তুরতুকের (Ladakh) উদ্দেশে চলেছি। গোটা পথের পাশে পাশে শ্যোক নদী। বরফ গলা জলের ঘোলা স্রোত। নিদারুণ রুক্ষতার মাঝে নদীর ধার বরাবর কিছুটা সবুজ। দুপাশে রুক্ষ পাহাড়ের মাঝে সাপের পিঠের মতো কালো পিচের রাস্তা শুয়ে আছে আলস্য মেখে। মনে হয় এই রাস্তা বরাবর অনন্তকাল চলা যায়। প্রথমেই তুরতুক গ্রামে না ঢুকে আরেকটু এগিয়ে চলুন ভারত পাকিস্তানের বর্ডার বা LOC দেখতে।
আরও পড়ুন: লাদাখের গভীরে: পর্ব ১
ভারতবর্ষের সীমান্তে রয়েছে থং গ্রাম। সহসা যেদিন দেশ বদলে গেলো এই মানুষগুলোর, সেদিন তারা দেখলেন তাদের কোনো প্রিয়জন রয়ে গেছেন ওপারে। বাকি জীবনে আর তাদের দেখা হয়নি দেশভাগের বেড়াজালে। তুরতুক গ্রামে ঢোকার মুখে একটা পাহাড়ি নদীর উপর ঝোলা পুল আছে, তা আবার বেজায় দোলে। অনেকটা সিড়ি ভেঙে উঠে মনোরম তুরতুক গ্রাম। তার সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটার, গুহার মধ্যে কোনো জলধারা থাকার কারণে ঠান্ডা। তুরতুকের পালা শেষ করে ফিরলাম নুব্রা। কাল যাব প্যাঙ্গং লেক।

সকাল নটা নাগাদ বেরোলাম প্যাঙ্গং-এর পথে। অনেকটা পথ, রাস্তা বেশ খারাপ। মাঝে মাঝে বরফ গলা জল রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। যত বেলা বাড়ে, ততই জল বাড়ে, কারণ বরফ গলতে শুরু করে। ১৮০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে প্রথম যখন ১৪০০০ ফুট উচ্চতায় নীল জলরাশি নিয়ে প্যাঙ্গং আপনার চোখে ধরা দেবে, তখন এক মুহূর্তে হতবাক হয়ে যাবেন এর রঙের বাহারে।

এই লেকের অনেকটাই চীনের মধ্যে। আমাদের দেশের সীমানার মধ্যে যেটুকু আছে, তার ধার বরাবর গাড়ি নিয়ে ঘুরে নিতে পারেন। লেকের শুরুর অংশেই থ্রি ইডিয়টসের শুটিং হয়েছিল, সেখানেই ট্যুরিস্টের ভিড়। এখান থেকে একটু এগিয়ে যান। ভিড়ের ভার কাটিয়ে অপরূপ রূপে প্যাঙ্গং ধরা দেবে আপনার চোখে। আমরা ছিলাম প্রায় চার কিলোমিটার দূরে মেরাক গ্রামে।

সেখানে লেকের ধারে জলের মধ্যে ব্রাহ্মণী হাঁস ঘুরে বেড়ায়। লেকের জলের রঙ সূর্যের আলোর সঙ্গে পালটায়, কখনও পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে লালচে। বিকেলে লেকের ধারে তীব্র হাওয়ার দাপট ঠান্ডা কামড় দিল। তবু সূর্য ডোবা পর্যন্ত রইলাম লেকের ধারে। এরপর ঘরের দিকে।

ইচ্ছে ছিল পরদিন সকালে আরেকবার লেকের ধারে যাবো, কিন্তু উচ্চতাজনিত কিছু সমস্যা সামান্য উঁকি দেওয়ায় ঝুঁকি না নিয়ে সো মোরিরি যাওয়ার পথে রওনা দিলাম। লেকের বাকি অংশটুকু গাড়ি থেকেই দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। চোখ ফেরাতে পারি না প্যাঙ্গং-এর থেকে। যে জায়গা থেকে প্যাঙ্গং বাঁক নিয়ে চীনের মধ্যে ঢুকে গেল, সেখান থেকেই সো মোরিরির রাস্তায় চললাম। এই ১৬০ কিলোমিটার রাস্তা বৈশিষ্টে অনন্য। এই রাস্তায় পার হতে হবে কাকসাং লা, প্রায় ১৭৮০০ ফুট উঁচুতে।

এই পথে পাবেন লাদাখের বুনো গাধা। আর পাবেন তিনটি ছোট ছোট, অথচ অপূর্ব সুন্দর লেক, মিরপাল সো, ইয়া ইয়া সো, কায়াগার সো। হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে আপনি গাড়ি নিয়ে লেকের একদম পাশে পৌঁছে যেতে পারেন। তবে কীভাবে ফিরবেন এবং কোথায় থাকবেন সেটা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নেবেন, কারণ এই রাস্তায় থাকার জায়গা নেই বললেই চলে।

