আকাশমাঝে উড়তে উড়তে কুসুম রাঙা ভোরের আলো চোখে পড়তেই বিমানের খুপরি জানলায় তাকিয়ে দেখি বাইরেটা আগুন রঙে মাখামাখি। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবো লাদাখের (Ladakh) লেহ (Leh) বিমানবন্দরে।

দুদিন লেহ (Leh) শহরে বিশ্রাম নিয়ে দেখে নিলাম শ্যে প্যালেস, থিকসে গোম্পা এবং থ্রি ইডিয়েটস স্কুল। তৃতীয়দিনের মাথায়, একটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পূর্ব লাদাখের (Ladakh) হানলে, সো মোরিরি অঞ্চল ঘুরতে। বাহনচালকের নাম তাসি। বেশ মিশুকে ও ভদ্র।

আমাদের প্রথম গন্তব্য চুমাথাং। এখানকার উষ্ণ প্রস্রবণ লাদাখি মানুষজনের কাছে রোগ নিরাময়ের জন্য খুব বিখ্যাত। চুমাথাং পৌঁছে দেখলাম জল তো উষ্ণ নয় , রীতিমতো ফুটন্ত। সেই জলে কাপড় কাচা, স্নান সবই হচ্ছে। তবে সব কাজের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা। এখানে মানুষ শুধু রোগ নিরাময়ের জন্য আসে না, এই জলে স্নান করলে পুণ্য হয় বলেও তাদের বিশ্বাস।

ভাবলাম এখানেই আজকের দিনটা থেকে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু রোগী ও পুণ্যার্থীরা আমাদের ইচ্ছার মুখে এক বালতি গরম জল ঢেলে দিল। দু-তিনটে হোটেল আছে, কিন্তু সব ঘর আগেই বুক হয়ে আছে। গোমড়া মুখে একটু গরম জল নিজেদের মাথায় ছিটিয়ে নিউমার পথে এগিয়ে চললাম।

কালো ময়াল সাপের মতো রাস্তা, দুপাশে ছবির মতো সুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ গাড়ি থমকে দাঁড়াল। রাস্তার একধার দিয়ে চলেছে হিমালয়ান রেড ফক্স। খানিকক্ষণ তার চলন-বলন দেখে, আবার গাড়ি চলতে শুরু করে। নিউমায় পৌঁছে রাত্রে আশ্রয় নিলাম রাব্গা হোমস্টেতে। গৃহকর্ত্রীর আন্তরিক আতিথেয়তায় মন ভরে গেল।

সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম হানলের পথে। দূরত্ব প্রায় সত্তর কিমি। পথে কোথাও দেখলাম কিয়াং (বুনো গাধা), কোথাও ভেড়ার পাল নিয়ে যাযাবর চাংপা উপজাতির মানুষদের। তারকাখচিত পরিষ্কার রাতের আকাশ দেখতে মানুষ আসেন হানলে।

মাঝরাতে হোমস্টের থেকে বেরিয়ে এসে সাক্ষী থাকলাম অসম্ভব সুন্দর সে দৃশ্যের। মণিমুক্তো ছড়ান রাতের আকাশ ভেদ করেছে আলোর ঝর্ণার মতো ছায়াপথ। এছাড়াও হানলেতে আছে একটি সুপ্রাচীন গোম্পা এবং একটি জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।

পরের দিন চললাম পৃথিবীর উচ্চতম গাড়ি চলাচল করা গিরিপথ- উমলিং লা (১৯,৩০০ ফিট)। রুক্ষ পাথুরে পথ পেরিয়ে চড়াই ভেঙে গাড়ি উঠে এল পাসের মাথায়। পথে অবশ্য সঙ্গে আনা অক্সিজেন একটু গ্রহণ করতে হয়েছিল। পাশের ফলকের সামনে মেলা বসে গেছে ছবি তোলার জন্য। আমরাও সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে একটুও পিছপা হলাম না। গিরিপথের ওপর মিনিট পনেরো কাটিয়ে, প্রায় এভারেস্ট জয়ের আনন্দ নিয়ে, আবার ফেরা হানলের পথে।
পরেরদিন চললাম সো-কার হ্রদের পথে। দুপুরের দিকে পৌঁছলাম সো-কার লেক। হ্রদের চারপাশ জুড়ে সাদা রঙের সোহাগা আর সোনালি শুষ্ক ঘাসে ভরে রয়েছে। সোনার মাঝে আসমানী নীল পাথরের মত বিরাজমান সো-কার হ্রদ। লেকের প্রচুর পাখি আশেপাশে দেখা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণী হাঁস, ব্ল্যাক নেকড ক্রেন।
পরেরদিন নিউমাতে রাত্রিবাস করে, তার পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সো-মোরিরি লেকের পথে। সো-মোরিরি পৌঁছনোর খানিক আগে পড়ল কিয়াগার সো হ্রদ। কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে গেলাম সো-মোরিরি হ্রদের পাড়ে। নীল ওড়নার মতো জলে ব্রাহ্মণী হাঁসগুলো আরামে স্নান করছে। ভাগ্যক্রমে আমাদের আশ্রয় মিলল লেকের উল্টোদিকের সো-মোরিরি গেস্ট হাউসে।

ঘরে ঢুকতেই মন কেড়ে নিল দেওয়াল জোড়া এক বিশাল জানলা। সেই জানলা দিয়ে অনতিদূরে দেখা যাচ্ছে গাঢ় নীল টলটলে সো-মোরিরি লেক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রূপসী সো-মোরিরির জলের রঙ পরিবর্তন হচ্ছে। ভোরবেলায় স্নিগ্ধ রূপ। বেলা বাড়তেই লেকের জল উজ্জ্বল নীল রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। তার দিক থেকে চোখ ফেরান যায় না।

পরেরদিন চললাম সো-কার হ্রদের পথে। দুপুরের দিকে পৌঁছলাম সো-কার লেক। হ্রদের চারপাশ জুড়ে সাদা রঙের সোহাগা আর সোনালি শুষ্ক ঘাসে ভরে রয়েছে। সোনার মাঝে আসমানি নীল পাথরের মত বিরাজমান সো-কার হ্রদ। লেকের প্রচুর পাখি আশেপাশে দেখা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণী হাঁস, ব্ল্যাক নেকড ক্রেন।
আরও পড়ুন: হরশিল ও বাগোরি গ্রাম
হঠাৎ দেখা পেলাম বিশালাকার লামেইগিয়ার পাখির। কোনও শিকারের দিকে লক্ষ্য করে প্রায় আমাদের মাথা ছুঁয়ে গেল ওই উড়ন্ত পখিটি। ঘাবড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দও পেলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে, ক্যামেরা বের করতে করতে সে উধাও। এগিয়ে চলি লেহ শহরের দিকে, যেখানে শেষ হবে আমাদের এবারের লাদাখ (Ladakh) ভ্রমণ।
ছবি সৌজন্য: লেখক
ভ্রামণিক, লেখিকা এবং ফটোগ্রাফার।
One Response
অনবদ্য অনুভূতি… নীল নীতিমায়