২০২১ সালের অগস্ট মাসের মাঝামাঝি। পায়ের তলার সর্ষে আর ঘরে থাকতে দিল না। আগের বছরের এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিট তখনও অনুমোদন করছে ভারতের যে কোনও প্রান্তে যাওয়া। আমার দুই উৎসাহী মাসি, মাঝ- সত্তরের মিষ্টিমাসি, অশীতিপর নঞ্চুমাসি, আর পঞ্চাশ-পার হওয়া আমি, এই আমাদের টিম। মায়ের অপারেশন হয়েছে, দূরের সফর আর করতে পারবেন না। তাই মা-কে এ যাত্রা নেওয়া গেল না।
গরমের সময়, বললাম ‘চল লেহ যাই।’ ভারতের অন্যান্য জায়গা হয় গরমে ভেপসে আছে, নয় বৃষ্টিতে কাকভেজা। কিন্তু মাসিরা বললেন, মধ্যপ্রদেশ কোনওদিন যাইনি, ওখানেই নিয়ে চল। গরম ফরম পরোয়া করি না। অগত্যা মধ্যপ্রদেশই ঠিক হল। কলকাতা থেকে ভোপাল তখন সরাসরি ফ্লাইট নেই। রাত আটটার উড়ানে দিল্লি, সেখান থেকে ভোর পাঁচটায় ভোপালের প্লেন। সারা রাত এয়ারপোর্টে বসে থাকা মোটেই ভালো নয়। এমনিতে চারঘণ্টার বেশি লে-ওভার হলে থাকতে দেয়ও না। তবে কিনা আমরা তিন মহিলা, তার ওপর দুজন পক্বকেশ দেখে বিমানবন্দরের আধিকারিকরা আর আপত্তি করেননি।
পরদিন ভোরে যখন ভোপাল পৌঁছলাম, তার আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। সোনালি নরম রোদ্দুর। আমাদের গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কলকাতায় মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজ়মের অভিজিৎবাবু ঠিক করে দিয়েছিলেন। সারথি আদিল দেখলুম রথ নিয়ে উপস্থিত। তিনজন সটান উঠে পড়লুম। সব হোটেলেই চেক ইনের সময় বেলা দুটো। অতক্ষণ কী করব রাস্তায়? তাই সেদিন ভোপালে থাকার চেষ্টা না করে সোজা ভোজপুর রওনা দিলাম। শুনেছি, এখানে পারমার বংশোদ্ভূত রাজা ভোজ একটি শিবমন্দির তৈরি করা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এই অসমাপ্ত মন্দিরের শিবলিঙ্গ একটি পাথর থেকে খোদাই করা (যাকে বলে মোনোলিথ) এবং আকারে ভারতের সর্ববৃহৎ।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ভীমবেটকা। এখানে প্রাচীন গুহাচিত্র দেখার পালা। এদিকে সবার তখন পেট চুঁইচুঁই। ট্রেনলাইনের একপাশে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের টুরিস্ট কমপ্লেক্স। সেখানে ছোট্ট জায়গার মধ্যে রেস্তোরাঁ, ঘর, গাড়ি রাখার জায়গা ও দোলনা ও আছে! প্রাতঃরাশ ভালোই হল। হাতমুখ ধুয়ে এবার গুহামানবদের কার্যকলাপ দেখা। তবে ভীমবেটকার সবকটি গুহা খোলা ছিল না। কোনও কোনও জায়গায় নিচু হয়ে গুহাচিত্র দেখলাম। ওখানকার এক সিকিউরিটি গার্ড আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন। পাহাড়ের গায়ে বল্লম হাতে অশ্বারোহী শিকারীর দল, হাতি, হরিণ, এসবের ছবি দেখে সবাই উৎফুল্ল না হতেই পারেন! প্রাচীন ইতিহাস চোখের সামনে দেখে সবার গায়ে কাঁটা না দিতেই পারে। কিন্তু আমাদের সকলের অসম্ভব ভালো লেগেছিল।
