(Purulia Wildlife) পুরুলিয়ার বন্যপ্রাণকে চাক্ষুষ করার স্বপ্ন ছিল বহুদিন ধরে। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। উত্তরের পাহাড়ে পাখির খোঁজে বার কয়েক গেলেও পুরুলিয়া যাওয়া হচ্ছিল না। তাই সত্যজিৎ যখন প্রস্তাব দিল, এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

২০২৩ সালের জুলাই মাসের একবারে শেষ। বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝেই। বর্ষায় পুরুলিয়া অপরূপা। পাহাড়ের কোলে সবুজের মেলা। এই ছবিই দেখে এসেছি চিরকাল। ভোর ভোর রিজার্ভ করা গাড়িতে চেপে দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জ, মেজিয়া, শালতোড়া হয়ে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া রোড ধরে চললাম পুরুলিয়ার উদ্দেশে। পথেই সকালের জলখাবার সেরে নিয়েছিলাম। এরপর পুরুলিয়া টাউনে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বড় বড় বাড়ি আর শপিং মলের ভিড়ে হারিয়ে গেছে পুরুলিয়ার নির্মল প্রকৃতির ছবি। বেশ ঝাঁ চকচকে শহর। (Purulia Wildlife)

আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানা হোটেল সিটি নেস্ট। লাগেজ রেখে বেড়িয়ে পড়লাম প্রকৃতির খোঁজে। আমাদের পুরুলিয়া সফরের গাইড সর্বজিৎ নন্দীকে গাড়িতে তুলে এগিয়ে চললাম শহর ছেড়ে পাহাড়ের কোলে। একটা নির্মল অনুভূতি শরীর মন সতেজ করে দিচ্ছে। নয়ন ভরে দেখছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে লালিত বর্ষার পুরুলিয়াকে। গাড়ি যেখানে থামল সেখান থেকে অযোধ্যা পাহাড়ে প্রবেশের গেট দেখা যায়। দূরে পাহাড়ের আবছা দৃশ্য ক্রমে স্পষ্ট হতে লাগল। গোজাবুরু, ঢোলবুরু, চামটাবুরু প্রভৃতি নাম তাদের। কোনটা কী পাহাড় আঙুল দিয়ে দেখাল সর্বজিৎ। একটা সবুজ পাহাড়ের রেঞ্জ দেখে আমার মনে হলে যেন ‘স্লিপিং বুদ্ধ’। (Purulia Wildlife)

আমরা যেখানে থেমেছিলাম সেই পথ ধরেই অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার রাস্তা। একপাশে মাঠের মধ্যে নানান গাছগাছালির ভিড়। এখানে টনি-বেলিড ব্যাবলার পাখির বাস। তবে আমরা তার দেখা পাইনি। দেখা পেয়েছিলাম রেড-রাম্পড সোয়ালো, গ্রে-বেলিড কাক্কু আর ওরিয়েন্টাল হানি বাজার্ডের। সবুজ পাহাড়ের সাথে শ্রাবণের কালো মেঘের ঘনঘটা চলছিল। এখান থেকে বেরিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের সর্পিলাকার পথ ধরে পাহাড় চড়া শুরু। (Purulia Wildlife)
বেশ কিছুক্ষণ হিলটপ থেকে চারপাশের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখে আমরা রওনা দিয়েছিলাম মাঠা রেঞ্জ অফিসের কাছে। সেখানেই কয়েকদিন আগে দেখা দিয়েছে মটেল্ড উড আউল বা বনপ্যাঁচা। কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে থেকে সে নিখোঁজ। সেখানে পৌঁছে আমরা প্রথমেই জঙ্গলের যেদিকে তাকে দেখা গিয়েছিল, সেদিকে ঘুরলাম। কিন্তু দুধরাজ, বর্ণালী, হোয়াইট-রাম্পড শ্যামা আর কালো-ঘাড় রাজন ছাড়া অন্য কিছু পেলাম না। (Purulia Wildlife)

