১৯৪১ সাল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে অসুস্থ কবিকে চিকিৎসার জন্য শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে। পরিচর্যার কাজে ঘনিষ্ঠ দু’চারজন পালা করে কবির কাছে থাকছেন। দেখতে দেখতে জুলাই মাসের ছাব্বিশ-সাতাশ-আঠাশ পেরিয়ে অগস্ট মাসের গোড়ার দিনগুলিও পার হচ্ছে রুদ্ধশ্বাসে। সেই সেবকদের একজনের দিনলিপি ছিল এমন…
‘কবি পুবশিয়রি হয়ে শোওয়া, আমি পায়ের কাছে একটা মোড়ায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছি। মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি আর পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
আস্তে আস্তে আকাশ স্বচ্ছ হয়ে আসতে লাগল। বরাবর এর অনেক আগেই বিছানায় বালিশগুলো উঁচু করে দিয়ে উঠিয়ে বসাবার হুকুম হত। আজ আর পুবদিকে মুখ ফিরিয়ে দেবার তাগিদ নেই। ঘরে কে আসছে, কে যাচ্ছে, কিছুই নজরে পড়ছে না। চেয়ে আছি একদৃষ্টে মুখের দিকে– আর কতক্ষণই বা ওঁকে দেখতে পাবো?…’
ঘরময় তখন অনেক লোক। কবির পায়ের দিকে মাটিতে বসে কেউ করছেন ‘পিতা নোহসি‘ মন্ত্রপাঠ। কেউ বা ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম’ মন্ত্র কবির কানের কাছে উচ্চারণ করছেন। একটা জরুরি ফোন আসায় (ফোনের ওপারে কে ছিলেন, কোনওদিন তার হদিশ মেলেনি। ফোনে বলা হয়েছিল, তাড়াতাড়ি নিজের বাসায় ফিরে যেতে বলা হয়েছে তাঁকে। তিনি সেইমতো রওনা দিয়ে বাসায় পৌঁছে জানেন এমন কোনও ফোন বাড়ি থেকে করা হয়নি।)
সেদিনের দিনলিপিকার ক্ষণিকের তরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে পথে নেমেছিলেন। কিন্তু জানা গিয়েছিল সেই ফোনটি সম্ভবত ভুয়ো ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে যখন জোড়াসাঁকোর জনারণ্যের বেড়া ডিঙিয়ে কবির ঘরে ঢুকলেন আর জানতে পারলেন…

‘এই স্বল্পক্ষণের মধ্যে হঠাৎই কবির শীর্ণ ডানহাতখানা, যে হাতে তিনি মানুষের জয়গানের কথা লিখে গেছেন এতকাল এতরকমভাবে, সেই ডানহাতটি কাঁপতে কাঁপতে উপরে তুলে কপালে ঠেকাতেই হাত পড়ে গেল…..
যেন বলে গেলেন…..
“এমন একান্ত করে চাওয়া
এও সত্য যত
এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া
সেও সেইমতো!!
এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;
নহিলে নিখিল
এতবড়ো নিদারুণ প্রবঞ্চনা
হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না!!
সব তার আলো
কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো….!!”
এই শেষ রোগশয্যাতেই তো কবি তাঁর কাছে বলেছিলেন তাঁর শেষ ইচ্ছের অমোঘ কথাটি।
“তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবির জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’– এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়…।”
এখন প্রশ্ন, কবির এই বন্ধুটি কে? কার কাছে এমন ইচ্ছের কথা অকাতরে জানাতে পেরেছিলেন?
