প্যানডেমিকের আতঙ্কে ইস্কুল সব বন্ধ, ছেলেমেয়েরা অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এমনকী পড়াশোনাও তাতে নাকি ভালোই এগচ্ছে। শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। আরে, ইশকুল কি শুধু পড়াশোনার জায়গা? অনলাইনে তো খালি শিক্ষক পড়াবেন, প্রশ্ন ধরবেন, আর খাতা দেখে ফেরত পাঠাবেন। বাচ্চারা গল্প করবে কার সঙ্গে? যেসব ক্লাস একদম ভালো লাগছে না, সেইসব ক্লাসের রাগ করবে কার কাছে? খাতার পেছনের পাতায় পাশের বন্ধুর সঙ্গে না খেলে তাদের চলবে কী করে? সবচেয়ে বড় কথা, টিফিন ভাগ করে খাবার মজাটা তো পুরো লোপাট হয়ে গেল!!!
এ কথা তো সকলেই জানে, যে নিজের টিফিনের থেকে বন্ধুর বাক্সের টিফিন সবসময়ই অধিক লোভনীয়। তার একটা কারণ নিশ্চয়ই অজানার চমক! নিজের বাক্সটিতে কী আছে তা তো মোটামুটি জানা, অনেক সময় সামনেই কেনা হয়েছে বা বানানো হয়েছে। বন্ধুর মা সকালে উঠে কী তৈরি করেছেন তা তো আর জানা নেই। তাই হয়তো বাড়তি একটা আনন্দ জুটে যায়!
শিবপুর ভবানী বালিকা বিদ্যালয়ে আমার গলায় গলায় বন্ধুত্ব ছিল মণিদীপার সঙ্গে। দু’জনের গল্প আর শেষই হত না। ক্লাসে পাশাপাশি বসার প্রচেষ্টা সর্বদা সার্থক হত না। ওই দুই মাথা এক করে ফিসফিস, গুজগুজ বন্ধ করার জন্য দিদিমণিরা দু’জনকে আলাদা করে বসিয়ে দিতেন। অগত্যা টিফিন পিরিয়ডে স্কুলকম্পাউন্ডের বাঁধানো বট বা জামরুল গাছের তলায় অথবা খেলার মাঠের ধারে বেঞ্চিতে বসে আড্ডা জমত। সেইসঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাওয়াটাও ছিল একটা দারুণ মজার ব্যাপার।
মণিদীপা আমার টিফিন খেয়ে কত আনন্দ পেত জানি না, আমার ফুর্তির অন্ত থাকত না। কারণ আমার মায়ের ছিল ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ভাল রাখার প্রবল বাতিক। শুধু মা কেন, আমার মামারাও স্বাস্থ্যসচেতন ডায়েট নিয়ে অবিরাম আলোচনা করে বিমল আনন্দ পেতেন। কোনও নতুন রান্না, বা নতুন কোনও প্যাকেটজাত খাদ্য গোচরে এলেই সেইসব খাবার কতদূর স্বাস্থ্যসম্মত, তা নিয়ে রীতিমতো পারিবারিক গবেষণা চলত। এর ফলাফল আমার পক্ষে অন্তত মর্মান্তিক হয়েছিল।

আমার ভাইয়ের কথা আলাদা। সে অত্যন্ত বাধ্য ছেলে। সোনামুখ করে দুধ-পাঁউরুটির মতো অখাদ্যও গলাধঃকরণ করে নিত। মা আমাদের টিফিনবাক্সতে মাখন-পাঁউরুটি, সন্দেশ এবং মাঝে মাঝে ডিমসেদ্ধ আর ছানা দিতেই পছন্দ করতেন। কে না জানে ওইসব খাদ্যের পুষ্টিগুণ অসাধারণ। কিন্তু দিনের পর দিন খেলে এদের তুষ্টিগুণ লোপ পায়। মা মাঝে মাঝে ফলমূল দিয়ে নতুনত্ব সঞ্চার করতেন বটে, কিন্তু সে অভিজ্ঞতাও বিশেষ সুখকর হত না। সকালে কাটা অর্ধশুষ্ক শশা, আপেল, নাসপাতি, পেয়ারা আর আঙুর কত আর সুস্বাদু হবে? বাক্স খুলে ফল দেখলেই আমার কান্না পেত।
অন্যদিকে মণিদীপার মা পুষ্টি ফুষ্টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। ওর টিফিনবাক্স খুললেই লুচি, মশলাদার আলুরদম বা কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে আলুচচ্চড়ি, বাড়িতে বানানো জিবেগজা, ডিম-পাঁউরুটির ফ্রেঞ্চটোস্ট, ঝালঝাল আলুকাবলি, নিদেনপক্ষে পরোটা আর গুড়ের দেখা মিলতই। তখন কি জানি, মণিদীপার মা একটি মর্নিংস্কুলে চাকরি করতেন বলে ভোরেই বেরিয়ে যেতেন। ওইসব টিফিন মণিদীপারা বাড়ির বামুনদিদিকে ইচ্ছেমতো অর্ডার করে বানিয়ে আনত।
এরপরও মণিদীপার হাতে আবার চার আনা, আট আনা থাকত। ওর দাদামশায় সেই জোগান দিতেন। আর আমার এমন বিশ্রী কপাল, যে হাতে পয়সা দেওয়ার ব্যাপারে মা আর বাবা একেবারে পারিবারিক ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, হাতে পয়সা দেওয়া মানেই বখে যাবার পথ প্রশস্ত করা। মাঝেমাঝে পিসিমণি এসে অবশ্য হাতে দু’ একটাকা গুঁজে দিতেন… সে তো সেই যুগে বাদশাহী ঐশ্বর্য।

