২৩, ২৬ জানুয়ারি মিলিয়ে ছুটি নেওয়ার ভাল মওকা। কপাল ঠুকে পরিকল্পনা করে ফেললাম। দুদিন হলং (Jaldapara forest), দুদিন কালিম্পং (Kalimpong hill), একদিন মংপং। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হোটেল বুকিং, ট্রেনের টিকিটের বন্দোবস্ত হল। এও এক যুদ্ধজয়। যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে ঢাল তরোয়াল নিয়ে কত্তা গিন্নী ট্রেনে চেপে বসলাম।
আরও পড়ুন: পায়ে পায়ে পঞ্চচুল্লির পায়ের কাছে
কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ৪০ মিনিট লেটে শিলিগুড়ি পৌঁছল। এখানে ইঞ্জিন পালটে জঙ্গলের (Forest) মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হাসিমারার দিকে। তিস্তা পার হয়ে সেবক ছাড়ার পর থেকেই অদ্ভুত সুন্দর এই যাত্রাপথ। ট্রেন কখনও ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, কখনও পার হয়ে যাচ্ছে ছোট বড় নদী। কত সুন্দর সব নাম তাদের। তিস্তা, জলঢাকা, তোর্সা তো চেনা, অচেনা ডিমডিমা, ডায়না, মূর্তি কত কী! গরুমারা জঙ্গলকে ডানহাতে রেখে ট্রেনের ছুট।

অবশেষে মাত্র ১ ঘন্টা লেটে ট্রেন পৌঁছল হাসিমারা। গাড়ি ঠিক করাই ছিল, ট্রেন থেকে নেমে রওনা দিলাম হলং (Jaldapara forest) এর দিকে। মাদারিহাটে ফরেস্টের গেটে কাগজপত্র দেখিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে গাড়ি ছুটল। পথে দেখা দিলো ময়ূর। এত কাছে! কিন্তু গাড়ি থেকে নামা নিষেধ, তাই গাড়ির জানলা দিয়েই ছবি তুললাম। রঙের বাহার মোহিত করে দিল।
সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এলে ফিরে এলাম ঘরে জানলার ধারে। একটু পরে বাংলোর কর্মীরা আলো ফেলতেই চোখে পড়লো সল্টলিকে অনেক জানোয়ার – গোটা চারেক গন্ডার, কয়েকটা বাইসন, অনেকগুলো হরিণ। আজ কুয়াশা নেই, ফলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সহসা দুই গন্ডারের বেদম মারামারি। একজন পরাজিত হয়ে জঙ্গলে পালাল, অন্যজন তার পিছনে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে চলল।
হলং নদীর ধারে এই মনভোলানো জায়গাতে অন্তত একবার থাকার চেষ্টা করুন, সারাজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। তবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেই সামনে হলং নদীর একটা সরু ধারা, যার ওপারেই সল্টলিক। এই বাংলোর ৫ নম্বর ঘর সবচেয়ে ভালো, সল্টলিক স্পষ্ট দেখা যায়। লটারি পাওয়ার মত ৫ নম্বর ঘর পেয়ে গেলাম। আমাদের তখন পায় কে! তবে কুয়াশার দাপট, চারিদিকে একটা ঝাপসা ভাব। কিন্তু তাতে কী এসে যায়! সামনের খোলা জায়গাটায় তখন একের পর এক ময়ূরের দল পেখম মেলে নেচে চলেছে, কি বাহার তাদের রঙের। মাঝে মাঝেই ময়ূরের তীক্ষ্ণ চিৎকার।

এমনি করেই সন্ধ্যা নেমে এল। সন্ধ্যাবেলায় বাংলোর কর্মীরা সল্টলিকে সার্চ লাইট ফেলে জন্তু জানোয়ার দেখায়, সেদিনও চেষ্টা করল, কিন্তু কুয়াশার দাপটে কিছুই স্পষ্ট করে দেখা গেল না। শুধু দেখলাম আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে চোখ, ওরা বললে বাইসন। রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম, কারণ কাল এলিফ্যান্ট সাফারি (elephant safari) আছে সকাল সাড়ে ছটায়।

ঝাপসা আলোয় ময়ূরের তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে দ্রুত তৈরি হলাম এলিফ্যান্ট সাফারির (elephant safari) জন্য। বাংলোর গেটের বাইরের বনদপ্তরের হাতি দাঁড়িয়ে আছে। একটা উঁচু টাওয়ারের মতো জায়গা থেকে হাতির পিঠে উঠে যাত্রা শুরু। সে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। হাতি চলেছে মাহুতের নির্দেশমত রাস্তায়, পথে এ গাছ, ও গাছ থেকে আপন মনে ডাল ভেঙে, পাতা খেতে খেতে। এ এক অদ্ভুত মজার অভিজ্ঞতা।

মাঝে মাঝে গাছের ডাল সামনে চলে আসছে, মাহুত সরিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু দুএকটা গায়ে ঘষেও যাচ্ছে। সাফারিতে তিনটে গন্ডার আর একটা সম্বরের দর্শন মিলল। আর ময়ূর তো আছেই। হাতির দলের সঙ্গে রয়েছে এক পুঁচকে শাবক। বিচিত্র তার কাণ্ডকারখানা। তবে মা যেদিকে চলেছে, সেও সেইদিকেই চলেছে। একঘন্টার সাফারি শেষে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার সল্টলিকের ধারে। এবার চোখে পড়ল একজোড়া হর্নবিল বা ধনেশ পাখি। রয়েছে অসংখ্য হরিয়াল বা হরতেল ঘুঘু। ঘরে এসে খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে চোখে পড়ে সামনের শিমূল গাছে নানা পাখি। এর মধ্যেই দেখি বাংলোর এক কর্মী বালতি ভরে নুন নিয়ে যাচ্ছেন সল্টলিকে দেওয়ার জন্য। সাথে সাথে ময়ূরের দল সার বেঁধে হাজির হলো নুন খেতে।

লাঞ্চ সেরে জানলার ধারে বসে থাকতে থাকতেই চোখে পড়ল ধীর পায়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সল্টলিকের দিকে চলেছে এক বাইসন। ব্যস, ক্যামেরা নিয়ে বাইরে। এরপর এক এক করে গন্ডার, আরও কিছু বাইসন, হরিণ, এমনকি এক বুনো শুয়োরও দেখা দিল। সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এলে ফিরে এলাম ঘরে জানলার ধারে। একটু পরে বাংলোর কর্মীরা আলো ফেলতেই চোখে পড়ল সল্টলিকে অনেক জানোয়ার – গোটা চারেক গন্ডার, কয়েকটা বাইসন, অনেকগুলো হরিণ। আজ কুয়াশা নেই, ফলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সহসা দুই গন্ডারের বেদম মারামারি। একজন পরাজিত হয়ে জঙ্গলে পালাল, অন্যজন তার পিছনে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে চলল। রাত নামল, রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। কাল চলে যাওয়ার আগে সকালবেলাটা যতটা উপভোগ করা যায়।

সকালে উঠে সল্টলিকের ধারে চললাম, হলং নদীর ধার বরাবর পায়ের চাপে বসে যাওয়া নরম মাটি, বুঝলাম গন্ডারের পায়ের ছাপ। বাংলোর কর্মীরা বললেন, আগে নদী পার হয়ে বাংলোর সামনের ঘাসজমিতে চলে আসত গন্ডারের দল, তবে এখন ইলেকট্রিকের তার থাকায় তারা আর ভিতরে আসতে পারেনা। এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই ১১টা বেজে গেল। গাড়ি এসে গেছে। সুতরাং এবার যাত্রা কালিম্পঙের (Kalimpong) পথে, গন্তব্য মরগান হাউস।

কালিম্পঙের (Kalimpong) রাস্তায় করোনেশন ব্রিজ পার হয়ে ডানদিকে তিস্তাবাজারের দিকে ঘুরে খানিক দূর যাওয়ার পর লম্বা জ্যামের কবলে পড়লাম। তিস্তার ভয়াবহ সেই জলস্ফীতি কী ভয়ানক ধ্বংসলীলা চালিয়ে ছিল, তার খানিকটা স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে এই রাস্তা। বেশ কিছু অংশে রাস্তা পুরোটাই ধুয়ে গিয়েছিল। সেখানে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। একমুখী করে গাড়ি ছাড়া হচ্ছে। তারাও আস্তে আস্তে কোনরকমে সাবধানে সেই অংশটুকু পার হচ্ছে।

যাইহোক, প্রায় দেড় ঘন্টা লেটে মরগান হাউস পৌঁছলাম। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেক চমক। মিসেস মরগান যে ঘরে থাকতেন, অর্থাৎ ১০১ নম্বর ঘর, সেটা আমরা পাইনি। বুকিং – এর সময় খালি ছিল না। রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকার সময় দেখেছিলাম ঘরটা হঠাৎ খালি দেখাচ্ছে। হোটেলে ঢুকে রিসেপশনে বললাম আমাদের বুকিংটা পালটে দেওয়া যায় কিনা। ওরা আনন্দের সাথে ব্যবস্থা করে দিল, আমি শুধু বাড়তি টাকাটুকু দিলাম।
ওয়েলকাম ড্রিঙ্কে মকাইবাড়ির চা। ব্যাডমিন্টন কোর্টের সাইজের ঘর। ঘরে ফায়ার প্লেস আছে, যদিও জ্বালানো হয় না। সামনের জানালা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। আর ডানদিকেরটা দিয়ে গলফ কোর্স। অস্তগামী সূর্যের লালচে আলোয় মরগান হাউসের একটা অন্যরকম চেহারা। সামনের ফুলে ছাওয়া বাগান, অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির, প্রচন্ড ঠান্ডা – সবমিলিয়ে মরগান হাউস মাত করে দিল।

কালিম্পঙে দুটো দিন কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে পায়ে হেঁটে দূরপিন গুম্ফা, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউস, আর বাজারে গিয়ে বিখ্যাত তাজ বেকারির কেক, পেস্ট্রি খাওয়া। বাকি সময়টা মরগান হাউসের ভিতরেই। দূরপিন গুম্ফা একটা অন্য অভিজ্ঞতা। তিনতলা মনাস্ট্রি – যা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের প্রতীক। একজন সিকিমিজ ভদ্রলোক তার ৮০ বছরের বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের অনুরোধে উপরতলাগুলো খুলে দিলেন লামারা। আমরাও সেই সুযোগে এই অপূর্ব সুন্দর মনাস্ট্রিটা পুরোটা দেখলাম। মনে একটা আক্ষেপ থাকছিল, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিচ্ছিল না। ফেরার দিন সকালে তিনি দেখা দিলেন, কুয়াশার কারণে একটু ঝাপসা, তবে তাতেই আমরা খুশি।
ফেরার পথে একরাত কাটালাম মংপং। শাল সেগুনের জঙ্গলে, হাইওয়ের মাত্র ৩০০ মিটার ভিতরে এই স্বর্গ। সকাল বিকেল তিস্তার হাওয়া শন শন করে বয়ে যায়, শাল সেগুনের পাতায় শব্দ করে, চোখ বন্ধ করলে ঝড় উঠেছে বলে ভুল করতে পারেন। একটু নীচ দিয়ে আলিপুরদুয়ারগামী রেল লাইন চলে গেছে, মাঝে মাঝে সেখান দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। তার পিছনে তিস্তার রূপোলি রেখা। আর রয়েছে পাখি আর প্রজাপতির দল। আপনাকে থোড়াই পাত্তা দেবে ওরা। কপাল খুব ভালো থাকলে হাতির দেখা পেতে পারেন। আমাদের অবশ্য হাতি দর্শন হয়নি।

ফেরার সময় হয়ে এল। গাড়ি নিয়ে চললাম নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। বেলা তিনটের বন্দে ভারত ধরে কলকাতা। মাথায় রয়ে যায় জলদাপাড়ার গন্ডার, বাইসন, ময়ূরের দল, মরগান হাউস, মোহময় মংপং। কানে বেজে ওঠে ময়ূরের ডাক, পাখির হইচই, বাতাসের ডাক। আর মন ফাঁক খোঁজে আবার পালানোর।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর।পেশায় শিক্ষক। বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ফোটোগ্রাফির ডিপ্লোমা। ভালোবাসেন বেড়াতে, ছবি তুলতে আর পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।
2 Responses
অসাধারণ লেখনী যেন দক্ষ শিল্পীর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা নানা মনমুগ্ধকর ছবির সমাহার।
জঙ্গল!
অসম্ভব সুন্দর!!
ভালোবাসার ভালোলাগার!!!