(Summer food) এই তো, কিছুদিন আগেও গুঁড়ো গুঁড়ো শাল ফুলে রাস্তা ঢেকে থাকতো। মৃদু কড়া গন্ধে মৌমাছিদের মৌতাত লেগে যেত। মানুষেরা চলতি পথে এসব দেখেও দেখত কিনা সেকথায় কাজ কি আর! বিগত বসন্তের গন্ধে তারা তলিয়ে গেছে। সব স্মৃতি তো আর পার্থিব যাপনের ভারে ন্যুব্জ্য নয়! তাই ভারী স্বাভাবিক নিয়মে বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম এসেছিল। (Summer food)

এতদিন বৈশাখও প্রায় ফুরিয়ে এলো। গাছে গাছে তালের মুকুল দেখা দিয়েছে। নিমফুলেরা ঝরছে অবিরত। খানিক মেঘের জল পেতে না পেতেই মাঠে মাঠে গিমেশাকের জাজিম মেলে দিয়েছে কে যেন। খুব নীচু হয়ে দেখলে মনে হয় চিকন হাতে কে যেন নকশা বুনেছে মাটির শরীরে। (Summer food)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১]
মানুষেরা এখন তেতে পুড়ে এসে আঁখের গুড়ের শরবত খাবে, কচি আঁখের সাথে লেবু মরিচ পেষাই করবে হামেশাই। এখন তো আর ঘরে ঘরে আখের চাষ নেই! আগে পাড়ায় পাড়ায় আখের শাল হতো কত! দানা দানা গুড় দিয়ে ছেলেবুড়োরা মুড়ি খেত, হাতেগরম রুটি খেত। দানা গুড় হারিয়ে গেলেও কী হবে, গিমেশাকের জাজিম গল্প বুনে চলে অবিরল। শালিজমি আর বাস্তুজমির রাজনীতি কি কেবল মানুষের চোখে ধরা দেয়? (Summer food)

মাটির গল্পে গিমে কলমি কুলেখাড়াদেরও কিছু কিছু স্মৃতি সত্তা মিলেমিশে থাকে তো। রান্নাঘর এতকিছু তলিয়ে ভাবার অবকাশ পায় বা পায় না। বরং জমি থেকে যখন পেঁয়াজ রসুন তোলার সময় হয়, তখন সে খানিক ছাঁচি পেঁয়াজ বাচিয়ে রাখে গিমেশাকের জন্য। মিঠে পেঁয়াজ দিয়ে গিমেশাকের ছেঁচকি, সে ভারী চমৎকার। (Summer food)
রাঢ়দেশে খানিক নরম মোটা চালে মানুষের শান্তি। ঘরে ঘরে হাড়িতে স্বর্ণ ফোটে। এক বা দুই ফুট দিয়ে হাড়ি নামিয়ে রাখো কেনো! জ্বাল ঠেলে ঠেলে এই ভাত নরম করা, সে ভারী ঝক্কি। বরং নামিয়ে রাখা একফুটের ভাত সব রান্না শেষ হলে চাপিয়ে দাও না আবার! দেখো না কেনো, কেমন নরম সুন্দর ভাত হয়। ভাতের মতো আর কী আছে! (Summer food)

গিমে না হোক শুসনি আছে। কোঁচড় ভরে শুসনি তোলে মেয়েরা বিকেল ভোর। কেউ বা আবার গোড়া তুলে এনে বাড়ির ধারে ঢালু জমিতে বুনে দেয়। খানিক জোর বা উপজোর(সার) দেয় হয়তো। বাজারে নিয়ে গেলে দু’পয়সা জুটেও যায়। কিন্তু সারের শুসনি দেখলেই বুঝে যায় মানুষ। অমন বড় বড় পাতার শুসনি কিন্তু মানুষ কিনতে চায় না সহজে। তার চেয়ে মাঠে ঘাটে যে শুসনি হয়, তার স্বাদ ঢের ঢের মিঠে। শুধু দু মুঠো রসুন আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে কড়াইয়ে নেড়ে নিলেই হলো। ওই দিয়েই মানুষ তোলা তোলা করে ভাত খেয়ে নেয় একেকদিন। (Summer food)
এমন ভাবার আসলে কোনো কারণ নেই, যে শাক-ভাত কেবল দারিদ্র্যের চিহ্ন। মানুষ সাধ করেও শাক-ভাত খায়। গরমের দিনে সে বড় সুখের। শাকের তো অভাব নেই! আগের মতো মাঠে ঘাটে আর শাক নেই বটে, তবুও কী বিপুলা এই পৃথিবী। দেশ গাঁয়ের মানুষেরা সামান্য জমি জিরেতকেই দেশ বলে মানে। দেশে যতদিন শাক আর ভাতের জোগাড় আছে, ততদিন মানুষের ঠিক চলে যাবে।
এসব তো আছেই, আর আছে পাঁচ মিশেলি শাক। সে শাকের স্বাদ ভারী সুন্দর। কড়াইয়ে সামান্য নুন ফেলে দিয়ে শাক কখানা কুচিয়ে দিয়ে দাও না হয়। চাপা ঢাকা দিলে জল উঠবে কত! সে জল মরে গিয়ে শাক নরম হলে ওই আবার রসুন মরিচে সাঁতলানো। কিন্তু এই পাঁচ মিশেলি শাক মানুষ ভেজা ভেজা ভালোবাসে। বেশ ঘাঁটা ঘাঁটা ভাব হবে শাকের, তবে এই শাক খেয়ে সুখ। (Summer food)

