Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

সুর্মা ভোপালির ডাকে অভিনয় করতে এসেছিলেন জয়-বীরুও!

Jagdeep
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

“আমা মিঁয়া, মেরা নাম সুর্মা ভোপালি ইঁয়েসে হি নহি হ্যায়…”

এ ভাবেই অবিরাম মুখভর্তি পান নিয়ে নিজের গুণগান… ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়াচ্ছে পানের পিক, মাথায় রঙিন টুপি, গোল গোল চোখ, কথায় কথায় নিজ বীরত্বের কথা (অবশ্যই মিথ্যে) ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা মহাকঞ্জুস কাঠের ব্যবসায়ী…

এইটুকু বললেই যে কেউ চোখ বুজে বলে দেবেন, এ তো সুর্মা ভোপালি। ‘শোলে’র সেই বিখ্যাত চরিত্র যার কাণ্ডকারখানা দেখে হাসতে হাসতে দর্শকের পেটে খিল ধরে যেত। সারাজীবন সুর্মা ভোপালি হয়েই বলিউডে নিজের জীবন কাটিয়ে দিলেন সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ জাফরি। হিন্দুস্তান যাকে ‘জগদীপ’ নামে চেনে। ৯ জুলাই মুম্বইতে তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল ভারতীয় চলচ্চিত্রের হাস্যকৌতুক চরিত্রের এক কিংবদন্তি অধ্যায়ের।

১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ মধ্যপ্রদেশের দাতিয়ারে জন্ম জগদীপের। আসল নাম আগেই বলেছি৷ অল্প বয়সেই হারিয়ে ছিলেন বাবাকে। ‘ওয়ালিদে’র মৃত্যুর পর মা-ই ছিলেন একমাত্র আশ্রয়। ঘরে তখন প্রচণ্ড অভাব, অনটন। মা একটি অনাথ-আশ্রমে রান্নার কাজ নিয়েছিলেন। সামান্য টাকায় চলত মা-ছেলের সংসার। জগদীপ নিজেই নানা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মায়ের সামান্য উপার্জনেই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন তা সম্ভব হয়নি। দিনভর অক্লান্ত খাটুনির জেরে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাকে সাহায্য করতেই খুব অল্পবয়সে কাজে নামেন জগদীপ। ঘুড়ি, সাবান বানিয়ে বাড়িবাড়ি বেচে উপার্জন করতেন তিনি। অতি-সামান্য হলেও তাতেই দিনগুজরান হত মা-ছেলের।

Jagdeep
শিশুশিল্পী জগদীপ। ছবি সৌজন্য – news18.com

এরপর একদিন ঘুরলো ‘কিসমত কা পাইয়া।’ যে রাস্তায় তিনি কাজ করতেন, সেখানেই একদিন শুরু হল ফিল্মের শুটিং। বি আর চোপড়ার হিট ফিল্ম ‘আফসানা’র (১৯৫১) শুটিংয়ে ডাক পড়ল ছোট্ট জগদীপের। নাটকের একটি দৃশ্যে দর্শকের সিটে বসা শিশুদের দলে অভিনয়। অর্থাৎ কিনা ‘এক্সট্রা।’ কোনও ডায়লগ নেই।

ফিল্ম জিনিসটা কী, তা-ই জানতেন না জগদীপ। তবু তিন টাকা পারিশ্রমিকের জন্য তাতেই রাজি হন। সেই দৃশ্যে উর্দুতে একটি সংলাপ ছিল যা কেউ বলতে পারেনি। জগদীপের মাতৃভাষা উর্দু হওয়ার জন্য তিনি বলতে পেরেছিলেন। এক ডায়লগে বাজিমাৎ। তিন টাকার বদলে ছ’টাকা নিয়ে মায়ের সঙ্গে নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরেন তিনি। এরপর শিশুশিল্পীর ভূমিকায় একাধিক সিনেমায় ছোট ছোট রোলে অভিনয় করেছিলেন। বুঝেছিলেন, সিনেমাই পারে তাঁকে ওই ভয়াবহ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে।

