উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আশ্চর্য গল্প থেকে সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য ছায়াছবি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর নানান জায়গায় খাওয়াদাওয়া নিয়ে বেশ কিছু দৃশ্য রয়েছে। এইসব খাওয়াদাওয়ার দৃশ্য দর্শকের মনে, ছবির চরিত্রদের নিজস্ব স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে খুবই সাহায্য করেছিল। আসলে, একজন মানুষের খাওয়াদাওয়া দেখলে তার সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি হয়। তাকে কিছুটা অন্তত চেনা যায়। সে কী খাচ্ছে, কিসে করে খাচ্ছে, কোথায় বসে খাচ্ছে, খাওয়ার সময় তার ভাবভঙ্গি কেমন– এগুলো দেখে তার রুচি, আচার-ব্যবহার ও সামাজিক অবস্থানের কিছুটা আন্দাজ তো পাওয়াই যেতে পারে। গুপী-বাঘার বিভিন্ন চরিত্রের ক্ষেত্রেও আমাদের কাছে সেটাই ঘটেছিল।
[the_ad id=”266918″]
সিনেমা শুরু হওয়ার পর প্রথম যাঁকে আমরা কিছু খেতে দেখি, তিনি হলেন আমলকী গ্রামের রাজবাড়ির রাজামশাই। ভোরবেলায় গুপীর বেসুরো গলার গান শুনে রাজামশায়ের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। রাজা পেয়াদাকে হুকুম করেন, গুপীকে ধরে নিয়ে আসতে। গুপীকে যখন রাজসভায় হাজির করা হয়, তখন রাজা তাঁর সিংহাসনে বসে জামবাটিতে মুখ ডুবিয়ে দুধ খাচ্ছিলেন। বাটিটা তাঁর দু’হাতে ধরা ছিল। মুখ ডুবিয়ে দুধ খাওয়ার ফলে তাঁর গোঁফেও দুধ লেগে যাচ্ছিল। এইভাবে সবার সামনে দুধ খাওয়াটা একজন রাজার পক্ষে যে খুব রুচিসম্মত নয় এবং এতে করে তাঁর চরিত্রের ভোগী রূপটাই যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এরপর যে খাওয়াদাওয়ার দৃশ্যটির কথা মনে পড়ছে, তা হল নদীর ধারে গুপীবাঘার খেতে বসা। বনের মধ্যে গভীর রাতে ভূতের রাজার বর পাওয়ার পর, ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে, গানবাজনা করে তাদের যখন বেজায় খিদে পেয়ে গিয়েছিল, তখন তারা তালি বাজিয়ে বলেছিল– ‘আয়রে তবে খাওয়া যাক/ মণ্ডামেঠাই চাওয়া যাক/ কোর্মা কালিয়া পোলাও/ জলদি লাও জলদি লাও!’ আর সঙ্গে সঙ্গে দু’খানা কাজকরা রুপোর থালায় করে এসে গিয়েছিল কাজু-কিশমিশ ছড়ানো পোলাও, যার একপাশে লেবু ও নুন। থালার চারপাশে গোল করে সাজিয়ে রাখা পাঁচটি রুপোর বাটিতে ছিল ফুলকপির কালিয়া, মাংস, মাছ, চাটনি আর বিরাট মাপের রাজভোগ। গুপী ওই খাবারগুলো দেখে যারপরনাই পুলকিত হয়েছিল। আর বাঘা, খেতে বসার আগে ছুটেছিল নদীর জলে হাতটা একটু ধুয়ে নেওয়ার জন্যে। এটা আসলে ওর অনেকদিনের অভ্যেস। খেতে খেতে, বাঘা যখন বিরাট রাজভোগটি তুলে নিতে গিয়েছিল, তখন সেটা যে বাটিতে ছিল, তা টলে পড়ে গিয়েছিল। বাঘা তক্ষুনি সেটাকে আবার সোজা করে রাখে। এ থেকে বাঘার অন্তরের সুস্থ রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। পড়ে গেছে তো পড়েই থাক, তাকে আবার তোলবার কী আছে– এমনধারা কোনো নাকউঁচু মানসিকতা তার ছিল না। গুপী-বাঘা নদীর ধারে যেখানে বসে খাচ্ছিল, সেখানে ওদের পাশে বসে ছিল একটা কালোরঙা নেড়িকুকুর। সে খাবার দেখে ল্যাজ নাড়াচ্ছিল। গুপী খেয়ে উঠে পড়ার সময় তার দিকে নিজের রাজভোগের পড়ে থাকা টুকরোটা ছুড়ে দেয়। কুকুরটি তা খেতেও থাকে।
