পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের শোকস্মরণিকা আমাকে যে এত তাড়াতাড়ি লিখতে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রথম যখন শুনেছিলাম তিনি জটিলতম শারীরিক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি, নিরন্তর চেয়েছি, তিনি ফিরে আসুন। আবার তালে, লয়ে, ছন্দে ভরিয়ে তুলুন প্রেক্ষাগৃহ তথা সমগ্র শ্রোতৃমণ্ডলীর মন। শেষ পর্যন্ত যখন শুনলাম, তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই, তখন সর্বপ্রথম মনে হল, আধুনিক তবলাবাদনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারার একটির অকাল পরিসমাপ্তি ঘটল।
কলকাতা শহরে আধুনিক তবলা বাজতে শুরু করে সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সময় থেকে। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের মধ্যে সাঙ্গীতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির মধ্যে অবশ্যই ছিল লখনউ ও বেনারস। যখন লখনউয়ের নবাব, ওয়াজিদ আলি শাহ নির্বাসিত হয়ে কলকাতায় আসেন, তখন থেকেই উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসার শুরু হয় এই শহরে। অনেকদিন পর্যন্ত কলকাতার বাঙালি তবলাশিল্পীরা প্রত্যেকেই ভারতবর্ষে ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাবকে সঙ্গীতে ছাপ ফেলতে দেননি; সেই সময়ে প্রকৃত অর্থে ‘খানদানি’ তবলাই বাজত কলকাতায়। লখনউ ও বেনারস, দু’ধরনের ‘বাজ’ই বাজত।

অনেকে মনে করেন, লখনউ বাজ থেকেই বেনারস বাজের উৎপত্তি– হতেই পারে। কিন্তু এই উৎপত্তিস্থল কলকাতা, না উত্তরপ্রদেশ, তা তর্কসাপেক্ষ। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হোক, উত্তরপ্রদেশ। এরপর উস্তাদ মসিত খান যখন কলকাতায় আসেন, তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ফারুক্কাবাদ বাজ, যা কিনা লখনউ বাজ থেকেই উৎপন্ন বলে ধরা হয়। উস্তাদ মসিত খানের পুত্র, উস্তাদ কেরামতুল্লা খান, ও শিষ্য সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ কলকাতায় তবলার প্রসারের কাজে ব্রতী হন। এই দু’জনের থেকে বেরিয়ে আসে আধুনিক তবলাবাদনের সর্বপ্রথম চর্চিত রূপ। সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর বাদনশৈলীতে নাগরিকতার কিছু চিহ্ন আনলেন, উস্তাদ কেরামতুল্লা খান আনলেন পরিশীলন।
উস্তাদ কেরামতুল্লা খানের শিষ্য ছিলেন পণ্ডিত স্বপনকুমার শিব। তাঁরই শিষ্য পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মধ্যে উস্তাদ কেরামতুল্লা খানের পরিশীলনের সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু আধুনিকতার ছাপ পাওয়া যেত, যা নিয়ে লেখাটির এই অংশে সামান্য আলোচনা করব। তাঁর একক বাদনে প্রথম যে জিনিসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হল, বাজনার বক্তব্যের ভূমিকা গঠন, বা পেশকারের ‘বঢ়হৎ’। প্রতিটি বাণীর প্রতি তাঁর সমান যত্ন সত্যিই বড় বিস্ময়কর ছিল। তারই মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল, তাঁর পেশকারে ধ্রুপদের আলাপের প্রভাব।

