banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

যামিনী রায়ের ছবির ঠিকানা

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Jamini Roy art

শিল্প সমালোচক শ্রী প্রণবরঞ্জন রায়ের এই প্রবন্ধ ‘দেশ’ পত্রিকার ১১ এপ্রিল, ১৯৮৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তারপর যামিনী রায়ের শিল্প সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টি্ভঙ্গির কিঞ্চিৎ বদল হয়েছে। ভবিষ্যতে কখনও তিনি সেই পরিবর্তিত ভাবনাকে নতুন কোনও লেখায় তুলে ধরতে চাইলে বাংলার পাঠকদের তা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে। আপাতত লেখকের অনুমতিক্রমে আমরা এই নিবন্ধ পুনর্মুদ্রণ করছি, বানানবিধি অপরিবর্তিত রেখে।


যামিনী রায় মহাশয়ের যত ছবি দেশ ও বিদেশের যত মিউজিয়াম ও ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ছড়িয়ে আছে তেমন আর কোন ভারতীয় চিত্রকর বা ভাস্করের নেই। বিতরণের এই ব্যপ্তি শুধু যে যামিনীবাবুর ছবির জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে তা নয়। তাঁর ছবির সংগ্রহণযোগ্যতা গুণ সম্বন্ধেও আমাদের সচেতন করে তোলে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয় তখন যামিনী রায়ের ছবি সংগ্রহ করতেন, তখন হয়তো ছবির দাম সংগ্রহণ-যোগ্যতার অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে; কারণ তাঁর জীবৎকালে যামিনীবাবুর ছবির দাম (পণ্যমূল্য) অন্যান্য শিল্পীদের ছবির দামের চেয়ে অনেক কম ছিল এবং অনেকের ছবির চেয়ে সহজে লভ্য ছিল। কিন্তু ক্লীভল্যান্ড মিউজিয়ম বা রোম মিউজিয়ম অথবা আর্মিতাজ গ্যালারি যখন তাঁর ছবি সংগ্রহ করেছে তখন পণ্যমূল্য কি তাঁদের বিবেচ্য বিষয় ছিল? ইওরোপীয় আধুনিকতার বিবর্তনধারার ইতিহাসের সঙ্গে যামিনীবাবুর শিল্পচিন্তার সাযুজ্য তাঁদের যামিনীবাবুর ছবি সম্বন্ধে উৎসাহিত করে থাকলেও পণ্যমূল্য নিশ্চয়ই তাঁদের বিবেচ্য হয়নি!

সব মহৎ শিল্পীই বহু পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিজস্ব বিশিষ্ট রীতিতে উপনীত হন; আর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য লাভ করার পর থেকে তাঁর শিল্পের সব পরিবর্তনের মধ্যেও ওই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য—চরিত্রলক্ষণ হিসাবে থেকে যায়। বাংলার লৌকিক পটচিত্রভিত্তিক যে অবিমূর্ত অথচ নকশাপ্রধান বিশুদ্ধশিল্প রীতিকে আমরা যামিনী রায়ের নিজস্ব রীতি বলে জানি, সে রীতিতে উপনীত হতে যামিনীবাবুকে পর্যায়ক্রমিক বহু শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছিল অথচ, যে-সব সংগ্রহশালায় এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে যামিনীবাবুর ছবি রয়েছে, তাতে পূর্ব জীবনের সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাক্ষ্য-প্রমাণ তেমন পাওয়া যায় না। অধিকাংশ সংগ্রহশালায় এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে যামিনী রায়ের কাজের যে-সব নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়, তা ওই বাংলার লোকশিল্প-ভিত্তিক অবিমূর্ত বিশুদ্ধ নকশাধর্মী ছবি। ব্যক্তিসংগ্রাহকরা সাধারণত সেসব ছবিই সংগ্রহ করেন যাতে শিল্পীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য স্বপ্রকাশ। কিন্তু প্রত্যেক মহৎ শিল্পীরই এমন কিছু গুণগ্রাহক সংগ্রাহক থাকেন, কিছু গুণগ্রাহী প্রতিষ্ঠান থাকে যাঁরা শিল্পীর বিবর্তনের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে রাখেন। যামিনীবাবুর দুর্ভাগ্য তাঁর গুণগ্রাহীদের মধ্যে বহু বাঘা পণ্ডিত, তার্কিক তত্ত্বজ্ঞ থাকলেও, ইতিহাসজ্ঞ শিল্পরসিক এমন কেউ ছিলেন না যাঁরা তাঁর শৈল্পিক বিবর্তনের ইতিহাসের সাক্ষ্যপ্রমাণ সব সংগ্রহ করে রাখতে পারতেন। শুধুমাত্র যামিনী রায়ের শিল্প সংরক্ষণের ভার দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৭৯ সালে কলকাতায় যে সংগ্রহালয়ের জন্ম দিয়েছেন সেটি এতই নবীন যে সেটি যদি যামিনী রায়ের শিল্পীজীবনের বিবর্তনের ইতিহাস সাক্ষ্য-প্রমাণ সহ তুলে ধরতে অপারগ হয় তবে তাকে দুষে লাভ নেই। দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহের মতনই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক পরিচালিত যামিনী রায়-গৃহের সংগ্রহশালাটিতেও সেই তিরিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ষাটের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যামিনীবাবু যেমন বহুপ্রজ তেমনটি আগে কখনও ছিলেন না। তাই হয়তো যামিনীবাবুর অ্যাটিপিক্যাল রচনা এত দুর্লক্ষ্য। 