পরের যে দৃশ্যে, হাল্লা রাজার নাদুসনুদুস মন্ত্রীকে তার নিজের কক্ষে, গুপ্তচরের সঙ্গে প্রথমবার কথা বলতে দেখা গেল, সেখানে তিনি তাঁর সিংহাসনে আড়াআড়ি ভাবে বসে, একটি পা বাইরে ঝুলিয়ে দোলাতে দোলাতে, বেদানা গোছের একটা কিছু খাচ্ছিলেন। কথা বলতে বলতে উত্তেজিত মন্ত্রী, তাঁর হাতে থাকা দু’চারটে ফলের কোয়া, দু’দুবার নিজের সিংহাসনের পিছনে ছুড়েও ফেলেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, খাবারের অপচয় নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না– যেখানে তাঁর রাজ্যের বেশির ভাগ প্রজাই কিন্তু আধপেটা খেয়ে থাকে।

অন্যদিকে, গানের প্রতিযোগিতার কারণে শুণ্ডি রাজসভার খোঁজ করতে করতে গুপী-বাঘা যখন বাজারে ঢুকে পড়েছিল, তখন তারা একজন বুড়ো মানুষের কাছে প্রাসাদের খোঁজ জানতে চায়। কথা না-বলতে পারা সেই মানুষটি তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং দূর থেকে প্রাসাদ চিনিয়েও দেন। বিদায় দেওয়ার সময় তিনি নিজের ঝোলা থেকে দুটি আপেল বের করে গুপী-বাঘাকে উপহার দেন। বাঘা বলেছিল, তারা ওটা কিনতে পারবে না কারণ তাদের কাছে পয়সা নেই। তারা গরিব। এতে করে সেই বুড়ো মানুষটি ইশারায় জানিয়েছিলেন, টাকা দিতে হবে না। তিনি ভালবেসে তাদের ওই ফলদুটো খেতে দিয়েছেন। রাজ্যের একজন সাধারণ প্রজার মনের এই উদারতা দেখে খুব সহজেই সে রাজ্যের আর্থসামাজিক রূপরেখার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। বুঝতে পারা যায়– সে রাজ্যের মানুষ এখনও ভালবাসতে জানে।
দু’খানা কাজকরা রুপোর থালায় করে এসে গিয়েছিল কাজু-কিশমিশ ছড়ানো পোলাও, যার একপাশে লেবু ও নুন। থালার চারপাশে গোল করে সাজিয়ে রাখা পাঁচটি রুপোর বাটিতে ছিল ফুলকপির কালিয়া, মাংস, মাছ, চাটনি আর বিরাট মাপের রাজভোগ। গুপী ওই খাবারগুলো দেখে যারপরনাই পুলকিত হয়েছিল। আর বাঘা, খেতে বসার আগে ছুটেছিল নদীর জলে হাতটা একটু ধুয়ে নেওয়ার জন্যে।
এবার এল হাল্লা রাজসভার একটি দৃশ্য। হাল্লারাজা যখন তাঁর সেনাপতিকে তলব করেছিলেন, তখন সেনাপতি, সেই রাজকার্যের সময়ও, রাজসভা লাগোয়া একটি ঘুপচি মতো জায়গায় বসে, বাটিতে করে কিছু একটা খাচ্ছিল। সেনাপতি মোটা-মানুষ। তাই সামনে ঝুঁকে পড়ে খাবার সময় পেটে যাতে চাপ না পড়ে, তাই তরোয়াল সমেত নিজের কোমরবন্ধ পাশে খুলে রেখেছিল। মন্ত্রীর চিৎকার শুনে সে যখন রাজর সামনে ছুটে এল, তখন তার মুখভর্তি খাবার আর কোমরবন্ধও ঠিকঠাক বাঁধা হয়নি। সেনাপতি ওটাকে এক হাত দিয়ে কোনওমতে ধরে। হাল্লারাজা তাকে দেখে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সে এত মোটা হয়ে যাচ্ছে কেন! কিন্তু মুখে খাবার থাকায় সেনাপতি উত্তর দিতে পারছিল না। তখন মন্ত্রীমশায় আগবাড়িয়ে জানিয়েছিলেন, সে নাকি বরাবরই অমন মোটা। অর্থাৎ সেনাপতি শুধু বসে থাকে আর খায়দায়। শারীরিক কসরত করা যে তার চাকরির একটা শর্ত– এটা সে প্রায় ভুলেই গেছে।
[the_ad id=”266919″]
