বিলেতে বিসর্জন দেওয়া হয় না প্রতিমা| পুজোর শেষে কোনও স্টোরেজে রাখা হয় ঠাকুরকে| নদী বা লেকে বিসর্জন দেওয়ার অনেক বিধি-নিষেধ| হয়তো বিলেতি সমুদ্রতেও তাই| তবে বাঙালিরা অতদূর যান না| বছর বছর স্টোরেজে রাখেন প্রতিমা| পুজোর সময় রঙ-তুলির টানে মেক-আপ দেওয়া হয় দরকার মতো| বিলেতে দুর্গা পুজোর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান| অনেক নতুন পুজো কমিটি পুরনো প্রতিমার খোঁজে থাকেন| অনেক পুরনো পুজো কমিটি নতুন প্রতিমার কথা ভাবেন বছর দশেক অন্তর| পুরনো প্রতিমা চলে যায় নতুন পুজোয়| নতুন প্রতিমা আসে পুরনো পুজোয়| কুমোরটুলি থেকে| আকাশপথে| এইভাবে প্রতিমার রিসাইক্লিং চলতে থাকে| বেঁচে থাকে বিলেতে বাঙালির পুজো| বেঁচে থাকে বাঙালিয়ানা|
২০১৯ এর জানুয়ারি মাস নাগাদ আমাদের শেফিল্ড ডিস্ট্রিক্ট দুর্গোৎসব কমিটি ঠিক করেন, এবার নতুন প্রতিমা হলে বেশ হয়| শেফিল্ডের পুজো চলছে প্রায় ত্রিশ বছরের ওপর| একই প্রতিমা প্রায় বছর কুড়ি ধরে আছে| মাঝে একবার খুব যত্ন করে রঙ ফেরানো হয়| তবে গত বছর মনে হয় প্রতিমাকে সত্যিই বেশ ক্লান্ত লাগছে| তাই নতুন প্রতিমার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়|
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পশ্চিমবঙ্গে বিলেতের বাঙালি আর পরিযায়ী পাখিদের মরসুম| শেফিল্ডের কমিটি মেম্বাররা দফায় দফায় কুমোরটুলিতে ঢুঁ মারতে শুরু করেন| এ-পাল, ও-পাল থেকে হোয়াটস্য়াপে ছবি যেতে থাকে উত্তর ইংল্যান্ডে| অনেক আলোচনা বিতর্কের পর রাজা পালের গড়া ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা পছন্দ হয় সবার| এয়ার ইন্ডিয়ার সৌজন্যে, কাস্টম্সের জট ছাড়িয়ে মা অবশেষে এসে পৌঁছন উত্তর ইংল্যান্ডের ছবির মতো পাহাড়ি শহর বার্নসলেতে| ইয়র্কশায়ারের এই শহরের মিল্টন হল পুজোর কদিন মেতে ওঠে| ঢাকের, ঘন্টার আওয়াজে| ভোগ, ধুপ-ধুনোর গন্ধে| পুজোর আনন্দে| আমাদের পুরনো প্রতিমা যায় লন্ডনের শহরতলীর ‘আড্ডা’র পুজোয়| সেই ওদের প্রথম পুজো|

বিলেতের অনেক পুজোয় নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় পুজোর ক’দিন| শেফিল্ডের পুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পুজোর পর আলাদা করে হয়| পুজোর কদিন পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ, ধুনচি নাচ, আরতি নিয়ে মেতে থাকে বাঙালিরা| গতবছর ঠিক হয় নবকলেবর বরণ করে নেওয়ার জন্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে ষষ্ঠীর দিন| বোধনের পরে| ঠিক হয় নাচ-গান-স্তোত্র দিয়ে করা হবে গীতি-আলেখ্য ধাঁচের একটি অনুষ্ঠান| স্ক্রিপ্ট লেখার ভার পড়ে আমার ওপর| বাঙালি এই ব্যাপারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র বাইরে খুব একটা কিছু পছন্দ করে না| উত্তমকুমার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেও গ্রহণ করতে পারেনি| বিরাট আলাদা কিছু করে চমক দিতে না চাইলেও, ভাবতে শুরু করি খানিকটা নতুন কিছু কীভাবে করা যায় |
∗∗∗
নরেন্দ্রপুরে সেপ্টেম্বর পড়লেই সকালের প্রার্থনায় আগমনী গান শুরু হয়ে যেত| একটা গান শিখেছিলাম আমরা — ‘আজ আগমনীর আবাহনে’| একটি ছবি আঁকা হয়েছে গানটিতে| ভরা শরতের ছবি| প্রকৃতির সঙ্গে মানবিক যোগের ছবি| গানে একবারও দেবী দুর্গার নাম নেই| মনে হয় না আর কোনও আগমনী গানে এইভাবে দেবী দুর্গাকে আবাহন করা হয়েছে।
