ই সন্তোষ কুমারের গল্পের অনুবাদ করেছেন এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার তৃষ্ণা বসাক। মৈথিলী, হিন্দি ও মালয়ালম অনুবাদকর্মে তিনি প্রতিমুহূর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ, উপদেষ্টা বৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপনা, সাহিত্য অকাদেমিতে আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান প্রকল্পের দায়িত্বভার- প্রভৃতি বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীকে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। বর্তমানে তিনি কলকাতা ট্রান্সলেটরর্স ফোরামের সচিব।
‘জেমস, আমি আগে এখানে এসেছি। এখানে, এই রেলিংগুলো ধরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম’ কমলা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ঝুলন্ত ব্রিজের রেলিংগুলো শক্ত করে আঁকড়িয়ে, জলের কলকল আওয়াজ শুনতে শুনতে।
‘যাত্রা শুরুর সময় তুমি বলেছিলে এটা’ জেমস হেসে বলল।
‘ও, তাই? কিন্তু সত্যি, ঠিক এই জায়গাটাই। ঠিক এই জায়গাটাই। জাস্ট একটা ছোঁয়া, ব্যস সব মনে পড়ে যাবে। এটাই আশ্চর্য।’
‘সত্যি!’
‘হ্যাঁ জেমস। কিন্তু সেইসময় অনেক বেশি জল ছিল। দূর থেকেই শব্দ শোনা যেত। আমরা ঠিক বর্ষার পরেই এসেছিলাম। সেসময়ে আমরা ব্যঙ্গালোর থাকতাম, জানো। কেন, আমি যা বলছি, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘ওহ, এটা আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয় কমলা। তুমি অন্তত পাঁচ বছর আগে এসেছিলে, তাই না? তাহলে তুমি কী করে এত জোর দিয়ে বলতে পারো, তুমি ঠিক এই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে ছিলে?’
‘আমি পারি জেমস। আমি কিছু জিনিস দেখতে পাই, যা তুমি পাও না, যদিও তোমার চোখ বড় বড় করে খোলা।‘
‘তুমি সবসময় চোখের কথা বল’ জেমস বলল।
কমলা জোরে হেসে উঠল। ‘আর কিছু না হোক, আমি অন্তত চোখ নিয়ে বলতে পারি, না জেমস?’
তারপর সে চুপ করে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জলস্রোতের শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল।
একজন পর্যটক তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। ঝুলন্ত ব্রিজের রেলিংগুলো ক্যাঁচকোঁচ করে উঠল।
‘হ্যাঁ আমি এখানে এমনি করেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।’ কমলা মনে করার চেষ্টা করল। সেটা সিজন টাইম ছিল, খুব ভিড়। লোকজন আমাদের গা ঘেঁষে ঠেলে চলে যাচ্ছিল। আর ব্রিজটা সাংঘাতিক দুলছিল। লোকের ধাক্কায় আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস নন্দন আমায় ধরে ফেলেছিল। এইরকমই ছিল ও। সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। নন্দন সবসময় আমার খেয়াল রাখত।’
‘আমার কথায় তুমি কি আপসেট হয়ে পড়লে?’ জেমস ওর ক্যামেরা শীর্ণ জলস্রোতের ওপর জুম করতে করতে জিগ্যেস করল।
‘এই, আপসেট হবার মতো কী আছে?’
‘কিছু না। কিন্তু আমি তোমাকে তোমার চোখ নিয়ে বলছিলাম।’
‘তুমি আমার চোখ নিয়ে কথা বলোনি। ওটা আমার সমস্যা।
আমি পারি জেমস। আমি কিছু জিনিস দেখতে পাই, যা তুমি পাও না, যদিও তোমার চোখ বড় বড় করে খোলা।
চোখের দৃষ্টি নেই বলে তাকে কেন দোষ দিতে হবে, জেমস? আমি তোমায় একটা কথা বলব জেমস? নন্দন আমার চোখদুটোকে পুজো করত। ও বলত, আমার চোখ দুটো বড় বড়। সে এমনকি একবার আমার চোখে কাজলও টেনে দিয়েছিল’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ’
‘ওহ, তাহলে সে তো নিশ্চয় দারুণ রোম্যান্টিক’
‘এটা কী, মাই ডিয়ার জেমস? ভালবাসার মানুষের চোখে কাজল পরানোর মধ্যে কিছু দোষ আছে?’
