(Bengali Novel)
আবার একটি মিটিং, তবে আজ মুখোমুখি।
সোমদত্তা সরকার আর মৌমিতা দেব রায়, দু’জনেই মিটিউবের ইন্ডিয়া পূর্বাঞ্চলের হেড অফিসে- জোনাল হেডের মুখোমুখি। আজ দু’জনেরই পোশাক, ভাবভঙ্গীতে একটা ইনফরমাল ভাব। তাঁরা মিস্টার অভিরূপ মজুমদারকে আপডেট করছেন। অফিসের সময় পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, তাঁদের সামনে প্লেটে এখনও কিছু স্ন্যাকসের ভুক্তাবশেষ এবং পানীয়। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: সূত্রধার: সপ্তম পর্ব
বড় স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে অভিরূপ, মন দিয়ে গ্রাফগুলো দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের মোট আটজন মিটিউবারের উন্নতির পরিমাপ, যাঁরা পাইলট প্রজেক্টে বিবেচিত হয়েছিলেন। তাঁরা গ্রীন ভিশনের রিসোর্স কেমন কাজে লাগিয়েছে, তাঁদের ভিশন অনুযায়ী কেমন কাজ করেছেন, কতটা তাঁদের নিজেদের প্রচেষ্টা আছে, ভিডিওর গুণগত মান এবং তাতে দর্শকদের কেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। দু’সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ডেটা নেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে লিলি-তারকরা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। বাকি মিটিউবারদের তুলনায়। (Bengali Novel)

শুভময় ফিরে তাকালেন মৌমিতার দিকে-
‘আপনি সিওর? এরা তো সবচেয়ে এগিয়ে আছে। মানে আমি বুঝছি বিষয়টা, এক বছরে মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার, মাথা ঘুরে গেছে- তাছাড়া ওরকম একটা প্রোগ্রামে যাওয়ার সুযোগ, ড্রিম কাম ট্রু, অত গিফট…’ (Bengali Novel)
একটু থামলেন-
‘তবে আমার মনে হয়, একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? এতটা এফোর্ট দেওয়ার পর… আপনিও তো? আই মিন দু’পক্ষই’। (Bengali Novel)
মৌমিতার মুখটা কীরকম অন্যরকম লাগছে। পড়া যাচ্ছে না। দৃষ্টি একটু অন্যমনস্ক।
‘সুযোগ দেওয়াই যায় শুভময়। কিন্তু ওঁরা এই দেখানোর স্বভাবটা বন্ধ করতে পারবে না। এটা বেরিয়ে আসবেই। এই বাজারে এত পণ্য, এত কিছু কেনার, এত কিছু খাওয়ার, পরার, ভোগ করার। ওঁদের কাছে এত টাকা এবং এত জনপ্রিয়তা। ওঁরা পারবে না রেজিস্ট করতে। আমি বেশি বোঝাবার চেষ্টা করলে একটা রেবেল হয়ে যাবে, খুব তিক্ত হয়ে যাবে সবকিছু। আরও সময় নষ্ট। ভাবুন না, আজ ওই প্রোগ্রামে এসেছে, কাল ওখানকার রান্নার চ্যানেলে আসবে, সেও তো বিরাট প্রেস্টিজ। এরপর আরও কিছু। ওরা পারবে না অভিরূপ। ওদের ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন দরকার।’ (Bengali Novel)
“এই কোম্পানির যিনি মালিক, তিনি বিশ্বাস করেন ক্লাইমেট ক্যাটাস্ট্রফি হয়ে আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে পৃথিবী একের চার অংশতে মানুষ থাকবে কোনওভাবে- টিকে থাকবে তাঁরাই, যাঁদের অর্থ, স্বাস্থ্য আছে বাকিরা কোনওভাবে বেঁচে থাকবে অতি দুঃসহ পরিবেশে, আবহাওয়ায়, বিশৃঙ্খলায়- ওই ডিস্টোপিক মুভি গুলোর মতো।”
‘তা কি করবেন ওঁদেরকে’?
