রবীন্দ্রনাথের অন্তত একশো গান চিনেছি আর ভালোবেসেছি যাঁর গায়নে, সেই সুবিনয় রায়ও একশো পেরলেন।
সুবিনয় রায়কে চেনা ও ভালোবেসে ফেলারও একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে আমার। ছয়ের দশকের শেষ দিকে বিশ-বাইশ বছর বয়েসে যখন ক্রমাগত ঘুরছি জর্জ, হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, রাজেশ্বরী, নীলিমার কণ্ঠজগতে, তখন এক পরিচিত, ভালোলাগা কণ্ঠকেই যেন নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগলাম। চেনা স্বরই, তবু কীরকম নতুন হয়ে ফিরে আসছে। আর একটু ভারী, আরও যেন নিটোল মধুর। কত স্বল্পশ্রুত, গভীর চেতনার গান তুলে আনছেন যে গীতবিতান খুলে, কথা দেখে দেখে এঁর গান শোনা ধরলাম। ভালোলাগা পেরিয়ে সুবিনয় রায়কে আমার ভালোবাসার পর্ব শুরু করলাম। আর ভালোবাসায় পড়ে তাজ্জব হতে থাকলাম শিল্পীর চলন, ধরন, নির্বাচনে। কত অনায়াসে কত কঠিন কাজ করে যাচ্ছেন, সব গানই যেন কেমন পূজা অঙ্গে ঢালা আর ওঁর চেষ্টাই যেন গেয়ে গেয়ে একটা নিজস্ব ঘরানা গড়ে নেওয়া। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবার ঘরানা? ঘরানা বইকি! অপ্রচলিত গান, তাতে ভিন্ন স্বাদ ও ভাবের রাগের ছোঁয়া, খুব পরিণত পরিবেশন, কিন্তু তার মধ্যেই কোথায় যেন এক সুরেলা উদাসীনতা— সব মিলিয়ে এক ভিন্ন গোত্র, নির্জন ঘর। না চাইতেই যে কত কিছু পেয়ে যাচ্ছি কবির গানের রসরহস্যের। যে-কারণে শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হওয়ার পর ওঁর এক ক্যাসেট প্রকাশের অনুষ্ঠানে ওঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলাম,
– সুবিনয় রায় হলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আমির খাঁ!
সুবিনয়দা বেশ চমকেছিলেন এমন একটা বর্ণনায়। ট্রিংকাসের ‘দ্য আদার রুম’-এর সেই অনুষ্ঠান শেষে টেবিলে পাশাপাশি বসে ওঁর কেবলই প্রশ্ন,
– অত বড় এক ওস্তাদের সঙ্গে তুলনায় গেলে কেন?
আরও কিছু কথার পাশাপাশি একটা কথা ওঁকে সেদিন বলতে পেরেছিলাম। তা হল,
– অত বড় ওস্তাদ, কিন্তু খেয়াল বন্দিশ নিয়ে যেন ধ্যানে বসছেন। হংসধ্বনির মতো মিষ্টি রোম্যান্টিক রাগেও কথা নিচ্ছেন কী? না, ‘জয় মাতে বিলাম্ভ, তাজ দে’। আপনিও দেখুন, যখন গাইছেন ‘পথে চলে যেতে যেতে’ আমরা কি ভাবছি সুরটা কী? চলেছি যেন ‘কোথা কোনখানে/ তোমার পরশ আনে কখন কে জানে’। পূজার গানের এ হল, যাকে বলা যায়, অশ্রু অঙ্গ। চোখের জলের তান। কম বড় ওস্তাদি?
তাতে সুবিনয়দা একটা অসম্ভব দামি কথা বলেছিলেন যা আজও ভুলতে পারিনি। বলেছিলেন,
– ওস্তাদিটা কোথায় জান, শঙ্কর? কঠিন কাজটা সহজ করে নেওয়ায়। কঠিন গান গাইছি মনে করলে তো গাওয়া হয় না। কঠিন কাজ, গুরু ভাবনা শিখে শিখে, চর্চা করে করে সরল করে নিতে হয়। তাই না?