এরপর একটি দৃশ্যে শুণ্ডিরাজার অতিথিশালায় আমরা গুপীকে প্রথমবার ঢুকতে দেখলাম। সেখানে একটি বড় রেকাবিতে অন্যান্য ফলের সঙ্গে আঙুরের থোকাও রাখা ছিল। তা দেখে গুপী অবাক হয়ে গিয়েছিল। গুপীর আঙুর খাওয়ার এমনই একটি দৃশ্য অবশ্য ‘হীরকরাজার দেশে’ ছায়াছবিতেও ছিল। সেটাও ছিল এই অতিথিশালাতেই। কিন্তু সেখানে গুপীর আঙুর খাবার স্টাইল এবং অ্যাপ্রোচ ছিল অন্য। আর আত্মবিশ্বাসও ছিল চোখে পড়ার মতো।
কথা বলতে বলতে উত্তেজিত মন্ত্রী, তাঁর হাতে থাকা দু’চারটে ফলের কোয়া, দু’দুবার নিজের সিংহাসনের পিছনে ছুড়েও ফেলেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, খাবারের অপচয় নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না– যেখানে তাঁর রাজ্যের বেশির ভাগ প্রজাই কিন্তু আধপেটা খেয়ে থাকে।
যাইহোক, এই ছায়াছবিতে সে অবাক হয়ে আঙুরের থোকাটা হাতে তুলে নিয়ে, তা থেকে একখানা আঙুর ছিঁড়ে মুখে দিয়েছিল এবং খুশি হয়ে উঠেছিল। সে বাঘাকে, সেই থোকা থেকে একখানা আঙুর খাবার জন্যে বলতে গিয়ে দেখেছিল,বাঘার খাটের পাশেও ঠিক একইরকম একটি রেকাবিতে, আঙুর সমেত নানারকমের ফল সাজিয়ে রাখা রয়েছে। বাঘা, ওই ঘরের মাঝখানে থাকা ফোয়ারাটির জলে প্রথমে হাত ধুয়ে, পরে কুলকুচি করে মুখও ধুয়েছিল। তারপর সেই ঘরের দু’জন পাংখাদারের একজনকে, তার জন্যে ভাল করে ‘তামুক’ সেজে আনতে বলেছিল। এরপর বাঘা, রেকাবিতে রাখা ফলগুলোর গন্ধ শুঁকে, কলার ফানা থেকে একটা পুরুষ্টু মর্তমান কলা ভেঙে নিয়েছিল। খাটে শুয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে, সেটার খোসা ছাড়িয়ে খেতে আরম্ভ করেছিল। কলাটা ছিঁড়ে নেওয়ার সময়, একটা আপেল রেকাবি থেকে মাটিতে পড়ে গেলে, বাঘা তখুনি সেটা আবার সেই পাত্রেই সাবধানে তুলে রাখে। মানে, সে অপচয় করতে ভালবাসে না। সে খাবারের মর্ম বোঝে। শুণ্ডির রাজা তাদের খোঁজখবর নিতে অতিথিশালায় চলে এলে, বাঘা সেই আধখাওয়া কলার টুকরোটি বেশ কিছুক্ষণ হাতের মধ্যে লুকিয়ে রেখে, শেষে তাঁর চোখ এড়িয়ে ফোয়ারার জলের মধ্যেই ফেলে দিয়েছিল।

এর কিছু পরের একটি দৃশ্যে হাল্লা রাজার রাজসভায়, খাজনা না-দিতে পারা প্রজাদের সঙ্গে গুপী-বাঘাকেও ধরে আনতে দেখা গিয়েছিল। লাইন করে দাঁড়িয়ে, জহ্লাদের হাতে গর্দান যাওয়ার কথা শুনে, গুপী-বাঘা তাদের গান-বাজনা শুরু করে কোনোমতে সেখান থেকে চম্পট দেয়। তারপর নির্জন একটি পুকুরের ধারে দু’জন তালি বাজিয়ে খাবার আনিয়ে খেতে বসে। শ্বেতপাথরের থালাবাটিতে করে খাবার এসেছিল। খাবার সময় তাদের তৃপ্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, খাবারগুলো অতি সুস্বাদু। দ্বিতীয়বার হাল্লা রাজার মন্ত্রীর সঙ্গে গুপ্তচরের মোলাকাতের দৃশ্যে, মন্ত্রী তাঁর সিংহাসনে বসে, দু’হাতে মাংসর বড় বড় ঝলসানো টুকরো ধরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিলেন। আর গায়ে বেশ কিছুটা করে মাংস লেগে থাকা হাড়ের টুকরোগুলোকে, ছুড়ে ছুড়ে ফেলছিলেন একটি ফেলনা-পাত্রে। মন্ত্রী গুপ্তচরকে বলেছিলেন, সে-ই রাতের মধ্যে গুপীবাঘাকে ধরে আনতে না