“মেঘেদের ছুটি কবে শেষ হবে, মা?”
“মেঘ আবার কে? সে কবে তোর বন্ধু হল? কোনওদিন নাম শুনিনি তো! কোথায় ওর সঙ্গে তোর আলাপ? মেঘ ছুটিতে গেছেই বা কোথায়? কবে গেছে?” — সুজাতা একসঙ্গে একগোছা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বাবানের উদ্দেশ্যে।
“এ বাবা! মা, তুমি ভেবেছ মেঘ শুধু আমার বন্ধু! মেঘ তো শুধু আমার বন্ধু নয়।”
“মেঘ শুধু তোর বন্ধু নয়! মেঘ তা হলে আর কার কার বন্ধু?”
“দাদু বলেছে, মেঘ আমাদের সবার বন্ধু। জানো না বুঝি! মেঘ আছে বলেই জল হয়। আর জল হয় বলেই গাছপালা বাঁচে। আর আমরাও বাঁচি।”
“ওহ্, তুই এতক্ষণ আকাশের মেঘের কথা বলছিলিস! আর আমি কী না কী ভাবছি। তা দাদু আর কী বলেছে?”
“দাদু বলেছে, মেঘেরা সব ছুটিতে গেছে।“
“মেঘেরা ছুটিতে গেছে! তা মেঘেরা ছুটিতে গেল কেন?”
“ওরা নিজেরা যায়নি, বড়রা নাকি সবাই মিলে ওদের ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে।“
“কেন?”
“আমিও দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বড়রা কেন মেঘেদের ছুটিতে পাঠিয়ে দিল? দাদু আমার প্রশ্ন শুনে চুপচাপ হয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, ‘লোভ আর স্বার্থকে পোষ মানাতে পারল না বলে।’ আমি চুপ করে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাতে দাদু বলল, ‘দাদুভাই, এখন তুই সব বুঝবি না! বড় হ, নিজেই বুঝতে পারবি’…”
“তুই দাদুর কাছে জানতে চাইলি না, মেঘেদের ছুটিতে যাওয়ায় কী হয়েছে?”
“হ্যাঁ, তা আর জানতে চাইব না! দাদু বলল, মেঘেরা সব ছুটিতে গেছে বলেই নাকি বৃষ্টি হচ্ছে না। আর বৃষ্টি হচ্ছে না বলে গরমও কমছে না। তুমি তো জানো মা, গরমে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি গরম একদম সহ্য করতে পারি না। তুমি মেঘেদের বল না মা, তাড়াতাড়ি ছুটি শেষ করে ফিরে আসতে।”
“সে তো তোর দাদুও বলতে পারে, আমাকে বলতে বলছিস কেন?”
“দাদু বলেছে, সবাই মিলে যেহেতু পাঠিয়েছে, তা-ই সবাই মিলে বললে তবেই নাকি মেঘেরা ফিরবে। শুধু দাদু বললে ফিরবে না।”

“মেঘেদের বুঝি ছুটিতে যেতে ইচ্ছে করে না?” হঠাৎ বাবার গলা শুনে একটু চমকে গেল বাবান। বাবা যে তাদের কথা দরজার আড়াল থেকে শুনছে তা ও বুঝতে পারেনি। বাবার দিকে ফিরে ও বলল, “আমিও তো দাদুকে সেটাই বলেছিলাম। সেটা শুনে দাদু বলল, ‘মেঘেরা ছুটিতে যায় তো! শুধু যায়-ই না, নিজের ইচ্ছামতো ছুটি কাটায়। বর্ষায় বৃষ্টি ঝরানোর কাজ শেষ করে ওরা ছুটিতে যায়। ছুটি নিয়ে শরতের নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো ওরা ঘুরে বেড়ায়। আর উঁকি মেরে মেরে দেখে জলে থইথই মাঠঘাট, জলা জমিতে ফুটে ওঠা সাদা কাশফুল।‘“
“দাদু এটা বলেনি, সে সময় শিউলি ফুল ফোটে, বাতাসে হিমের পরশ লাগে, চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে? আর তারপরই আসে পুজোর ছুটি, পুজোর ছুটিতে ওরাও সকলের সঙ্গে মিশে উৎসবে মেতে ওঠে?”
