অজান্তেই ঘুমটা ভেঙে গেল ইয়াসমিনের।
মুমতাজ ইয়াসমিন।
এখন অবশ্য বিয়ের পরে সবাই ওকে মুমতাজ বলেই ডাকে। তবুও এক কালের ইয়াসমিন ডাকটা সে ভুলতে পারে না। কী যেন একটা স্বপ্ন! পাশে স্বামী নিশ্চিন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বপ্নটাকে এক লহমায় উড়িয়ে দিয়ে ফের পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে মুমতাজ। কী যেন একটা মনের ভিতর খচখচ করছে। বেঙ্গালুরু শহরের বুকে তাদের সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট। জীবনযাপনকে আনন্দময় এবং আরামদায়ক করার মোটামুটি সব উপকরণই আজ মজুত ইয়াসমিনের বাসায়। শৌখিন ভাবে সাজানো স্নানঘর ইয়াসমিনের একান্তই নিজস্ব। বলা যায় একমাত্র জায়গা যেখানে সে মনের আয়নায় উঁকি মারতে পারে নিঃসংকোচে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে আনমনেই হাতটা চলে যায় তোয়ালের দিকে। হঠাৎ নিজের দিকে চোখ যেতেই, মনে এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে স্বপ্নটা মাথার ভিতর জানান দিয়ে যায়, “আমি আছি ………..আমরা আছি …….তোর খুব কাছাকাছি।”
চুম্বক
– মোহন ?
– ইয়েস স্যার ।
– মৃন্ময় দেবনাথ ….. ?
-আছি স্যার,
-মৃণালিনী বসু ?
– প্রেজেন্ট স্যার
-মুমতাজ ইয়াসমিন …?
-ইয়েস স্যার।
রোল কল শেষে ত্রিপাঠি স্যারের ফিজিওলজি ক্লাস। ফার্স্ট বেঞ্চ আঁকড়ে ধরার ইঁদুরদৌড়ে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু এই তিনজন কোনওমতেই নিজেদের দখল ছাড়তে রাজি নয়। শ্রীলা, প্রভা আর ইয়াসমিন। যেন তেন প্রকারেণ হোস্টেল থেকে এক দৌড়ে ছুটে আসা শুধুমাত্র, স্যারের সবচেয়ে কাছে বসে গোগ্রাসে ক্লাস করার জন্য। আবার অদ্ভুতভাবে তিনজনের মধ্যেই অলিখিত কম্পিটিশন, কে স্যারের সবচেয়ে পছন্দের ছাত্রী হতে পারে।
তিনজনেই ডাক্তারি পড়ে। সুশ্রুতপুর মেডিকেল কলেজ। ২:১ অনুপাতে পুরুষ এবং স্ত্রী। হাহুতাশ এবং হাজার মহিলা সংরক্ষন করেও এর প্রতিকার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যাই হোক তাতে ভারী বয়েই গেছে। অনেক বন্ধুদের মাঝে এই তিনজন একটু অন্যরকম। তিনজন সেই প্রথম দিন থেকেই অজানা জটে জড়িয়ে আজ আত্মার আত্মীয়, পরম বন্ধু। তিনজনেরই হঠাৎ করে দামাল ইচ্ছে হয় বৃষ্টিতে চুপচুপে ভিজে আইসক্রিম খেতে, মাঝরাতে হোস্টেলের মাঠে ঘুরঘুর করতে কিংবা দশ আঙুলের নখ দশরঙে রঙিন করে সারারাত জেগে গল্প, মায় কোনও অকালপক্ক শভিনিস্ট ছেলের মস্তিস্কচর্বন করতে।
তিনজনের মধ্যে প্রভা থাকে বেশ দূরে। ছোটখাটো ছুটিতে তাই সে হোস্টেলেই থাকে। এদিকে তার টানে ব্যাকুল বাকি দু’জন কাছে থাকা সত্ত্বেও বাড়ি যেতে বিশেষ আগ্রহী হয় না। দেখতে দেখতে একে একে দিন কাটে। কাটে মাস, বছর। তিনজনেই থার্ড ইয়ারে। এই সময়টাকে ডাক্তারি পড়া ছাত্রছাত্রীরা হনিমুন পিরিয়ড বলে। মধুচন্দ্রিমাই বটে। কারণ শেষ দু’টো বছর বিবিধ বিষয়ের চাপে ঘাড় যখন নুয়ে পড়ছে তখন এই থার্ড ইয়ার, শুধুমাত্র ইএনটি.,অপথালমোলজি এবং কমিউনিটি মেডিসিন। ফলে তিনজনেরই প্ল্যান ছিল এবার তারা কোথাও ঘুরে আসবে। একদম নিজেরাই।
এমন সময় এক সুন্দর রোদ্দুর ধোওয়া সকালে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত শ্রীলা আর প্রভা জানতে পারে যে ইয়াসমিনের বিয়ে।
– তোর কি মাথা খারাপ? চেঁচিয়ে ওঠে শ্রী ,
– এটা একটা বিয়ে করবার সময়? সামনে পরীক্ষা! তাছাড়া ফাইনাল ইয়ার বাকি! তারপরে পড়াশুনো আছে! তুই একটা ……যাতা !
