এই একটা সময় যখন চঞ্চলচন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে ভয় নেই। দূরবীনের পর্যবেক্ষণ নেই। চঞ্চলচন্দ্রকে কি জুড়ানের বৃত্তান্ত বলব? কিছুই বুঝতে পারছি না, কিন্তু বসন্ত মল্লিকের কন্যা নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। শ্যামাশ্রী যে গান গেয়েছিল, সেই গান বসন্তর মেয়ে গেয়েছিল কেন আমার সামনে ? কেন এমন হয় ? জীবনে কত কিছু ঘটে যায়, যার ব্যাখ্যা নিজে খুঁজে বের করা কষ্টের।
সুমিতাভকে আমি জুড়ানের কথা বলিনি। জুড়ানের সঙ্গে যা হয়েছে বলিনি কেন না আমি লিখব। এতদিন বাদে মনে হচ্ছে লিখতে পারব। শ্যামাশ্রী যেন আড়াল থেকে বলছে, লেখ অনুতোষ, লেখ। আমি সমস্ত সম্ভাবনাকে সত্য করে তুলব। ডোরবেল বাজিয়েছি। বেশ লম্বা, শীর্ণকায় চঞ্চলচন্দ্র দরজা খুলেছেন। সহাস্যে ডাক দিলেন, আসুন।
তাঁর চোখে চশমা, চশমার ভিতরে দ্যুতিময় চোখ। গালে না কামানো কয়েকদিনের পাকা দাড়ি। পরনে আধ ময়লা পায়জামা, পাঞ্জাবি। ঘরে এসি নেই। বনবনিয়ে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। জানালা দিয়ে অনেক দূর, সেই আমাদের প্রাতঃভ্রমণের পার্ক অবধি চোখ চলে যায়। চা খাব কি না জিজ্ঞেস করলেন। হ্যাঁ বলতে তিনি নিজেই তা করে দিলেন। তারপর বললেন, কদিন বাদে তিনি চলে যাবেন, রানি রোডে নতুন ফ্ল্যাট পেয়েছেন। তিনি কোথাও বেশিদিন টিকতে পারেন না। লোকে তাঁকে পছন্দ করে না। কথাটা বলে হা হা করে হাসতে লাগলেন। আবার এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে তাঁর ভালোও লাগে না। আমরা দেখছিলাম, খুব সাধারণ আসবাব তাঁর এই ফ্ল্যাটে। থাকার মধ্যে আছে অনেক বই। সব এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। টেবিলের উপর একটি ল্যাপটপ, দেওয়ালে মা ও শিশু, যামিনী রায়ের পটচিত্র। সোফায় বসে আমি জিজ্ঞেস করলাম, যাচ্ছেন কেন ?
চঞ্চলচন্দ্র বললেন, এমনিই যেতাম, বড় ফ্ল্যাট খুঁজছিলাম, আবদাল্লাকে নিয়ে থাকব, ও আর রাস্তায় থাকবে কেন, কয়েকমাস বাদে বর্ষা আসবে, তখন ও যাবে কোথায়, আর আবদাল্লা খুব ভয় পেয়েছে, পুলিশ বলেছে মেরে হাড়গোড় ভেঙে দেবে, আমি ওকে রানি রোডের ফ্ল্যাটে তুলে দিয়েছি, এবার আমি যাব, আবদল্লাকে নিয়েই তো থাকব।
একটা রাস্তার মানুষ বই তো নয়। আমি বললাম, আপনি তাকে চিনলেন কীভাবে?
জেরুজালেম থেকে চিনেছি, গভীর রাতে আল-ফারাবি হোটেলে চিনেছি। চঞ্চলচন্দ্র বললেন।
বুঝতে পারলাম না।
চঞ্চলচন্দ্র বললেন, সে কাহিনি দীর্ঘ, তার এক ভয়ানক অতীত, ক্রুশ বিদ্ধ ঈশ্বরপুত্রর যন্ত্রণার মতো সে কাহিনি যন্ত্রণাদায়ক, থাক তা।
আপনি তাকে এই কমপ্লেক্সে নিয়ে আসতেন, তাই নীলমাধববাবুর আপত্তি, তাকে পাকাপাকি নিয়ে এলে হয়ত নীলমাধব কিছু বলতেন না। সুমিতাভ বললেন।
না, হত না, এই আবাসনে সকলেই হিন্দু, নীলমাধব বলেছিলেন মুসলমান হলে হবে না।
মুসলমান বন্ধু, হবে না?