Jagdeep
ষাটের দশকে আফসানা ছবিতে নজর কাড়েন জগদীপ। এ ছবিতে নায়ক ছিলেন শাম্মি কপূর। ছবি সৌজন্য – theindianexpress.com

এ ভাবে দিন কাটতে কাটতে আচমকাই একদিন নির্দেশক ফণী মজুমদারের ‘ধোবী ডক্টর’ (১৯৫২)-এ কিশোর কুমারের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেন জগদীপ। আশা পারেখ ছিলেন তাঁর ছোট্ট বান্ধবীর ভূমিকায়। ফিল্ম হিট হয়। এতদিন মাস্টার ইশতিয়াক নামে কাজ করছিলেন তিনি। ফণীই রাখেন তাঁর নতুন নাম – জগদীপ। ‘ধোবী ডক্টর’ করে বেশ প্রশংসিত হয় তাঁর কাজ।

ওইটুকু ছোট্ট চরিত্রেও সাবলীল অভিনয় নজর কেড়েছিল আর এক কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার বিমল রায়ের। তাঁর ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩) ছবিতে ডেকে নিলেন জগদীপকে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে মাইলস্টোন গড়ে ‘দো বিঘা জমিন।’ প্রশংসিত হয় মাস্টার জগদীপের অভিনয়। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। গুরু দত্তের ‘আর পার’ (১৯৫৪), বলরাজ সাহনীর সঙ্গে ‘ভাবী’ (১৯৫৭), পৃথ্বীরাজ কাপুরের সঙ্গে ‘তিন বহুরানিয়া’ (১৯৬৮), এজেন্ট বিনোদ (১৯৭৭)-এর মত অসংখ্য চলচ্চিত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেন জগদীপ। চার দশকেরও বেশি সুদীর্ঘ ফিল্ম কেরিয়ারে জগদীপ চারশোটিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

Jagdeep
কমেডি হোক বা ভিলেন, দুই চরিত্রেই সমান সাবলীল ছিলেন। ছবি সৌজন্য – indiatvnews.com

কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’-তে (১৯৭৫) সুর্মা ভোপালির চরিত্রে জগদীপের সেই মজার অভিনয়। শোনা যায় গোড়ায় জগদীপ এই চরিত্রে অভিনয় করতে চাননি। পরে পরিচালকের জেদাজেদিতে রাজি হন। এও শোনা যায় ‘শোলে’র শুটিং আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র ‘সুর্মা ভোপালি’ চরিত্রের জন্য নতুন করে শুটিং করেন সিপ্পি। বাকিটা ইতিহাস। লোকের মুখে মুখে ফিরেছিল সুর্মা ভোপালির চরিত্রে জগদীপের সেই অসাধারণ অভিনয়। কিন্তু এর জন্য বিপদেও পড়তে হয় তাঁকে। সে এক মজার গপ্পো।

‘শোলে’র কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সেলিম-জাভেদ। সুর্মা ভোপালির চরিত্র তাঁদেরই সৃষ্টি। কিন্তু অনেকেই জানেন না, সুর্মা ভোপালি কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়! সত্যি সত্যিই একজন মানুষ ছিলেন যাঁর নাম সুর্মা ভোপালি!

Jagdeep
সুর্মা ভোপালির চরিত্রে এমনই মজেছিলেন যে পরে এই নামে একটি ছবিও পরিচালনা করেন। ছবি – theindianexpress.com