‘কে জানে? এটা কিন্তু কোনওদিন আমার কাছে আশা কোরও না কমলা।’
‘জেমস, প্লিজ তুলনা কোরও না। প্রত্যেকে আলাদা, তাই না?’
যদিও তারা দুজনেই ঝর্নার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, তবু খুব গরম লাগছিল।
চারটের ম্লান সূর্য বালির ওপর পাতার ছায়াচ্ছন্ন ছবি আঁকছিল।
রাস্তার ধারের ফেরিওলার কাছ থেকে ওরা শসা কিনল। শসাগুলো সত্যি ঠান্ডা ছিল। এক কামড় দিয়ে, কমলা তার শসাটা ফালি ফালি করে দিতে বলল আর ফেরিওলাকে বলল তার ফালিগুলোয় লঙ্কাগুঁড়ো আর নুন লাগিয়ে দিতে। কিন্তু জেমসের চা খেতে ইচ্ছে করছিল।
কমলা জিজ্ঞেস করল ‘তুমি ঝর্নার ছবি তুলেছ?’
‘হুঁ,’ অলসভাবে বলল জেমস। কিন্তু তার ক্যামেরা তার কাঁধে প্রিয় পোষ্যের মতো জিরোচ্ছিল।
কমলা নিজের শসাটা শেষ করে বলল ‘বেড়াতে বেরিয়ে এইসব ছোট ছোট জিনিস নিয়ে খুশি থাকত নন্দন। কেউ কেউ ভাবতে পারে নন্দন খুব কিপটে, কিন্তু ঘটনা সেটা নয়। আসলে বাইরের খাবার থেকে সমস্যা হবে এই দুশ্চিন্তা করত। প্রায়ই বলত ‘পেট গড়বড় করবে’ কিন্তু যাইই কারণ হোক, বেড়ানোর দুদিনের মধ্যেই ও একটা কাঠির মতো রোগা হয়ে যেত।
জেমস ওকে একটা কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
কমলা হাসল ‘কাঠির মতো! তুমি কী করে দেখলে? তোমার জিভে এই প্রশ্নটাই উশখুশ করছে, না জেমস?’
‘এই, না’ জেমস নিজের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করল।
‘হ্যাঁ সোনা, আমি মন পড়তে পারি। আমরা যখন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি, তখন তো নিজেদের চেহারা বুঝতে পারি, পারি না, জেমস?’
‘আমার এক কাপ চা চাই’ জেমস বলল।
তার সেলফোন বেজে উঠল, কিন্তু সে উপেক্ষা করল। ঝর্না থেকে সরু পথ ধরে বেরনোর জায়গাটা বেশ খানিকটা দূরে। ক্লান্ত কমলা ফুটপাথের ধারে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ল।
‘অনেকদিন পরে এতটা হাঁটলাম আমি।’ ‘আমার পা ব্যথা করছে’ জেমস বলল। কমলা তার শাড়ির নীচটা তুলে পায়ের ডিমে মাসাজ করল। তার গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছিল। কয়েকটা মেয়ে তাদের পাশ দিয়ে জোরে জোরে কথা বলতে বলতে ঝর্নার দিকে হেঁটে গেল। কমলা মাথা নিচু করে তার পা মাসাজ করতে থাকল যতক্ষণ না ওদের গলার স্বর দূরে মিলিয়ে গেল।
‘তুমি কি ওদের দিকে তাকালে?’ কমলা জিজ্ঞেস করল।
‘কাদের দিকে?’
‘এক্ষুনি আমাদের পাশ দিয়ে গেল, ওই মেয়েগুলো’
‘না তো, কেন?’
