ধানসিড়ি প্রকাশনীর প্রতিটি বইয়ের মধ্যেই বড় যত্নের ছাপ থাকে। যেমন সজ্জায়, তেমনই বিষয়বৈচিত্র্যে। ঘুরে ফিরে হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে করে প্রতিটি বই। এ ভাবেই গত বছর বইমেলায় কিনে ফেলেছিলাম ‘চিন্তামণির থটশপ’। সুরসিকা সাহিত্যিক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের কল্পবিজ্ঞানের বই। টার্গেট পাঠক কিন্তু শুধু ছোটরা নয়। বড়রাও। আজ যদিও সেই বইয়ের কথা নয়। বরং বলব ইন্দিরাদির অন্য একটি উপন্যাসের কথা। উপন্যাসটির নাম ‘ত্রিধারা’। তিন যুগের, তিন প্রজন্মের তিন নারীর কথা। এ এক আশ্চর্য সফরং।
যশোধরা, স্রগ্ধরা এবং শ্রীধারা। তিন নারী। সুন্দরী, ব্যক্তিত্বময়ী। দিদিমা, মায়ের যুগ পেরিয়ে নাতনির প্রজন্ম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ-ও বোধ হয় তিন প্রজন্ম নিয়ে এক সাদামাটা ট্রিলজি। কিন্তু কাহিনির অবিশ্বাস্য গতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে তিন নারীর জীবনের কেন্দ্রে এক রোমাঞ্চকর অলৌকিকতা।
এই অলৌকিক চিত্রকল্পে জুড়ে রয়েছে ভ্রমণকাহিনি। মধ্যপ্রদেশের অপার্থিব সৌন্দর্য এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় মাখানো। অমরকন্টক, ঘুঘুয়া ফসিল পার্ক, বিলাসপুর, ভীমবেটকার নিখুঁত বর্ণনা। লেখিকার ভ্রমণকাহিনি আর রম্যরচনায় অনায়াস দক্ষতা তাঁকে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছে একটি রোমাঞ্চকর উপন্যাস। কনে দেখা মেঘের আলোয় জমে গেছে একের পর এক দৃশ্যকল্প। সুন্দরী শিক্ষিতা যশোধরা দশ বছরের বিবাহিত জীবন শেষে সফল মাতৃত্বের স্বাদ পেলেন। স্রগ্ধরা মায়ের লেখা ডায়েরি পড়ে সেই একই জায়গায় গিয়ে নিজেও অন্তঃসত্ত্বা হয়। এই দু’টি ঘটনা এক আশ্চর্য সুতোয় গাঁথা। শুধুই অলৌকিক? যুক্তিতর্কের বেড়াজালের উর্ধ্বে থাকে যে মায়াময় জগৎ, সেখানে কাল্পনিক, অলৌকিক আর কাকতালীয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই অনুসন্ধিৎসা তাড়িয়ে বেড়ায় শ্রীধারাকে। আর সেও সেই একই ঘটনার সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে আসে। এভাবেই তিন প্রজন্ম, তিন নারী এবং ভীমবেটকার গুহার আলো-আঁধারি কুহেলিকা; সব মিলিয়েই ‘ত্রিধারা’।
যুগের ধর্ম এসেছে উপন্যাসে। পরিবর্তনশীল চিন্তাধারা। বিয়ের বিশুদ্ধতাও আছে। আবার ‘লিভ টুগেদার’-ও। সমাজ সংসার যেমন রয়েছে, তেমন মিলেমিশে গেছে ইতিহাস, ভূগোল। লেখিকার পাঠের গভীরতা উপন্যাসের রসহানি ঘটায় না। বরং পাঠক তরতরিয়ে এগিয়ে যান তিন প্রজন্মের বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির হাত ধরে। রক্তের টান আর অলৌকিক এক ঘটনা তিন পক্ষকেই দাঁড় করিয়ে দেয় স্থান ও কালের এক চরম আবর্তে। সে যেন অন্তঃসলিলা এক নদী। কখনও আসে হিপনোটিজম, কখনও হ্যালুসিনেশন।
ভীমবেটকার রক পেন্টিং আর কেভ আর্টের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক অজানা সত্য। প্রাগৈতিহাসিক যুগের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আজকের ঐতিহ্য। জন্মজন্মান্তরের মৈথুনরহস্য নিয়ে ধূসর অতীত সৃষ্টির তুলিতে এখানে রঙিন। সিঙ্গল মাদার থেকে মাঙ্গলিক এক পুরুষের কাপুরুষতায় এই উপন্যাসের শেষ। কিন্তু সৃষ্টির যে আদিম রস ছড়িয়ে রয়েছে, যে রহস্য গোপন রয়েছে, সেই সব কিছুতেই লেখিকা বুলিয়ে দেন তাঁর কলমের মায়াকাজল। সেখানেই এই উপন্যাসের সাফল্য, উত্তরণ।
বইয়ের নাম – ত্রিধারা
লেখক – ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক – ধানসিড়ি
দাম – ২০০ টাকা
জন্ম কলকাতায় ১৯৭১ সালে। কর্মসূত্রে ১৯৯৮ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের এফ এম রেনবো ও এফ এম গোল্ডে উপস্থাপিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং ‘ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলজি’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি পেলেও একমাত্র প্যাশন লেখালিখি। ‘আজকাল’, ‘আবার যুগান্তর’, ‘খবর ৩৬৫’, ‘একদিন’ ও অন্যান্য বহু পত্র-পত্রিকা-ওয়েবজিনে লেখালিখির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। গাংচিল প্রকাশনা থেকে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘অসমাপ্ত চিত্রনাট্য’।