উঠোন বলে কিছু থাকবে কী করে? পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আচমকা কাঠের পাটাতন বা টিনে-ছাওয়া মাটির ঘর। ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়লে অক্কা পেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। অথচ এখানে মৃত্যুর কথা ভাবতেই লজ্জা লাগে। উঠোন না থাকলেও, ওই একরত্তি ঘরের পাশে একফালি উঁচুনিচু ভূমিখণ্ডে মাচায় ঝোলে স্কোয়াশ। পেঁপে সদৃশ সবজিটি এ অঞ্চলের পেটেন্ট বলা যায়। পাহাড়ি অঞ্চলের। ঘরের বেড়াতেও স্কোয়াশের লতানে গাছ। সবুজ যেন ঘরে ঢুকে পড়ছে। শুধু কি ঘরে? ঘর হতে দুই পা ফেলিলেই চারপাশে ঘন সবুজ। পাহাড় বটে, কিন্তু ধূসরতার লেশমাত্র নেই দিগন্তে। পাথরও যেন সবুজ। ঘন বন না হলেও সবুজের কিন্তু কমতি নেই।
গাঁয়ের নাম তাসিগাঁও। নাম শুনলে মনে হবে না, বাংলা মুলুকে এমন তল্লাট আছে। নাম কেন, হেলিকপ্টার থেকে হঠাৎ নামিয়ে দিলেও বোঝার উপায় নেই যে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বাংলা এটা! যে কোনও ঘরে ঢুকুন। কোথাও মমতার ছবি নেই। মোদীরও না। এমনকি গান্ধী-সুভাষকেও খুঁজে লাভ নেই। আমাদের চেনা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কারও বিগ্রহ কিংবা বাঁধানো ফটো, এমনকি ক্যালেন্ডার পর্যন্ত নেই। আছেন জিগমে সিংগে ওয়াংচুক। ভূটানের রাজা। ঘরে ঘরে তিনি আছেন। যেন ত্বমেব রাজা দেবতা ত্বমেব ত্বমেব মন্ত্রী ইত্যাদি আর কী। টেলিভিশন বস্তুটার বালাই নেই। থাকবে কী করে? গাঁয়ে বিদ্যুতের কথা কষ্টকল্পনাতেও যে আসবে না তাসিগাঁওবাসীর। রেডিয়ো আছে। বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। না, আকাশবাণী মিলবে না। ঘরে ঘরে সুর ছড়ায় নেপাল রেডিয়োর গান। বাংলা ভাষা এখানে অচল। নেপাল রেডিয়োর গান শুনলেও এখানকার বাসিন্দারা এক বিজাতীয় ভাষায় কথা বলেন। হিন্দিটায় কাজ চলে বটে। তবে সবাই বলতে, বুঝতে পারেন না। নেপালি কিংবা ভূটিয়া জানলে কোনও কথাই নেই। তাহলে এখানে আপনি স্বজন। মনে হতেই পারে, আমি নিশ্চয়ই নেপাল, ভূটান, নিদেনপক্ষে সিকিমের কোনও গ্রামের গপ্পো ফেঁদে বসেছি। আরে ছোঃ! তাসিগাঁও নিখাদ বাংলার এক গ্রাম।
তবে দার্জিলিং পাহাড়ের গ্রাম নয়। তাসিগাঁও আলিপুরদুয়ার জেলার এক পাহাড়ি বসত। এই জেলায় অনেকে বক্সা জঙ্গলে বেড়াতে আসেন। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প। অনেকটা জমিদার পরিবারের তালপুকুরে ঘটি না ডোবার অবস্থা। বাঘের নামে সরকারি প্রকল্প। কোটি কোটি টাকা মঞ্জুরি আসে। কেন্দ্র-রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাঙ্কও এখানে বাঘের কল্যাণে টাকা ঢেলেছে। কিন্তু কানামাছি ভোঁ ভোঁ। শেষ কবে বক্সায় বাঘ দেখা গিয়েছে, হলফ করে বলার কেউ নেই। তাও লোকে আসে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ঢালাও আয়োজন করে রেখেছে প্রকৃতি। চিতাবাঘ, বাইসন, হরিণ, হাতি, ময়ূর, নানা জাতের পাখি, হাজার রকমের পতঙ্গ দেখতে দেখতে বাঘের কথা মনেই আসবে না। পিচঢালা পথ জুড়ে প্রজাপতি যেভাবে স্বাগত জানায়, তাতে বরং ব্যাঘ্রগর্জন শুনলে পিন্ডি চটকে যেতে পারত ভয়ে। প্রকৃতির এমন নয়নাভিরাম পরিবেশে সেটা কি ভালো লাগত?
