(Switzerland) লুসার্ণ স্টেশন থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। ঝকঝকে নীল আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের পাল। দূর দিগন্তে সারিবদ্ধ সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। কারোর বুকে, কারোর মাথায় তুষারের ঝিকিমিকি। এতকাল শুধু ছবিতে দেখা, বিখ্যাত আল্পস! খানিক এগোতেই নীলচে সবুজ লুসার্ণ লেকের মুকুরে আল্পসের স্বপ্নিল প্রতিচ্ছবি। আহা! একেই বুঝি বলে ‘চোখের আরাম আর প্রাণের শান্তি’!
গতকাল এসে পৌঁছেছি জুরিখ, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী। ছবির মত সাজানো গোছানো শহর, ঝকঝকে রাস্তাঘাট, পার্ক, ঝলমলে দোকানপাট আর বহুতল। প্রতিটি বিল্ডিং এক একটি ব্যাংক। সারা দুনিয়ার কালো টাকা রাখার ‘সুইস ব্যাংক’ সব এখানেই। বড্ড মেকি, বড্ড বেশি চকচকে। সব থেকেও কী যেন নেই।

আজ লুসার্ণ সব পুষিয়ে দিল। প্রায় নাচতে নাচতেই হাঁটছি পাথুরে রাস্তা দিয়ে। লুসার্ণ শহরের একটা অদ্ভুত ‘old world charm’ আছে। ছোট ছোট কাফে, বেকারির পাশাপাশি বড় বড় আধুনিক দোকান। ইতিহাস আর আধুনিকতার সুন্দর সমন্বয়। চতুর্দশ শতকে তৈরি সম্পূর্ণ কাঠের ঐতিহাসিক ‘চ্যাপেল ব্রিজ’ ও ‘ওয়াটার টাওয়ার’ এখানকার সব থেকে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য। ফুলে ফুলে ভরা ব্রিজটিকে ভারী ভালো লাগে। ছবিতে ছবিতে শহরের ইতিহাস ধরা আছে ব্রিজের গায়ে। পুরোনোর উপর কত মায়া এদের! রাতে আলো ঝলমল ব্রিজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আক্ষরিক অর্থেই মন হারিয়ে যায় এক রূপকথার জগতে। সময় থাকলে অবশ্য লেকে নৌবিহার করবেন। কাছেই আছে মাউন্ট পিলাটস ও মাউন্ট টীটলিস, দুটোই খুব সুন্দর।
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে কয়েকটি দিন
তবে এবারের ভ্রমণকথায় আমি আপনাদের পরিচয় করাতে চাই ইন্টারলেকেনের সঙ্গে। সেখান থেকে আমরা যাবো ইয়ুনফ্রাউ (Jungfrau), ইউরোপের সর্বোচ্চ রেলওয়ে স্টেশন। লুসার্ণ-ইন্টারলেকেন যাত্রাপথটি এককথায় অপূর্ব। মখমলি সবুজ উপত্যকার বুক চিরে ছুটে চলা নদী, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা দুরন্ত ঝরনা, আকাশের রঙ মেখে সেজে ওঠা হ্রদ, মাঝে মাঝে সুন্দর গ্রাম। আর বরফ ঢাকা আল্পস? সে তো সব সময়ের সঙ্গী।

ইন্টারলেকেন নামটি এসেছে এর অবস্থানগত কারণে। হালকা নীল থুন (Thun) আর ফিরোজা রঙা ব্রিয়েনজ (Brienz) হ্রদের মাঝখানে হরিদ্রাভ উপত্যকা জুড়ে ছড়ানো শহরটির সৌন্দর্য ভাষাতীত। আল্পসের তিন বিখ্যাত শৃঙ্গ ইয়ুনফ্রাউ, আইগার (Eiger), মশঁ (Monch) অসীম মমতায় তাকে ঘিরে আছে। ক্ষণে ক্ষণে তাদের রূপ বদলায়, বদলে যায় পারিপার্শ্বিক। সকালে ঝকঝকে নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মিনারের সারি, হ্রদের শান্ত হৃদয়ে তার অসামান্য প্রতিফলন।