শ্রী-র ধৈর্য্য কম। সে কথা শোনার আগেই ,রাগে নিজের মনে গজগজ করতে থাকে। ইয়াসমিনের কপালে ভাঁজ ,মুখ ভার, সে বলে উঠল
– আমি কী করব বল। আব্বা আম্মা ছেলে দেখেছেন। তাঁদের পছন্দও হয়েছে। সকালে আমাকে আম্মা বললেন। আমি বললাম সামনে পরীক্ষা। ওঁরা কিচ্ছু শুনতে রাজি নন। বললেন সামনের মাসেই একটা ভালো দিন দেখে …..
প্রভা আর থাকতে না পেরে বলল, ‘আমরা একবার কথা বলব কাকু কাকিমার সঙ্গে?’
– ভালো ঘর-পরিবার। ছেলে ডাক্তার। বিয়ের পর পড়াশুনো করতে দেবে বলেছে। এতকিছুর পরেও ইয়াসমিনের বিয়েতে আপত্তি থাকার কি কোনও কারণ থাকা উচিত? আর তোমরা তো ওর বন্ধু! তোমাদের তো উল্টে খুশি হওয়া উচিত! না না, এই ছেলের সঙ্গেই আমার মেয়ের বিয়ে হবে।
মুখের ওপর ফোনটা রেখে দিয়েছিলেন বিরক্ত ইয়াসমিনের বাবা। প্রভা বলেছিল, “তোর কী ইচ্ছে সত্যি করে বল তো?” ইয়াসমিন তখন কি যেন একটা ভাবছিল। প্রভার প্রশ্ন, বাবার বিরক্তি, শ্রীর রাগ, এবং তার নিজের অসহায়তা, সব ছাপিয়ে তার বুকের একচিলতে কোণে ভেসে উঠেছিল একটা নাম ……ইমরান। না না। এই দুর্বলতাকে সে কোনওদিনই প্রশ্রয় দেয়নি। কিন্তু কী যে হয়েছে গত একমাস ধরে… যবে থেকে ক্লিনিকাল পোস্টিং শুরু হয়েছে মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে।
ইমরান ওদের থেকে তিন বছরের সিনিয়র। এখন মেডিসিনের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্র। থার্ড ইয়ারের ইয়াসমিনদের ব্যাচের ক্লাস নেবার দায়িত্ব ছিল তার। অনাবিল হাসি আর সহজ মন অনেকের মতো মুগ্ধ করেছিল ইয়াসমিনকেও। এই মুগ্ধতা কখন যে ভালোলাগায় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে, সে নিজেও টের পায়নি। ইমরান খুব সুপুরুষ না হলেও, অফুরান জীবনীশক্তি তার মধ্যে। অক্লান্ত পরিশ্রমে ব্যাচের পর ব্যাচ ক্লাস নিতে পারে অনায়াসে। খুব স্বাভাবিক কারণেই কলেজের সবার পছন্দের। শুধু একটা কথাই ইয়াসমিনের মনের ভিতর অস্বস্তি আনে বারবার। কানাঘুষোয় সে জানতে পেরেছে যে ইমরানের সুরাপানে আসক্তি বেশ ভালো রকম। দিনের বেলা কলেজে বা হসপিটালে দেখে অবশ্য বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই। কিন্তু নিজের মনের এই দুর্বলতার কথা হাজার চেষ্টা করেও তার সবচেয়ে প্রিয় দুই সখিকে বলে উঠতে পারেনি ইয়াসমিন। অথচ প্রভা যেন অন্তর্যামী হয়ে মনের গোপন অতল গভীরে রাখা সিন্দুক ভেঙে টের পেয়ে গেছে! সে তাকিয়ে আছে ইয়াসমিনের দিকে একদৃষ্টে, ‘কী হল তোর? শুনতে পেলি কী বললাম? ‘
শ্রী রেগে কাঁই। “ও তোর কথা শুনবে কেন? ও তো বিয়ের আনন্দে লাফাচ্ছে! আর ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমরা যে কত একা হয়ে যাব তাতে ওর কী? আমাদের একসঙ্গে বেড়ানোর প্ল্যানটাও ভন্ডুল করে দিল!“ হঠাৎ করে তিনজনের একসঙ্গেই মনে পড়ে গেল, সত্যি তো! তাহলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া আর হলো না! সেদিন মাঝরাতে প্রভা আর ইয়াসমিনের মাঝে কী কথা হয়েছিল কেউ জানে না। কিন্তু ঘরের ভিতর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ বাইরের কেউ টের পায়নি।