পাকাপাকি হবে না। চঞ্চলচন্দ্র বললেন।
আমরা এসব জানি না যে তা নয়। নীলমাধবের খুব আপত্তি মুসলমান নিয়ে। চুপ করে থাকলাম। কিন্তু লোকটাকে আমার অদ্ভুত লাগছিল। আবদাল্লাকে পেয়েছে জেরুজালেমে। তা কী করে হয়? স্বগতোক্তির মতো করে চঞ্চলচন্দ্র বলছিলেন, “আবদাল্লা আমার বন্ধু, নিরূপায়, অসহায়, আবদাল্লা আমার ভগবান।”
খাবার কাউকে দিইয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। আমি বললাম।
কুকুরে কেড়ে নেয়। চঞ্চলচন্দ্র বললেন, কুকুর, কাক তার পাতা নিয়ে টানাটানি করে, সে আটকাতে পারে না, খুব দুর্বল, দেখেননি কীভাবে শুয়ে থাকে ?
রাস্তার লোক, আবাসিকরা আপত্তি জানাতেই পারে। আমি বললাম।
চঞ্চলচন্দ্র হাসলেন, আমার অতিথি, হুঁ তাইই, রাস্তারই লোক, তার কোনও সংস্থান নেই, আমারও আর কিছু করার নেই এই করা ছাড়া, কিছু একটা করতে হবে তো বেঁচে আছি যখন।
কী করবেন, বয়স কত আপনার? জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি বললেন, সেভেন্টি হল গেল মাসে।
সুমিতাভ বললেন, এত বয়সে নতুন কিছু করা যায়?
যায়, আপনি তো লিখছেন, লিখছেন তো?
তাইই তো, করা যাবে না কেন, আমিও…। কথা থামিয়ে দিলাম আমি মধ্যপথে। বলতে পারলাম না আমিও লেখা আরম্ভ করেছি পঞ্চাশ বছর বাদে। হবে না শ্যামাশ্রী, হবে না? হবে অনুতোষ, হবে।
চঞ্চলচন্দ্র বললেন, আরম্ভের কোনও বয়স নেই, রবীন্দ্রনাথ ৩০শে জুলাই ১৯৪১ সালে কী লিখেছেন,
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে। …
………
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তা’রে চিরসমুজ্জ্বল।”
এর দিন আট বাদে কবি চলে গেলেন।
সুমিতাভ বললেন, কবি মুখে মুখে বলেছিলেন।
চঞ্চলচন্দ্র বললেন, অন্তরের সাড়া পেলে সব করা যায়।
আমরা এসব জানি না যে তা নয়। নীলমাধবের খুব আপত্তি মুসলমান নিয়ে। চুপ করে থাকলাম। কিন্তু লোকটাকে আমার অদ্ভুত লাগছিল। আবদাল্লাকে পেয়েছে জেরুজালেমে। তা কী করে হয়? স্বগতোক্তির মতো করে চঞ্চলচন্দ্র বলছিলেন, “আবদাল্লা আমার বন্ধু, নিরূপায়, অসহায়, আবদাল্লা আমার ভগবান।”
আমরা দুজনে চুপ করে থাকলাম। তখন চঞ্চলচন্দ্র বললেন, জেরুজালেম থেকে ফিরে আবদাল্লাকে তিনি এই পাড়ায় এসে পেয়েছেন, গুড লাক, লোকটাকে পেয়ে তাঁর জীবন বদলে গেছে।
কেন? সুমিতাভ চমকে উঠলেন। তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
চঞ্চলচন্দ্র বললেন, “তাহলে শুনুন…, আমি জেরুজালেম ঘুরে আসা লোক, যিশুর জন্ম আর মৃত্যু, পুনরুত্থান হয়েছিল ওখানে, মানুষের কল্যাণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, কষ্ট পেয়েছিলেন, আবদাল্লাকে আমি ত্যাগ করতে পারব না, নির্দেশ আছে।”
আমরা চুপ করে আছি। তিনি বললেন, জেরুজালেম থেকেই আমি আবদাল্লাকে খুঁজছিলাম, আপনারা জেরুজালেমের কথা জানেন?
সুমিতাভ বললেন, তিনি জানেন। তিন ধর্ম, ইহুদি, খ্রিস্ট এবং ইসলাম ধর্মের সহাবস্থান সেই প্রাচীন শহরে।
আপনারা কি জেরুজালেম সিন্ড্রোমের কথা জানেন? ঝুঁকে পড়লেন চঞ্চলচন্দ্র, জিজ্ঞেস করলেন অস্ফূট কন্ঠে।
মাথা নাড়লাম দু’জনেই। জেরুজালেম ইজরায়েলের দখলে এখন। জেরুজালেম নিয়ে শত শত বছর ধরে কম যুদ্ধ হয়নি। চঞ্চলচন্দ্র বলছেন, জেরুজালেমে তিনি গিয়েছিলেন ভ্যাটিকান ঘুরে। তিনি মক্কায়ও গেছেন। ভারত তীর্থ সব তাঁর দেখা। জেরুজালেম শহরে পা দিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল আবদাল্লাকে চাই, এক মুহূর্তের জন্য একে যেন দেখেছিলেন জেরুজালেমের পথে, কিন্তু তখন কিছু মনে হয়নি, জেরুজালেমের আল ফারাবি হোটেলে রাত্তিরে ল্যাপটপে খুঁজতে খুঁজতে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন আর একজনকে। চঞ্চলচন্দ্র বলছেন, জেরুজালেমে পা দিলে মানুষের ভিতরের সমস্ত কলুষতা ধুয়ে যায়, মানুষ নাকি ধার্মিক হয়ে যায়, তিনি কত রাত অবধি জেগে থাকতেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁকে খুঁজতে।
সে কে, ঈশ্বর? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঈশ্বর তো মহাব্রহ্মাণ্ডে বিরাজ করেন, যদি তিনি থাকেন, দেখুন আমি নাস্তিক না আস্তিক জানি না, কিন্তু জেরুজালেমে পা দিয়ে মনে হয়েছিল এখনও মানুষ ক্রুশবিদ্ধ হয়েই যাচ্ছে, আবদাল্লাও তাই। চঞ্চলচন্দ্র বললেন, আর একটি কথা আছে, আমাকে তিনি নির্দেশ দিলেন আল-ফারাবি হোটেলে।
কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কী করে বুঝব, পাঠক আপনিও কি বুঝতে পারছেন? চঞ্চলচন্দ্র কেমন মগ্ন হয়ে যাচ্ছেন নিজের কথা বলতে বলতে। আমি বুদ্ধুর মতো জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি গুরু আছেন?
চঞ্চলচন্দ্র চুপ করে থাকলেন একটু সময়, তারপর বললেন, না, কিন্তু তিনি যা বলেন তা আমাকে করতেই হয়, না হলে আমি নাস্তিক।
তিনি কে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি আপনার ঈশ্বর?