যদিও ইতিহাস বলছে জীবনের এমন আর একটি শেষ ইচ্ছের কথা তিনি এর আগে প্রিয়তমা ভাইঝি ‘বিবি’ অর্থাৎ ইন্দিরাদেবীর কাছেও ব্যক্ত করেছিলেন। মৃত্যুর প্রায় বছর দশেক আগে, ১৯৩০ সালের ২৫ অক্টোবর ইন্দিরাদেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায় হয় – শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্ম্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।’ সেদিন কবির ‘তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও’ এই আকুলতার মর্যাদা দিয়ে সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন নির্মলকুমারী মহলানবিশ, যাকে তাঁর ডাকনাম ‘রানী’ বলেই কবি ডাকতেন।

নির্মলকুমারী ‘রানী’ মহলানবিশ প্রখ্যাত ব্রাহ্ম আচার্য হেরম্ব মৈত্রের কন্যা এবং বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্ত্রী। দু‘জনেই কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন, বহুবার কবি এঁদের কাছে আলিপুরে বা বরানগরের ‘গুপ্তনিবাসে’ গিয়ে থেকেছেন। ১৯৪১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্মলকুমারী ও প্রশান্তচন্দ্রের বিয়ের সাম্বাৎসরিক উপলক্ষে কবি আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন,
‘রানী ও প্রশান্ত
বর্ষ পরে বর্ষ গেছে চলে,
ছন্দ গাঁথিয়াছি আমি তোমাদের মিলনমঙ্গলে
এবার দিনের অন্তে বিরল ভাষায় আশীর্বাণী
রবির স্নেহের স্পর্শ আনি
পশ্চিমের ক্লান্ত রশ্মি হোতে
যোগ দিল তোমাদের আনন্দিত গৃহের আলোতে।’
–কবি
১৫ই ফাল্গুন, ১৩৪৭
এই রানীকেই কবি সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন, যার সংখ্যা ৫০২টি; রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের সময়কালে শারদীয় সংখ্যা ১৯৬০-এর ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঁচটি এবং ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকার সাধারণ সংখ্যা ১৯৬০ সালের ৫ নভেম্বর থেকে টানা দু‘বছর অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৪৯৭টি প্রকাশিত হয়েছিল। এই রানী মহলানবিশকেই তিনি ‘পথ ও পথে-প্রান্তরে’ এবং ‘শ্যামলী’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। নির্মলকুমারীকে লেখা চিঠি থেকে ৬৪টি চিঠি নিয়ে সংকলিত হয়েছিল ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ বই। সেটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। রবীন্দ্রনাথ এই গ্রন্থ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘তাঁর চিঠি হল ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গ মানুষের সঙ্গে আলাপ প্রতিলাপ। তা সর্বসাধারণের সাহিত্য দরবারে উপস্থাপিত করবার নয়।’
কতটা গভীর সম্পর্ক ছিল কবির সঙ্গে নির্মলকুমারীর, তা সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় একটি ব্যাপারে। কবির শেষের দিনকার মুহূর্তগুলিতে তাঁর দেখাশোনা, সেবাশুশ্রুষার গুরুদায়িত্ব বর্তেছিল যে গুটিকয়জনের উপর, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।। শেষের দিনগুলোতেও কবি কৌতুক করে তাঁকে ‘হেডনার্স’ বলে ডাকতেন। কখনও যদি নির্মলকুমারীর কোথাও যাওয়ার কথা উঠত, কবি তখন হুমকি দিতেন। সেই হুমকি ছিল এমন, ‘শেষ পর্যন্ত এমন একটা অসুখ করবো, তখন দেখি আমার হেডনার্স কী করে যায়।’