পারলে, তার গর্দান যাবে। তখন গুপ্তচর, মন্ত্রীর হাতে ধরা মাংসের টুকরোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। জিগ্যেস করেছিল, আর যদি সে গুপীবাঘাকে ধরে আনতে পারে, তাহলে? মন্ত্রী প্রথমে ভেবেছিলেন, গুপ্তচর বুঝি বকশিসের লোভে এই কথা বলছে। তারপর তাচ্ছিল্য করে জিগ্যেস করেছিলেন, তার মাংস খাবার শখ হয়েছে কিনা! আর এতে, হাল্লার না-খেতে পাওয়া অধিকাংশ দরিদ্র প্রজাদের মতোই একজন গরিব মানুষ গুপ্তচর, মন্ত্রীকে জানিয়েছিল, সে বহুদিন মাংস খায়নি। কিন্তু মন্ত্রী তাকে, সবসময় খাই-খাই করার জন্যে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, আগে গুপী-বাঘাকে ধরে নিয়ে আসতে, তারপর খাওয়ার কথা হবে। আসলে সবসময় ‘খাই-খাই’ তো গুপ্তচর করত না। করতেন তিনিই। আর মন্ত্রীর মুখের এই নিষ্ঠুর এবং অমানবিক কথাগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল, দু’হাতে মাংস ধরে ছিঁড়ে খেতে খেতে তিনি এগুলো বলছিলেন বলে।
নির্জন একটি পুকুরের ধারে দু’জন তালি বাজিয়ে খাবার আনিয়ে খেতে বসে। শ্বেতপাথরের থালাবাটিতে করে খাবার এসেছিল। খাবার সময় তাদের তৃপ্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, খাবারগুলো অতি সুস্বাদু।
এই দৃশ্যেরই শেষে গুপী-বাঘা যখন মন্ত্রীর সিংহাসনের পিছনে ধরা পড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে পালিয়ে যেতে গেল, তখন মন্ত্রী, তাদের লক্ষ্য করে, নিজের হাতের আধ-খাওয়া মাংসের টুকরোটা জোরে ছুড়ে দিয়েছিলেন। আর সেটা সোজা গিয়ে লেগেছিল বাঘার ঢোলের চামড়ায়। লেগে, ঢং করে একটা আওয়াজও হয়েছিল। সেদিন হাল্লার মন্ত্রীর ঘর থেকে উধাও হওয়া গুপী-বাঘাকে, গভীর রাতে মাঠের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিল গুপ্তচর এবং তার দলবল। ওদের ওপর মাছ ধরার জাল ছুড়ে দিয়ে ধরে ফেলে পেয়াদারা। পেয়াদাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময়, গুপী-বাঘার পায়ের একপাটি করে জাদু-জুতো, সেই মাঠেই খুলে পড়ে গিয়েছিল। ফলে, ওরা হাতে-হাতে তালি-মেরে উধাও হয়ে যেতেও পারেনি। ওই মাঠেই পড়েছিল বাঘার প্রিয় ঢোল। ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে পেয়াদারা কয়েদ ঘরে বন্দি করে রেখেছিল। সেখানে হাল্লার মন্ত্রী ওদের দেখতে এসেছিলেন এবং মানুষে খাবার অযোগ্য লপ্সি জাতীয় যে খাদ্যটি বন্দিদের রোজ খেতে দেওয়া হয়, তা গুপীবাঘাকে খেতে বাধ্য করেছিলেন। সেই অখাদ্য খাবার মুখে তোলার আগে, বাঘা বেচারা নিজের অভ্যেস মতো, হাত ধোবার জন্যে একটু জল চেয়েছিল ওই মন্ত্রীর-ই কাছে। এতে মন্ত্রী, তাকে একটা রাম-দাবড়ানি দিয়েছিলেন।
[the_ad id=”270084″]