এবার মৌমিতা ভাল করে তাকালেন অভিরূপের দিকে।
সশব্দে হেসে উঠলেন।
‘আপনি কি ভাবলেন? আমি ওদের কোনও ক্ষতি করব? ট্রোল করব? আরে না না…’ (Bengali Novel)
ওঁরা ওঁদের মতো থাকবেন। আমরা ওঁদের আর কোনও সাহায্য করব না। জাস্ট কাটিং দেম লুজ। ওঁদের তো অলরেডি অনেক সাবস্ক্রাইবার আছে। তবে কি জানেন ওঁরা খুব সহজে রিসোর্স পাচ্ছিল, আইডিয়া পাচ্ছিল। এখন ওঁদের, ওগুলোর পেছেনে সময়, অর্থ দুইই খরচ করতে হবে। জনপ্রিয়তা ধরেও রাখতে হবে। পারবে কি? এন টিভিতে যাওয়ার পর। কিছু দর্শকদের মনে হচ্ছে ওঁদের মধ্যে অহংকার দেখতে পাচ্ছে। ন্যাকামিও। কিছু নেগেটিভ কমেন্ট ওঁরা পেতে শুরু করেছে। এরপর মিটিউবের অ্যালগরিদম যেভাবে কাজ করে…’ (Bengali Novel)
অভিরূপ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন। তারপর বলে উঠলেন-
‘এই নেগেটিভ কমেন্ট করছে কারা? প্ল্যান্টেড না তো’? হাসলেন অভিরূপ।
মৌমিতা আরও জোরে হাসলেন।
এবার সোমদত্তা এই হাসি ঠাট্টা কেটে বলে উঠলেন। (Bengali Novel)
“যখন সত্যি আর পৃথিবীতে কিছু থাকবে না- যাঁর কাছে মানুষের শেষ অর্গানিক জীবনের ইতিহাস থেকে যাবে, সাস্টেইনবেল অরগ্যানিক জীবনের শেষ ছবি, সরল মানুষ, পুকুরের, লেকের মাছ, ক্ষেতে ফলানো ফসল, নিজেদের গাছের ফল— সে তো ভগবান।”
‘তাছাড়া এই প্রজেক্টের ভিডিওগুলো শুধু ভিডিও তো নয়, এগুলো ভবিষ্যতের জন্য ডকুমেন্টেড থাকবে।’
অভিরূপের ভুরুতে প্রশ্ন।
‘এই প্রজেক্টর পিছনে যে আরও কিছু আছে, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি অনেকদিন থেকেই। আপনাদের মতো থিঙ্ক ট্যাংক যেখানে। এটা কোনও এক্সপেরিমেন্ট নাকি? কোনও গভর্নমেন্ট না কর্পোরেশন করছে?’ (Bengali Novel)
‘এক্সপেরিমেন্ট? তা বলতে পারেন। সারা পৃথিবীতে সাস্টেইনেবল, অরগ্যানিক সরল জীবনযাত্রা, তিনবছর ধরে যাঁরা আমাদের মান অনুযায়ী রাখতে পারবে, সেই ভিডিওগুলো থেকে যাবে, একটি বিশেষ কর্পোরেশনের নিজস্ব লাইব্রেরিতে।’ (Bengali Novel)

‘হুম কোন কর্পোরেশন?’
সোমদত্তার মুখে ফুটে উঠল হাসি। (Bengali Novel)
‘এই কোম্পানির যিনি মালিক, তিনি বিশ্বাস করেন ক্লাইমেট ক্যাটাস্ট্রফি হয়ে আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে পৃথিবী একের চার অংশতে মানুষ থাকবে কোনওভাবে- টিকে থাকবে তাঁরাই, যাঁদের অর্থ, স্বাস্থ্য আছে বাকিরা কোনওভাবে বেঁচে থাকবে অতি দুঃসহ পরিবেশে, আবহাওয়ায়, বিশৃঙ্খলায়- ওই ডিস্টোপিক মুভি গুলোর মতো। আর তিনি থাকবেন- যেখানে তিনি এখন যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অন্য গ্রহে বা স্পেসে। অন্ততঃ চেষ্টা তো তাই করছেন। আর তখন…’ (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: সূত্রধার: ষষ্ঠ পর্ব
মুখের কথা শেষ হল না তাঁর
অভিরূপ মজুমদার বলে উঠলেন-
‘তিনি এগুলোকে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করবেন?’
এবার মৌমিতা বলে উঠলেন-
‘না হয়তো অর্থের জন্য নয়, পাওয়ার বলতে পারেন বা জিনিয়াসরা খানিকটা মেগালোম্যানিয়াকও হন। তিনি মনে করেন, এগুলোই হবে ভবিষ্যৎ মানুষের বিরাট সম্পদ। মানে যাঁরা বেঁচে থাকবে তাঁদের কাছে। সেটার আভাস আমরা রিসার্চ করার সময় এখনই পেয়েছি।’ (Bengali Novel)
‘ইন্টারেস্টিং। বুঝতে পারছি খানিকটা। কিন্তু কী আভাস? এখনই কীভাবে পাচ্ছেন?’