বিষ্ণু দে’র নির্ভরযোগ্য লেখা থেকে জানা যায়, যামিনীবাবু তাঁর ছাত্রাবস্থায় (১৯০৩-১৯০৭) ছবি থেকে নিজের ব্যয় নির্বাহ করতেন। অবশ্য তাঁর পিতৃকুলের কি গ্রামীণ, কি শহুরে শাখা মোটেই অসচ্ছল ছিল না। একবার বড়দিনের আগে কোনও এক ইহুদী ব্যবসায়ীর জন্য তিনি জলরং দিয়ে কিছু পোস্টকার্ড এঁকে প্রতি একশো কার্ড পিছু দশ থেকে বারো আনা উপার্জন করেছিলেন। গরাণহাটার এনগ্রেভারদের করা ছবিতে জলরঙ ধরিয়েও তিনি কিছু উপার্জন করতেন এমন কথাও বিষ্ণুবাবু শুনিয়েছেন। কিন্তু যামিনীবাবুর সেসব কাজ চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শাহেব সোহরাওয়ার্দী জন আরউইন বা উইলিয়ম আর্চার কারোরই হয়নি। 

গিলার্দি নামে যে ইতালিয় শিক্ষকের কাছে অবনীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক ন্যাচারালিস্ট পদ্ধতিতে প্রতিবিম্বায়নের পাঠ নিয়েছিলেন, যামিনী রায়ও তাঁরই কাছে প্রতিকৃতি রচনা শিখেছিলেন। ছাত্রত্ব শেষে জীবিকা নির্বাহের জন্য কমিশন নিয়ে অ্যাকাডেমিক ন্যাচারালিস্ট পদ্ধতিতে ক্যানভাসের উপরে তেল রং দিয়ে পোর্ট্রেট আঁকতেন এ-তথ্য অনেকের জানা থাকলেও যামিনীবাবু রচিত পোর্ট্রেট দেখার সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়েছে। যে-দুটি দেখার সৌভাগ্য বর্তমান লেখকের হয়েছে, তাতে মনে হয়, যামিনীবাবু রেমব্রান্ডট-এর আলো-ছায়া বিতরণের পদ্ধতিতে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং শুধুমাত্র সাদৃশ্যের বিম্বায়নই তাঁকে প্রতিকৃতি রচনায় প্ররোচিত করত না। তবে বিষ্ণুবাবু যে বলেছেন অ্যাকাডেমিক বাস্তবতাবাদ সম্বন্ধে তাঁর মনে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার পর থেকে, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যামিনীবাবু আর কোনদিন তেলরঙ দিয়ে প্রতিকৃতি রচনা করেননি, কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। তিরিশের দশকের শেষভাগকে যদি যামিনীবাবুর ইওরোপীয় অ্যাকাডেমিক প্রাতিবিম্বিক বাস্তবতা সম্বন্ধে মোহভঙ্গের কাল বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে ধরতে হয় সে-সময়ের পরে তিনি আর তেল-রঙে প্রাতিবিম্বিক পোর্ট্রেট রচনা করেননি। দিল্লির ধূমিমল গ্যালারির রবি জৈন (বা মহেন্দ্র জৈন?)-এর সংগ্রহে যামিনী রায়কৃত, তাঁদের পিতার যে পোর্ট্রেটটি আছে সেটি চল্লিশের দশকের প্রথমপাদে অঙ্কিত। 

