(Monsoon) ইচ্ছের লাগাম না টেনে তাকে ছুটিয়ে দিলাম রাতে। দার্জিলিং মেলের কামরা, সওয়ারি আমরা কয়েকজন। জুলাই মাস, সকাল থেকেই মেঘের মুখ আবছা ভার, মাঝে মাঝে ঘন বিদ্যুতের ঝলক! এখন অঝোর ধারায় (Monsoon) বৃষ্টি পড়ছে। রাতে ট্রেন, ঠিক সময়েই ছুটছে। মনের লাগাম ছুটছে পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথে।
পরদিন সকালে, এন.জে.পি স্টেশন। ড্রাইভার অভিমুন্য লামা ইনোভা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। স্টেশন চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে সকালের জলযোগ সেরে যাত্রা শুরু হলো। সুন্দর চা’বাগান ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথে গাড়ি এগিয়ে চলল। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। একের পর এক পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে যেতে লাগলাম। পাহাড়ি পথের পাশে অতল খাদ। খুব সাবধানে গাড়ি চলছে। কখনো সখনো পাইন গাছের সারি, ঝরনাধারা। ঘন জঙ্গল, নিঝুম-নির্জন পরিবেশ। ক্রমেই জঙ্গলের পরিধি বাড়বাড়ন্ত।

অবশেষে ঈপ্সিত ‘কাসোয়ান’, প্রথম দিনের রাত্রিযাপন। পরিচ্ছন্ন সবুজ পরিবেশ। গৃহকর্ত্রী সকলকে ‘সাদা খাদা’ দিয়ে স্বাগত জানালেন। অতিথি আপ্যায়নের রীতি। মনে হয় তাদের পূর্বপুরুষ নেপালের বাসিন্দা। এই রীতি নেপালে এখনও আছে। তারা অতিথিদের খুব শ্রদ্ধা করেন। প্রথমে ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস, পরে ডাইনিং রুমে যত্ন সহকারে পরিপাটি করে দুপুরের খাবার দিলেন। খাবারগুলো গরম ও সুস্বাদু।
আরও পড়ুন: জঙ্গল পাহাড়ের গল্প
বেলা তিনটে। ঘরগুলো পরিপাটি করে গোছানো। জানালার বড় কাচের পাল্লা দিয়ে বাইরের দৃশ্য সহজেই দেখা যায়। বর্ষার সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান নয়। (Monsoon) বৃষ্টি একনাগাড়ে পড়ছে। বাইরে একটি গোল ঘর, ঝোলা বারান্দা আছে। সেখানে বসে আরামে আড্ডা দেওয়া যায়।
সন্ধ্যে সাতটার সময় চিকেন বার্বিকিউ, সঙ্গে হোমস্টে’র ভেজ পকোড়া ও কফি হাজির। আলসেমিতে রাত কাটল। পরদিন ভোর বেলায় হেঁটে কাসোয়ান গ্রাম ঘুরে, দু’শো বছরের পুরানো মাটির বাড়ি দেখতে গেলাম। মাথায় খড়ের চাল। দেওয়াল প্রায় কুড়ি ইঞ্চি চওড়া। নিরিবিলি ছোট গ্রাম। আরও দুটো হোমস্টে আছে। সবুজে-সবুজ ছয়লাপ। প্রায় প্রতিটা বাড়িতে নানান ফুলের গাছ। সামনে পাইনের সারি, ঘন জঙ্গল। (Monsoon)

সকালের জলখাবারের পর, পরবর্তী ঠিকানা ‘ঋষিহাট’। প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি পড়ছে। (Monsoon) সেই বৃষ্টির মধ্যেই ড্রাইভার অভিমুন্য গাড়ি নিয়ে পাড়ি জমাল। এইভাবে অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে তার কোনও অসুবিধা নেই। পথ নিঝুম। গা ছম্ ছম্ করা নির্জনতা। ঘন জঙ্গলে দিনেও আঁধার নেমেছে। আলোআঁধারির অনন্য রূপ। (Monsoon) অনবরত বৃষ্টি, কখনও মেঘলা আকাশ। পাকদণ্ডী বেয়ে কখনও ডানদিক কখনও বাঁদিক।
অবশেষে পাহাড়ি বাঁকের শেষে নিরাপদে এসে পৌঁছলাম ঋষিহাট হোমষ্টে। পাহাড়ি ছোট গ্রাম। অনেকটা উঁচুতে। অপরূপ বর্ষার সাজে সজ্জিত। (Monsoon) বৃষ্টির বহুবিধ রূপের সাক্ষী। একজন ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার ছিলেন। আমাদের আসাতে তিনি হিমসিম খাচ্ছিলেন। সেই দিন রাঁধুনিও অনুপস্থিত। নিজেরাই হাত লাগালাম। (Monsoon) বৃষ্টির কারণে ঋষিহাট গ্রাম ঘুরে দেখা সম্ভব হলো না। বর্ষায় প্রকৃতির ভরা যৌবন। এক অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী। সেই বা কম কি!
এইভাবে অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে তার কোনও অসুবিধা নেই। পথ নিঝুম। গা ছম্ ছম্ করা নির্জনতা। ঘন জঙ্গলে দিনেও আঁধার নেমেছে। আলোআঁধারির অনন্য রূপ। অনবরত বৃষ্টি, কখনও মেঘলা আকাশ। পাকদণ্ডী বেয়ে কখনও ডানদিক কখনও বাঁদিক।
পরদিন আমাদের যাত্রা ‘দাওয়াইপানি’। এই অঞ্চলটা পাখিদের মিলন ক্ষেত্র, মানে প্রজনন ভূমি। পাখি প্রেমীদের স্বর্গভূমি। আরও শুনলাম, এটাই নাকি পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র স্নো লেপার্ড-এর প্রজনন কেন্দ্র। জায়গাটা খুব রোম্যান্টিক। কাঞ্চনজঙ্ঘা দার্জিলিংকে তার সব সৌন্দর্য উন্মুক্ত করেছে। আর দাওয়াইপানি’কে দিয়েছে তার নিবিড় ভালোবাসার স্পর্শ।