সুবিনয়দার এই ভাবনার সঙ্গে আমার অন্যভাবে একটা পরিচয় ঘটে গিয়েছিল বেশ আগেই। আমার স্ত্রী ইন্দ্রাণী সুবিনয়দার ছাত্রী, ওর কাছে শুনতাম কী ভীষণ কড়া শিক্ষক। পান থেকে চুন খসার জো নেই। শিখিয়ে শিখিয়ে পারফেক্ট করে তবে রেহাই। কোনও বিরলশ্রুত রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে জিজ্ঞেস করলেই ইন্দ্রাণী বলত, “এটা সুবিনয়দার আছে।” তো একবার ওকে বলেছিলাম একটা গান দাদার থেকে তুলে এনে আমায় শোনাতে। গানটার রেকর্ড বা ক্যাসেট খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছিলাম, কোত্থাও পাইনি। খোঁজার কারণ, আমার ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, জ্ঞান গোঁসাই ও ভীষ্মদেবভক্ত বাবা গানটা আমার দিদিদের গানের মাস্টারনি মৃদুলাদির কাছে শুনতে চেয়েছিলেন। মহিলা গানটা শোনেনইনি কখনও। বলেছিলেন, “বড়বাবু, আমি তুলে আপনাকে শোনাব।” সে-সুযোগ তাঁর হয়নি, কারণ অল্পকালের মধ্যে আমার পিতৃদেব চলে গেলেন। গানটার কথা বলতে ইন্দ্রাণী বলেছিল,
– গানটা আমার সুবিনয়দার থেকে তোলাই আছে। তুমি চাইলে শুনিয়ে দিচ্ছি।
বলেই কবির স্ত্রী-বিয়োগের পর সর্ফর্দায় বাঁধা গানটা আমায় শুনিয়ে দিল। আমি ওকে বলেছিলাম সেদিন,
– কোনওদিন তোমার ক্যাসেট হলে এই গানটা অবশ্যই তাতে রেখ।
পরে একসময় সুবিনয়দার রেকর্ডেই গানটা শোনা হয় এবং সেই থেকে শোনার বিরাম নেই। কারণ, এই গানে একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, আমার বাবা এবং সুবিনয়দাকে পাই। সুবিনয়দাকে শুনতে শুনতে ধারণা হয়, স্বয়ং কবিকেই তাঁর আত্মকথা গাইতে শুনছি। গানটা সম্পূর্ণ তুলে দিলে সম্ভবত ধারণাটা পরিষ্কার হবে; ৪১ বছর বয়সের গানটা এরকম…
‘দুঃখরাতে, হে নাথ, কে ডাকিলে—
জাগি হেরিনু তব প্রেমমুখছবি
হেরিনু ঊষালোকে বিশ্ব তব কোলে,
জাগে তব নয়নে প্রাতে শুভ্র রবি
শুনিনু বনে উপবনে আনন্দগাথা,
আশা হৃদয়ে বহি নিত্য গাহে কবি।’

সাতের দশকের মাঝামাঝি যে দু’জন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীকে নতুন উদ্যমে শুনে যাচ্ছি, তাঁদের একজন রাজেশ্বরী, অন্যজন সুবিনয়দা। সুবিনয়দা ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ/ এমনি লীলা তব’ বা ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গেয়ে যেমন ‘গীতাঞ্জলি’-কে গানে গানে মেলে ধরছেন, আসরে তেমনি অপূর্ব গভীরতায় নিবেদন করছেন ‘চিরসখা হে, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না’ কি ‘এ মোহ আবরণ খুলে দাও’, যে-গান রাজেশ্বরীর রেকর্ডে শুনে শুনে কত অলৌকিক বিকেল, সন্ধে, রাত কেটেছে আমার। এর মধ্যে ১৯৭৬-এ রাজেশ্বরী বিদেশ থেকে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ফিরে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে গান দুটো আশ্চর্য মহিমায় গাইলেন। আসরের পর কথা হয়েছিল ‘সানডে’ পত্রিকার জন্য ওঁর একটা সাক্ষাৎকারের। বললেন পরদিন বারাণসী যাচ্ছেন, ফিরে এসেই কথায় বসবেন। নিয়তি এমন, ওই কাশীতেই উনি দেহরক্ষা করলেন। ওঁর কাছে আর জানা হল না কবির তরুণ বয়সের এই দার্শনিক গানগুলোর প্রতি ওঁর বিশেষ ধ্যান কেন। ‘এ মোহ আবরণ’ (২৩ বছর), ‘চিরসখা’ (৩৭ বছর), ‘চিরবন্ধু, চিরনির্ভর’ (৩১ বছর) গানগুলো তখন দেখছি সুবিনয়দারও ধ্যানজ্ঞান। আসরে আসরে নিবিষ্টভাবে গেয়ে যাচ্ছেন। শ্রোতাদের স্ট্যান্ডার্ড কী, তা নিয়ে ওঁর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, অবিকল উস্তাদ আমির খাঁ-র মতো নিজের মধ্যে ডুবে, আত্মস্থ হয়ে সেবা করে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের। যখন ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ গানের এমন কথাগুলো গাইছেন—
‘কত যে গিরি কত যে নদীতীরে
বেড়ালে বহি ছোট এ বাঁশিটিরে’
কিংবা ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ গানের এমন কথা গাইছেন,
‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার
বাজাই আমি বাঁশি—
গানে গানে গেঁথে বেড়াই
প্রাণের কান্না হাসি…’
তখন বাউল মূর্তিটা কীরকম স্নিগ্ধ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের। অত্যন্ত নিয়মবাগিশ, ব্যাকরণবিদ সুবিনয়দার মধ্যেও এরকম একটা মগ্ন বাউল হয়তো ছিল, যে নিয়ন্ত্রণ করত ওঁর গানের ভ্রমণসূচি। সুবিনয়দার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে কবির একটা জীবনীই গড়ে নেওয়া যায়। এ নিয়ে ওঁকে একবার জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন,
– ওঁর জীবন আর গান পাশাপাশি রেখে বোঝার অনেক কিছু আছে। তার পরেও মুহূর্মুহু বিস্মিত হতে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা করার জিনিস, যা শিখতে শিখতে ভালোবাসাটা তৈরি হয়। বোঝার থেকেই তো ভালোবাসা আসে, তাই না?