এখান থেকে সোজা পাঁচমারি। একে ‘সাতপুরার রানি’ বলা হয়। সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন পিপারিয়া। সেখানে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় পাঁচমারি পৌঁছতে। নানা জায়গায় রাস্তার কাজ চলছে। বহু আয়াসে এসে পৌঁছলাম অবশেষে। তখন বিকেল চারটে। এরমধ্যে আমাদের হোটেল থেকে বার দুই ফোন করে ফেলেছে। সরকারি পর্যটন দফতরের অনেকগুলো লজ এখানে আছে। আমরা ছিলাম ‘সাতপুরা রিট্রিট’-এ। পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাংলো, সামনে চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসের লন। বারান্দায় বসে বিকেলে চা জলখাবার ভালোই লাগল।

দুই অবাঙালি ভদ্রলোক পাশের ঘরে উঠেছেন। আমার অশীতিপর নঞ্চুমাসিকে নমস্কার করে বললেন, ‘নমস্তে মা-জি, আপ ক্যায়সে হ্যাঁয়?’ মুশকিল হল একে হিন্দিতে কাঁচা, তার ওপরে আশি পেরিয়ে আমার মা-মাসির কান কিঞ্চিৎ গোলমাল করছে। কিন্তু অপ্রস্তুত হবার আশঙ্কায় তাঁরা কাউকে সেটা বুঝতে দিতে চান না। তাই অধিকাংশ প্রশ্নই আন্দাজে ধরে নিয়ে উত্তর দেন। এবারেও তাই হল। মাসি স্মার্টলি উত্তর দিলেন, ‘কলকাত্তা সে’। ভদ্রলোক খুবই ভদ্র, তাই খ্যাক করে হাসলেন না, কিন্তু হাসি চেপে পালিয়ে গেলেন। আর আমরা? হেসে গড়াগড়ি।
পর্বত শহর পাঁচমারিতে অনেক দ্রষ্টব্য। অগস্টে খানিকটা বৃষ্টি পেয়ে ঝরনাগুলো পুষ্ট হয়েছে। সব জায়গায় কিছুটা গাড়ি যায়, তারপর হাঁটতে হবে। তাই সব জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করিনি, বেছে বেছে গেছি। আমাদের গাড়ি নিয়েই বেরোলাম। প্রথমে যাবো জটাশঙ্কর। আসলে পাঁচমারিতে আরাধ্য দেবতা হলেন শিবঠাকুর। পাহাড়ের গুহায় ছোট্ট অনাড়ম্বর শিবলিঙ্গ। গল্পে আছে, ভস্মাসুরের তপস্যায় খুশি হয়ে সে যে ভয়ঙ্কর বর চেয়েছিল, শিব তাতে তথাস্তু বললেন। শিবের বরে বলীয়ান ভস্মাসুর যার মাথায় হাত রাখবে সে তৎক্ষণাৎ ভস্মীভূত হবে! ভস্মাসুর তার ক্ষমতার প্রথম প্রয়োগ করতে চাইলো শিবের উপরেই!! বেগতিক দেখে শিব তো ‘যঃ পলায়তি সঃ জীবতি’ পন্থা অবলম্বন করলেন। ভস্মাসুর তাঁকে তাড়া করল। পালাতে পালাতে শিব হাজির, আর কোথায়, এই পাঁচমারিতে! জটাশঙ্করে এসে শিব তাঁর জটা খুলে ছড়িয়ে দিলেন। সেই জটার ঘনঘটায় ভস্মাসুর শিবঠাকুরকে খুঁজে যাচ্ছে, সেই ফাঁকে তিনি গুহায় লুকিয়ে বসে আছেন ‘গুপ্ত মহাদেব’–এ।

শিবের এ অবস্থায় বিষ্ণু এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে, মোহিনী রূপ ধরে। ভস্মাসুর মোহিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কামনা করে বসল। মোহিনী জানালেন তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে একভাবে নাচতে পারবে, তবেই সে পুরুষকে তিনি গ্রহণ করবেন। ভস্মাসুর তৎক্ষণাৎ রাজি। মোহিনী নাচতে শুরু করলেন, মোহিনীআট্টম নৃত্যশৈলীর সূত্রপাত নাকি এখান থেকেই। ভস্মাসুর মোহিনীর প্রতিটি ভঙ্গিমা অবিকল নকল করল। নাচতে নাচতে মোহিনী নিজের মাথায় করতালু রাখলেন। দেখাদেখি ভস্মাসুরও নিজের মাথায় হাত রাখল, এবং ভস্মে পরিণত হল। উদ্ধার পেয়ে কৃতজ্ঞ মহাদেব বেরিয়ে এলেন। তিনিও মোহিনীর রূপে মুগ্ধ হলেন। মোহিনী ও শিবের একটি পুত্রসন্তান জন্মায়, দক্ষিণভারতে সেই সন্তানই নাকি আয়াপ্পান বা মণিকান্তন নামে পূজিত হন।
গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা পথ হেঁটে এলাম বাঁধানো রাস্তায়। একজন গাইড বসেছিলেন। তাঁর সাহায্য নিলাম। এক জায়গায় জুতো খুলে খালি পায়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম সরু পথ ধরে। প্রাকৃতিক গঠনে দু’দিকের পাহাড়ে নানা মূর্তি দেখা যায়। কোথাও গণেশ, কোথাও সি়ংহের মাথা, কোথাও বা ভাল্লুক। এক বয়স্কা মহিলা গলা ছেড়ে গান গাইছেন, সারা উপত্যকা গমগম করছে তার গানে। একজায়গায় পৌঁছে ভাবলাম আর যাবার জায়গা নেই। দেখি সেখান থেকেই গন্তব্য শুরু! গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন। অন্ধকার ঘুটঘুটে, মোবাইল ফোনে আলো দেখাচ্ছেন গাইড, মাসিদের পিছনে আমি। ঠান্ডা জলে পায়ের পাতা ডুবে যায়, গুহায় স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাকমাইট এড়িয়ে খানিকটা এসে দেখি পূজারী বসে আছেন ‘শিউজি’ কে নিয়ে। নিরাভরণ দেবতার অনাড়ম্বর পূজা। দক্ষিণা দিয়ে প্রসাদ পেলাম নকুলদানা। বেরিয়ে এলাম অন্য পথ দিয়ে। ফেরার পথে কিনলাম মধু। ওখানে ফুলগাছ নেই বললেই চলে। তবে আয়ুর্বেদিক গুণসম্পন্ন গাছগাছড়া অঢেল। মৌমাছিরা এই গাছপালা থেকে রস সঞ্চয় করে পাহাড়ের গায়ে লাগা মৌচাকে। এই মধু খেতে তেমন মিষ্টি নয়, কিন্তু গুণ আছে।
জটাশঙ্কর থেকে বেরিয়ে পাঁচমারি থেকেও বেরিয়ে গেলাম। গন্তব্য তামিয়া। সেখান থেকে পাতালকোট। দুটোই পড়ে নাগপুর যাবার পথে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কী আছে ওখানে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুর কথা বলতে পারব না। সরকারি পর্যটনকেন্দ্র তালাবন্ধ, কিন্তু ছাদে ওঠা যায়। সেখান থেকে পুরো উপত্যকা তার সবুজ সরসতা নিয়ে ছড়িয়ে আছে। খাবার ব্যবস্থাও বেসরকারি হোটেলে, তবে তার মান খুব ভালো।
মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়ারা জেলার আর এক আকর্ষণ হলো পাতালকোট। চারিপাশে পাহাড়ের বেড়া, তাই উপত্যকার আদিবাসীরা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেনি। কিন্তু আমাদের আর সেখানে যাওয়ার সময় ছিল না। যাতায়াতের পথে মানুষজন চোখেই পড়েনি। কেবল মাঝে মধ্যে গোরুর দেখা মিলেছে। অবশ্য রাস্তার ধারে একজন পেঁড়া বিক্রি করছিল, কিনে খেলাম। অতীব সুস্বাদু।

পরদিন সকালে পাঁচমারি ঘুরব ওখানকার জিপ নিয়ে। বাইসন লজে পৌঁছে গেলাম। সেখানে মস্ত লাইন। টিকিট কেটে জিপ এবং গাইড পেতে হয়। ওখানকার যে বাংলোর মধ্যে মিউজিয়াম রয়েছে, সেই বাড়িটি পাঁচমারির সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। পাঁচমারিতে আর্মির বড়ো ক্যাণ্টনমেণ্ট আছে। ঢোকা বেরনোর একটাই রাস্তা। প্রতিবার ঢুকতে গেলে ট্যাক্স দিতে হবে।
আমাদের প্রথম স্টপ পাণ্ডব গুফা। পাঁচটি গুহা এক জায়গায়, তো সেগুলো পাণ্ডবদের দখলে থাকার কথা। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের সৌজন্যে জানা গেছে সেখানে জৈন বা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। কিন্তু পাণ্ডবদের নাম রয়েই গেছে। এরপর রজতপ্রপাত, যার আরেক নাম সিলভার ফলস। হাল্কা স্রোতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম, ছোট ছোট মাছ ঠুকরে ঠুকরে পায়ের ফাটাচটা পরিষ্কার করে দিল।
