ওর সঙ্গে প্রথম দেখা শেষ বিকেলে। রোজ দুবার সে আসত। তার আঁধার আঁধার ডানা মেলে টুপ করে এসে বসত বুড়ি পাথরটার ওপর। সেই বুড়ি পাথরটা, যে তার নাতিপুতি পাথরগুলোকে আগলে রাখত, যাতে তারা জলে ভেসে অনেক দূরে চলে না যায়। ওরা ছোট বলেই নদীর জল কখনও ওদের ডুবিয়ে দিত, নয়তো ঢেউয়ের দোলায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইত অনেক দূরে। অর্ধেক জলে ডুবে থেকে সেই প্রাচীনা পাথর সব কিছু নজর করত। আর ওর ওই ভাসানো মাথার ওপর পাখিটা এসে বসত সকাল বিকেল। চলে যাওয়ার আগে নদীর পাশে একটা বাঁশের মাথায় ক্ষণিক থেমে বিদায় নিত।
পাখিটা যেই জলের মধ্যে ঠোঁট ডোবাতো, অমনি জলে-পাথরে বেজে উঠত গান। যেন থেমে ছিল, ঘুমিয়েছিল সকলে। পাশে থাকা গাছগুলো পাতা ঝরিয়ে দিত সে আনন্দ কলতানে। সকালবেলায় পাখিটার ঠোঁটের ছোঁয়ায় ওদের সবার ঘুম ভাঙত। ও সঙ্গে করে আনত দিনের প্রথম আলো। তারপর সারাদিনের মতো চলে যেত নিজের কাজে।
আবার ফিরে আসত আলো নিভে আসা বিকেলে। তখন ওর খেলা থামত সাঁঝের আঁধার ঘন হলে। আর সে চলে গেলেই ওই জল, হাওয়া, গাছ, পাথর সব যেন তলিয়ে যেত ঘুমের দেশে। পাখিটা অন্ধকারকে ডানায় নিয়ে চলে যেত, পরদিন ভোরে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

এই খেলাই দেখলাম তিনদিন ধরে। নাম বলেছিল পাখিটার। সে নাম মনে নেই। ও যেন সুখ জাগানিয়া। নদীর নাম ‘চুমাং খোলা’।
এই জায়গাটার খোঁজ দিয়েছিল এমন একজন, যার কাছে এই অঞ্চল ভ্রমণ-যোগ্যতার ম্যাপকাঠি ছুঁতে পারেনি। বলেছিলেন— “গিয়ে দেখতে পারো, মানুষজন কেউ নেই, বিলকুল ফাঁকা, আমার শুনেই ভালো লাগেনি।”
মন বলেছিল, ভালো লাগবে… লাগবেই। তাই মাদারিহাট, চিলাপাতার জঙ্গল দেখার শেষে তিন দিন রেখেছিলাম এই জনহীন প্রান্তর টোডের জন্যে।
চিলাপাতার জঙ্গল থেকে যে গাড়ি নিয়ে এলো, তার চালক ও চালকের সঙ্গী টোডের নাম শোনেনি। নতুন জায়গা দেখার আগ্রহে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছে।

গাড়ি যত এগোয়, পথ ততই বন্ধুর হয়। নতুন পাওয়া দুই ভাইয়ের উদ্বেগ ততই বাড়ে প্রৌঢ়া দুই দিদির জন্যে।
“দিদি, থাকার জায়গা ঠিকঠাক আছে তো? কথাবার্তা ঠিক মতো বলে নিয়েছেন তো?”
“হ্যাঁ ভাই, সব বলা আছে।”
তবু তাদের চিন্তা দূর হয় না।
এই যে গলে পচে অধঃপাতে যাওয়া আমার দেশ, সর্বত্রই দেখলাম এমন মানুষদের। যারা চেনা শোনা জানার ধার না ধেরেই সাহায্যের হাত বাড়ায়, চিন্তায় ব্যাকুল হয়। সে জন্যই ভালোবাসাটা রয়ে যায় বুকের মধ্যে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য।
মুঠোভাষে সারথি প্রশান্ত ভাই কথা বলে নিয়েছিল হোমস্টের উইলিয়ামের সঙ্গে। সে দাঁড়িয়েছিল এক পথের মোড়ে, যে রাস্তার পরে গাড়ি আর চলবে না। পির ব্যাগ নিয়ে চলতে পারলেও উইলিয়াম আর তার ভাই উইলফেট সে সুযোগ দিল না।
হাঁটা পথ গ্রামের মধ্যে দিয়ে। পাথুরে পথ চলতে চলতে গেরস্ত বাড়ির উঠোন, গোয়াল, রান্নাঘর, পাইপের টুপিয়ে পড়া জলের নীচে রাখা বাসন ডিঙিয়ে, ধুতরো ফুলের গাছে দোল খাওয়া শিশুর জুতোর দোল দেখিয়ে এনে ফেলল খিল খিল করে বয়ে চলা এক নদীর পাশে।
গ্রামের নাম ডোনাথাং। নদীকে পাশে রেখে আরো খানিক এগিয়ে যেখানে এসে ছয়জন মানুষ থামলাম, সেই জায়গায় নামই ‘টোডে’। আসলে ওই জায়গার নাম হওয়ার ছিল নিভৃতি।

