তিন বন্ধু মিলে খেলা করছিল একটি বাড়িতে। বৈঠকখানার সামনের বাগানে ছিল একটি পাখির বাসা। বাসায় থাকা পাখির ছানাগুলো মুখ বার করে তিন বন্ধুর খেলা দেখার চেষ্টা করছিল। একটি পাখির ছানা গাছের ডাল থেকে পড়ে যায় মাটিতে। তিন বন্ধু সযত্নে তুলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও, শেষ রক্ষা হয়নি। সে মারা যায় খানিক পরে। চোখের সামনে এভাবে পাখির ছানার মৃত্যু, শিশু মনে দোলা দেয়।
আপাত-নিরীহ, এই ছোট্ট সাধারণ ঘটনাটি, একজনের মনে দীর্ঘস্থায়ী দাগ কেটেছিল। এই দুঃখে,ছেলেটি ওই বয়সেই বাড়ির দেওয়ালে তার প্রথম পদ্যটি লেখে। মনের করুণ রস তাকে সৃষ্টির পথে নিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীকালে সেই কবিতাটি নিজে হাতেই বাড়ির দেওয়াল থেকে মুছে ফেলেছিল সে। কিন্তু আজীবন সেই কলম আর থামেনি। রচিত হয়েছে কথাসাহিত্যের অমর সৃষ্টি। সেই অবোধ বালক আর কেউ নয়, প্রকৃতি, জীবন আর সামাজিক সাহিত্যের অধীশ্বর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। (Tarashankar Bandyopadhyay)
১৮৯৮ সালের ২৩ শে জুলাই বীরভূম জেলার লাভপুরের জমিদার পরিবারে জন্ম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা প্রভাবতী দেবী। লাভপুরের যাদব লাল হাইস্কুলে পড়াশোনা শেষ করে, ১৯১৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তারাশঙ্কর জড়িয়ে পড়েন অসহযোগ আন্দোলনে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। ১৯৩০ সালে গ্রেফতার হতে হয়েছিল তাঁকে। পরে মুক্তি পান। তবে অল্প বয়সেই স্বাস্থ্য ভেঙে যায়।
ভিডিও: বাংলা কথাসাহিত্যের হীরে-‘মানিক’ – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে ‘মারাঠা দর্পণ’ নাটক রচনার মধ্যে দিয়ে। পরবর্তীকালে তিনি আরও কয়েকটি নাটক রচনা করেন। যেমন ‘পথের ডাক’, ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘কালরাত্রি’, ‘যুগ বিপ্লব’। নিজের রচিত কয়েকটি ছোটগল্প ও উপন্যাসেরও নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যই ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। তাঁর কলম বাংলা কথাসাহিত্যকে পুষ্ট করেছে, জীবনের অনন্য রূপের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে পাঠককে। অল্পকালের জন্যে চাকরি এবং ব্যবসায় যুক্ত হলেও, পরবর্তী সময়ে সাহিত্যকেই তিনি তাঁর সাধনা ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। বিষয়ের অভিনবত্বে রচনা করেছেন স্বতন্ত্র ধারা।
প্রায় ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং চারটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। ‘ত্রিপত্র’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ছোটবেলায় পদ্য লেখা দিয়ে শুরু করলেও, কবিতায় সেভাবে পাওয়া যায়নি তাঁকে। কিন্তু যে কয়েকটি কবিতা রচনা করেছেন, নিজের ছাপ রেখে গেছেন। ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে প্রথমবার দেখা হয়। সেবছরই তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ প্রকাশিত হয়েছিল। (Tarashankar Bandyopadhyay)
তাঁর উপন্যাসে বারবার সামন্ততান্ত্রিক সমাজজীবনের ছবি অপূর্ব মমতায় বর্ণিত হয়েছে। গ্রামজনপদকে এক অদৃশ্য দানবের আগ্রাসনে আধা শহরে পরিণত হতে দেখেছেন তিনি। সেই পটভূমিতেই গল্প উপন্যাসের চরিত্রদের তৈরি করেছেন। চৈতালি ঘূর্ণির পর ‘রাইকমল’, ‘আগুন’ উপন্যাসের মাধ্যমে তাঁর কলম পরিচিতি লাভ করে। তবে ‘নিশিপদ্ম’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র মতো উপন্যাস তাঁকে সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্রের স্থান দিয়েছে। (Tarashankar Bandyopadhyay)
ভিডিও: মুক্তারামের রামকথা – জন্মদিনে শিবরাম
বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৫৫ সালে পেয়েছিলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার এবং ১৯৬৯ সালে পেয়েছিলেন পদ্মভূষণ পুরস্কার। তাঁর গল্প, উপন্যাস নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি সিনেমা তৈরি হয়েছে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘জলসাঘর’ ও ‘অভিযান’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেছিলেন। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও নানা সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত থেকেছেন। (Tarashankar Bandyopadhyay)
প্রকৃতিপ্রেমী, নিরহংকারী, সমাজসচেতন এই কথাসাহিত্যিক আত্মজীবনী লিখেছেন সহজ সরল অকপট ভাষায়। বলেছেন “নিজের জীবনকালের কথায় নিজের জীবনকে গৌণ করে, কাল’কে বড় করে শৈশবের কথা এবং কৈশোরের কথা লিখে, সাহিত্য জীবনের কথা লেখার সংকল্প যখন করেছিলাম তখন এই কাজ যে কতখানি কঠিন তা ভেবে দেখিনি। লিখতে বসে মনে হচ্ছে এমন কঠিন কাজে হাত না দেওয়াই ভাল ছিল।” ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর জীবনকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তবে আজও নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে অজস্র পাঠকের হৃদয়ের অধীশ্বর হয়ে রয়েছেন তিনি। আজ তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Tarashankar Bandyopadhyay)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।