ব্যক্তি সংগ্রাহক তাঁর রুচি ও সাধ্যমত ছবি সংগ্রহ করেন। তা নিয়ে বলার কিছুই থাকতে পারে না। কিন্তু ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট-এর মতন যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলার বিবর্তনের ইতিহাসের সব সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সংগ্রহ করে রাখা; বিশেষ করে যামিনীবাবুর মতন যে-সব শিল্পীর শিল্পকর্মকে জাতীয় সম্পদ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান যখন দায়িত্বহীনের মতন কাজ করেন তখনই ক্ষোভের কারণ হয়। শ্রীমুকুল রায়ের সংগ্রহে তাঁরই এক পিতৃপুরুষের একটি প্রতিকৃতি আছে। তিরিশের দশকের প্রথমার্ধে যামিনীবাবু এই অনবদ্য রেমব্রান্ডটীয় প্রতিকৃতিটি এঁকেছিলেন। বছর দশেক আগে, বর্তমান লেখক মুকুলবাবুকে অনুরোধ করেন ছবিটি তিনি যেন ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টকে বেচে দেন। এবং মুকুলবাবু রাজি হলে, এই লেখক NGMA-কে ছবিটি কিনে নেবার পরামর্শ দেন। কিন্তু ছবিটি যামিনীবাবুর বলে চেনা যায় না এই অজুহাতে আর কেনা হয়নি। এই তো আমাদের ইতিহাস-চেতনা! এই তো আমাদের কৃতিদের প্রতি কর্তব্যবোধ!

যামিনী রায়ের শিল্প বিবর্তনের ইতিহাস এক অর্থে ভারতবর্ষে আধুনিক শিল্পের বিবর্তনের ইতিহাসের সমতুল্য। যামিনী রায় জীবন শুরু করেছিলেন পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক প্রাতিবিম্বিক বাস্তববাদী ধারায় বিশ্বাসী চিত্রকর হিসাবে। সেখান থেকে তিনি সরে যান আরও একটু শিল্পসম্মত পাশ্চাত্য বাস্তবতার অন্য এক সমৃদ্ধ ধারায়। কিন্তু সে ধারাও তাঁর শৈল্পিক শুদ্ধতার সন্ধান দিতে পারল না। তিনি ফিরলেন, পোস্ট-ইম্প্রেশনিজমের দিকে। জর্জ সোরা, ফান গঘ এবং সর্বোপরি পোল সেজান তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করলেন। তাঁরা চিত্রক্ষেত্রকে যেভাবে দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র বলে ধরে, বর্ণান্তরহীন একভার রঙের পুঞ্জের সাহায্যে নকশা গড়ে তুলতেন, দ্বিমাত্রিক ডৌলের দাবিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিম্বকে যে-ভাবে ভেঙে রঙিন নকশায় পরিণত করতেন, সে-সবই যামিনীবাবুর শৈল্পিক শুদ্ধতাসন্ধানী চিত্তকে আকৃষ্ট করল। তিনি যে সোরা, ফান গঘ আর সেজানের ধরনের কিছু নিসগ্র চিত্র আঁকলেন শুধু তাই নয়, ওই ফরাসী ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রীদের বেশ কিছু ছবি নিজের মতন করে কপিও করলেন। কিছু তেল রঙে ক্যানভাস ও বোর্ডের উপর, কিছু টেম্পেরায়, কিছু গুয়াশে। তাঁর নিজস্ব বিশিষ্ট রীতিতে ছবি আঁকতে শুরু করার পরেও তিনি টেম্পেরায় সেজানের ধরনের বেশ কিছু নিসর্গ দৃশ্য এঁকেছিলেন। এ জাতীয় কিছু নিসর্গ দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত যামিনী রায় গৃহসংগ্রহালয়ে থাকলেও খুব বেশি নেই। আছে বিষ্ণু দে মহাশয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে, লোকায়ত দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও আর্থিক ঐতিহাসিক অশোক সেন-এর মত সংগ্রাহকদের কাছে। 