‘মিথ্যুক, তুমি মেয়েদের দেখো না, নাকি?’
‘ওহ ওরা!’
‘ওরা কি সুন্দর ছিল?’
‘হবে হয়তো’
‘ লুকোচ্ছ কেন? সৌন্দর্য তো দেখার জন্যেই তাই না?’
‘ওহ, তোমার সঙ্গে থেকে কী করে আমি অন্য মহিলাদের দিকে তাকাব?’ জেমস হাসল
‘মহিলা নয়, মেয়ে। এরা কমবয়সী। ওদের কথা শুনলেই বোঝা যায়’
‘ওকে কমলা। হোক না’
‘নন্দনের সঙ্গে যখন থাকতাম, এই একটা দারুণ জিনিস ছিল। ও আমার জন্যে সবকিছু বর্ণনা করত।’
‘তুমি নিশ্চয় হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরতে’
‘কেন? আমি তো আর বাচ্চা ছিলাম না’ কমলা হাসল
‘শুনবে জেমস। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে প্রতি সন্ধেয় আমরা কোনও না কোনও মলে যেতাম আর ছেলেমেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা ওদের কথা আলোচনা করতাম। দারুণ মজা হত। তুমি যদি টিটকিরি না করো, তবে তোমায় একটা দুষ্টুমির কথা বলি’
‘আমি তোমায় ঠাট্টা করি না। তুমি এর মাস্টার’
‘ধন্যবাদ জেমস’
‘বেশ। কিন্তু কী যেন আমায় বলতে যাচ্ছিলে তুমি?’
‘হাহা, মজার কথা একটা। কোথায় যেন থামলাম? হ্যাঁ, আমরা মলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম তরুণ তরুণীরা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। নন্দন আমায় বলেছিল, ছেলেমেয়েগুলোর লো ওয়েস্ট জিনসের ওপর দিয়ে ওদের অন্তর্বাস দেখা যাচ্ছে। সে সময় ওটাই চলছিল’
‘তো?’
‘তো কী? আমি নন্দন কে বলতাম আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানাতে। সারা সন্ধে ওই অন্তর্বাসগুলো নিয়ে আমরা মজা করতাম’
কমলা হাসতে শুরু করল, হেসেই চলল, যতক্ষণ না কাশতে শুরু করল।
‘তুমি একটু ক্ষেপি আছ কমলা’ জেমস বলল ‘তুমি একা নও, তোমরা দুজনেই। ও কেন তোমায় ছেড়ে চলে গেল আমি বুঝতে পারি না। তোমরা সত্যিই মেড ফর ইচ আদার’
হাহা, মজার কথা একটা। কোথায় যেন থামলাম? হ্যাঁ, আমরা মলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম তরুণ তরুণীরা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। নন্দন আমায় বলেছিল, ছেলেমেয়েগুলোর লো ওয়েস্ট জিনসের ওপর দিয়ে ওদের অন্তর্বাস দেখা যাচ্ছে।
কমলা কোনও সাড়া করল না। সে তার শাড়ি ঠিক করল আর হাত জোড় করে ওখানেই অলসভাবে বসে রইল। তারপর সে তার চোখ বুজল। জেমস ওর চোখের পাতার পাণ্ডুর নগ্নতার দিকে তাকাল না। সে ক্যামেরা বার করে একটা পাতা ঝরানো গাছের ছবি তোলার চেষ্টা করল। পত্রহীন শাখায় তিনটে পাখি কিচিরমিচির করছিল।
আবার তার সেলফোন বাজল। কিন্তু সে আগের মতোই কয়েকবার বাজার পর থামিয়ে দিল।
‘চলো যাওয়া যাক’ কমলা বলল। ‘ড্রাইভার নিশ্চয় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে’
‘এটা ওর কাজেরই মধ্যে পড়ে। এর জন্যে কি আমরা ওকে টাকা দিই না?’
‘ফোনটা ধরলে না কেন?’ কমলা জিগ্যেস করল
‘ভাবলাম পরে ধরব’
‘এলিজাবেথ ছিল, তাই না?’
