পাহাড় তো সবসময়েই ডেকে চলেছে, সে ডাকে সাড়া দেওয়া আর পকেটের সাধ্য মেলাতে পারলেই একটা ছুট। মনের গভীরে একটা সাধ উঁকি দেয়, লাদাখ (Ladakh) যাবো। পরিকল্পনামাফিক কর্তা, গিন্নী, ছেলে তিনজনে মিলে লাদাখের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। রাতের উড়ানে দিল্লী পৌঁছলাম রাত ১১টা নাগাদ। এয়ারপোর্টে রাতটুকু কাটিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটার উড়ানে লেহ।
বিমান যাত্রা আমার কোনওকালেই পছন্দের নয়। কেবল মেঘেদের উঁকিঝুঁকি। কিন্তু এবার যেন আমার ভুল ভাঙানোর জন্য প্রকৃতি বদ্ধপরিকর। বিমান আকাশে ডানা মেলল, একটু পরেই মেঘের আড়াল ছিঁড়ে কারাকোরাম পর্বতমালার বরফচূড়ায় ঝলসে উঠল সূর্য। কানে এলো বিমানচালকের ঘোষণা, আমরা প্রায় ৩৫০০০ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে চলেছি, বাইরের তাপমাত্রা -২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আমি শুধু দুচোখ ভরে দেখে চলেছি আর ধন্যবাদ জানাচ্ছি সৃষ্টিকর্তাকে আমাকে এই দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

এক ঘণ্টার উড়ান। আমরাও ধীরে ধীরে পা রাখি বাইরে। ছোট্ট এয়ারপোর্ট, রানওয়ে যেন শুরু হয়েই শেষ হয়ে যায়, চারিদিকে রুক্ষ নেড়া পাহাড়, তাদের মাথায় বরফ। এই মনোরম শোভা বেশীক্ষণ দেখার উপায় নেই, সেনাবাহিনীর তাড়ায় বাসে উঠে বিমানবন্দরের ভিতরে এলাম। যে হোটেলে উঠবো তারাই গাড়ির ব্যবস্থা করেছে, আগের দিনই গাড়ির নম্বর, ড্রাইভারের নাম, ফোন নম্বর পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমার কোলকাতার দুটি প্রিপেইড সিম’এর কোনোটাই কাজ করছে না। একজন কর্মীর ফোন থেকে ফোন করতে জানলাম ড্রাইভার এয়ারপোর্টের বাইরে আমার নাম লেখা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা মিটলো। বাইরে এসে ড্রাইভারের সাথে মোলাকাত, থিনলেস দোরজে নামের এক হাসিখুশি যুবক, আমাদের পুরো যাত্রায় আমাদের সারথি ছিল থিনলেস, সর্বদাই মুখে হাসি নিয়েই থেকেছে।

লেহ আমাদের অস্থায়ী আস্তানা হোটেল পালাম হিলস্। মালিক স্টাঞ্জিন ওয়াঞ্চুক বাকি ট্যুরের হোটেল, গাড়ি সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে। হোটেলে ঢোকার মুখে থোকা থোকা গোলাপের সাদর অভ্যর্থনা। নিরিবিলি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোটেল, বিশাল আকারের ঘর, জানালা দিয়ে মাথায় বরফ নিয়ে কারাকোরাম পর্বতমালার উঁকিঝুঁকি। এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে, শান্ত পরিবেশে এর অবস্থান, অথচ বাজার মাত্র ২০০ মিটারের হাঁটা পথ।

তবে অবাক করল মে মাসে ১১৫০০ ফুট উচ্চতার বেশ গরম লাগছে। ঘরে পাখাও রয়েছে। পরে জেনেছি হোটেলে কয়েকটা বাতানুকূল ঘরও আছে। প্লেনেই প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে স্নান করে পায়ে হেঁটে দেখতে চারপাশ বেরোলাম। উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে, তাই পদাতিক। বেরিয়ে বুঝলাম সামান্য চড়াই রাস্তাতেই বেশ হাঁফ ধরছে, তাই আস্তে আস্তে এগোলাম। এদিক ওদিক হেঁটে একটা তিব্বতি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে হোটেলে। কাল লেহ’র স্থানীয় আকর্ষণ দর্শন।