আমাদের বসতে বলে দুই ভাই ঢুকে গেল তাদের পাকশালায়। দেখতে লাগলাম। চোখ, মন ভিজতে লাগল, ডুবতে লাগল, চারিদিক থেকে ভেসে আসা আনন্দ গানের সুরে। সামনে চোখ মেললে দূরে বহু দূরে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় সারি। বাঁদিকে তুলনামূলক নিকট দূরের পাহাড়েরা ভুটানের। সে পাহাড়ের গায়ে হলুদ ফুলের জলসা। তার পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে চুমাং নদী। সেই পাহাড় আর নদী-ঘেরা বিপুল সবুজ বিস্তারের মাঝে কয়েকটা তাঁবু বিছানো। ইচ্ছে হলে এখানেও হতে পারে রাত্রিবাস। তলিয়ে গেলাম। ঘোর ঘোর আচ্ছন্নতার থেকে ফিরে এলাম উইলিয়ামের ডাকে।
ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ গন্ধ বিলাচ্ছে। কফির স্বাদে জিভ জুড়ালো। কফি পানান্তে এবার থাকার জায়গা দেখতে যাওয়া।
রান্নাঘরের পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে এক নালা। সেই নালাকে পাশে নিয়ে হেঁটে, বাঁশের সাঁকো ডিঙিয়ে এসে পড়লাম যেখানে, সেখানেই থাকার ঘর। ত্রিভুজাকৃতি ঘর। প্রথম দেখায় সে ঘর সকলের মন মজাবেই।
ঘরের পিছনে ঘন জঙ্গল। সামনে বয়ে চলেছে নদী। শিহরিত হচ্ছিলাম। পৌঁছাতে আসা দুই ভাই নিশ্চিন্ত মনে ফেরত গেল। পাহাড়, জঙ্গল, নদী থাকলেও দিদিরা জলে পড়েনি।

বসেই রইলাম। এমনটাই যেন শেখালো সবাই মিলে। এখানে কথা বলতে নেই— এই গাছের পাতার, বুনো ফুলের, শুকনো ডালের, পাথরের, জলের, বাতাসের, মেঘের অংশ হতে হয়। মিশে থাকতে হয় তাদের সঙ্গে নিশ্চুপ হয়ে। তবেই ওদের কথা শোনা যায়। বোঝা যায়। সেই ভাষা বোঝার চেষ্টায় যখন মন একাগ্র, তখনই কোথা থেকে এক পশলা বাতাসের মতো ভেসে এল সেই পাখি, দিনের আলো নিভে যাওয়ার সংকেত ঠোঁটে নিয়ে।
নভেম্বর মাস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা ঘিরে ধরতেই ঘরে ঢুকতে হল। তিন বাহুর ঘরের আট বাহু দরজা এবং ছয় বাহুর জানালা, সিমেন্টের খাট।
সন্ধের টুকিটাকি, রাতের রুটি ইত্যাদি ঘরে পৌঁছে দিয়ে দুই ভাই গ্রামে চলে গেল। আবার ওরা আসবে কাল সকালে। আমরা দুই প্রাণী রয়ে গেলাম। ঘটনাক্রমে চুমাং রিভার নেস্ট হোমস্টেটিতে সেদিন আর কোনও সদস্য ছিল না।
রাত ঘনালো। ঠান্ডা হাড় কাঁপালো। সে কাঁপন উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে এলাম চাঁদের আশায়— পূর্ণিমা যে। কিন্তু আকাশ কালোয় কালো। তবু আশা ছাড়ি না। ঘরবার করতে করতে একসময় রাত যখন আরও গভীর হল, মেঘের বাঁধন টুটে জোছনা ঝরল মাটিতে। যেন বলে গেল প্রতিটা জীবনই এমন। আলো–আঁধার, ভালো-মন্দ, সহজ-কঠিন, দ্বন্দ্ব আর ছন্দের খেলা। হালটা শক্ত করে ধরে থাকলে ইতির দেখা মেলে। নয়তো নেতির কাঁদনে জীবন পানসে হয়ে ওঠে।

রাত ফুরোলো। ঘুম জড়ানো চোখে বাইরে বেরিয়ে দেখি নদী, নদীর জল, পাথর, গাছ, পাতা, জলে ডোবা গাছের শিকড় সব আড়মোড়া ভাঙছে। তাদের সারা গায়ে তখনও ঘুমের কাঁথা জড়ানো। কারুর ডাকের অপেক্ষায় তাদের জেগে ওঠা থমকে আছে যেন!
সে এল। সেই পাখি। ডানায় করে নিয়ে এল দিনকে। ঠোঁট ডোবাল জলে। কলকলিয়ে উঠল নদীর জল। ফিসফিসিয়ে উঠল গাছের পাতা। শুরু হল পাথরের রুনুঝুনু নূপুর ধ্বনি।
আরও একটা নতুন দিন। আজও টোডের সঙ্গে দিনযাপন। কিন্তু আর কিছু লেখার নেই ওর বিষয়। নদী, পাহাড়, জঙ্গল, পাখি, কীটপতঙ্গ সবকিছু নিয়ে টোডে দাঁড়িয়ে আছে বুকে ভালো রাখার মন্ত্র নিয়ে। তবে সবার কাছে সে ধরা দেয় না।
আসলে এক নিভৃত–নির্জন অনুভবের, উপলব্ধির নাম টোডে।
থাকার জায়গা: চুমাং রিভার নেস্ট।
যোগাযোগ- ৯০৫১৭৯৯৯৩৬, ৯০৬২৫১৭৫১৮।
স্টেশন– নিউ মাল জংশন।
মালবাজার থেকে দূরত্ব ৭৫ কিমি।
ছবি সৌজন্য: লেখক
স্বাতি নন্দী পেশায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে, মানুষ দেখতে। ট্রাভেলস্ রাইটার্স ফোরামের সদস্য।
2 Responses
খুউউব ভাল লাগল। অন্যরকম ভ্রমণ, অনন্য স্বাদের লেখা।
ডুবলাম, ভাসলাম এ ভ্রমণ কথায়।