“হ্যাঁ, বলেছে তো। কিন্তু তুমি এসব জানলে কী করে বাবা?”
“শুধু এটা নয়, আমি এটাও জানি, দাদু বলেছে, মেঘেদের এখন খুব মন খারাপ। কারণ ওদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু গাছেদের সঙ্গে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। তাই মানুষ ওদের ছুটিতে না পাঠালেও ওরা অভিমানে নিজেরাই একদিন দূরে চলে যেত।”
“ওঃ, বুঝতে পেরেছি। দাদু আমাকে বলার আগে তোমাকেও সবকিছু বলেছে। এটা কিন্তু দাদু একদম ঠিক করেনি! দাঁড়াও, দাদুকে গিয়ে আমি ধরছি, কেন আমাকে বলা কথাগুলো তোমাকে আগে বলেছে?”
“এ কথাগুলো তোর দাদু আমাকে বলেনি। তোকে যখন বলছিল আমি পাশ থেকে শুনে ফেলেছি।”
“এটা তাহলে তুমি ঠিক করোনি বাবা। মা আমাকে বলেছে, দু’জনে কথা বললে সেটা কখনও লুকিয়ে শোনা উচিত নয়। তা-ই তো মা?”
“লুকিয়ে তো শুনিনি। কানে আসছিল বলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আর তোর মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, দাদু-নাতির কথা শোনার সময় এরকম কোনও বাধা আছে কি না?”
বাবা-ছেলের কথা শুনতে শুনতে সুজাতা তখন মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন: গল্প: ১৩বি হরি ঘোষ স্ট্রিট
রাতে খাওয়ার পর বিছানায় বাবার পাশে শুয়ে বাবান জানতে চাইল, “মেঘ ধরো আমাদের কাছে এল না, কিন্তু আমরা তো মেঘের রাজ্যে যেতে পারি! পারি না?”
“মেঘের রাজ্যে! যাওয়া যায়? তোর মাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ।”
“মা, তুমি বল না, আমি কিছু ভুল বলেছি! দাদু-দিদুন অনেক দিন না এলে আমরা তো গিয়ে দাদু-দিদুনের সঙ্গে দেখা করি। দেখা করি না কিনা বল?”
“হ্যাঁ, গিয়ে দেখা করি তো! তাদের ঠিকানা জানা আছে বলে গিয়ে দেখা করি। কিন্তু আমাদের তো মেঘেদের রাজ্যের ঠিকানা জানা নেই, তা-ই মেঘেদের রাজ্যে আমরা যাই কী করে বল!”
“আচ্ছা, গুগল ম্যাপে সার্চ করলে হয় না!”
“তা মন্দ বলিসনি। একবার গুগল ম্যাপে সার্চ করে দেখলে হয়! তবে এত রাতে আর গুগলদেবকে জ্বালাবি! ওঁকে শান্তিতে ঘুমোতেও দিবি না?”
মলয়ের কথা শুনে সুজাতা বলল, “একে তো বাবা ওর মাথায় এটা-ওটা ঢোকাচ্ছে, তুমিও এখন আবার এসব আরম্ভ করেছ!”
মলয় বুঝল সুজাতা বিরক্ত হচ্ছে। তা-ই আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “বাবান ঘুমিয়ে পড়। মা নাহলে রাগ করবে।”

গরম বেড়েই চলেছে। গরমের চোটে শুধু বাইরে নয়, বাড়িতেও টেকা দায়। পুরো বাড়ি তো আর এয়ার কন্ডিশনার লাগিয়ে ঠান্ডা রাখা সম্ভব নয়! এক তপ্ত দুপুরে গলদঘর্ম অবস্থায় স্কুল থেকে ফিরে বাবান সুজাতাকে বলল, “মা, বাইরে কী গরম গো! গা যেন পুড়ে যাচ্ছে, চামড়া জ্বালা করছে। এদিকে আকাশেও মেঘেদের দেখা নেই, বৃষ্টি আর হবে না মনে হয়! এত গরম আমার আর সহ্য হচ্ছে না। বাবাকে বলো না আমাকে কোনও ঠান্ডার জায়গায় নিয়ে যেতে।“
“কিন্তু স্কুল তো এখনও ছুটি পড়েনি। স্কুল অফ করে কি তোর বাবা তোকে বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইবে? মনে হয় না।… দেখি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে।”
পরের দিন শেষ বিকালে দাদুর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে বাবান বলল, “দাদু, কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় বল তো?”