সকাল ৯ টায় থিনলেস গাড়ি নিয়ে হাজির। পাহাড়ি রাস্তা বলেই বোধহয় তিনজনের জন্য একটা ইনোভা। বেড়ানোর গল্প শুরু করার আগেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। সিগারেটের বিজ্ঞাপনে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ শেষে থাকে, আমি প্রথমেই বলে নিলাম। যাঁরা ছবি তুলতে ভালোবাসেন তারা দয়া করে গাড়ি থেকেই ছবি তুলবেন আর নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে ছবি তুলবেন। নচেৎ আপনি গন্তব্যে পৌঁছবেন না, কারণ যেখানে দাঁড়াবেন সেটাই তো ভিউ পয়েন্ট।

প্রথম গন্তব্য শান্তি স্তূপ। আর পাঁচটা সাধারণ স্তূপের মতো হলেও আকাশে সাদা মেঘের দল আর চারিদিকে ন্যাড়া পাহাড় এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়। এখান থেকে চললাম লেহ প্যালেস দেখতে। সেঙ্গে নামগিয়াল ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯ শতকের মাঝামাঝি ডোগরা সম্প্রদায় এই প্রাসাদ দখল করে এবং রাজপরিবার এই প্রাসাদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ৯ তলা এই প্রাসাদের গঠনশৈলী অবাক করে।

নীচের দিকে দেওয়াল ৬ ফুট চওড়া, উপরের দিকে ৩ ফুট। উপরের তলায় রাজপরিবার থাকতেন। এখন এই প্রাসাদ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে। এখান থেকে চললাম সেনাবাহিনীর ‘হল অফ ফেম’ দেখতে। তবে এখানে ঢুকতে গেলে যে টিকিট কাটতে হবে তা হয় অনলাইন পেমেন্ট অথবা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। আর পাঁচটা ওয়ার মিউজয়ামের মতোই।

এরপর এক বিস্ময় ম্যাগনেটিক হিল, গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ, অথচ অত বড় ইনোভা গাড়িটা দিব্বি গড়াচ্ছে। এই রাস্তার উপর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বিচিত্র পাথরের আকৃতি। এরপর গুরদুয়ারা পাথর সাহিব। সেই গুরু নানকের উপর পাথর গড়িয়ে দেওয়ার কাহিনী। এখান থেকে একটু এগোলেই পাশে ইন্দাস অর্থাৎ সিন্ধু নদী। কত পড়েছি সিন্ধুর কথা।

বেশ খানিকটা এগিয়ে সিন্ধু আর জাঁসকর নদীর সঙ্গম। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে, ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছাড়িয়েছে, কিন্তু বেশ জোরালো আলো। খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরতি পথে। হোটেলে পৌঁছলাম সাতটা নাগাদ, তখনও বেশ আলো। কিছুক্ষন বাজারে ঘোরাঘুরি করে হোটেলে বিশ্রাম। কাল লেহ ছেড়ে নুব্রার পথে।

সকাল ৯ টা নাগাদ রওনা হলাম নুব্রার পথে। নুব্রাতে থাকা যায় ডিসকিট বা হুন্ডারে। আমাদের রাত্রিবাস ছিল ডিসকিটে। এই মনোরম যাত্রাপথ প্রকৃতির অকৃপণ দানে ভরপুর। তবে রাস্তার অবস্থা মাঝে মাঝেই বেজায় খারাপ। বেলা তিনটে নাগাদ হোটেলে পৌঁছে মালপত্র রেখে চললাম ডিসকিট মনাস্ট্রি দেখতে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে অনেকটা জায়গা নিয়ে লাদাখের অন্যতম প্রাচীন এই মনাস্ট্রি। দালাই লামা এখানে এসেছিলেন, তাঁর জন্য একটা ঘরও এখানে নির্দিষ্ট করা আছে।

এরপর নুব্রা ভ্যালি। পথে নুব্রার সেই বিখ্যাত বালিয়াড়ি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সে রূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। হুন্ডার টপকে চললাম বিখ্যাত দু কুঁজওয়ালা ব্যাকট্রিয়ান উট দেখতে। থিকথিকে ভিড় আর উটে চড়ার জন্য মারামারি দেখে উটগুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছিল।

আলো নিভে যেতে ফিরলাম হোটেলে। হোটেলের ঘর থেকে তখন পশ্চিম আকাশে মায়াবী আলো। খেয়ে দেয়ে ঘুম। এরপর যাবো তুরতুক, ভারত পাকিস্থান সীমান্ত।
পরের পর্ব আগামী মাসে
ছবি: লেখক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর।পেশায় শিক্ষক। বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ফোটোগ্রাফির ডিপ্লোমা। ভালোবাসেন বেড়াতে, ছবি তুলতে আর পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।
One Response
Excellent….!