ঠিক পরের মাসে ধুমধাম করে ইয়াসমিনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সেই ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে। ইমরান কোনওদিন জানতেও পারেনি যে তার জন্যে মনে এত আগুন নিয়ে একটি মেয়ে আরেকজনের ঘরের প্রদীপ জ্বালাতে যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই বাকি বছরটা ইয়াসমিন এক কলেজে থাকলেও তিনজনের খুব একটা দেখা হয়ে ওঠেনি। হোস্টেলেও আর থাকা হয়ে ওঠেনি ইয়াসমিনের। প্রতিনিয়ত স্বামীসেবা আর ঘরকন্না বাদ দিয়ে নিজের জন্যে বাঁচা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে ।
হঠাৎ আজকের এই স্বপ্ন! নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে ইয়াসমিন। সময় বেশ কয়েক বছর শরীরের বয়স বাড়িয়ে দিলেও, মনটা আজও সেই হোস্টেলে ফেলে আসা ইয়াসমিনেরই। ইমরান আজ কোথায় সে জানে না। প্রভা আর শ্রীলার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সাংসারিক প্রয়োজনে এবং স্বামী পছন্দ করেন না বলে সে আজ ডাক্তারি করে না। কিছু বন্ধুদের মুখে খবর পেয়েছিল যে প্রভার বিয়ে হয়ে গেছে। সাংসারিক জীবনে সে ব্যস্ত গৃহিণী। শ্রীলা বিয়ে করেনি। একটি মেয়ে দত্তক নিয়ে সে খুশি। বসার ঘরের জানলা দিয়ে পূব আকাশের ভোরের আলো তার ঘরের সোফা কুশন আলতো ছুঁয়ে ভোর জানান দিচ্ছে। অনেকদিন পর ইয়াসমিন আনমনে আড়মোড়া ভেঙে চায়ের জোগাড় করতে পা বাড়াল।
এমন সময় ক্রিং ক্রিং! অসময়ে ফোনটা বাজতে চিন্তার জাল গুটিয়ে ফোনটা ধরল সে।’ আচ্ছা নমস্কার। এখানে কি ডক্টর মুমতাজ ইয়াসমিন থাকেন?’ বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে তার। এ সম্বোধন পায়নি সে বহুদিন।
– হ্যাঁ বলছি। কে বলছেন?
ওপার থেকে দশ সেকেন্ড কোনও উত্তর আসে না। তারপর তারস্বরে “আরে গাধা তোর বাবা বলছি রে! এই মানে থুড়ি মা ……..আমি রে, শ্রীলা। কী ভেবেছিলিস? মরে গেছি? মরে গেলেও তোকে কোনওমতেই ছাড়ব না রে। এই নে ধর আরেকটা শক খা।’
কিছু বোঝার আগেই ওপার থেকে গলা ভেসে এল। “আমি প্রভা। আমরা বেঙ্গালুরু এসেছি। এবারের ব্যাচ মিট এখানে। তোকে ছাড়ছি না। তোর আব্বা-আম্মার কাছে তোর ঠিকানা পেলাম। রেডি থাক, আজ দেখা হচ্ছে। আর বর বারণ করলে জোলাব খাইয়ে দে।’ ওপার থেকে আবার হাসির হুল্লোর ভেসে এল। ‘আচ্ছা এবার রাখলাম দেখা হচ্ছে টাটা।’
এক হাতে ফোন ধরে মাটিতে বসে পড়ল ইয়াসমিন। তাহলে কি একেই বলে টেলিপ্যাথি?
প্রপা দে গঙ্গোপাধ্যায় পেশায় ডাক্তার, নেশায় কবি-গদ্যকার-লিমেরিকার। কবি ও কবিতার পরিমন্ডলে বড় হয়ে ওঠা প্রপার লেখা শুরু কবিতার হাত ধরে। এক অন্য ধরনের শৈলী-বর্ণ-ছন্দ-ভাবনা নিয়ে পথ চলার সূচনা মায়ের আঙুল ধরে। মা প্রখ্যাত কবি চিণ্ময়ী দে। সমাজ ও সময়, কলম, ষড়রিপু আর মনস্তত্ত্ব নিয়ে জাগলিং করার সাহচর্য ও সাহস যুগিয়েছে। মোদ্দা কথা হল, ইনি জাতে কলমচি তালে ডাক্তার। বোহেমিয়ান, ব্রাউনিয়ান প্রপার বিচরণ সাহিত্যের অন্দরে, বন্দরে।