Jamini Roy
যামিনী রায় এক ভারতীয় চরিত্রের নকশাপ্রধান বিশুদ্ধ শিল্প গড়ে তুলেছেন।

ইওরোপীয় চিত্রকলার বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করেই যামিনী রায় অন্য নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ চিত্র সম্বন্ধীয় ধারণায় উপনীত হন। নিজস্ব শিল্প ধারণার বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যেই যামিনীবাবু বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে, বিশেষ করে কালীঘাটের পটের সঙ্গে, সেজান প্রবর্তিত পোস্ট ইম্প্রেশনিজম-এর এবং সিনথেটিক কিউবিজমের গঠনতান্ত্রিক সাযুজ্য আবিষ্কার করেছিলেন। বাংলার লোকশিল্পে যা ছিল সুপ্ত সম্ভাবনা, তাকেই উপাদান হিসাবে ব্যবহার করে যামিনী রায় এক ভারতীয় চরিত্রের নকশাপ্রধান বিশুদ্ধ শিল্প গড়ে তুললেন। আমাদের দেশের আলো-বাতাস আর নিসর্গ থেকে পাওয়া রঙের জোরালো একভার প্রয়োগ আর কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সভ্যতায় পূর্ণতার সঙ্কেতবাহী বঙ্কিমরেখাধৃত সুগোল ডৌল হল তাঁর ছবির প্রধান উপাদান। আঙ্গিকপ্রধান ইওরোপীয় ছবির ধারায় রেখার বঙ্কিম ছন্দ এবং ডৌলের বর্তুলাকার দুর্লক্ষ্য; দেখতে পাওয়া যায় শুধু আঁরি মাতিস আর ফেরণঁ লেজেরের ছবিতে। যামিনী রায় যখন তাঁর বিখ্যাত নিজস্ব শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন, সে সময়ে মাতিস এবং লেজেরের বিশেষ করে মাতিসের ছবির বেশ কিছু কপি করেছিলেন। কপিগুলি হুবহু নকল নয়, খানিকটা ফ্রি-হ্যান্ড কপি। তার কিছু নিদর্শন বিষ্ণু দে এবং অশোক সেনের সংগ্রহে থাকলেও, ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট কিংবা যামিনী রায়-এর গৃহসংগ্রহালয়ের মতন সাধারণগম্য সংগ্রহালয়ে নেই। 

santhal dance jamini roy ngma
সাঁওতাল নাচ, যামিনী রায়, ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট।

বড় আঁকার আগে খসড়া হিসাবে, সাধারণ কাগজে কালি-কলমের আঁচড়ের সাহায্যে যামিনীবাবু যে স্কেচ বা লে-আউটগুলি করতেন ড্রইং হিসাবে সেগুলি অনবদ্য। এন. জি. এম. এ বা যামিনী রায় গৃহসংগ্রহালয়ে তার কোন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না। বেশ কিছু আছে প্রখ্যাত অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জির ব্যক্তিগত সংগ্রহে। কিছু আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে। এই দুই সংগ্রহই যামিনী রায়ের মৃত্যুর পর। 

১৯৭২-এর এপ্রিলে যামিনীবাবুর দেহান্তের পরে, বিষ্ণু দে মহাশয়ের নেতৃত্বে কলকাতার বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ জানান, সরকার যেন যামিনীবাবুর নিজস্ব সংগ্রহের (অর্থাৎ তাঁর বাড়িতে রক্ষিত তাঁর সব ছবি) কিনে নিয়ে তা সাধারণের জন্য সংরক্ষণ করেন। কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতর সব কিনে নিতে রাজি হলেও, কলকাতায় তাঁদের ক্রীত ছবি রাখতে দিতে রাজি হলেন না। বললেন, ক্রীত ছবি যাবে ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট-এ, দিল্লিতে। বললেন, কলকাতায় ভাল সংগ্রহশালা নেই, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। বিষ্ণুবাবুরা সঙ্গত কারণেই রাজি হলেন না; যামিনীবাবুর কলকাতায় সাধারণের দেখার জন্য কোন ছবি থাকবে না, এ হয় কি করে! প্রয়াত অ্যাডভোকেট জেনারেল স্নেহাংশুকান্ত আচার্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ জানালেন, যামিনী রায় মহাশয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহের সব ছবি কিনে নেবার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বললেন, কেন্দ্রীয় সরকার যদি ক্রয়মূল্যের অর্ধেকের ব্যয়ভার বহন করে তবে তাঁরা বাকি অর্ধেক কিনে নিতে পারেন। কেন্দ্রীয় সরকার রাজি হলেন, কিন্তু ওই পূর্ব শর্তে। দু’লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রায় দু’শো ছবি ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টে চলে গেল। ওঁরাই বেছে নিয়ে গেলেন।