সাতের দশকের শেষ দিক থেকে সুবিনয়দার জনপ্রিয়তা তরতর করে বাড়তে দেখলাম। ‘A musician’s musician’, ‘সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গীতজ্ঞ’ তকমা ওইরকম সময় থেকে ওঁর পরিচয়ে লেগে যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় অবধারিতভাবে এসে পড়তে থাকে ওঁর গান ও গায়ন। ওঁর ব্রহ্মসঙ্গীত প্রিয় হতে থাকে আরও বিস্তৃত শ্রোতৃসমাজে। শঙ্খ ঘোষ ওঁর গানের বর্ণনায় বললেন এমন একটা কথা— ‘জলের ঢেউ তরল তানে’। আর ১৯৮২ সালে রীতিমতো এক আশ্চর্য সমাদর পেলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের। ব্যাপারটা এখনও চোখের সামনে ভাসছে, বলি…। বিখ্যাত সঙ্গীত সংস্থা ‘জলসাঘর’ ওই ’৮২ সালে চোরবাগানের বিখ্যাত মল্লিক বাড়িতে রবিশঙ্করের সংবর্ধনায় আয়োজন করেছিল ‘বাবু সন্ধ্যা’। অমন এক আসর আমি অন্তত আর কখনও দেখিনি এ শহরে। বিখ্যাত বাঙালি বাবুবিবিদের মধ্যে কে নেই সেই সন্ধ্যায়! তিলধারণের জায়গা নেই আসরে। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আসরের উদ্দেশ্য ও উদ্যোগ নিয়ে শুরুতে কিছু বলার।
সেই কাজটুকু করে আমি রবিশঙ্করের কাছাকাছি বসা সুবিনয় রায়কে অনুরোধ করলাম গান দিয়ে আসরের মুখপাত করার। এবং ওঁর সামনে রাখা হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে সুবিনয়দা ধরে নিলেন ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’। কবির ৩৬ বছর বয়সে নির্মিত ঝাঁপতালের এই গান ততদিনে সুবিনয়দার ‘সিগনেচার নাম্বার’ হয়ে গেছে। আর ধরলেনও এতই সুন্দর, যে সারা দুনিয়ার সেরার সেরা গান শুনে কান ভরানো রবিশঙ্করও রীতিমতো নড়েচড়ে বসে ওঁর বড় বড় সুন্দর দুই চোখ আরও বড় করে মেলে একদৃষ্টে সুবিনয়দাকে দেখতে দেখতে গানটা শুনতে থাকলেন। ওঁদের পাশে মঞ্চে বসে দেখা এই দৃশ্য আমার মানসপটে ছবির মতো ধরা আজও। পরের ব্যাপারটা আসরশেষে বাড়ির যে-ঘরটাকে গ্রিনরুম করা হয়েছিল, সেখানে। রবিশঙ্কর চা খাচ্ছিলেন, বেশ ক’জন বাঙালি বাবু ওঁকে নমস্কার জানাতে এসেছেন। এঁদের একজনকে দেখে পণ্ডিতজি উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– এতদিন কোথায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন ভাই? এই গান নিয়ে!
সেই বাঙালি বাবুটি সুবিনয় রায়।

এই বাবুটির আর এক চমৎকারিত্ব দেখেছিলাম বাংলাদেশের শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিলাইদহে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব ব্যাপক আয়োজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ১২৮তম জন্মজয়ন্তীর। সরকারের আমন্ত্রিত দলে আরও অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ ও সুবিনয় রায়ও ছিলেন। লেখক-সাংবাদিক হিসেবে সেই দলে ছিলেন এই অধমও। শিলাইদহের ওই বিশাল অনুষ্ঠানে শান্তিদেবদা বিশ-বাইশ হাজার শ্রোতার সামনে তালের মজা নিয়ে, নাটকের গান দিয়ে দিব্যি উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করলেন। হৈ হৈ, করতালি, কত কী। তারপর সেই জনসমুদ্রের সামনে এসে ছোট্টখাট্টো, নির্জন ব্যক্তিত্ব সুবিনয় রায় কী করলেন? ধরে নিলেন ওঁর ওই অনুপম কণ্ঠলাবণ্যে ‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে, ছেড়ো না’। অমনি বিশ-বাইশ হাজার মানুষ নিশ্চুপ হয়ে শ্রোতা বনে গেল। সুবিনয়দা পর পর গেয়ে গেলেন ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’, ‘এ কী এ সুন্দর শোভা’, ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’… একের পর এক আশ্চর্য নির্বাচন, আর চারদিক জুড়ে কী এক মুগ্ধ বিস্ময়! মনে হল রবিঠাকুরের যে বোটটা যত্নে রাখা আছে ওঁর বাড়িতে, তাতেই যেন ভেসে চলেছি পদ্মায়। পদ্মাবোট তখন গানের ভেলা।
*ছবি সৌজন্য: আনন্দবাজার পত্রিকা
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।