দার্জিলিং থেকে মাত্র ২২ কিমি দূরে জোড়বাংলো টপকে এই রাস্তা। লামাহাটা যাওয়ার পথে ৬ মাইল এর আগে থেকে পথ ওপরের দিকে উঠে গেছে। এটাকে নয়াবস্তিও বলে। দাওয়াইপানি এক টুকরো স্বর্গ। এর প্রশান্তিময় পরিবেশ, কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয় পর্বতমালার চমকপ্রদ দৃশ্যের জন্য পরিচিত। গ্রামটিতে একশোরও বেশি পরিবার বাস করে।
আশেপাশে দর্শনীয় স্থান বলতে, ঘন পাইন বন, গ্লেনবার্ন টি এস্টেট, লামাহাট্টা টি এস্টেট, তাকদাহ টি এস্টেট আর নির্ভেজাল প্রকৃতি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দার্জিলি শহর দেখা যায়। পায়ে পায়ে দাওয়াইপানির নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম – গ্রামের রাস্তা, ফুলের বাগান, চা বাগানের দৃশ্য, হাস্যোজ্জ্বল স্থানীয় মানুষজন। হিমালয় শুনে ঘুম থেকে উঠে, অনন্য হিমালয় পাখির সন্ধান পাওয়া দুষ্কর নয়।

খুব ভোরে পাখির কিচির-মিচির শব্দে ঘুম ভাঙা কাছাকাছি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দিনের আলো ওঠার আগে একটি আকর্ষণীয় সূর্যোদয়ের সাক্ষী ও দিনের আলোয় ম্লান হয়ে যাওয়া সূর্যাস্তর অপূর্ব মুহূর্তের লোভনীয় সাক্ষী। জোরবাংলো, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে, রক গার্ডেন, জাপানিজ পায়জা টেম্পল, ন্যাশনাল পার্ক এর মতো চমৎকার দর্শনীয় স্থানগুলিতে ভ্রমণ করা যেতেই পারে।
(Monsoon) আজকের গন্তব্য দাওয়াইপানি থেকে দার্জিলিং। অভিমুন্য তাগাদা দিচ্ছে। দার্জিলিং-এ রিসর্ট আগে থেকে বুক করা আছে। একটি চা বাগানের ক্যাফেটেরিয়া দেখে ম্যালের কাছে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসর্টে ঢুকব, সেরকমই পরিকল্পনা।

গাড়ি দার্জিলিং ঢুকেছে। ডানদিকে চা’বাগানের পাশেই ‘গুডরিকের’ কাফেটেরিয়া। চা এল আমাদের টেবিলে। পাহাড়ি সুবেশী সুশ্রী ওয়েট্রেস হাসি মুখে টি-পট থেকে কাপে চা ছেঁকে পরিবেশন করলেন। সঙ্গে চকলেট পেস্ট্রি, হ্যান্ডমেড কেক, পোটাটো ফিঙ্গারস্। চারদিকে চা-বাগানের সবুজায়ন, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি। কুয়াশাচ্ছন্ন দার্জিলিং। অন্ধকার নেমে আসছে। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ইন্দ্রজালের জাদুকর যেন রেশমী চাদর মোড়া মায়া বিস্তার করেছে।
ছবি সৌজন্য: লেখক, শ্রেয়সী লাহিড়ী, flickr
হাওড়া জেলায় বাসিন্দা। পড়াশুনা লিলুয়া টি. আর. জি. আর খেমকা হাই স্কুল। কলেজ- সিটি কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেসন, মির্জাপুর স্টিট, কলিকাতা। বি. কম গ্র্যাজুয়েট। ছোট থেকে কবিতা লিখতে ভালবাসেন। ট্রেকিং, মাউন্টেনিয়ারিং ভালোবাসেন, লেখালিখির হাতেখড়ি পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ভ্রমণ পত্রিকায়। হিমালয়াস্ বেকন-এর একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ট্রাভেল রাইটার্স ফোরামের সদস্য।