দ্বিপ্রহরে যখন তারা মেঘের চাদর মুড়ে দিবানিদ্রায়, উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় হৃষ্টপুষ্ট গাভীর দল, গলার ঘন্টার মিঠে সুরে খুশির অনুরণন। সন্ধ্যেয় মেঘের আড়াল সরিয়ে গোধুলীর লালিমা মেখে যখন তারা লাজুক হেসে মুখ দেখায়, লেকের অতল জলে সে কোন রহস্যের হাতছানি। দূরে চার্চের ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং, শহর ঘুমোয়, আমরা পিয়াসী আত্মার মত ঘুরে ঘুরে প্রাণ ভরে উপভোগ করি এই অনন্য সৌন্দর্য। সুইজারল্যান্ড এত সুরক্ষিত, রাত বিরেতে অনায়াসে ঘুরতে পারেন। কিন্তু, ছ’টা বাজতে না বাজতেই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।

পরদিন সকাল সকাল আধা ঘুমন্ত শহরকে ফেলে রেখে ছুটলাম ইয়ুনফ্রাউ। সূর্য তখনও কুয়াশার ঘেরাটোপে আটকা, ঠান্ডা জব্বর (গরমকালেও এদিকে ঠান্ডা ভালোই থাকে)। ভালো করে মাথা মুড়ে চলেছি, গন্তব্য ইন্টেরলেকেন অষ্ট (Interleken Ost) রেল স্টেশন। সেখান থেকে প্রথমে যাবো ক্লেইন শেডগ (Klein Scheidagg), তারপরে ট্রেন বদলে ইয়ুনফ্রাউ।
এই রুটে পুরো টিকেট একবারে কেটে নিলে যেকোনো স্টেশনে নেমে ঘুরে ফিরে আবার পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়া যায়। এ দেশে ট্রেন চলে ঘড়ির কাঁটা মেপে। এক ট্রেন থেকে নেমে দেখবেন কানেকটিং ট্রেনটি ঠিক পাশের প্লাটফর্মে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। সুইস ফ্লেক্সি পাস থাকলে এই টিকেটগুলোতে খানিক ছাড় পাওয়া যায়।

ইন্টেরলেকেন-ইয়ুনফ্রাউ রেলপথ সুইজারল্যান্ডের আলপাইন রুট বলে পরিচিত। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এটি প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এক চমকপ্রদ বিস্ময়। চোখে না দেখলে যা বিশ্বাস করা শক্ত। সন ১৮৯৬, আডল্ফ গয়ের-জেলার (Adolf Guyer-Zeller) নামের এক শিল্পপতি পরিকল্পনা করেন, আইগার ও মশেঁর পেটের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে ইয়ুনফ্রাউ পৌঁছনোর। স্বভাবতই প্রকৃতি এই হঠকারিতা পছন্দ করে নি। বারে বারে আঘাত হেনেছে। কখনও ধবস, কখনও তুষার বৃষ্টি, কখনও আবার প্রচন্ড শীত। শেষ অব্দি মানুষের সহ্যশক্তি, ধৈর্য আর বিপদ তুচ্ছ করে অটল দাঁড়িয়ে থাকার দু:সাহসের কাছে প্রকৃতি হার মানতে বাধ্য হয়। (Switzerland)