রাস্তা পার করে উল্টোদিকের জঙ্গলে ঢুকেছি। গাছের মগডালে বসে আছে সিঁদুরে মৌটুসি আর মাটিতে বসে জলপান করছে অ্যাঙ্গেলড সানবিম প্রজাপতি। এরই মধ্যে ডাক দিয়ে সে তার অস্তিত্ব জানান দিল। রেঞ্জ অফিসের উল্টো দিকের বনে গাছের ডালে পাতার ফাঁকে বসে আছে বনপ্যাঁচা। এখান থেকে আমরা দুপুরের খাবার খেতে চলে গিয়েছিলাম সোনাকুপি রেস্টুরেন্টে। (Purulia Wildlife)
মেঘের চাদর সরে রোদ দেখা দিতেই পুরুলিয়ার বিখ্যাত রক অ্যাগামারা রোদ পোহাতে পাথরে এসে বসল। আরেকটু উঠতেই দেখি একটা গাছের পাতার আড়ালে নববধূর মত মুখ ঢেকে বসে আছে ইন্ডিয়ান ঈগল আউল। এখান থেকে আমরা গেলাম বেঙ্গল ফক্সের খোঁজে।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর গাড়ি চেপে পৌঁছে গেলাম মায়াবন। সত্যিই মায়ায় ঘেরা মায়াবী বন যেন দু-হাত বাড়িয়ে ডাকছে পরম সোহাগে। একটা ছোট্ট ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে গেছে জলের ক্ষীণ ধারা। তাতে ক্রিমসন মার্স গ্লাইডার, রুডি মার্স স্কিমার, গ্রেটার ক্রিমসন গ্লাইডার ফড়িংদের রঙিন আড্ডা। বনে ঢুকতেই একজোড়া সহেলী পাখি আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। এখানে দেখা পেয়েছিলাম ফটিকজল আর দুধরাজের সাথে ফ্রক-টেল ড্রঙ্গো কাক্কু পাখি আর থ্রি-স্ট্রাইপড পাম স্কুইর্যাল কাঠবেড়ালির। (Purulia Wildlife)

পাখি দেখতে পাখি পাহাড়ে পৌঁছলাম সন্ধ্যার আগেই। শান্ত স্নিগ্ধ সবুজে ঘেরা পাহাড়ের কোলে ঠিক যেন ছোট্ট আরশিনগর। এখানে জঙ্গল আউলেটের সঙ্গে দেখা পেয়েছিলাম বাদামি-মাথা বসন্তবৌরি, চশমা পাখি, বাঁশপাতি, দুধরাজ আর সোনালি কাঠঠোকরার। কিছুটা সময় কাটিয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে গেলাম অযোধ্যা লোয়ার ড্যামের কাছে। (Purulia Wildlife)

সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসতেই চারপাশের পরিবেশ বদলে যেতে লাগল। ক্ষীণ আলোয় নীলচে আভা ফুটে উঠছিল লোয়ার ড্যামের জলে। নিকষ অন্ধকার চারপাশ ঢেকে ফেলতেই পাশের ঝোপ থেকে রাতচরারা তাদের উপস্থিতি জানিয়ে দিল ডাক শুনিয়ে। এই নৈশ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য রাতের বন্যপ্রাণ চাক্ষুষ করা। লোয়ার ড্যাম থেকে গাড়ি একটু একটু করে উপরে উঠছে আর চারপাশ ভালো করে লক্ষ্য করছি। এমন সময় দেখি সামনের তারে একটা পাখি এসে বসল। টর্চ ফেলতেই পাশের তারে উড়ে গেল। খুব ধৈর্য ধরে এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলে নিরীক্ষণ করে বুঝলাম এটা ইন্ডিয়ান নাইটজার নয় বরং কম দৃশ্যমান জঙ্গল নাইটজার। (Purulia Wildlife)

