(Tulsi Chakraborty) “উনি যে ভাবে অভিনয় করেন, আমি তো কোনোদিনই পারব না। ওঁর মতো ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না।” বক্তা স্বয়ং উত্তমকুমার। আর যাঁর সম্পর্কে এই সশ্রদ্ধ উক্তি, তিনি আর কেউ নন, বাংলা ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী!
তাঁর অভিনয় দক্ষতার কথা বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “কেউ যদি দেখাতে পারেন অমুক ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী খারাপ অভিনয় করেছেন, তা হলে আমি লাখ টাকার বাজি হেরে যাব। কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই খুব উঁচু দরের সহজাত অভিনয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি।” অথচ কেউ প্রশংসা করলে তুলসী নিজের সম্পর্কে বলতেন, “আমি হলাম গিয়ে হেঁশেলবাড়ির হলুদ। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতেই আছি। কিন্তু হলুদের কি নিজস্ব কোনও স্বাদ আছে!” (Tulsi Chakraborty)
কৃষ্ণনগরের গোয়াড়ি নামে এক ছোট্ট গ্রামে, ১৮৯৯ সালের ৩রা মার্চ তুলসী চক্রবর্তীর জন্ম। কম বয়সে বাবা মারা যান। ফলে বেশি দূর পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি। যাযাবর জীবনের সেই শুরু। অল্প কিছু রোজগারের আশায় ফুটপাথের দোকানে কাজ করেছেন। ঘড়ি মেরামতির কাজ থেকে তৎকালীন ‘মতি রায়’ সার্কাসে জোকারের পার্ট, সবই করেছেন। পরে তাঁর জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তী তাঁর জন্য ছাপাখানায় কম্পোজিটরের চাকরি দেখে দেন। চিৎপুরের সেই ছাপাখানায় নিয়মিত থিয়েটারের পোস্টার-হ্যান্ডবিল ছাপা হতো। পোস্টারে শিল্পীদের নাম, থিয়েটারের মনোহারী ভাষা পড়ে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখতেন তুলসী। (Tulsi Chakraborty)
জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীও ছিলেন থিয়েটার জগতের মানুষ। সেই সূত্রেই স্টার থিয়েটারে যাওয়া আসা ছিল। উইংসের ধারে দাঁড়িয়ে থিয়েটার দেখতেন তরুণ তুলসী চক্রবর্তী। সেখান থেকেই অভিনয়ে আগ্রহ। ভাবতেন অভিনেতা হতে পারলে তাঁর নামও নিশ্চয়ই একদিন পোস্টারে ছাপা হবে।
শেষমেশ ছাপাখানার কাজ ছেড়ে যোগ দিলেন স্টার থিয়েটারে, সালটা ১৯১৬। তখন স্টার থিয়েটারের কর্ণধার প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর ছত্রছায়াতেই অভিনয়ের পাঠ শুরু। এই মানুষটিকে আজীবন গুরু বলে মেনে এসেছেন তুলসী চক্রবর্তী। (Tulsi Chakraborty)
ভিডিও: রবির আলোয় – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
থিয়েটারে অভিনয় করতে এসেই তিনি তালিম নিলেন টপ্পা গানের। শিখলেন তবলা-পাখোয়াজ বাজানো। এমনকি নাচেও পারদর্শী হয়ে উঠলেন। ১৯২০ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে প্রথম সুযোগ পেলেন অভিনয়ের। সেই শুরু, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নাটকের সূত্রেই এল ফিল্মের অফার। ১৯৩২-এ প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুনর্জন্ম’। ১৯৩৯ সালের ‘জনকনন্দিনী’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ছিল দেখার মতো। ১৯৪৫ সালে নিরেন লাহিড়ীর পরিচালনায় ‘ভাবীকাল’ ছবিটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে।
পরে কৌতুক অভিনেতা হিসাবে খ্যাতি পেলেও প্রথমে কিন্তু সিরিয়াস চরিত্রেই অভিনয় করতেন তুলসী চক্রবর্তী। ১৯৩২ থেকে ’৬১ সাল পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রকে একের পর এক অসামান্য চরিত্র উপহার দিয়েছেন। বাংলা, হিন্দি, উর্দু মিলিয়ে অভিনয় করেছেন চার শতাধিক ছবিতে। এর মধ্যে বাংলা ছবির সংখ্যাই তিনশোর বেশি। (Tulsi Chakraborty)
অভিনয়ই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। চরিত্র যেমনই হোক, অভিনয়ের নিজস্বতায় সর্বত্রই তিনি অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কখনও ‘পথের পাঁচালি’-র প্রসন্ন পণ্ডিত, কখনও ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির চক্কোত্তি মশাই। আবার কখনও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর মেস-মালিক রজনীবাবু। তাঁর অনবদ্য অভিনয়ে ম্লান হয়ে গিয়েছেন বহু তারকা, মহাতারকারাও। (Tulsi Chakraborty)
১৯৫৮ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁকে মুখ্য চরিত্র ভেবে ‘পরশ পাথর’ করার কথা ভাবেন। সত্যজিতের প্রস্তাব শুনে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর মতো অভিনেতাকেও যে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে তা আসলে কোনোদিনও ভাবেননি। সত্যজিৎ বেশি পারিশ্রমিক দিতে চাইলে তাও নেননি। শহরের রাস্তায় বড় বড় হোর্ডিং দেখে নিজেই বলেছিলেন, “এ আমি কী হনু হলাম রে!” সত্যজিতের মতে, “ভাঁড়ামিতেই হোক বা জাত কমেডিতেই হোক, তুলসীবাবুর জায়গা নিতে পারে এমন আর কেউ এদেশে নেই।”
এরপরেও ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রাপ্য মর্যাদা তিনি পাননি। আজীবন ন্যূনতম পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন অধিকাংশ ছবিতে। অনেক সময় পারিশ্রমিকও নিতেন না। ফলে এতকিছুর পরেও দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। স্ত্রী ঊষারানিকে নিয়ে হাওড়ার কৈলাস বসু লেনে ছোট দু’কামরার ঘরে থাকতেন। শেষ জীবনে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হয়েছে৷ তাঁর মৃত্যুর পরও চূড়ান্ত অর্থকষ্টে কেটেছে ঊষারানি দেবীর জীবন।
শতবর্ষ পেরিয়ে আজও তাঁর নামে হয়নি কোনও রাস্তা, মূর্তি বা পুরস্কার। তাঁর অধিকাংশ কাজ ও বসতবাটি সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। তবুও সিনেমার সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তীর যোগসূত্র হারানোর নয়, কারণ বাংলা ছবির সত্যিকারের ‘পরশ পাথর’ তো তিনিই!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।