‘যেমন ধরুন লিলির ভিডিও? এই প্রোজেক্ট যখন আমরা শুরু করি, ডেটা, রিসার্চ কমিটির করা ইন্টারভিউস, কোয়াশ্চেনেয়ার এগুলোর থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়, কেন দেশ-বিদেশের আরবান পপুলেশন এগুলো দেখে। মানে লিলির বা ঐরকম ভ্লগ। ভাবুন, লিলির ভিডিও যাঁরা দেখে তাঁদের মধ্যে বড় অংশ শুধুমাত্র শহুরে, উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি পপুলেশন, যাঁরা দেশে এবং বিদেশে থাকেন। চল্লিশের ওপরের মহিলারা বিশেষ করে।’ (Bengali Novel)
“কত কিছুই তো হতে পারে- আরে রাতারাতি সোশ্যাল মিডিয়াতে দারুণ হ্যাক হবে, বহু ভ্লগ একসাথে নষ্ট হয়ে যাবে। হতে পারে না? কিছু ভিডিও পার্মানেন্টলি। তাঁরা আবার নতুন করে শুরু করবেন।”
‘কেন দেখেন? কী পান?’
‘শহরের ছোট ফ্ল্যাটে সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, ডেস্কজব করা মহিলারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে ডায়েট করতে, একের পর এক নানারকম, প্রোটিন বেসড, ভিগান, বেশিরভাগ সময় ফাস্টিং… ভাবুন তো তখন কাঁচা সোনা রঙের সর্ষে বাটার মধ্যে নধর কাঁচালঙ্কা দিয়ে রান্না করা, পুকুর থেকে তোলা পার্শে মাছের ঝাল দিয়ে এক থালা ঢেঁকিছাটা চালের ভাতের ভিডিও? একসাথে উইড আর অর্গাজম। তার সঙ্গে গাছপালার ছায়া পড়া, পুকুর, শাড়ি পরা গোলগাল চেহারার মিষ্টি বৌ, শান্তিপূর্ণ কথা, বোকা বোকা নির্দোষ আহ্লাদ— ওই সব কিছু, যা তাঁদের কর্পোরেট জব, বাড়ি গাড়ির ই.এম.আই, উচ্চবিত্তের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা, ছেলে মেয়ের উচ্চশিক্ষা, বেড়াতে যাওয়া… ফিগার বজায় রাখা জীবনে একদম ওয়েসিস, সে মুম্বাই বলুন আর দুবাই আর মিনিয়াপোলিস।’ শুভময় কথাটা কেটে বলে উঠলেন- (Bengali Novel)

‘যখন সত্যি আর পৃথিবীতে কিছু থাকবে না- যাঁর কাছে মানুষের শেষ অর্গানিক জীবনের ইতিহাস থেকে যাবে, সাস্টেইনবেল অরগ্যানিক জীবনের শেষ ছবি, সরল মানুষ, পুকুরের, লেকের মাছ, ক্ষেতে ফলানো ফসল, নিজেদের গাছের ফল— সে তো ভগবান।’ (Bengali Novel)
‘বিংগো’। মৌমিতা বলে উঠলেন।
‘বুঝলাম। কোন জিনিয়াসের কথা বলছেন সেটাও। ক’দিন অন্তর অন্তর স্পেস শাটল পাঠাচ্ছেন। তবে তিনি এসবও ভাবেন, সেটা জানতাম না। নিজে ভেবেছেন, না কেউ আইডিয়াটা ওঁকে বিক্রি করেছে?’
মৃদু মৃদু হাসতে থাকেন দু’জনেই। (Bengali Novel)
আরও পড়ুন: সূত্রধার: পঞ্চম পর্ব
‘সেটা কে জানে মিস্টার মজুমদার? অনেক ওপর লেভেলের ব্যাপার।’
‘ও আর একটা প্রশ্ন, তিন বছর পর। ওই কোম্পানি কিনে নিল এদের ভিডিওগুলো? তারপর?’
‘সে দায়িত্ব আপনাদের। কত কিছুই তো হতে পারে- আরে রাতারাতি সোশ্যাল মিডিয়াতে দারুণ হ্যাক হবে, বহু ভ্লগ একসাথে নষ্ট হয়ে যাবে। হতে পারে না? কিছু ভিডিও পার্মানেন্টলি। তাঁরা আবার নতুন করে শুরু করবেন।’ মৌমিতা হাসতে হাসতে জিন এন্ড টনিকে দীর্ঘ চুমুক দিলেন। (Bengali Novel)
‘এটা কিন্তু জাস্ট জোক।’
‘অফ কোর্স।’ শুভময়ও হাসছেন। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত্রি নামছে বাইরে। (Bengali Novel)
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
(ক্রমশ)
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।