ফেরার নিষেধ প্রায় জেলখানার মত। এই বন্দিত্ব একাকিত্ব আর রোগ টেস্ট পজিটিভ হওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত চাপের।
সব মিলিয়ে অবসাদ, হতাশা, উদ্বেগ, ঘুম- ক্ষিধে কমে যাওয়া, বিরক্তি, অসহায়ত্ব। এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা আসাও স্াভাবিক কিছু নয়। এ তো গেল সাধারণ ভাবে সুস্থ মানুষ যারা লকডাউনের প্রভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাদের কথা। যারা আগে থেকেই ডায়াগনোসড মানসিক রুগী, তাদের অনেকেই এই অবস্থায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। চিৎকার চেঁচামেচি, অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলছেন। অনেক ক্ষেত্রে রোগের পুরনো উপসর্গ যেমন হ্যালুসিনেশান কিংবা ডেলিউশান ফিরে আসছে।
আছাড়াও রয়েছেন সেই সমস্ত ‘মুখহীন’ মানুষগুলো। যারা শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে এক রাজ্য থেকে থেকে আর এক রাজ্যে গেছিল রাজমিস্ত্রী বা যে কোনো কারখানার মজদুর হতে। যারা এখন অবাঞ্চিত ভাবে ফিরছে নিজেদের রাজ্যে বাসে গাদাগাদি করে অথবা পায়ে হেঁটে। কারুর কোলে বাচ্চা কেউ বা সন্তানসম্ভবা। পথে মৃত্যুও হচ্ছে। বেশ কিছু মানুষকে ফেরা মাত্র নর্দমা পরিষ্কার করার রাসায়নিক দিয়ে চান করান হচ্ছে। মানবতার এই চরম অবমাননা হচ্ছে যাদের ওপর তাদের মনের অবস্থা কল্পনা করার জন্য কোনও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব নয়। শুধু এই টুকু বলতে পারি এই সব দৃশ্য দেখে বেশ কিছু সংবেদন শীল মন আর আগের মত নেই।
এই রোগ আর লকডাউন থেকে আশু মুক্তি নেই। কারণ এটাই এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র রাস্তা। তাই এই পরিস্থিতিতে কী করে ভালো থাকা যায় একটু দেখে নেওয়া যাক।
১. এক একটা দিন ধরে প্ল্যান করতে হবে। অর্থাৎ আজকের এই দিনটা এই চব্বিশটা ঘন্টা ঠিক মত কাটাতে হবে। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।
২. প্রত্যেক দিন সকালে উঠে কিছু ব্যায়াম করতে হবে। যেমন আধঘন্টা ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ বা স্ট্রেচিং। এখন সকালে হাঁটতে যাবার দরকার নেই।
৩. কম তেল মশলা দেওয়া স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার খান।
৪. খুব কম সময়ের জন্যে টিভির খবর দেখা বা সোস্যাল মিডিয়া দেখুন। সোস্যাল মিডিয়ার খবরের ওপর বেশি গুরুত্ব দেবেন না।
৫. যে সমস্ত আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গ পছন্দ হয় তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগে রাখুন।
৬. গুগল দেখে রোগের উপসর্গ মিলিয়ে নিজের করোনা ইনফেকশন হয়েছে কিনা বোঝার চেষ্টা করবেন না। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৭. বইপড়া, পছন্দের সিনেমা দেখা (মোবাইলে বা টিভিতে), পছন্দের গান শোনার পুরান অভ্যেসগুলো ফিরিয়ে আনুন।
৮. নিজের এলাকার একা থাকা মানুষ বা বৃদ্ধ মানুষগুলোর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ওষুধ বিষুধ কিনে পৌঁছে দিন। অর্থ সংগ্রহ করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করুন। ন্যুনতম প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন চাল ডাল আলু কিনে দিন। তবে এসব কাজ করতে হবে সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করে। সার্জিকাল মাস্ক পরুন। বাড়ি ফিরেই ভালো করে হাত ধোন। স্বেচ্ছাসেবীরা এক কি দুজনের বেশ একসঙ্গে যাবে না। এই বিষয় গুলো একধরনের মানসিক শান্তি দেবে দু পক্ষকেই।
৯. এই সময়েও হাসতে ভুললে চলবে না। হাসা মানসিক স্থিতি বজায় রাখার সবথেকে সহজ পদ্ধতি।
১০. পরিবেশ দূষণ অন্যান্য বন্য জীবজন্ত, পাখি থেকে রাস্তার কুকুর বেড়ালকে অবহেলা করা সব কিছুই মানুষের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। যেমন COVID 19 এর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে সাধারণ ভাবে বাদুড়ের দেহে বসবাসকারী এই ভাইরাস তার স্বাভাবিক বাসস্থান অর্থাৎ বাদুড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন বাসস্থান মানুষের দেহ খুঁজে নিয়েছে। এখন অখন্ড অবসর ভাবুন, মানুষ এই পৃথিবীর বিরাট অপেরার একটা চরিত্র হিসেবে বাঁচুক। একা বাঁচা যায়না।
১১.মনে রাখবেন এই রোগমুক্তি একদিন হবেই। মানুষ বিশ্বযুদ্ধ, প্লেগ, ফ্লু, কলেরা, ম্যালেরিয়ার মহামারীর মৃত্যু মিছিল থেকেও আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। এবারো আমরা আবার উঠে দাঁড়াব।
আমাদের জয় হবেই।
ডঃ সুমিত দাশ পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। স্বাস্থ্যের বৃত্ত পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গণ স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অবসর সময়ে বেড়াতে যেতে ভালোবাসেন।