‘কবির সঙ্গে ইয়োরোপ’ এবং ‘কবির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে’ ভ্রমণসঙ্গী হয়েও তিনি কবির শেষ কয়েকদিনের সঙ্গলাভের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গেছেন তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ গ্রন্থে। এই বই থেকেই জানা যায়, কবি কেমন করে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শান্ত সংযত সমাহিত ছিলেন। নির্মলকুমারী অকপটে লিখেছিলেন,
‘জীবনে অজস্র স্নেহ তাঁর কাছে পেয়েছি। খুব কাছের থেকে তাঁকে দেখেছি। আঠারো বছর ধরে তাঁর সেবা করার সৌভাগ্য আমার ঘটেছে। এই দীর্ঘকালের মধ্যে অনেকবার অনেকের উপর রাগও করতে দেখেছি। কিন্তু কখনো কোনো মানুষকে ছোটো করতে দেখিনি। হয়তো কখনো কারো সম্বন্ধে অনিবার্য কারণে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন; কিন্তু পরক্ষণেই সে জন্য বেদনা অনুভব করেছেন। কতদিন আমাকে বলেছেন,
‘জানো, কারো ওপর রাগ করতে কেন আমি লজ্জা পাই? তখনই মনে হয় নিজেকে যে ছোটো করলাম। মনকে প্রতিদিন বলি, শান্ত হও, সমস্ত অন্যায়, সমস্ত বিক্ষোভের মধ্যে তোমাকে শান্ত থাকতে হবে, নইলে তোমার হার হলো। এই পরাজয় যাতে না ঘটে সেই জন্যেই প্রতিদিন শেষরাত্রে উঠে আমার ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্’ মন্ত্র স্মরণ করি। এরই ভিতর আমার মন আশ্রয় পায়।’
এইভাবেই নির্মলকুমারী রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবনের বোধ এবং জীবনদর্শনের শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে কতখানি সুন্দরশোভনতা এবং সম্ভ্রমশুভ্রশূচিতায় মগ্ন থাকতেন, তার উদাহরণ নির্মলকুমারীর লেখায় উঠে এসেছে। কবি তাঁকে বলেছিলেন,
‘যখন বাইরের সঙ্গে মন কলহ করতে উদ্যত হয়, তখন সেই ইতরটায় আমি নিজেকে অসুন্দর দেখি, তাতেই কষ্ট পাই। আত্মমর্যাদার একটা শোভা আছে; প্রবৃত্তির বশে আত্মবিস্মৃত হয়ে সেইটেকে যখন ক্ষুণ্ণ করি, তখন অনতিকাল পরে মনে বড় ধিক্কার জন্মায়।’
এই ‘ঘরোয়া রবীন্দ্রনাথ’–কে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। বুঝেছিলেন ‘যে আদর্শ লেখায় প্রচার করেছেন সেই আদর্শ শেষদিন পর্যন্ত জীবনেও পালন করেছেন’ কবি। নিজের জীবনের মধ্যে দিয়ে অস্তিত্বের সত্য মূল্য কোথায়, তিনি তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন দেশবাসীকে। তাই ‘বাইশে শ্রাবণ‘ গ্রন্থশেষে একটি বিনীত আবেদন রেখে গেছেন পাঠকের দরবারে—
‘যারা তাঁকে দেখেননি, কোনোদিনও দেখবে না, তারা যেন আমাদের চোখের ভিতর দিয়ে তাঁর সত্যরূপটি দেখতে পায়; নিজেদের অযোগ্যতাবশতঃ কোথাও যেন সে ছবিটিকে ম্লান না করি – এইমাত্র কামনা।’
গ্রন্থঋণ:
১) বাইশে শ্রাবণ : নির্মলকুমারী মহলানবিশ।
২) কবির সঙ্গে ইউরোপ : নির্মলকুমারী মহলানবিশ
৩) কবির সঙ্গে দাক্ষিণাত্য : নির্মলকুমারী মহলানবিশ
৪) দেশ পত্রিকা শারদীয়া ১৯৬০
৫) দেশ পত্রিকা ৫ নভেম্বর ১৯৬০ — ১৫ এপ্রিল ১৯৬২
৬) রবীন্দ্রনাথ : প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ
ছবি সৌজন্য: লেখক
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
One Response
আহা কি সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন লেখক মঙ্গলময় বাইশে শ্রাবণ প্রেক্ষাপটের সেই অমোঘ সত্য দৃশ্য। সত্যই সুন্দর হয়ে থাকুক বাঙালীর হৃদয় জুড়ে অম্লান হয়ে।