হাণ্ডিখোর সুইসাইড পয়েন্টে দাঁড়িয়ে গভীর সবুজ উপত্যকার সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কিছু মনে আসে না। আমাদের গাইড বারবার বলছিলেন আপনাদের ভাগ্য ভালো। এই তো কদিন পরেই স্বাধীনতা দিবস, আর লম্বা ছুটিতে এখানে এত লোকজন আসবে যে আর পা ফেলার জায়গা থাকবে না। এখান থেকে সোজা রিচগড়। ইংরেজিতে লেখা ‘Ridge garh’, কিন্তু কোনও ridge নেই, আছে ভাল্লুক বা ঋক্ষ, যেখান থেকে নামটা এসেছে। খাড়াই বেয়ে উঠে, তারপর শেষটা আর নামতে ভরসা পেলাম না। পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলে ভাল্লুক বেরিয়ে আসতে কতক্ষণ! আর ভাল্লুক খুব আক্রমণাত্মক। ওদের রাগ করার কারণ দরকার হয় না।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ উদ্যানে কিছুক্ষণ কাটল প্রকৃতির মাঝে। গুপ্ত মহাদেবের গুহায় ঢোকার চেষ্টা করিনি, আমার ক্লসট্রোফোবিয়া আছে। বাপদ হতে পারে। বড়া মহাদেব গেলাম। চওড়া চওড়া সিঁড়ি, জলে ভেসে যাচ্ছে। খালি পায়ে উঠতে উঠতে পা ধোয়া হয়ে গেল। গুহায় অবস্থান করছেন ইনিও। বাইরে একদল শিবভক্ত ঢোল বাজিয়ে বাঁশি বাজিয়ে নাচগান করছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, অথচ তাদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।
বৃষ্টি শেষে আমরা রওনা হলাম ধূপগড়। পাঁচমারির সর্বোচ্চ স্থান। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। মেঘের ফাঁকে রোদ্দুর মুখ লুকিয়েছে, ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। উঠতে আর কারো ইচ্ছেই হচ্ছে না। ধূপগড় থেকে ফিরে সবাই টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন লম্বা সফর। যাবো মঢ়াই, থাকবো মঢ়াই বাইসন লজে। তাওয়া নদীর বাঁধের ফলে তাওয়া লেক তৈরি হয়েছে, সেই লেক ঘিরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাতপুরা ন্যাশানাল পার্ক। মধ্যপ্রদেশ তো জঙ্গলে ভরা। কানহা, বান্ধবগড়, পেঞ্চ এদের মধ্যে নামকরা। সাতপুরায় যেতে গেলে লেকের ধারে মঢ়াই বাইসন লজে থাকাই ভালো। এখানে ধারেকাছে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না, তাই তিনবেলার আহার এরাই দেয়। খাবার ব্যবস্থা বেশ ভালো। তবে পৌঁছতে অনেকটা সময় লেগেছিল।
*সব ছবি লেখকের তোলা।
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১০ জুন ২০২২
বিশাখা ঘোষ পেশাগত বাঁধনে বাঁধা অর্থনীতির সঙ্গে। কিন্তু মন চায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, আর অজানা পৃথিবীকে চিনতে। তাতে নিজেকেও তো চেনা হয়। আপনাকে জানাতে তাঁর ভারী কৌতূহল। ছাত্রাবস্থা কেটেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাস আর আইএসআই-তে। এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্য়ালয়ে অধ্যাপনা করেন। ভালোবাসেন আড্ডা মারতে।
2 Responses
বেশ বেশ
কি সুন্দর লেখা, পরবর্তি লেখার অপেক্ষায় রইলাম