তাসিগাঁও কিন্তু এই বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকার মধ্যেই পড়ে। বেড়াতে কেউ কেউ জয়ন্তী আসেন। ট্রেকিং করে বক্সাদুয়ারে যান। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বক্সা দূর্গ আছে এখানে। কোচবিহার রাজের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে এই কেল্লাটা ব্যবহার করত ভূটান। মিলিটারি ব্যারাক হিসেবে। পরে ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধেও কাজে লাগে। পাহাড়ের ওপর দূর্গ। তাতে উঁচু নজরমিনার। বহু দূর থেকে শত্রুপক্ষের গতিবিধি নজরে আসত। কেউই তাই এই পথে ভূটান দখলে অগ্রসর হতে পারেনি তেমন ভাবে। কিন্তু সিঞ্চুলা চুক্তিতে সেই বক্সা ফোর্ট হাতছাড়া হয় ভূটানের। এলাকার দখল পায় ভারতের তদানীন্তন শাসক ইংরেজরা। বক্সাপাহাড়ের পথ তখন দূর্গম। দূর্গটা পছন্দ হল ব্রিটিশদের। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কয়েদখানা বানিয়ে ফেলল তারা। পাণ্ডববর্জিত এই এলাকা থেকে পালানো ঠেকানোর জন্য পাইক-বরকন্দাজ দরকার নেই। হয় বাঘের পেটে যেতে হবে, নাহয় হাতির পায়ে মরতে হবে। সাপের ছোবলের ভয় তো ছিলই।
স্বাধীন ভারতেও তাই কয়েদখানাটি পছন্দ ছিল নেহেরু সরকারের। বেগড়বাঁই করতেন কমিউনিস্ট পার্টির যে নেতারা, তাঁদের ধরে এনে এখানে পোরা হতো। এখন সেসব স্মৃতি। ভাঙতে ভাঙতে দূর্গ অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। তবু ধংসাবশেষ দেখতে কেউ কেউ আসে। বক্সা দূর্গের সামনে কিছুটা নিচে একটা বিরাট মাঠ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিবিজড়িত। এই মাঠে তাঁরা ফুটবল খেলতেন। এখনও খেলা হয়। চারপাশে পাহাড়। এই মাঠ থেকে যে পাথুরে পথ ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে উত্তর দিকে উঠে গিয়েছে, সে পথেই অনেকটা ওপরে তাসিগাঁও, যে গ্রামের কথা প্রথমে বলেছিলাম। একেবারে পাহাড়ি খাড়াই বলে ট্রেকাররা ছাড়া বড় একটা কেউ তাসিগাঁও যান না। তবে দূর্গের পূর্ব দিক দিয়ে উঠে লেপচাখাঁ এখন জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন।
তাসিগাঁও উঠতে দম লাগে। এই পথেই একসময় যাতায়াত করতেন ভূটানি সেনা ও বণিকরা। এখন এই পথে পিঠে টুকরি বোঝাই কমলালেবু নিয়ে পাহাড় থেকে সমতলে নামেন স্থানীয়রা। সে অবশ্য শুধু শীতের মরসুমে। বছরের বাকি সময়টা পথটা ময়াল সাপের মতো অলস পড়ে থাকে। তাসিগাঁও যে ভারতে, সেকথা তাসিগাঁওয়ের কেউ বিশ্বাস করেন কিনা, জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনও। আসলে এটা বনবস্তি। বাংলার গ্রাম। তবে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা নয়। বাংলা ভাষাও নেই। আমার গবেষক বন্ধু সেই কবে লিখেছিলেন, মনুমেন্টের উচ্চতা থেকে দেখলে বাংলা ভাষা যতদূর যায়, তার পরেও আছে দেশ। সেটা বাংলার ভূখণ্ড। কিন্তু বাংলা ভাষার নয়।