আমি বলার মত গান গাইতে পারি না| স্টেজে একক গান কখনও গাই না, এটা বুঝি বলেই| তবে কোরাসে গলা মিলিয়েছি| নরেন্দ্রপুরে থাকতে বাড়ি এলে, প্রার্থনার গান গেয়ে মা-বাবাকে শোনাতাম| আমাদের বাড়ি আট পুরুষের দুর্গাপূজা হয়| নবমীর দিন রাতে প্রস্বস্তি বন্ধন হয়ে যাওয়ার পর বাড়ির সবাই মিলে নাচ-গান-আবৃত্তি-বাজনা, যে যেমন পারে — কিছু না কিছু করত| আমি সেবার ‘আজ আগমনীর আবাহনে’ গানটি করেছিলাম| সুর ঠিকঠাক লাগাতে পেরেছিলাম বলেই মনে হয়| সবার ভাল লেগেছিল মোটামুটি| আমার দিদিমা দেখি ঝরঝর করে কাঁদছেন| আমার হাত ধরে বলেন — ‘ভাই, সেই ছোটবেলায় শুনসিলাম এই গানটা | ভুইলাই গেসিলাম রে ভাই| আবার তুই মনে করাইয়া দিলি’| আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আশীর্বাদ করেন|
মিল্টন হলের একটি স্টোরেজে অন্ধকারে স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডায় মা দুর্গা সপরিবারে অপেক্ষা করছেন| সমস্ত সোশ্যাল gathering বন্ধ করার ফরমান জারি করেছে সরকার| পুজোর কদিনও মিল্টন হলে ভরে থাকবে ঝুপসি অন্ধকার| ভার্চুয়াল কিছু অনুষ্ঠান হবে ফেসবুকের পাতায়|
নটিংহ্যাম শহরের একটু বাইরে একটি হাসপাতালে কাজ করেছি প্রায় বছর দশেক| ভারি সুন্দর ছিল আমার হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তাটা| ছবির মতো সুন্দর গ্রামের ভেতর দিয়ে| কখনও বা অবাধ কান্ট্রিসাইড| ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়| কোথাও আবার সমতল ভূমি| সবুজের নানা শেড| অলসভঙ্গিতে ভেড়া চড়ছে| ঝক্ঝকে দিন হলে তো কথাই নেই| সোনা রোদে চারদিক ঝলমল| শরতকালের আমেজ পুরোপুরি পাওয়া যায় সেপ্টেম্বর পড়লেই| রোদমাখা দিনগুলোয়| ঘন নীল আকাশ| হালকা, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ| গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে কোনও পুরনো পুজো সংখ্যার গান বা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চিরকালীন চণ্ডীপাঠ| শরীর-মন জুড়ে একটা পুজোর আভাস বুলিয়ে দেয়|
এই কান্ট্রি রোড, সাউথওযেল নামের একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে যায়| রাস্তার দু’পাশে ছোট কটেজ ধরনের বাড়ি| একটা মাঝারি মাপের গির্জা| দু-একটি সুদৃশ্য দোকানের পসরা| একটি ছোট্ট সিনেমা হল — সত্তরের দশকে টিভির দাপটে বন্ধ হয়ে যাওয়া| এখন সেখানে পাব| তবে নাম বা আকৃতি কিছুই বদলানো হয়নি| ‘দ্য় সিনেমা’ লেখা সাইনবোর্ড এখনও ঝুলছে| পুরনো হলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও কিছু ছবি দেওয়া বোর্ড বাইরে| বাণিজ্যিক কারণে পরিবর্তন মেনে নেওয়া, কিন্তু পুরনোকে মনে রেখে দিয়ে| ছোট গ্রামের শেষপ্রান্তে চার্চের বিশপের মাঝারি আকারের খিলান দেওয়া বাড়ি|

এই বাড়ি ছাড়িয়ে গেলে পাহাড়ির রাস্তায় অনেকটা যাওয়া| আশেপাশে নির্ভেজাল প্রকৃতি| খানিক গেলে একটি খামার বাড়ি| ইংরেজিতে যাকে বলে বার্ন হাউস| শরৎকালে এই বাড়িটার সামনে এসে চোখ আটকে যেত| বেশকিছু কাশফুলের ঝাড় | পুজোর আমেজ পূর্ণতা পেত| এই কাশফুল দেখে নরেন্দ্রপুরের শরতের কথা মনে পড়ে যেত| দেশেও গ্রামের দিকে না গেলে কাশফুল বেশ বিরল| পূজাবার্ষিকীর প্রচ্ছদের বাইরে নতুন প্রজন্মের অনেকেই কাশফুল দেখেনি |যেদিন হাতে সময় থাকত, সেই Barn এর কাছে গাড়ি থামিয়ে খানিক সময় নিয়ে দেখতাম কাশফুলের ঝাড়| এখানে পাম্পাস গ্রাস বলা হয়| চামড় রঙা কাশফুল হালকা হাওয়ায় দুলত| মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতাম| আবার এগিয়ে যেতাম হাসপাতালের দিকে| বছর দুয়েক আগে দেখি বাড়িটার সামনে ‘ফর সেল’ বোর্ড ঝোলানো| এদেশে বাড়ি কিনেই নতুন মালিক দ্রুত কিছু পরিবর্তন করেন বাড়ির| প্রথমেই মনে হল, এই কাশফুল রাখবেন তো নতুন মালিক?