১৯১২ সালে, ১৬ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম, অজস্র অর্থ ব্যয়, ও আত্মাহুতির পর (অনেক শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন নির্মাণকালে) ক্লেইন শেডগ থেকে ৯ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ শেষ হয় ইয়ুনফ্রাউ জখ স্টেশনে। এটি কগওয়েল রেল প্রযুক্তিতে তৈরি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চালিত রেলপথ যেটি সেই সময়ে এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার। ট্রেনে বসে থাকলে হয়তো ঠিক বুঝবেন না, কিন্ত ট্রেনটি খাড়াই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়েই ক্রমশ উর্দ্ধগামী, প্রায় ৫০০০ ফিট ওঠে। (Klein Scheidegg –6762 ft, Jungfrau Joch -11,332 ft). (Switzerland)
চমক তখনও কিছু বাকি ছিল। ষোলকলা পূর্ণ হল ‘আইস প্যালেস’ দর্শনের পর। আলেটস হিমবাহের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি হয়েছে একটি প্রায় দু-তিন কিলোমিটার লম্বা আইস টানেল। ‘এরা দেখছি সুড়ঙ্গ কাটায় বড়ই পারদর্শী’ গোছের বাঁকা মন্তব্য করে যখন প্রায় পাঁচতলা নেমে টানেলে ঢুকলাম, স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে আমি একেবারে বেকুব বনে গেলাম।
পুরো যাত্রাপথে দু-তিনটি স্টেশনে নেমে আমরা সুড়ঙ্গের মধ্যস্থ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু বরফের প্রাচীর দেখেছি। কিন্ত এ যে কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সেটা বুঝলাম ইয়ুনফ্রাউ জখ পৌঁছে। এক বিশালাকায় লিফট, এক ঝটকায় (২৫ সেকেন্ড) উঠিয়ে দিল ৩৫ তলা উঁচুতে স্ফিংস অবজারভেটরিতে (sphinx observatory)। (Switzerland)
বাইরে বেরিয়ে ঘোর লেগে গেল। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ। নীল আকাশ, হীরের মত জ্বলজ্বলে ইয়ুনফ্রাউ। এত কাছে যে তার শরীরের সব ঘাত প্রতিঘাত সুস্পষ্ট ভাবে নজরে পড়ছে। ঝকঝকে রোদের আলোয় আলেটস হিমবাহ (Aletcsh glacier), যা ইউরোপের দীর্ঘতম হিমবাহ, দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে পুরো প্যানোরমিক দৃশ্যটি বেশ খানিকক্ষণ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম। (Switzerland)

এরপর এগিয়ে চললাম বরফাবৃত স্পেশাল পথ দিয়ে। অঙ্গে অঙ্গে আল্পসকে অনুভব। দড়ি ধরে চলতে চলতেও বেশ কয়েকবার পিছলে পড়ার যোগাড়। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বসেই পড়লাম। পেঁজা তুলোর মত নরম বরফ, হাত দিলেই গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। মুঠো করে তুষারবল বানানোর বৃথা চেষ্টা, হাতে মুখে বরফের ইলশেগুঁড়ি – এই অনুভূতিটাই অদ্ভুত এক ভালোলাগার অবতারণা করে যা ভাষায় বোঝানো যায় না। (Switzerland)
উত্তেজনার পারা খানিক কমলে দেখি ঠান্ডায় আঙুল প্রায় বেঁকে যাওয়ার জোগাড়। তড়িঘড়ি ছুটলাম ভেতরে কফি শপে। গরমাগরম কফি প্রয়োজনীয় উষ্ণতার যোগান দিল ঠিকই সাথে পকেটে কিঞ্চিত ছ্যাঁকাও দিল। সুইজারল্যান্ডে যত্রতত্র এই ছ্যাঁকা লাগে, দেশটা বড়ই ‘এক্সপেনসিভ’ কিনা। তবে দেশটি অসম্ভব সুন্দর, তাই ওসব গায়ে মাখবেন না। (Switzerland)
চমক তখনও কিছু বাকি ছিল। ষোলকলা পূর্ণ হল ‘আইস প্যালেস’ দর্শনের পর। আলেটস হিমবাহের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি হয়েছে একটি প্রায় দু-তিন কিলোমিটার লম্বা আইস টানেল। ‘এরা দেখছি সুড়ঙ্গ কাটায় বড়ই পারদর্শী’ গোছের বাঁকা মন্তব্য করে যখন প্রায় পাঁচতলা নেমে টানেলে ঢুকলাম, স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে আমি একেবারে বেকুব বনে গেলাম। (Switzerland)