এমন ভাবার আসলে কোনো কারণ নেই, যে শাক-ভাত কেবল দারিদ্র্যের চিহ্ন। মানুষ সাধ করেও শাক-ভাত খায়। গরমের দিনে সে বড় সুখের। কিছু না থাক পোস্তশাক (কেউ কেউ বলেন বউটুনি) আছে, নুনিয়া শাক আছে। শাকের তো অভাব নেই! আগের মতো মাঠে ঘাটে আর শাক নেই বটে, তবুও কী বিপুলা এই পৃথিবী। দেশ গাঁয়ের মানুষেরা সামান্য জমি জিরেতকেই দেশ বলে মানে। দেশে যতদিন শাক আর ভাতের জোগাড় আছে, ততদিন মানুষের ঠিক চলে যাবে। (Summer food)

গরমের দিনে টক খেতে সাধ হয় বটে মানুষের। সে নিরামিষ টক হোক কী আমিষ। পোস্ত দিয়ে আমসি রান্না হয় যেদিন! হোক না সে ভারী সাধারণ! মানুষের সুখের রকমই এমন। তাকে তুমি তোমার মতো করে বুঝতে চাইলেই বিপদ। বিশ্বায়ন এখনও তাই বিপদ সীমার বাইরে। এই মাঠ কলমির লতা তাকে ঠেকিয়ে রেখেছে কোনোমতে, স্পর্শ বাঁচিয়ে।
গিমে ছেঁচকি
উপকরণ : গিমে শাক বেশ খানিকটা, ছাঁচি পেয়াজ দুই মুঠো, সর্ষের তেল, নুন।

পদ্ধতি: ছাঁচি পেয়াজ খোসা ছাড়িয়ে নিন। ছোটো গুলো আর খণ্ড করার দরকার নেই, বড় গুলো দুই ফালি করে দিন। শাক বেছে নিন। শক্ত ডাঁটি বাদ দিয়ে কচি ডাঁটা আর পাতাই কেবল নিন। কড়াই বসিয়ে সর্ষের তেল দিন। তেল গরম হলে শাক দিন। সামান্য নেড়ে ওর উপরেই ছাঁচি পেয়াজ দিন। নুন দিন। ঢাকা দিতে হবে না। সামান্য নেড়েচেড়ে জল শুকিয়ে নিন। হালকা ভেজা ভাব থাকতেই মাখা মাখা শাক নামিয়ে নিন। গরমের দিনে ভারী সুন্দর এই তেতো শাক।
গাঁদাল পাতার ঝোল
উপকরণ : কালবাউশ মাছ/ পোনা মাছ, আলু, কচি পটল, কাঁচালঙ্কা, জিরে, গোলমরিচ, গাঁদাল পাতা, নুন, হলুদ, সর্ষের তেল।

পদ্ধতি : মাছ পরিষ্কার করে ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ পরে মাছ ভেজে নিন। ওই তেলেই সাদা জিরে ফোড়ন দিয়ে আলু পটল ছাড়ুন। সামান্য সাঁতলে নুন হলুদ জল দিন। কিছুক্ষণ ফুটলে মাছ দিন। সব সেদ্ধ হলে ঢাকা খুলে উপর থেকে বাটা মশলা দিন (৪-৫টি গাঁদাল পাতা, হাফ চামচ জিরে, ৫-৬টি গোলমরিচ, একটি কাঁচালঙ্কা এক সঙ্গে বাটা)। অল্প সময় ফুটিয়ে উপরে আর কয়েকটি কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। গরম গরম পাতলা ঝোল খেতে ভালো।
ছবি সৌজন্য: লেখক, ফেসবুক
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।