মন্ত্রী সেখান থেকে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই গুপী-বাঘা যখন সেই বন্ধ কয়েদখানার ভেতরে বসে, ভূতের রাজার বরে আনানো উপাদেয় সব খাবার খেতে শুরু করেছিল, তখন তার সুগন্ধে, কয়েদঘরের দরজায় বসে থাকা প্রহরীর ঘুম ভেঙে যায়। সে বসা অবস্থা থেকে বিস্ফারিত চোখে উঠে দাঁড়ায়। খাবারের লোভে, গরাদের দরজা দু’হাতে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে। যেহেতু প্রহরী কথা বলতে পারে না, তাই দুর্বোধ্য আওয়াজ করে গুপী-বাঘা কী কী খাবার খাচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করে। ওরা বাটি তুলে তুলে দেখায় এবং বলে, তাতে মাংস, পোনামাছ, ইলিশমাছ, পটলের দোরমা– এইসব রয়েছে। বাঘা তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে ওগুলো খেতে চায় কিনা। উত্তরে প্রহরী গরাদ ধরে লাফাতে আরম্ভ করে। তখন বাঘা তাকে কয়েদঘরের ভেতরে আসতে বলে। প্রহরী গারদের তালা খুলে পাগলের মতো খাবারগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে শুরু করে। আর গুপী-বাঘা গরাদের দরজা খোলা পেয়ে পালিয়ে যায়। বহুদিন ভাল খাবার পেট-ভরে না খেতে পাওয়া প্রহরীর এই যে পাগলপারা অভিব্যক্তি, চোখ বড় বড় হয়ে যাওয়া, মুখ হাঁ করে দুর্বোধ্য চিৎকার করা– এগুলো হাল্লার রাজকর্মচারীদের জীবনযাপনের মান বোঝাবার জন্যেও খুবই জরুরি ছিল।
হাল্লার না-খেতে পাওয়া অধিকাংশ দরিদ্র প্রজাদের মতোই একজন গরিব মানুষ গুপ্তচর, মন্ত্রীকে জানিয়েছিল, সে বহুদিন মাংস খায়নি। কিন্তু মন্ত্রী তাকে, সবসময় খাই-খাই করার জন্যে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, আগে গুপী-বাঘাকে ধরে নিয়ে আসতে, তারপর খাওয়ার কথা হবে। আসলে সবসময় ‘খাই-খাই’ তো গুপ্তচর করত না। করতেন তিনিই।
এর বিপরীতে সর্বক্ষণ খাবার খেতে থাকা মন্ত্রীর শান্ত এবং নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি আগাগোড়া এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে, সে রাজ্যে খাদ্য ছিল। কিন্তু তা সবার নাগালের মধ্যে ছিল না। মন্ত্রী ইচ্ছে করেই তাঁর অধীনে কাজ করা কর্মচারীদের বঞ্চিত করে, অভুক্ত রেখে, নিজে সর্বক্ষণ গান্ডেপিন্ডে গিলে চলতেন।

কয়েদখানা থেকে পালিয়ে গুপীবাঘা আগের রাতে পড়ে থাকা তাদের একপাটি করে জুতো আর ঢোলখানা সে-ই মাঠ থেকে উদ্ধার করে। তারপর তারা সেই প্রান্তরে যায়, যেখানে হাল্লারাজার সব সেনা যুদ্ধের জন্যে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে গিয়ে গুপী গান গাইতে আর বাঘা ঢোল বাজাতে শুরু করে। সেই গান-বাজনা শুনে পদাতিক এবং উটে-চড়া সমস্ত সৈন্যরা নিথর হয়ে যায়। নিথর হয়ে যান মন্ত্রীমশাই আর রাজবাড়ির বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ হাল্লারাজাও। নিজেদের গানের মধ্যে দিয়ে গুপীবাঘা, মণ্ডামিঠাই ভর্তি রাশি রাশি হাঁড়ি আকাশ থেকে নেমে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করে। আর সঙ্গে সঙ্গে মিহিদানা, পুলিপিঠে, জিবেগজা– এইসব সেরা সেরা মিষ্টিতে ভরা অজস্র হাঁড়ি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো নেমে আসতে শুরু করে সেই খোলা প্রান্তরে। হাঁড়িগুলো মাটির ওপর সুন্দরভাবে এসে এসে বসে পড়তে থাকে। একটুও ভাঙে না। পদাতিক সৈন্যরা সেইসব হাঁড়ির দিকে ছুটে যায়। উটের ওপর যারা বসেছিল, তারা উট থেকে নেমে ছুটতে শুরু করে মিষ্টির হাঁড়ি নেওয়ার জন্যে। বহুদিন ভাল করে না খেতে পাওয়া, রোগা, ক্ষয়াটে, শীর্ণ চেহারার সৈন্যরা, যে যেভাবে পারে একটা করে হাঁড়ি তুলে নিয়ে সেই অপূর্ব মিষ্টি খেতে শুরু করছিল। মন্ত্রীমশাই একটা হাঁড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সেটাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে, কোনওমতে একপাশে সরে যাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পাগলের মতো দৌড়তে থাকা সৈন্যদের পায়ের চাপে সেই হাঁড়িটাও ভেঙে চুরমার গিয়েছিল। যিনি চিরকাল নিজের প্রজাদের সুখাদ্য থেকে বঞ্চিত করে এসেছেন– তাঁর সাধের খাবারটুকুও প্রজাদের পায়ের চাপেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
[the_ad id=”270085″]
হাল্লারাজা, হৈ-হট্টগোলের আওয়াজ শুনে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে দৌড়তে দৌড়তে চলে এসেছিলেন বাইরে, যেখানে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে ছিল। গুপী-বাঘা তাঁকে দেখে, কাছে এগিয়ে গিয়ে, একটা মিষ্টির হাঁড়ি তাঁর হাতে তুলে দেয়। তিনি শিশুর মতো প্রথমে সেই হাঁড়ির গন্ধ শোঁকেন। তারপর তা থেকে মিষ্টি তুলে নিয়ে মুখে পোরেন। তখন গুপী-বাঘা, হাল্লারাজাকে দু’ধার থেকে জড়িয়ে ধরে, ‘শুণ্ডি’ বলে দু’হাতে তালি মারে এবং মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে নিয়ে শুণ্ডিরাজার সামনে পৌঁছে যায়। উপেন্দ্রকিশোর তাঁর ‘গুপীগাইন বাঘাবাইন’ গল্পে গুপীবাঘার খাবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘ভাজ্য, ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত’– এইভাবে সবকিছু লিখেছিলেন। সত্যজিতের ছবিতে ভিস্যুয়াল ডিটেলিং খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিল। আর এই কারণেই, এই ছায়াছবিটির নানান দৃশ্যে, খাওয়াদাওয়ার নানান অনুষঙ্গ, আমাদের মনের মধ্যে চিরকাল জ্বলজ্বল করতে থাকবে।
রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়, পড়াশুনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লেখালেখির শুরু নয়ের দশকে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে ছোটগল্প, কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিতার বইয়ের সংখ্যা দশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিরিশেরও বেশি বইয়ের। পেশায় চাকরিজীবী।
10 Responses
এই বিষয়টি নিয়ে পড়ে খুব ভালো লাগলো বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে সূক্ষ্ম জায়গা গুলো কত সুন্দর করে বললেন — বাটিটা সোজা করে রাখা, খাওয়ার ধরন… আপনার লেখা চলতে থাকুক 🙏
অনেক ধন্যবাদ সুকন্যা!
চমৎকার লেখা। আগে এতো ডিটেলসে কখনও ভাবিনি। আমাদের চোখ খুলে দিলেন।
আপনার ভালোলাগা আমার কাছে পুরস্কার পাওয়ার মতো!!! অনেক ভালোবাসা নেবেন দাদা!!
দেখার চোখ থাকলে কতভাবে যে দেখা যায়, আপনি তা দেখিয়ে দিলেন।
অনেক ধন্যবাদ!!!
আপনার ভালোলাগা আমার কাছে পুরস্কার পাওয়ার মতো!!! অনেক ভালোবাসা নেবেন দাদা!!
খাদ্যরসিকরাই এভাবে ভাবতে পারে— যথার্থ মূল্যায়ন।
ভালো লাগলো
Daarun laaglo pore. Ki ashadharon express korechhen !