∗∗∗
মনে হল গীতি-আলেখ্য একটু অচেনা গান দিয়ে শুরু করলে বেশ হয়| পুজোর কাছাকাছি এলেই ‘আজ আগমনীর আবাহনে’ গানটি আমার মাথায় ঘুরঘুর করে| ইউটিউব সার্চ করে পেয়ে গেলাম গানটা – মানবেন্দ্রনাথ মুখার্জীর গলায় আর ডা. সুহৃতা পালের গলায়| ডা. পালের ভার্সনটা তোলা সম্ভব মনে হল| ফেসবুকে আলাপ হল স্বপন মিত্র মহাশয়ের সঙ্গে| উনি জানালেন এই গানটির রচয়িতা ও সুরকার হীরেন বসু| এই গান প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৩১ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দাস (বিখ্যাত অভিনেতা অনুপকুমারের বাবা)| আমার দিদিমা ধীরেন দাসের গানটাই শুনেছিলেন — য়া আজীবন মনে ছিল তাঁর| ১৯৫২-তে এই গানটি রেকর্ড করেন মানবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়| হালে একটা টিভি চ্যানেলে গানটা রেকর্ড করেছেন ডা. সুহৃতা পাল| ঘটনাচক্রে ডা. পাল আমাদের নরেন্দ্রপুরের এক বছর সিনিয়র ডা. কল্যাণ পালের স্ত্রী| তৈরি হয়ে গেল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপ| লেখা হল স্ক্রিপ্ট| মহালয়ার দিন হল আমাদের পূর্ণাঙ্গ রিহার্সাল| অনুষ্ঠানের flyer তৈরি, কস্টিউম বাছা, ফেসবুকের জন্য ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা — বেশ একটা সাজসাজ ভাব| গীতি-আলেখ্যর নাম দেওয়া হলো ‘আগমনীর আবাহনে’| খুব যত্ন করে গানটা তুলে নেয় সুদীপ্তা সামন্ত| শুধুমাত্র হারমোনিয়ামের সঙ্গে অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে| পুজোর নানা আবেশের সঙ্গে যোগ হয় একটি পুরনো হারিয়ে-ফিরে-পাওয়া গান| পূর্ব বাংলার গ্রাম, কলকাতার উপকন্ঠের এক স্কুল ছুঁয়ে সেই ছবির মত গান দোলা দিয়ে যায় বেশ কিছু বাঙালির মনে| উত্তর ইংল্যান্ডে|
∗∗∗
বছর খানেক আগে নতুন এক হাসপাতালে জয়েন করেছি| নটিংহ্যামের সেই রাস্তায় যাওয়ায় হয়নি বহুদিন| এর ভেতর একদিন হাতে খানিকটা সময় ছিল| মনে হল সেই পুরনো রাস্তায় একবার গিয়ে দেখি| সব কিছু একই আছে| শুধু সেই বার্ন হাউসের মালিক বদল হয়েছে বুঝতে পারলাম| বাড়ির সামনের সেই কাশফুল আর দেখলাম না| শরতের আয়োজনেও যেন এবার খামতি|
২০২০| করোনার প্রকোপে সারা পৃথিবী ধুঁকছে| উত্তর ইংল্যান্ডে আছড়ে পড়েছে সেকেন্ড ওয়েভ| এই কথা ভেবেই আগে থেকেই এবার পুজো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়| মিল্টন হলের একটি স্টোরেজে অন্ধকারে স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডায় মা দুর্গা সপরিবারে অপেক্ষা করছেন| সমস্ত সোশ্যাল ‘গ্য়াদারিং’ বন্ধ করার ফরমান জারি করেছে সরকার| পুজোর কদিনও মিল্টন হলে ভরে থাকবে ঝুপসি অন্ধকার| ভার্চুয়াল কিছু অনুষ্ঠান হবে ফেসবুকের পাতায়| সুদীপ্তা এবারও গাইবে ‘আজ আগমনীর আবাহনে’| করা হবে চন্ডীপাঠ| খানিকটা বাঙালিয়ানার উত্তাপ হয়তো ছুঁয়ে যাবে আমাদের মনে| অনেক পুরনো স্মৃতির সঙ্গে মাখামাখি করে|
দু দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনে প্রবাসী পাঞ্চজন্য পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। অবসর সময়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন।
One Response
অপূ, অসাধারণ লেখাটি মন প্রাণ একেবারে ভরিয়ে দিল একবার পড়ে সাধ মিটলনা তাই আবার পড়লাম।এমন লেখার অপেক্ষায় আবারও রইলাম ।