আমার ঈশ্বর পথে শুয়ে থাকে অন্নের আশায়। চঞ্চলচন্দ্র বলেছিলেন, আবদাল্লা বা এইরকম কত মানুষ।
সবটা বুঝতে পারছি না। আমি বললাম।
তখন সুমিতাভ মৈত্র বললেন, বাকিটা ভেবে নিতে হবে।
কী করে ভাবব? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছি, ভেবেই কি সত্য উদ্ধার হয়, জুড়ানই কি তাহলে ঠিক? জুড়ান যেমন ভেবেছে বসির আর বসন্ত নিয়ে কত কথা। বসন্তর বাড়ি লবঙ্গ গ্রামের কথা জুড়ান ভেবেছে। জুড়ানের সবই কল্প-কাহিনি। তার বাস্তব সত্য নেই। কিন্তু জুড়ান বলে তার কথাই বাস্তব, তার কথাই সত্য।
আপনি কি ফেসবুক থেকে ঈশ্বরীকে পেয়েছেন? সুমিতাভ জিজ্ঞেস করেছেন, আল-ফারাবি হোটেলে আপনি প্রথম ফেসবুকে প্রবেশ করেন এবং সার্চ করতে থাকেন, তাই তো ?
চঞ্চলচন্দ্র বললেন, না, ফেসবুক ছিল, ডিঅ্যাক্টিভেট করা ছিল, আল-ফারাবি হোটেলে আবার লগ ইন করলাম, উদ্দেশ্য তাকে যদি খুঁজে বের করতে পারি, ঈশ্বরী।
আমি অবাক। এমন হয় নাকি? পাঠক আপনি বলতে পারবেন ফেসবুকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরী থাকেন কি না। আবদাল্লার মতো ভিখিরিকে কি ফেসবুকে পাবেন আপনি? ক্রুশ বিদ্ধ যিশু কিংবা পুরির মন্দিরে প্রবেশ করে অকস্ম্যাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শ্রীচৈতন্যকে কি ফেসবুকে পাওয়া যাবে? ফেসবুক তো শুনেছি প্রতিবাদ কলহের জায়গা। নিন্দামন্দর জায়গা। আমার মেয়ে ফোনে আমাকে সেই কথা বলেছে।
চঞ্চলচন্দ্রর সেই কাহিনি লেখক সুমিতাভ মৈত্র আমাকে বলেছিলেন ক’দিন বাদে। সুমিতাভ বলেন, পুরো কাহিনি দরকার হয় না, সামান্য সূত্র পেলে, ইঙ্গিত পেলেই তিনি লিখতে পারেন। কিন্তু তিনি সত্যিই লিখেছেন না ফেসবুকে বসে চঞ্চলচন্দ্রর সঙ্গে আরও কথা বলে সবটা জেনেছেন তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু এতদিন বাদে মনে হচ্ছে বার্ধক্য কিছুই না। পৃথিবীতে কত কিছু ঘটছে, তার ভিতরে আমারও কিছু অংশ আছে, ধুলিকণার মতো হলেও আছে। কাহিনি সবই কি ঘটে, না লেখক ঘটিয়ে দেন? কাহিনি কী করে তৈরি হয়? আমি সুমিতাভকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন না কাহিনি আমিও তৈরি করতে চাই। শ্যামাশ্রীর কাহিনি।
কাহিনি শূন্য থেকে নামে, প্রায় শূন্য থেকেই গল্প চলে আসে। সুমিতাভ বললেন, তবে হ্যাঁ, কাহিনি তো নিজের ভিতরে বাস করে যে তা আমরা টের পাই না, লেখার সময় কাহিনি চলে আসে, আসতে থাকে।।
আমি চুপ করে থাকলাম। আমার তো শ্যামাশ্রী আছে। আমি শ্যামাশ্রীকে পেয়েছি। মাঝের পঞ্চাশ বছর বিলীন হয়ে গেছে মহাশূন্যে। সেই মহাশূন্য থেকেই গল্প নেমে আসবে, আমি আরম্ভ করব। ইতিমধ্যে জুড়ান আবার এসেছিল। বউয়ের মাথায় ভীমরুল চাক বেধেছে। জুড়ানকে আবার কিছু দিয়েছি। কত তা বলব না। সব কিছু বলতে নেই। ব্যক্তিগত কিছু থাকতে হয়। আমি তো ফেসবুকে নেই। সুতরাং গুপ্ত খবর মুক্ত করব আর কোথায়? পাঠক আপনি বলুন।
অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।