‘হ্যাঁ কেন?’
‘আন্দাজ করলাম। ও এখনও তোমাকে ফোন করে যায়?’
‘ওর গরজ। আবার ফোন করবে’
‘কী সেই মহা দরকার?’ কমলা জিগ্যেস করল
‘ওহ, কিছু না’
‘কিন্তু তবু… নাকি আমাকে বললে কোন সমস্যা হবে?’
‘কীসের সমস্যা? ও নিজেই তো একটা সমস্যা’
কমলা হাসে ‘দাঁড়াও আমাকে আন্দাজ করতে দাও। ওয়াইল্ড গেস।তোমার কাছে এমন কিছু আছে যাতে ওর ক্ষতি হতে পারে। একটা চিঠি, কিছু তথ্য…। এইরকম কিছু, তাই না?’
‘এটা তো তোমার গেস, তাই না? আমি কেন বলব এটা ঠিক না ভুল?’
‘ইয়েস। এটাই আমার প্রশ্নের একদম সঠিক উত্তর’ কমলা হাসল। তারপর সে চুপ হয়ে গেল।
‘এরকম কোরও না জেমস’ কমলা বলল ‘ওকে ছেড়ে দাও’
জেমস সাড়া করল না।
‘জাস্ট ছেড়ে দাও’ কমলা বলল মাথা তুলে। ‘তুমি যদি রাগের মাথায় র্যাশ কিছু করো তো পরে পস্তাবে। ঘৃণা জিনিসটা ভালবাসার মতো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একঘেয়ে হয়ে যায়’
এবারেও জেমস কোনও উত্তর দিল না। সে তাকিয়ে দেখল ডাল থেকে পাখিগুলো উড়ে গেছে।
‘তোমার এক্স-র নামটা যেন কী? ওহ,হ্যাঁ, নন্দন। তুমি কি নন্দন বলে ডাকো?’ হঠাত জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমার স্বপ্নে’ এই কথা বলে কমলা ওর হাত ধরল। কমলার হাত অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা, জেমস ভাবল।
‘আচ্ছা, এই জায়গাটা কি ভাল জেমস?’
‘হ্যাঁ, কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছ?’
‘আমি জানি না। কিন্তু কেন জানি গতবারের মতো লাগছে না’
‘কমলা উঠে এই বেঞ্চের একদম ধারে গিয়ে দাঁড়াও, হাতদুটো নামাও। এইতো, এবার আমি একটা ছবি নেব’
‘ঠিক আছে?’
‘একদম। আর একটা’
‘এই দিনের আলোয় তুমি ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে কেন?’
‘তুমি কী করে বুঝলে?’
‘আমি বুঝি। এটাই। নন্দন কখন ফ্ল্যাশ ইউজ করত না। ও স্বাভাবিক আলো পছন্দ করত।’
ওরা যখন গেট পেরিয়ে পার্কিং লটে গিয়ে দাঁড়াল, ক্যাব ড্রাইভার ওদের কাছে গাড়ি নিয়ে এল। সকালে হোটেলেই গাড়ি ঠিক হয়ে গেছিল। ড্রাইভার এক মাঝবয়সী লোক। বলেছিল ওর বউ মালয়ালি। বোধহয় এই জন্যই কি সে এদের প্রতি কন্সিডারেট ছিল? বুদ্ধ মন্দিরে পৌঁছতে এক ঘন্টার বেশি লাগল। ততক্ষণে গোধূলি হয়ে গেছে। কমলা নন্দনের সঙ্গে তার স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছিল।
সেবার তারা মন্দিরের সামনে একটা হোটেলে উঠেছিল। সেটা চালাত লামারা। সন্ধেবেলা ওরা মন্দিরের রাস্তা ধরে অনেক ভেতরের গ্রামে চলে গিয়েছিল। রাস্তাটা ছিল নির্জন, পরিত্যক্ত। অন্ধকার হয়ে গেলেও নন্দন হাঁটা থামায়নি। সেটা ছিল উদ্বাস্তুদের গ্রাম, তাদের বাড়ি, মন্দির, ইস্কুল, দোকান আর তারপর ভুট্টা ক্ষেত। নন্দন তাকে সব খুঁটিয়ে বলেছিল। ফেরার পথে রাস্তার ধারের ঝুপড়ি থেকে ওরা চা খেয়েছিল। এটা চালাত একজন তরুণ উদ্বাস্তু। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা এই জায়গাতেই। তার মাতৃভূমি তার কাছে ছিল কানে শোনা এক দেশ। নন্দন সবসময়েই এইসব খুঁটিনাটি জানতে আগ্রহী ছিল।
‘আমরা লামাদের হোটেলে থাকতে পারতাম’ কমলা বলল
‘ওই হোটেলে হয়তো বিদ্যুৎ জল কিছুই নেই’ ভাঙা ভাঙা মালয়ালমে ড্রাইভার বলল
‘কিন্তু বিদ্যুৎ দিয়ে কমলা কী করবে, তাই না?’ জেমস বলতে বলতে থেমে গেল
‘সত্যি।’ কমলা হাসল। ‘সবসময় আমরা কেন বিদ্যুৎ চাই? আমাদের আগেকার দিনের লোক কি এটা ছাড়া বাঁচেনি?’
একজন ভিখারি তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইল, সে চেঁচিয়ে বলছিল সে অন্ধ। জেমস তার পার্স থেকে কিছু খুচরো বার করে তাকে দিল।
‘একি জেমস, তুমি ওকে ভিক্ষা দিলে?’
‘বেচারা চোখে দেখতে পায় না’
‘ও কি চোখে দেখতে পায় না বলেই গরিব?’
‘তাই নয় কি?’
‘না। তাহলে তোমার হিসেবে আমিও তো গরিব?’
‘কক্ষনো না’
‘সেক্ষেত্রে তুমি ওকে ভিক্ষা দেবে কেবল সে অন্ধ বলে?’
জেমস উত্তর দিল না। দূরে সে দেখল বৌদ্ধ মন্দিরের সোনালি তোরণ আর সূর্যের আলোক স্নান। সে দৃশ্যটার ছবি নেবে কিনা ভাবল।
‘একজনের চোখের দৃষ্টি নেই। ব্যস এইটুকুই’ কমলা বলে চলল ‘প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা সীমাবদ্ধতা আছে। তুমি কি সবাইকে ভিক্ষা দিয়ে চলবে? অন্ধ বলে ও যে কমা মানুষ তা কিন্তু নয়’
‘ওহ কমলা, তুমি আর তোমার দর্শন! নাকি এটা সেই ভদ্রলোকের থেকে এসেছে?’
‘নন্দন কক্ষনো কাউকে ভিক্ষা দিত না। এটা ছিল ওর নীতি’
‘তুমিও দাও না। এখানেই গল্প শেষ, তাই না?’
কমলা মন্দিরের হলের মেঝেতে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল, যেন প্রার্থনা করছে। নৈঃশব্দ্য রহস্যময় মন্ত্রের মতো চারপাশে অনুরণিত হচ্ছে, সে অনুভব করল।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য
ই সন্তোষ কুমার মালয়ালম ভাষার এই প্রজন্মের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর বেশি। সেরা গল্প সংগ্রহের জন্যে এবং উপন্যাস 'অন্ধাকরানঝি' –র জন্যে দু'বার পেয়েছেন কেরালা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার যথাক্রমে ২০০৬ আর ২০১২ সালে। এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ- আইল্যান্ড অফ লস্ট শ্যাডোজ ২০১৫ সালের ক্রসওয়ার্ড পুস্কারের জন্য বাছাই হয়েছিল। তাঁর দুটি গল্প থেকে মালয়ালম সিনেমা হয়েছে। তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি, তামিল, হিন্দি এবং জার্মান ভাষায়। বাংলায় অনুবাদ এই প্রথম।