Raavana, Jamini Roy, NGMA
রাবণ। পেন অ্যান্ড ইংক অন পেপার। ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট।

১৯৭৮-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকার যামিনী রায় মহাশয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রক্ষিত তাঁর আনুমানিক দুশো পঁচিশখানি ছবি আড়াই লক্ষ টাকায় কিনে নিতে রাজি হলেন। তার সঙ্গে উপহার হিসাবে পরিবারের কাছ থেকে আরও পঞ্চাশটি ছবি পেলেন। কিন্তু ছবি রাখা হবে কোথায়? কলকাতায় তো স্থায়ী প্রদর্শনশালা নেই। বিষ্ণুবাবু বললেন, দেশ-বিদেশে মহাপুরুষেদর বসতবাড়ি সরকার অধিগ্রহণ করে স্মারকসংগ্রহশালা বানায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও যামিনীবাবুর বসত বাড়ির একতলার স্টুডিও ঘরগুলিকে নিয়ে তেমনই এক স্মারক সংগ্রহালয় তৈরি করতে পারেন। স্নেহাংশুকান্ত আচার্যর মধ্যস্থায়, মাসিক দু’হাজার টাকা ভাড়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৭৯-তে যামিনীবাবুর ডিহি শ্রীরামপুর লেনের (বালিগঞ্জ প্লেস ইস্ট) বাড়ির একতলার স্টুডিও ঘরগুলি নিয়ে যামিনী রায় স্মারক সংগ্রহশালার পত্তন করলেন। যেহেতু যামিনী রায় মহাশয়ের পুত্র অমিয় রায় ওরফে পটলবাবুই বহুকাল ধরে যামিনীবাবুর সঙ্গে থেকে কাজ করতেন এবং যামিনীবাবুর ছবি-পত্রের হদিশ জানতেন সেহেতু বিষ্ণুবাবু এবং স্নেহাংশুবাবুর অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকেই একটা মাসোহারার ভিত্তিতে সংগ্রহশালার কিউরেটর নিযুক্ত করেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রহশালার দ্বার উদ্ঘাটন হতে আরও সাত বছর কেটে গেল। অবশেষে ১৯৮৬ সালে সর্বসাধারণের জন্য যামিনী রায় স্মারক সংগ্রহশালার দ্বার খোলা হল। 

আগে তেল-রং আর জল-রঙে ছবি এঁকে থাকলেও, নিজস্ব বিশিষ্ট রীতিতে ছবি আঁকতে শুরু করার পর থেকে যামিনীবাবু সাধারণত নিরামিষ টেম্পেরায়, গুয়াশে আর কালি দিয়ে ছবি আঁকতেন। ভূ-জ আর উদ্ভিদ-জ রং, উদ্ভিদ-জ আঠা আর জলে দ্রব কালিই ছিল তাঁর ছবির প্রধান উপাদান। বোর্ড আর হাতে তৈরি কাগজই তাঁর জমি হত। মাধ্যমের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না, কারণ মাধ্যম তিনি পরীক্ষামূলকভাবেই ব্যবহার করতেন। তারপরে যখন তিনি শুনতেন ছবির রং ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে বা রঙের চলটা উঠে যাচ্ছে, তার উত্তরে তিনি বলতেন, আমাদের লৌকিক শিল্পীরা ছবির স্থায়িত্বের কথা না-ভেবেই ছবি আঁকতেন, তাঁরা জানতেন সব কিছুর মতন শিল্পবস্তুও নশ্বর। ফলে, তাঁর ছবি সংরক্ষণ করাটা বড় সমস্যা। যামিনীবাবুর বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টের বাড়ির একতলাটা এমনিতেই বেশ নিচু। পাড়াটায় বৃষ্টি হলেই হাঁটু-জল দাঁড়ায়। জল দাঁড়িয়ে থাকে। দেওয়াল যায় ভিজে; শ্যাওলা ধরে, নোনা হয়। সেখানে এসব ছবি থাকবে কেমন করে? যামিনীবাবুর ছবি যে-ধরনের সংগ্রহশালাতেই থাকুক না কেন, বেশ যত্ন এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দাবি করে। যে দাবি মেটাতে পারেন সুকান্ত বসু, পঙ্কজ দত্ত, অরুণ ঘোষের মতন রীতিমতন শিক্ষিত শিল্প সংরক্ষণকারীরা। তাও, তাঁরা খালি হাতে পারবেন না। তাঁদের দরকার এন. জি. এম. এ. বা ন্যাশনাল মিউজিয়ম অথবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতন ল্যাবরেটরি। বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ-কৌশল প্রয়োগের চেয়েও বেশি দরকার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। এন. জি. এম. এ-তে এসব রয়েছে। সেখানে যামিনীবাবুর ছবি হয়তো সুস্বাস্থ্যে থাকবে। কিন্তু যামিনী রায় স্মারক সংগ্রহালয়ে কি তা থাকবে?