তাসিগাঁও, আদমা, উচলুম, লেপচাখাঁ-এ যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা ডুকপা উপজাতি গোষ্ঠীর। নেপালি নয়, ভুটিয়াও নয়। তাসিগাঁওয়ের সঙ্গে সবদিক থেকেই নৈকট্য আছে ভূটানের। তাসিগাঁও পেরিয়ে আর একটু উঁচুতে উঠলে পাহাড় টপকে ভূটান। রাজার দেশ। ড্রাগনের দেশ। ভূটান তাসিগাঁওকে অনেক কিছু দেয়। বাজার করতে হলে ভূটান, মজুর খাটতে হলে ভূটান, এমনকি তাসিগাঁওয়ের ছেলেমেয়েরা পড়তেও যায় ভূটানে। দিগন্ত-বিস্তৃত পাহাড় আর উন্মুক্ত আকাশের তলায় কোথায় বা সীমান্ত, কোথায় বা বিধিনিষেধ।বক্সাপাহাড়ের এই গ্রামগুলির জীবিকা মরসুমি। ভূটান থেকে কমলালেবু বহন করা ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকের কমলার বাগান আছে। হলদে রংয়ে প্রকৃতির তখন ভিন্ন সাজ। সেই কমলালেবু বিক্রি করে সারা বছরের সংসার চলে এই গ্রামগুলোতে।
কমলালেবুর রংয়ে কিন্তু হলদেটে হয়ে যায় না বক্সাপাহাড়ের এই বনবস্তিগুলির জীবন। নগর সভ্যতা থেকে অনেক দূরে বটে। কিন্তু জীবন এখানে স্কোয়াশের লতানে গাছের মতো সবুজ। বহুতলের সুউচ্চ অহমিকার ছিটেফোঁটা কোথাও নেই। দারিদ্র্যের মাত্রা যত তীব্রই থাক, যে কোনও ডুকপা বাড়িতে গেলে চা আর একথালা ডিমসেদ্ধ সামনে রেখে অতিথি সেবা করেন ওঁরা। পথে ডুকপা কিশোরীর একমুখ মিষ্টি হাসি যেন পাহাড়ের মন ভালো করা পরিবেশের প্রতীক। আর কিছুটা গেলে রোভার্স পয়েন্ট। বক্সাপাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। মাউন্টেনিয়ার, ট্রেকারদের প্রিয় গন্তব্য। রোভার্স পয়েন্ট নামটা দিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্বাস। বক্সাপাহাড়ের বাসিন্দা প্রয়াত মাঠে ডুকপা নিজেকে জগন্নাথ বিশ্বাসের বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। জগন্নাথদা কবি গল্পকার। আবার পরিবেশবিদ। পঞ্চাশের দশক থেকে এই অঞ্চলের পরিবেশ-বিপন্নতা সম্পর্কে আমৃত্যু সতর্ক করে গিয়েছেন। জিম করবেটের বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। বক্সা তাঁর যেন দ্বিতীয় বাসস্থান ছিল। এখানকার ডুকপা, নেপালিরা ছিলেন তাঁর স্বজন। বক্সা ফোর্টের পথে সদরবাজারে ‘রোভার্স ইন’ নামে যে হোমস্টে আছে, তার নামটাও জগন্নাথদার দেওয়া। হোমস্টে কনসেপ্ট চালু হওয়ার বহু বছর আগে তাঁর উৎসাহে হরিশঙ্কর থাপার কাঠের বাড়িতে রোভার্স ইন-এর জন্ম। মূলত ট্রেকারদের ঠেক ছিল ওটা।