ভোপালে তিনপুরুষের বাসস্থান ছিল ফরেস্ট অফিসার নাহার সিংয়ের। রোগা-সোগা তালপাতার সেপাই টাইপ চেহারা কিন্তু হাঁকডাক ছিল সাংঘাতিক। ভোপালের লোকেরা মজা করে তার নাম দেয় ‘সুর্মা’ (সাহসী, বীর) এবং ভোপালের মানুষ বলে ‘ভোপালি’। এই নাহার সিংই ছিলেন সেলিম-জাভেদের অনুপ্রেরণা। তাঁর কথা ভেবেই ‘সুর্মা ভোপালি’ চরিত্রটি সৃষ্টি হয়, যাকে অমরত্ব দেন জগদীপ। কিন্তু ‘শোলে’ সুপারডুপার হিট হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন নাহার সিং। তাঁর মনে হয়েছিল তাঁকে নিয়ে সিনেমায় বিদ্রুপ করা হয়েছে। তিনি সরাসরি দুজন উকিল নিয়ে বম্বে আসেন ও জগদীপ-সহ সেলিম-জাভেদের বিরুদ্ধে মানহানির মকদ্দমা ঠোকেন। পরে জনি ওয়াকার-সহ ইন্ডাস্ট্রির একাধিক বিশিষ্টজনের হস্তক্ষেপে নাহার সিংহের মন গলানো সম্ভব হয়েছিল। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন জগদীপও৷

মজার ব্যাপার, পরে ‘সুর্মা ভোপালি’ (১৯৮৮) নামে একটি কমেডি ফিল্ম পরিচালনাও করেছিলেন জগদীপ। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তাতে অভিনয় করেছিলেন ‘শোলে’র অন-স্ক্রিন জয় ও বীরু অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্র।

Jagdeep
রাজকুমার সন্তোষীর কমেডি ক্লাসিক ‘আন্দাজ আপনা আপনা’য় সলমন খানের বাবার ভূমিকায় জগদীপের অভিনয় ছিল অসাধারণ। ছবি সৌজন্য – news.18.com

জীবন সায়াহ্নে রাজকুমার সন্তোষীর কমেডি ক্লাসিক ‘আন্দাজ আপনা আপনা’য় সলমন খানের বাবার ভূমিকায় জগদীপের অভিনয় ছিল অসাধারণ। ‘চায়না গেটে’ সুবেদার রামাইয়া চরিত্রে তাঁর অভিনয়ও অবিস্মরণীয়! একটা সময় কাজ না পাওয়ার জন্য ‘পুরানা মন্দির’,’ভিরানা’র মত বি-গ্রেড হরর ফিল্মেও অভিনয় করতে হয়েছিল তিনি। শেষ ছবি ছিল ২০১৪ সালে ‘গলি গলি চোর হ্যায়’। চোর ধরতে গিয়ে হয়রান এক কনস্টেবলের ভূমিকায় জগদীপ তুলনাহীন।

Jagdeep
ব্যক্তিজীবন খুব একটা সুখের না হলেও মুখের হাসিটি ছিল সদা-অমলিন। ছবি সৌজন্য filmfare.com

জগদীপের ব্যাক্তিগত জীবনেও এসেছে বহু উত্থানপতন। তিন-তিনবার বিয়ে করেন তিনি। তাঁরই সন্তান হলেন অভিনেতা নাভেদ ও জাভেদ জাফরি। ২০০১ সালে কলকাতা শহরেই সারাজীবনের কর্মকাণ্ডের জন্য কলাকার অ্যাওয়ার্ড দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। সেই জগদীপ চিরবিদায় জানালেন বলিউডকে। ৮১ বছর বয়সে নিভে গেল প্রাণ-প্রদীপ। কিন্তু আজও দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁর অভিনয়ের গুণে যে অনাবিল আনন্দ ও হাসির রসদ খুঁজে পান, তা-ই তাঁকে করে তুলেছে সাক্ষাৎ কিংবদন্তি।

জগদীপের প্রয়াণ ঘটলেও সুর্মা ভোপালির মৃত্যু নেই। তিনি অমর।

Author Prasenjit Dasgupta

পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।

Picture of প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।
Picture of প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

পেশায় সাংবাদিক প্রসেনজিতের জন্ম ১৯৮১-তে। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের ফেলো, প্রসেনজিতের গবেষণার বিষয় রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও সঙ্গীততত্ত্ব। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। অবসরে ভালোবাসেন সরোদ বাজাতে, পুরনো চিঠি ও বই পড়তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস