সিকিম (Sikkim) মানেই নিসর্গ। স্বর্গীয় পাহাড়ি সৌন্দর্য। তার আনাচেকানাচে কত বৈচিত্র্যময়তা। পাহাড়ের গাম্ভীর্য, হরিৎ অরণ্যের সজীবতা, নদীর বহমানতা, ঝরনার (Waterfalls) উচ্ছ্বলতা আর পাহাড়চুড়োর দুধ সাদা বরফ… এক এক জায়গায় এক এক রকম বৈচিত্র্যময়তা নিয়েই সিকিম। আর সেই ল্যান্ড অফ অর্কিডের মাটিতে প্রতিবার পা রাখলেই বারেবারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা পাহাড় কেনার আকুতি মনে পড়ে।
আদিগন্ত পাহাড়শ্রেণীর ঘন সবুজের ঘেরাটোপে নির্জন বনঝাকরি ঝরনার ( Banjhakri Waterfall) উদ্দামতা ভাসিয়ে নিয়ে চলে। কখনো মেঘের আনাগোনা, কখনো বা বৃষ্টির ফোঁটা পাথুরে পথ পিচ্ছিল করে দেয়। এধারে শৈবাল, ওধারে রাজকীয় ফার্ন…পাহাড় ধাপে ধাপে নেমে এসেছে উপত্যকার বুকে। চাষাবাদের জন্য তা স্থানীয় মানুষেরই সৃষ্ট। সবুজ আর সজীব। পাহাড়ি মেয়ে মরদের পিঠের চিরন্তন ঘামের দাগ অনুভূত হয়। খেয়ালখুশিতে টুকটাক ফসল ফলিয়েছে তারা মনের খুশিতে। আলো হয়ে ভুট্টা, বড় এলাচ এসবই ফলেছে। এ গাছ থেকে ও গাছের খুঁটিতে বাঁধা সারে সারে রঙিন পতাকা। পতপত করে উড়ছে মনের সুখে। তিব্বতের ধর্মীয় অনুশাসন। বাতাসের শনশনানিতে কাপড়ে লেখা বাণী মিশে গিয়ে শান্তির আবহ তৈরি করবে এমনই বিশ্বাস ওদের।

সেখানেও নিরিবিলির ছোট্ট বৌদ্ধগুম্ফা। যত্রতত্র শান্ত নিরালা পরিবেশ। পাখির ডাক মানুষদের ঘর-গেরস্থালি, অতন্দ্র প্রহরার শালপ্রাংশু গাছেদের নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা সবটুকুনই যেন পরম প্রাপ্তি। তাই বুঝি সুনীলবাবু নিজের এক টুকরো মহার্ঘ নদীর বিনিময়ে সস্তার পাহাড়টিই কিনতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর মতে পাহাড় স্থানু আর নদী বহমান। নদীর গা ঘেঁষে দাঁড়ালে পাহাড় কত গল্প বলে ওঠে। ঝরনা কলকল করে সেই গল্পের আসরে যোগ দেয়। বনদেবীর দ্বারে দ্বারে শুনি গভীর শঙ্খধ্বনি… না, না, শাঁখের আওয়াজ নয়। বনঝাকরির নিজস্ব আপন টেরিটরিতে ঢোকার কিছু পরেই কানে এল ঝরনার আওয়াজ। ওপর থেকে জল পড়ার তীব্র শব্দ। গ্যাংটকের এই স্থাণুবৎ পাহাড়ের সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে চলেছিলাম ক্রমশই বনঝাকরি ঝরনার কাছে।
অতিমানব ইয়েতির মতোই নেপালীদের বিশ্বাসে বনঝাকরীকে নিয়ে লোকায়ত গল্প আজও গহীন অরণ্যে হিমালয়ের পাহাড় থেকে পাহাড়ে ধাক্কা খায়। জলপ্রপাতের আর বনঝাকরির সম্মিলিত ঝঙ্কারে উদ্বেলিত হয় অরণ্য।
কেবলই মনে পড়ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “পাহাড় চূড়ায়”। যে পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য। তিনি সেই অরণ্য পার হয়ে একের পর এক শুধু রুক্ষ পাহাড় পেরিয়ে, একেবারে তার চুড়োয়, মাথার খুব কাছে যেতে চেয়েছিলেন। বনঝাকরি ঝরনার কাছে গিয়ে মনে হল যদি আমিও একটা পাহাড় কিনতে পারতাম! ঠিক যেন দুহাত দিয়ে পাহাড় আগলে বসে আছে সেই ঝরনাকে। ঠিক যেমন বনদেবী আগলে রাখেন পাহাড়ের সন্তানসন্ততিদের। বনপাহাড়ি, বনশঙ্করী, বনবিবি, বনদুর্গার পরে আরেক নেপালের লৌকিক অরণ্যদেব ও দেবী এরা।

গ্যাংটক থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে এই নিসর্গ। ভাড়ার গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছিলাম এক সকালে। সেথায় সৌন্দর্য বিলোয় প্রকৃতি আর আমরা দুহাত ভরে কুড়িয়ে নিই সেই অকৃপণ দান। সেলফি তোলার হিড়িকে প্রাণ অতিষ্ঠ বুঝি স্বর্গীয় রমণীয় এই নিসর্গের।
সুউচ্চ জলপ্রপাত এই বনঝাকরিকে ঘিরে রয়েছে এক লোকগল্প। তা মিথ না মিথ্যে সে নিয়ে বিতর্কে যাব না। এ অরণ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি যথাক্রমে বনঝাকরি ও বনঝাকরিণী নামে খ্যাত। এই জলপ্রপাতের আশেপাশেই ছিল তাদের ডেরা। তাই এদের মূর্তিও আছে এখানে। স্থানীয় আদিবাসী বলে মনে হল।

পুরুষটি দীর্ঘকায়, আর স্ত্রী খর্বকায়া। উভয়েই শ্যামবর্ণ। হাতে খড়গ। করালবদনা। অতি ভীষণা নারী ঠিক আমাদের কালীর মত। তবে এদের মুখের দুপাশে দুই বড় শ্বদন্ত বের করা, ভয়ানক হিংস্র মুখভঙ্গী। হাতে কুড়ুল। তারা এ জঙ্গলেই ঘরসংসার পেতেছে আদি অনন্তকাল ধরে আর শক্তির উপাসনা করে নিত্য। জঙ্গলমহলের আদিবাসী সম্প্রদায় চিরকালই অরণ্যের অধিকার নিয়ে সচেতন। অরণ্যকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখে আসছে তারা। কিন্তু এখানে এই বনদেবতা এবং তাঁর যোগ্য সহচরী শুধু অরণ্যই নয়, তারা আবার শিশুরক্ষক। শোনা গেল সে গল্প। তাই কি এত তর্জন গর্জন সে ঝরনার?
বনঝাকরি নাকি সূর্যের বংশধর। এমন মানব শিশুদেরই তিনি ঠিক খুঁজে বের করতেন যাদের মধ্যে মহান শমেন (Shaman) বা পুণ্যাত্মা হওয়ার লক্ষণ প্রবল এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য নিজের গুহায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন। যেসব বাচ্চা সত্যিই পবিত্র চিত্তের অধিকারী হত,তাদের তিনি নিজের বিদ্যা উজাড় করে শিখিয়ে তাদের ঘরে আবার পাঠিয়ে দিতেন মানবকল্যাণের জন্য।
জানলাম অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী এই বনঝাকরি নাকি ছোট ছোট পবিত্র চিত্ত বাচ্চাদের ধরে আনতেন একসময়। শমেনিজম-এ দীক্ষা দিয়ে ‘ঝাকরি’ করার জন্য। ‘ঝাকরি’ একটি ‘নেপালি’ শব্দ যার মানে ‘ওঝা’ বা ‘শমেন’ (Shamanism – Shaman)। এসব বুঝি সাহেবি কায়দায় উচ্চারিত শব্দ। বাকি সবটাই উপজাতীয়। মূলত যারা দুষ্ট বা নেগেটিভ আত্মা তাড়িয়ে সমাজের রোগবালাই দূর করে। কিছুটা তান্ত্রিক উপাসনার মত। নেপালের কিরাত বা ব্যাধ উপজাতীয়দের প্রথা এই ঝাকরি। বনঝাকরি নাকি সূর্যের বংশধর। এমন মানব শিশুদেরই তিনি ঠিক খুঁজে বের করতেন যাদের মধ্যে মহান শমেন (Shaman) বা পুণ্যাত্মা হওয়ার লক্ষণ প্রবল এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য নিজের গুহায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন।

যেসব বাচ্চা সত্যিই পবিত্র চিত্তের অধিকারী হত,তাদের তিনি নিজের বিদ্যা উজাড় করে শিখিয়ে তাদের ঘরে আবার পাঠিয়ে দিতেন মানবকল্যাণের জন্য। ছোটো বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাবার পেছনে বনঝাকরির কোনো বদ মতলব থাকত না। নেপালীদের বিশ্বাস ঘরে ফেরার পরে এইসব শিশুরা অতিরিক্ত শক্তিশালী আর বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যেত। অতিমানব ইয়েতির মতোই নেপালীদের বিশ্বাসে বনঝাকরিকে নিয়ে লোকায়ত গল্প আজও গহীন অরণ্যে হিমালয়ের পাহাড় থেকে পাহাড়ে ধাক্কা খায়। জলপ্রপাতের আর বনঝাকরির সম্মিলিত ঝঙ্কারে উদ্বেলিত হয় অরণ্য।

“তখন বিজনে বসি, নীরবে নয়ন মুদি,
স্মৃতির বিষণ্ণ ছবি আঁকিব এ মানসে।
শুনিব সুদূর শৈলে, একতানে নির্ঝরিণী,
ঝর ঝর ঝর ঝর মৃদুধ্বনি বরষে”
পাহাড়ি পথ হেঁটে ফিরতে ফিরতে মনে মনে আওড়ে উঠি। আহা রবিঠাকুর! ছিল হিমালয় আর নির্ঝরিণী। আজও আছে তেমনি।
ছবি সৌজন্য: লেখক
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।