মাথার উপরে বরফের পাহাড়, নীচে বরফের গুহায় নীলাভ মায়াবী আলো। সেই বরফ কেটেই তৈরি অপূর্ব সব ভাস্কর্য। কত রকমের মূর্তি, শুনলাম পৃথিবী বিখ্যাত সব ‘আইস ভাস্কর’রা এইসব মূর্তি গড়েছেন তিল তিল করে। তা থেকে ঠিকরে পড়ছে কত রকমের আলো, সবটাই বরফে আলোর প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে। টানেল বলছি বটে, তবে বেশ চওড়া ও উঁচু, মাকড়সার মত এদিক ওদিক অনেক হাত পা ছড়ানো। মসৃণ বরফের দেয়ালে হাত পিছলে যায়, মেঝেও ততোধিক পিছল। হাড় হিম করা ঠান্ডা। ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালোই লাগছিল কিন্ত দুর্বল বঙ্গসন্তান, ঠান্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার আবস্থা। বেরিয়ে এলাম। (Switzerland)

ফেরার পথে লটারব্রুনেন (Lauterbrunen) স্টেশনে নেমে পরলাম। ছবির মত সুন্দর গ্রামটি বিখ্যাত ঝরনার জন্যে। প্রায় ৭০ টি ছোট বড় জলপ্রপাত আছে এখানে। খুব ভালো লেগেছিল পাহাড়ের গা বেয়ে সগর্জনে দুরন্ত বেগে ছুটে আসা স্টবচ জলপ্রপাত (Staubach)। এখানে লোকাল কাফেটরিয়া আছে, তারই একটায় লাঞ্চ সেরে ট্রেনে চেপে ইন্টেরলাকেন ফিরলাম। দিনভর ছুটোছুটির উপহার পেলুম একটি অনবদ্য সূর্যাস্ত। (Switzerland)
প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি :
ভারত থেকে সরাসরি ফ্লাইট নেই সুইজারল্যান্ডের, কিন্ত ইউরোপের যে কোন বড় শহর থেকে জুরিখ যাওয়া যায় প্লেন কিংবা ট্রেনে। যদিও ‘সেনগেন ভিসা’য় এখানে যাওয়া যায় তবু সুইজারল্যান্ড তার নিজস্ব মুদ্রা – সুইস ফ্রাঁ- ব্যবহার করে। মাঝে মধ্যে ইউরো নিলেও, ফেরত খুচরো সুইস ফ্রাঁ’তেই দেয়। (Switzerland)
সুইজারল্যান্ড খুব সহজেই নিজেরা ঘুরতে পারেন। সুরক্ষিত ও সহজগম্য দেশ। অন্তর্বর্তী ট্রাভেল এর জন্যে আছে সুইস ট্রাভেল পাস বা সুইস ফ্লেক্সি পাস। এতে সুইজারল্যান্ডের সমস্ত ট্রান্সপোর্ট- ট্রেন, বাস, বোট- ব্যবহার করা যায়, এক দিনে একাধিক বার। আগে থেকে কেটে নিতে পারেন অনলাইনে। এছাড়াও অনেক মাউণ্টেন ও মিউজিয়াম টিকিটে ছাড় পাওয়া যায়। (Switzerland)
সব ধরনের খাবার পাবেন। দাম খুবই বেশি। যে কোন জায়গার জল খাওয়া যায়। আপনার নিজের বোতলে ভরে নিলেই হল। (Switzerland)
ছবি:শুভাশীষ ব্যানার্জী , Pexels, Pickpik
মণিদীপার লেখায় কল্পনা ও বাস্তব হাত ধরাধরি করে চলে। সহজ ঝরঝরে ভাষায় শিশুদের জন্যে মজাদার গল্প বোনার পাশাপাশি, তিনি তথ্যনির্ভর ভ্রমনসাহিত্য রচনায় সমান মুনশিয়ানা দেখান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্রী একসময় চুটিয়ে লিখেছেন দ্য স্টেটসম্যান, সানন্দা, ভ্রমণ, Better Photography, Times Journal of Photography, The China Post এবং Travel in Taiwan-এর মতো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
তার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে বিশেষ নিউল্লেখযোগ্য—ঠামমা ও গাভাস্কর, The Misadventures of Teddy Tumbledore, এবং Jungle Beats