কায়াগার সো পার করে একটু এগোলেই আরেক চমক। সো মোরিরি ধরা দেবে আপনার চোখে। প্রায় ১৫০০০ ফুট উচ্চতায় এই লেক পাহাড়ের ছায়া বুকে নিয়ে চোখ ধাঁধিয়েে দেবে। অপূর্ব সুন্দর এই লেক। কিন্তু প্যাঙ্গং-এর মতো আত্মীয়তা গড়ে তোলা কঠিন, কারণ গাড়ি থেমে যাবে লেকের থেকে অনেকটা দূরে। লেকের একেবারে জলের ধারে যেতে অনেকটা হাঁটতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এখানে বেশ শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়, বহু মানুষকে স্থানীয় হাসপাতালে যেতে দেখেছি। কাজেই হোটেলের জানলা দিয়ে বা গাড়িতে বসে এই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করাই সহজ। যদিও আমরা লেকের ধারে চলে গিয়েছিলাম। লেকের শান্ত জলে যখন পাহাড়ের ছবি আপনাকে দ্বিধায় ফেলে দেবে কোথায় দিগন্ত রেখা, তখন শুধুই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেবেন এই দৃশ্য দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

আজ ফিরে চলা লেহ এর পথে। থিনলেস জানাল, আমরা চাইলে ফুগায় প্রাকৃতিক গিজার দেখাবে, আর তাংলাং লা দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা একপায়ে খাড়া। ফুগাতে দেখবেন প্রাকৃতিক গিজার থেকে কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর গরম জল উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে। আর তাংলাং লা সম্পর্কে যতই বলি না কেনো কম বলা হয়। বিরাট জনপ্রিয় খারদুং লা ১৭৮৮০ ফুট, তাংলাং লা ১৭৪৮০ ফুট, অপূর্ব সুন্দর, অথচ লোকের ভিড় নেই, সেনাবাহিনীর চলাচল সীমিত। অথচ মানালি হয়ে লাদাখ আসার পুরোনো পথে এই পাস পার হতে হয়।

এরপর লেহ’র কাছে র্যাঞ্চো স্কুল। যদিও আদৌ এটা স্কুল নয়, সিনেমার সেট সাজিয়ে রাখা। ২৫০ কিলোমিটার সফরের পর ফিরে এলাম লেহ’তে।
লাদাখের বাসের শেষদিনটা কার্যত ছিল আমাদের বাফার ডে। লাদাখের তিনটে বিখ্যাত মনাস্ট্রি দেখরে বেরোলাম। থিনলেসও নিয়ে যেতে খুবই আগ্রহী। প্রথমেই লামায়ুরু মনাস্ট্রি। লেহ থেকে কার্গিলের রাস্তায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। জাসকার ও সিন্ধুর সঙ্গম ছাড়ার পর থেকেই অদ্ভুত ভাবে পালটে যেতে থাকে পাথরের রঙ, আকৃতি। শুধু যেন এই পাথরের বৈচিত্র্য দেখেই দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আর লামায়ুরু, কেমন ফোপড়া হয়ে যাওয়া পাহাড়ের উপর সুন্দর মনাস্ট্রি।

এখান থেকে ফিরতি পথে গেলাম আলচি মনাস্ট্রি। আলচি ঠিক মনাস্ট্রি নয়, কারণ এখানে লামাদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, এটি চোসকর। তিনটি মন্দির, অন্দরেে গান্ধার আর্টের ছোঁয়া মুগ্ধ করে। এখান থেকে এলাম লিকির। তবে অনেকটা দেরি হয়ে যাওয়ায় লিকির মনাস্ট্রির ভিতরে ঢুকতে পারিনি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় এর মনোমুগ্ধকর রূপ বাইরে থেকেই দেখেছি।

দশটায় থিনলেস হাজির, লাদাখকে বিদায় জানানোর পালা। এগিয়ে চললাম এয়ারপোর্টের পথে। ফেরার উড়ানে ঘুরে ঘুরে দেখা কারাকোরামের রুক্ষ অথচ দৃপ্ত রূপ। একসময় মেঘের দল ঢেকে দেয় দৃশ্যপট। চোখ যা দেখেছে তা মনের গভীরে গেঁথে আছে। সময়ের স্রোত তাকে ফিকে করতে পারবে কিনা সময়ই বলবে।
ছবি: লেখক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর।পেশায় শিক্ষক। বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ফোটোগ্রাফির ডিপ্লোমা। ভালোবাসেন বেড়াতে, ছবি তুলতে আর পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।