কিন্তু মণিদীপার খুচরোর জোগান নিরবচ্ছিন্ন ছিল। তাই টিফিন শেষ করে আমরা গেটের বাইরে তেঁতুলের আচার, হজমিগুলি, কাঠি আইস্ক্রিম, কাঠি আলুরদম, ঘুগনি, ঝালমুড়ি, ইত্যাদি দেবভোগ্য উপাদেয় খাদ্যের রসগ্রহণ করে অনেকসময় ঝালের চোটে উহ্ আহ্ করতে করতে ক্লাসরুমের দিকে দৌড় দিতাম। দেরি হলে আর উপায় নেই। কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড়াতে হবে।
বেশ মনে আছে, সেটা শীতকাল। আমার টিফিনবাক্সে মাখন-পাঁউরুটির সঙ্গে গাজর, বিট ও মটরশুঁটি সেদ্ধ দেখে ভদ্রতার তোয়াক্কা না-করে মণিদীপা মুখ বেঁকাল। অর্থাৎ অত্যন্ত পুষ্টিকর ওই ব্যাপারটা সে খেতে চায় না। বদলে সে প্রবল প্রত্যয়ে জানাল আগামীকাল সে কড়াইশুঁটির কচুরি আর শুকনো আলুরদম আনবেই আনবে।
– সকালে উঠে অতসব তোর মা রান্না করবেন?
– তুই দ্যাখ না শুধু। কাল টিফিন পেলেই তো হল?
তা আর বলতে! পরদিন আমার রীতিমতো উত্তেজনা হচ্ছিল। আড়চোখে দেখলাম মা তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে বিস্কুটে জেলি মাখিয়ে টিফিনবাক্সে ভরছেন। অন্য অনেককিছুর মতো এটিও আমার ঘোর অপছন্দের খাবার। যাই হোক, মনে মনে ঠিক করলাম বিস্কুটগুলো আজ স্কুলের গাবদাগোবদা নেড়িকুকুর কেল্টি আর লালুকে দিয়ে দেব, সে যতই পাপ হোক। কড়াইশুঁটির কচুরি ক’খানা মণিদীপার টিফিনবাক্সে ধরবে মনে মনে হিসেবও করে নিচ্ছিলাম।

সেদিন যথারীতি পাশাপাশি বসার সুযোগ হয়নি। অঙ্কের ক্লাসে চূড়ান্ত অপদার্থ হিসেবে আমাকে আবার এগিয়ে এনে ধীরাদি ফার্স্টবেঞ্চিতে বসালেন। একঝলক তাকিয়ে মনে হল মণিদীপার মুখখানা শুকনো দেখাচ্ছে। তবে কি…? তবে কি…? যাই হোক, আর দুটো পিরিয়ডের পরেই টিফিনের ঘণ্টা বাজল। বটগাছতলায় বসে দুজনেই বাক্স খুললাম। এ কী বিস্ময়! এ কী দুর্যোগ! মণিদীপার বাক্সে মাখন-পাঁউরুটি, সন্দেশ আর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একটা আধখানা চটকে যাওয়া কলা! মণিদীপার সেদিনের হাসিটা আমার অনেক পরে মনে হয়েছিল, যাকে বলে ‘ক্যাথারটিক’।
– ধরা পড়ে গেলুম রে…।
পাঁউরুটি আর বিস্কুট চিবোতে চিবোতে জানলুম বামুনদিদি কীভাবে মণিদীপার মায়ের কাছে সব ফাঁস করে দিয়েছেন। হয়তো নিত্যদিন আবদার মেটাতে মেটাতে মহিলা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। পরম সমব্যথায় একাত্ম হয়ে আমি আর মণিদীপা টিফিনের পরের পিরিয়ডটাও বটতলাতেই বসে রইলাম। ফলও মিলল হাতেনাতে।

নন্দিতা দিদিমণি জগাইমাধাইয়ের মতো দু’জনকে বসে থাকতে দেখে মধুর বচনে আপ্যায়িত করে পরের পিরিয়ডটা ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। পরদিন থেকে আমার আর মণিদীপার টিফিনবাক্স প্রায় ‘আইডেন্টিক্যাল টুইনের’ চেহারা ধরল।
ক্লাস সেভেনে ওঠার পর আমরা শিবপুর ছেড়ে যাদবপুরে চলে এলাম। মণিদীপার সঙ্গে আর কোনওদিন আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ইস্কুলের বাচ্চাদের টিফিন ভাগ করে খেতে দেখলে আজও বটতলায় বসে সেই একসঙ্গে গুড়-পরোটা খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। সত্যি বলছি, নাকে আজও টাটকা গুড়ের সুগন্ধ পাই!
*ছবি সৌজন্য: Youtube, Tagbangla, Cookpad, Zeenews
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।