হরিশঙ্করবাবুকে আমরা বলতাম বক্সার চলমান ইতিহাস। কেউ গেলে গড়গড়িয়ে সেই ইতিহাস বলতেন। অবৈতনিক গাইড যেন। এখন তাঁর ছেলে ইন্দ্র থাপা রোভার্স ইন চালান। ইন্দ্র স্বভাবকবি। কবিতা লেখেন নেপালি ভাষায়। তাঁর কবিতায় উঠে আসে বক্সার জীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ, যন্ত্রণা, সমস্যা। সে কবিতা কোথাও ছাপা হয় না। কেউ শোনেও না। বাইরে থেকে যাঁরা যান, তাঁদের কাছে তিনি হোমস্টের মালিক। তাঁর কবি প্রতিভার খোঁজ কে রাখে। ইন্দ্রের কবিতার বাংলা মর্মার্থ, “যন্ত্রণায় টনটন করছে আমার পিঠ। পাহাড়ি পথে আমি নামছি। পিঠে আমার কমলালেবুর ঝুড়ি। হাত আমার ব্যথায় ভেঙে আসছে। তবু আমি জানি আমাকে এ বোঝা নিয়ে নামতেই হবে। ওই বোঝা নামিয়ে চড়াই ভেঙে আবার ফিরে এলে বাড়িতে নুন ভাত জুটবে। বাড়ির সবাই মিলে অনেকদিন পর ছাং পান করব।” ডুকপাদের ঘরে তৈরি পানীয়ের নাম ছাং।
বক্সাকে ঘিরে আলিপুরদুয়ারে পর্বতারোহণ প্রশি্ক্ষণের কথাও জগন্নাথ বিশ্বাস প্রথম ভেবেছিলেন। এই এলাকায় প্রকৃতিপাঠ শিবিরের সূচনাও তাঁর হাত ধরে। আজ বক্সাপাহাড়ে যে পর্যটকদের আনাগোনা, তাতে উৎসাহ দেওয়ার পিছনে ছিল ট্রেকারদের ভূমিকা। তবে যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত-র মতো হয় বক্সা ফোর্ট, সদরবাজার কিংবা লেপচাখাঁ। তাসিগাঁও, উচলুম তাই এখনও প্রকৃতিতে কুমারিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে।
উচলুম এক আশ্চর্য গ্রাম। এখানে এলে পাহাড়ের গাম্ভীর্য সবাইকে মৌন করে দেয়। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। দুচোখ ভরে শুধু দেখা। চারপাশে পাহাড়। মাঝখানে অনেকটা নিচে একটা ছোট্ট বসত। পাহাড়ের রং ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। সূর্যের ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে আলো-ছায়ার খেলা চলে পাহাড়ে পাহাড়ে। উচলুমে সব বাড়িতেই কাঠের পাটাতনের ঘরে বড় বড় জানালা। কোন গরাদ নেই, শিক নেই। মুক্ত বাতাস, মুক্ত প্রকৃতি কোথাও বাধা পায় না। জানালার পাশে পাটাতনে শুয়েবসে বাইরে তাকিয়ে থাকলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। স্বর্গ আছে কী নেই, তা নিয়ে কত তর্ক! দরকার কী? ভগবানের দেশ যদি বলতেই হয়, তাহলে উচলুমের কথা বলাই ভালো। নীরবতাও যে একরকম সৌন্দর্য, তা শেখাবে উচলুম। লেপচাখাঁ কিংবা তাসিগাঁও হয়ে একবার উচলুমে পৌঁছলেই হল। স্বর্গের শোভা একেবারে চোখের সামনে।
কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।
4 Responses
I would be curious to know whether these village people’s name figure in the electoral roll of India.
বাহ ।
এতো সুন্দর সাবলীল লেখা.. তোর কাছেই এই সব অজানা স্থান গুলোর খবর পাই.. খুব ইচ্ছে রইলো ওখানে যাওয়ার.. আরো নতুন নতুন গ্রাম শহরের কথা.. যা লোক চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে তা বাইরে সবার সামনে তুলে ধর..
যে দেশে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ভোটই মোক্ষ, সেখানে লোকগুলোর আগ্রহ থাক না থাকলে, ভোটার তালিকায় নাম উঠে যায়। ভোট পড়ে। তালিকায় যাঁদের নাম থাকে, তাঁরা না দিলেও ভোট পড়ে।