এখান থেকে আপার ড্যামে উঠতে উঠতে দাঁতাল হাতি আর লেপার্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। যদিও তাদের কারোর সঙ্গেই আমাদের মোলাকাত হয়নি। দুপাশ অন্ধকার আর হেড লাইটের আলোয় বেশ ছমছমে পরিবেশে। এগিয়ে যেতে যেতে দেখি বাঁ পাশে তারের উপর বসে আছে জার্ডনের নাইটজার আর তার পেছনে আধভাঙা চাঁদ। হঠাৎ সামনের রাস্তায় উড়ে এসে জুড়ে বসল একটা ইন্ডিয়ান স্কপস আউল। (Purulia Wildlife)

সর্বজিৎকে ছেড়ে দিয়ে আমরা হোটেলে পৌঁছলাম বেশ রাতে। পরদিন ভোরে উঠে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ইন্ডিয়ান ঈগল আউল দেখব বলে। শহর ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল তিলাবনির কাছে এক পাহাড়ের উদ্দেশে। পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটায় ঢুকে প্রথমেই একজোড়া শেয়ালের দেখা পেলাম। রাস্তা পারাপার করছিল। তিতির পাখির দল মাঠ থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার সংগ্রহ করছে। পাহাড়ের কাছে পৌঁছে গাড়ি থামল। পায়ে হেঁটে পাহাড়ের কাছে এগিয়ে চলেছি। একপাশে চাষের খেত আর ঘাসবন, অন্য পাশে লম্বা গাছের সারি। পাহাড় যেন তৈরি হয়েছে ঈগল আউলকে আশ্রয় দিতেই। পায়ে হেঁটে যেতে যেতে বেঙ্গলফক্স আর হায়নার পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। (Purulia Wildlife)

পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু যাদের জন্য এখানে আসা তাদেরই দেখা নেই। বেশ কিছুক্ষণ বাদে একটা প্যাঁচা উড়ে এসে পাথরের উপর বসল। সেটার ছবি তুললাম দূর থেকে। অন্যদিকে মাঠের আলে বসে ডাক দিচ্ছে কালো তিতির। উড়ন্ত অবস্থায় তার ছবি তুলে পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। একটা পাথরের খাঁজে অবশেষে বসে থাকতে দেখলাম প্যাঁচাটাকে। আমি আর সর্বজিৎ পাথরের খাঁজ, গাছের ডাল ধরে উপরে উঠছি আর দেখছি হায়নার চিহ্ন। মেঘের চাদর সরে রোদ দেখা দিতেই পুরুলিয়ার বিখ্যাত রক অ্যাগামারা রোদ পোহাতে পাথরে এসে বসল। আরেকটু উঠতেই দেখি একটা গাছের পাতার আড়ালে নববধূর মত মুখ ঢেকে বসে আছে ইন্ডিয়ান ঈগল আউল। এখান থেকে আমরা গেলাম বেঙ্গল ফক্সের খোঁজে। পুটুস ফুলের ঝোপ আর লাল মরামের উপরে বসে আছে সাদার্ন গ্রে-শ্রাইক আর ইন্ডিয়ান বুশলার্কের। (Purulia Wildlife)

মাঠের আল ধরে হেঁটে চলেছি খেঁকশিয়ালের ছবি তুলতে। জমির এক অংশে চাষ হচ্ছে আর চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট দূরেই মানুষের জনবসতি। এর মধ্যেই খেঁক শিয়ালের পরিবার বাস করছে সপরিবারে। আলের নীচে আয়েশ করে বসে আছে একটা খেঁকশিয়াল। আমরা আল ধরে এগিয়ে যেতেই সতর্ক প্রাণীটা ছুট লাগাল। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগল। ছবি হলো, তবে আরও কাছে থেকে ছবি চাই। সেই আশায় বিকেলে আবার আসা হবে। (Purulia Wildlife)

বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে দুপুরের খাবার খেতে একটা ধাবায় গেলাম। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এল। গুমোট ভাব আর নেই। খাওয়া শেষ করে আমরা আবার পৌঁছে গেছি আগের জায়গায়। কিছুক্ষণ মাঠের অন্য প্রান্তে ঘোরাঘুরি করলাম। পথে যেতে যেতেই রাস্তার পাশে চাষ জমিতে স্টোন কার্লুর দেখা পেলাম। একটা কাঁটা গাছের বৃষ্টিভেজা শিকড়ে বাজ বসেছিল। সরালরা ঘরে ফিরছে। আমরাও বেঙ্গল ফক্স তুলতে চলেছি, এমন সময় কালো তিতির মাঠের মধ্যে ডেকে উঠল। খুব সন্তর্পণে কিছুটা এগিয়ে তাকে আবিষ্কার করলাম পুটুস ঝোপের পাশে। ছবি তুলে ফিরে এলাম।

মাঠে নেমে দেখি বিজ্ঞের মত মদনটাক একা বসে আছে মাঠের মাঝে। আমাদের দেখে উড়ে গেল আকাশি নীল মেঘে গেরুয়া আবির ছড়ানো আকাশপানে। আলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম তাকে। আমরা আর পিছু না নিয়ে অপেক্ষা করলাম। তার সঙ্গিনীও হাজির। একটু করে এগোতে থাকি আর থেমে যাই। দুটো বাচ্চার খুনসুটি দেখলাম প্রাণ ভরে। আলের উপর বসে ভিডিও বানালাম। সে আমাদের দেখে আর পালাচ্ছে না। ছবি তুলে ফেরার পথে তাদের বাসা খুঁজে পেলাম।

ফেরার পথে একটা কুটুরে প্যাঁচা পেলাম। সন্ধ্যা নামার আগে সে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছিল। এদের ছেড়ে আসতে মন চায় না। হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম বাড়ির পথে। সন্ধ্যার চা জলখাবার পেটে পড়তেই গাড়িতেই ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম। হঠাৎ চঞ্চল বলে উঠল, ‘অমরদা কতগুলো শেয়াল দেখ’! চমকে উঠে বললাম কোথায় শেয়াল! দেখি রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকার আগে চোখ দিয়ে মেপে নিচ্ছে আমাদের। সেদিন রাত্রে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমি আর সর্বজিৎ যে পাহাড়টায় উঠেছিলাম সেখানে আমি একা, আর আমার হারানো টুপিটা মাথায় পড়ে একটা বাচ্চা হায়না হাসছে ‘হাঁ-হাঁ-হাঁ’।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া বা সাঁতরাগাছি ষ্টেশন থেকে পুরুলিয়া যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে। এছাড়া ট্রেন আসছে আসানসোল ষ্টেশন থেকে। বাসেও পুরুলিয়া যাওয়া যায়।
কখন যাবেন: প্রখর গ্রীষ্ম ছাড়া যেকোনো সময় পুরুলিয়া যাওয়া যায়। ঋতুভেদে রূপ বদলায় রূপসী পুরুলিয়া।
কোথায় থাকবেন: পুরুলিয়া শহরে প্রচুর হোটেল আছে। আমরা ছিলাম স্টেশনের কাছে ‘হোটেল সিটি নেস্ট’-এ। যোগাযোগের নম্বরঃ ৮৩৮৮০৫৬২১৪ । অযোধ্যা হিলটপে পলাশবাড়িতে থাকতে পারেন (ওয়েব সাইট: www.palashbari.com) ।
গাইড: সর্বজিৎ নন্দী, মুঠোফোন – ৯০০২৪৭২০৮৫
ছবি: লেখক, Wikimedia Commons
লেখক, পেশায় বিদ্যালয় শিক্ষক। ভালবাসেন পাহাড়ে ঘুরতে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করেন জীববৈচিত্র, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ইকোট্যুরিজম বিষয়ে। লেখকের প্রকাশিত বই – ‘বাংলার উভচর’।