“কেন দাদুভাই! দাদুর সঙ্গে বেরিয়ে আর পোষাচ্ছে না বুঝি!”
“না দাদু, আসলে গরমে আমার খুব কষ্ট হয় তো! তা-ই মাকে বলছিলাম বাবাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলতে, যেখানে গেলে অন্তত এই গরমের হাত থেকে বাঁচা যায়।”
“তুই সবচেয়ে কী ভালবাসিস বল?”
“এখন তো আমার সবচেয়ে ভালবাসার জিনিস মেঘ।”
“তা হলে বাবাকে বল, তোকে মেঘের রাজ্যে বেড়াতে নিয়ে যেতে।”
“ঠিক আছে, বাবাকে তা-ই বলব।”
“তবে দেখিস দাদু, বেড়াতে গিয়ে আমাকে আর মেঘকে ভুলে যেন ছুটিকে পছন্দ করে বসিস না!”
“না দাদু, ছুটিতে যেতে চাওয়া তো শুধু আমার কষ্ট হচ্ছে বলে। মা বলেছে, শুধু ছুটি-ছুটি করে বেড়ালে চলবে না। ছুটি থেকে ফিরে নতুন এনার্জি নিয়ে আবার পুরনো অভ্যাসে পড়াশোনায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।”

মাত্রাতিরিক্ত গরম আর তাপপ্রবাহের কারণে ক’দিন পরেই স্কুলে ছুটি পড়ে গেল। গরমে কাবু বাবানকে নিয়ে সুজাতা-মলয় হাজির হল মেঘেদের বাড়ি—মৌসিনরামে। যে নামটা শুনলে প্রথমেই মেঘের কথা মনে আসে, সেই মেঘালয়ে। মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড়ের কোলে— মৌসিনরামে সবসময়ই মেঘের আনাগোনা। তারা যেদিন পাইন গাছের বনের মধ্যে দিয়ে মৌসিনরামে ঢুকছিল, সেদিন মেঘ এসে যেন জাপটে ধরল তাদের। তারপর কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! এত বৃষ্টি যে তিন দিন তারা কটেজ থেকে বেরোতেই পারল না। প্রথম দিন বাবানের আনন্দ দেখে কে! সে কটেজের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে একমনে বৃষ্টি দেখে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল জানলার বাইরে। বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছিল বাবানকে, আর বাবান ছুঁয়ে যাচ্ছিল ঝরে পড়া বারিধারাকে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে দাঁড়িয়েই ছিল। সুজাতা এসে তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর বাবান আবার এসে দাঁড়িয়েছিল জানলার পাশে। বেশ কিছুক্ষণ পর পা ব্যথা করতে থাকায় সোফায় বসে পড়ে সে। তারপর কখন যে সে সোফায় ঘুমিয়ে গিয়েছিল, তার আর খেয়াল নেই!
দ্বিতীয় দিন অবশ্য বাবানের আর সেই উৎসাহ রইল না। সে বাইরে বেরনোর জন্য ছটফট করছিল। ঘরে বসে থেকে থেকে সুজাতা-মলয়ও বিরক্ত হয়ে উঠছিল। সুজাতা মলয়ের কাছে জানতে চাইল, ”ওয়েদার ফোরকাস্ট কী বলছে?” — “একসেসিভ অ্যান্ড ইনসেসান্ট রেন ফর নেক্সট টু ডেজ।” — “তা হলে আর ট্যুরের রইল কী! আমাদের তো এমনিতেই তিন দিন পর এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে!” হতাশ গলায় মলয় বলল, “তাই তো দেখছি! কিন্তু ঘরে আটকে কাঁহাতক এই বসে থাকা যায় বল তো! দেখছি ট্যুর অপারেটরকে বলে। বৃষ্টির মধ্যেই যদি গাড়ি করে কাছাকাছি কোথাও বেড়িয়ে আসা যায়!”