একটু বিস্তারিত বলি। ধ্রুপদের আলাপের বেশ কিছু মূল আঙ্গিকের মধ্যে একটি হল, আলাপের সময়ে ব্যবহৃত শব্দাংশ, বা ‘সিলেবল’-এর মধ্যে হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বরের পার্থক্যগত বিশ্লেষণাত্মক বিস্তার। পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পেশকার বাজাতেন, তখন ধ্রুপদের গায়নশৈলীর কাঠামো বজায় রাখতেন, এবং ধ্রুপদের আলাপে ব্যবহৃত শব্দাংশগুলির অনুরূপ বাণীর ব্যবহারে পেশকারের রূপ নির্মাণ করতেন। তবলায় সুরের অনুপ্রবেশের পথ সবসময় খোলা নয়– এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছিলেন তিনি। হয়তো তা সম্ভব হয়েছিল, তাঁর গানের তালিম থাকার জন্যই। তিনি খুব সুন্দর গানও গাইতেন। সাধারণত একটি প্রচলিত ধারণা আছে, যে, তবলা বাজালে গানের গলা ‘হাস্কি’ হয়ে যায়। তা যে ভিত্তিহীন, এবং সর্বৈব মিথ্যা, তা তাঁর গান শুনলেই বোঝা যেত।
পেশকারের প্রসঙ্গেই বলতে হয়, তেহাইয়ের বিস্তারের সময়ে আচার্য শঙ্কর ঘোষ প্রবর্তিত পদ্ধতিতে ‘সম’-এর আগে কোনও মাত্রা থেকে ‘মোকাম’ নিয়ে ‘সম’ এ ফেরা, এবং তেহাইটা ‘মোকাম’-এর গ্রহে সম্পূর্ণ নির্ভুল অঙ্কের হিসেবে শেষ করার ক্ষেত্রে শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যিই অসামান্য পারদর্শী ছিলেন। শুধু তাই নয়, উপরোক্ত পদ্ধতির সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেছিলেন ‘মোকাম’-এর বোল কে তেহাইয়ের পাল্লা হিসেবে ব্যবহার করা।
পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজনার আধুনিকতার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বলতে হবে যে বিশেষ রচনাগুলি তিনি বাজাতেন, তাদের কথা। ফারুক্কাবাদ বাজের তালিমের সম্পূর্ণ ছাপ তাঁর বাজনায় থাকা সত্ত্বেও তাঁর বাজনার স্বাতন্ত্র্য কিন্তু বেশিটাই আসত তাঁর উদ্ভাবন করা রচনাগুলির থেকে। কখনও কখনও তাঁর রচনা শ্রোতাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলত আকস্মিকতার আলোড়ন, এমনই তাদের গতি। আবার কখনও সেখানে কোনও পুরনো বাজনার প্রসঙ্গ এসে পড়ত; তিনি ইচ্ছে করেই আনতেন– সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে ইন্টারটেক্সচুয়াল কনটেক্সট। পরম্পরাগত যে রচনাগুলি তিনি বাজাতেন, তাতে তিনি প্রায়ই আনতেন তাঁর সমগ্র সামাজিক শিক্ষার প্রভাব, যা অতীতের সেই রচনাগুলিকে দিত প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট।
তবলা সঙ্গতের ক্ষেত্রে পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজনাই বর্তমান শতাব্দী সবচেয়ে বেশি শুনেছে, এ বিষয়ে আমার সঙ্গে সম্ভবত কেউই দ্বিমত হবেন না। সঙ্গতের ক্ষেত্রে যা যা পথ তিনি দেখিয়েছেন, প্রত্যেক উঠতি তবলাশিল্পীরই তা গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত।

যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গতের ক্ষেত্রেই হোক, বা গানের সঙ্গে সঙ্গতের ক্ষেত্রেই হোক, পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের তালিম থেকে প্রাপ্ত রাগরূপের সঠিক ধারণা তবলার বহুশ্রুত ঠেকাগুলিকে এক একটি রাগের স্বরবিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলত। তারযন্ত্রের ‘বোল’-এর ধ্বনির অনুরূপ ধ্বনি তিনি তবলার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন, যা সমগ্র সাঙ্গীতিক উপস্থাপনাকে শ্রোতার মনের অনেক কাছাকাছি নিয়ে যেতে সাহায্য করত। বাঁশি বা সন্তুরের মতো যন্ত্রের সঙ্গে বাজানোর সময়ে, তাঁর হাতের আওয়াজের সুনিয়ন্ত্রিত শব্দের পরিমিতিও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বড় অসময়ে চলে গেলেন তিনি।
ভাবলে বেশ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, যে আর কখনও মঞ্চে সেই মানুষটাকে দেখব না, যিনি মুখে স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে অসামান্য ছন্দের লালিত্যে শ্রোতাদের তথা আমাদের, শিক্ষার্থীদের, বিভোর করে রাখবেন।
পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি শুভঙ্করকাকু বলে সম্বোধন করতাম। যখনই দেখা হত, খুব মধুর ব্যবহার করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, ভাল আছি কিনা, রিয়াজ় ঠিকমতো করছি কিনা। সবসময়েই অপার ইতিবাচকতায় ভরিয়ে রাখতেন চারপাশের সকলকে। একজন অনুজ তবলাশিল্পী হিসেবে আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ, কারণ আমার গুরুদের কাছে আমি যা শিক্ষা পেয়েছি, তাছাড়া আমি যদি কারুর বাজনা শুনে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়ে থাকি, তিনি শুভঙ্কর কাকু।
তাঁকে আমার প্রণতি জানাই।
*ছবি সৌজন্য: arts.stanford.edu, Facebook, timesofBengal
সুভদ্রকল্যাণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতকোত্তর। বর্তমানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর করছেন। স্তরের ছাত্র। বাংলা ও ইংরাজি উভয় ভাষাতেই তাঁর লেখা সংগীত ও সাহিত্য বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বহু বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছেন, সেগুলিও প্রকাশিত ও সমাদৃত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরাজি ভাষায় কবিতা লেখেন সুভদ্রকল্যাণ। তাঁর আরেকটি পরিচয় রাগসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। সংগীতশিক্ষা করেছেন আচার্য শঙ্কর ঘোষ, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, ডঃ রাজিব চক্রবর্তী প্রমুখ গুরুর কাছে। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা।
One Response
অপূর্ব লেখাটি।