যামিনী রায় মহাশয় তাঁর এক একটি ছবির অনেকগুলি variation করতেন। সব শিল্পীই তা করেন। কিন্তু যামিনীবাবু অনেক সময়েই অনুলিপিধর্মী variation গুলি এঁকে দেবার দায়িত্ব দিয়ে দিতেন অমিয়বাবু বা পুত্রসম কোন শিষ্যকে। সেটাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করতেন না। বলতেন, শিল্পের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ওস্তাদ শিল্পী ছবির রূপধ্যান করেছে, পথ বাতলে দিয়েছে, আর সুযোগ্য শিষ্য তাকে শরীর দিয়েছে। তিনিও তাই করেছেন সময়ে সময়ে, অনুলিপি কর্মটি তাঁর অনুমোদন পেয়েছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? যামিনী রায়-এর স্বহস্তে অঙ্কিত ছবির রেখায় যে স্বতঃস্ফূর্তি লক্ষ্য করা যায়, সেটা কি নকল ছবির সযত্নে টানা রেখায় দেখা যায়? যামিনীবাবুর নিজের হাতে লেপা সপরিসর বর্ণক্ষেত্রে বুনোটের যে বৈভব দেখা যায়, তা কি নকল ছবির একভার বর্ণক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়? যামিনীবাবুর স্বহস্তে আঁকা ছবির অলঙ্করণে নিয়োজিত টান, টোন, ঢ্যাঁড়া, ড্যাশ, বিন্দু, ফুটকির নিয়মিত বিন্যাসের মধ্যেও যে অনিয়ম লক্ষ্য করা যায়, নকল ছবির যান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিকতায় তা আকর্ষণ হারায়। যামিনীবাবুর ছবি এত সহজেই মোটামুটিভাবে নকল করা যায় বলেই যামিনীবাবুর ছবির সব সংগ্রহালয়ের উপরে মূল ছবিকে রক্ষা করার একটি অতিরিক্ত দায় বর্তায়। যামিনী রায় গৃহের স্মারক সংগ্রহালয়ের কর্তৃপক্ষ কি সে দায়িত্ব বহনের উপযুক্ত? দায়িত্ব আরও আছে। যামিনী রায়ের শিল্পীজীবনের বিভিন্ন পর্বের সাক্ষ্য-প্রমাণ সব সংগ্রহ করার। সে দায়িত্ব কি তাঁরা পালন করছেন? 

ছবি: ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট-এর ওয়েবসাইট থেকে।

প্রণবরঞ্জন রায় বর্ষীয়ান বিশ্রুত চিত্র সমালোচক ও প্রাবন্ধিক। বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রণবরঞ্জন রাজ্য সরকারি কর্মচারি ছিলেন। সোসাইটি অফ কনটেমপোরারি আর্টিস্ট সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রণবরঞ্জন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পঁচিশ বছর ধরে। অধ্যাপনা করেছেন বরোদার এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলাভবন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ললিত কলা অকাদেমির এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্যও ছিলেন দীর্ঘদিন। বহু সংবাদপত্রে, সাময়িকীতে চিত্র সমালোচনা করেছেন, দেশ বিদেশের জার্নালে লিখেছেন অজস্র গবেষণাপত্র, প্রবন্ধ। একাধিক তথ্যচিত্রের কাজও করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com