“সেটা কি ঠিক হবে?”
“আমিও তো সেটাই ভাবছি।”

পরের দিন দুপুরে বিছানায় শুয়ে জানলার বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারাপাত শুনতে শুনতে সুজাতা বলল, “দেখ বাবান, তুই চাইছিলিস মেঘের রাজ্য, আর তোর বাবা তোকে এনে হাজির করল বৃষ্টির দেশে!” বাবান বলল, “মা, আমাদের ওখানকার সব মেঘগুলোও কি আমাদের মতো এখানে ছুটি কাটাতে এসেছে?” মলয় বলল, “তাই তো দেখছি! অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। বন্ধুদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে কার না ভাল লাগে বল! তোর ওখানে মেঘেদের জন্য মন খারাপ করছিল, তা-ই মেঘেরা ওখানে তোকে দেখতে গিয়েছিল। তারপর ওখানে দেখতে না পেয়ে তোর সঙ্গে এখানে ছুটি কাটাতে এসেছে।”
“কে বলল মেঘগুলো ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল?”
“কেন, তোর দাদু! আমরা তখনও এখানে পৌঁছইনি, দাদু ফোন করে বলল, বাবান ক’দিন এত মেঘ মেঘ করছিল, আর দেখ আজ ও বেরোল আর এখানে মেঘ করে এল!”
“তুমি আমাকে বলোনি কেন?”
“তুই তখন ঘুমিয়ে ছিলি বলে বলা হয়নি। তারপর আর বলার কথা মনে ছিল না।”
“চল বাবা, মেঘ আমাকে আবার দেখতে আসার আগে বাড়ি ফিরে যাই। বন্ধুদের সঙ্গে আমার নিজের বাড়িতে ছুটি কাটাতেই ভাল লাগে। বিশেষ করে মেঘের মতো বন্ধুর সঙ্গে।”
“কেন বাবান? মেঘের সঙ্গে নিজের বাড়িতে ছুটি কাটাতে ভাল লাগে কেন?” সুজাতা জানতে চাইল।
“কেন আবার? আকাশে মেঘ করে এলে দাদুর চোখ চকচক করে ওঠে। দাদুকে তখন গল্পতে পেয়ে বসে। দাদু সে সময় কত কত গল্প বলে। আর সেই গল্প শুনতে শুনতে আমারও মন যেন কোথায় চলে যায়। আমার খুব ভালো লাগতে থাকে।”
“কিন্তু গিয়ে যদি দেখিস মেঘেরা আর তোর সঙ্গে দেখা করতে আসছে না?”
“তা কি হয় মা! আমার বন্ধু আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না!”
মলয় বলল, “তোর সঙ্গে তো ওরা দেখা করতে এসেছিল! কিন্তু তুই-ই তো ছিলি না। এখন ওরা যদি অভিমান করে তোর সঙ্গে আর দেখা করতে না আসে?”
“আমার সঙ্গে দেখা করতে না এলেও কাজে তো ওদের ফিরতেই হবে। কাজ না করে ওরা কতদিন থাকবে! ছুটির ফাঁদে আটকে পড়তে কারই বা ভাল লাগে!”
ছবি সৌজন্য: Istock, Vectorstock, Maxpixel,
পেশায় শিক্ষক দিলীপকুমার ঘোষের জন্ম হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের দফরপুর গ্রামে। নরসিংহ দত্ত কলেজের স্নাতক, রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। নেশা ক্রিকেট, সিনেমা, ক্যুইজ, রাজনীতি। নিমগ্ন পাঠক, সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত সৈনিক। কয়েকটি ছোটবড় পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে অণুগল্প, ছোটগল্প এবং রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'সুখপাঠ' এবং 'উদ্ভাস' পত্রিকায় রম্যরচনা এবং দ্বিভাষীয় আন্তর্জালিক 'থার্ড লেন'-এ ছোটগল্প প্রকাশ পেয়েছে।
2 Responses
ছোটদের জন্য সুন্দর লেখা
ধন্যবাদ সোমেনবাবু। বাংলালাইভ. কম-এ আমার আরও কিছু লেখা আছে। সেগুলো পড়ে দেখার আমন্ত্রণ রইল।